#বিদায়_বরণ
১৬ পর্ব
লেখা – মেহরুন্নেছা সুরভী
শিখিনীর রুমের দরজা আর মেইন দরজা একদম সামনাসামনি। শিখিনী ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই কিংশুকের চোখে চোখ পড়ল। কিংশুক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে যামিনী।
কিংশুক চিনতে ভুল করল না, এই সেই সেদিনের দেখা শুভ্রতার পরী। কিংশুকের হৃদয়ে পদ্মফুলের পুষ্পে পুষ্পবীত হয়ে ওঠল।
মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল হৃদয়ের লালন করা শুভ্রতার মানুষটাকে!
শিখিনী অল্প সল্প চিনতে পারল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে। সেদিন সকালে তাদের দরজার সামনে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ আবার এই বাসায়?
শিখিনী মাথার টাওয়ালটা খুলতে খুলতে এগিয়ে এলো। চোখ মুখে একরাশ বিস্ময়। যামিনী কিংশুকের হাত ধরে এগিয়ে এলো। দরজাটা বন্ধ করে দিলো। কিংশুকের হাতে অনেক জিনিস।
শিখিনীর উদ্যেশে যামিনী বলল, ” শিখি আপু, এই আমার ভাই কিংশুক। ”
শিখিনী ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওহ, তাহলে ইনিই সে!
কিংশুক সামান্য অসস্তি অনুভব করল। সেদিন তো শিখিনীর সাথে পরিচয় হয়নি। তাই কম্ফোর্ট ফিল করতে পারছে না। যামিনীর হাতে প্যাকেটগুলো দিলো। যামিনী সেগুলো রান্নাঘরে রেখে আসল। এতক্ষণে শিখিনী আর কিংশুক সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ছিলো।
যামিনী ফিরে আসতেই বলল, ” ভাইয়াকে বসাও, আর খেতে দেও। আম্মু একটু পরেই ফিরে আসবে।”
শিখিনী আঁচলটা ঠিক করতে করতে নিজের রুমে চলে গেল। শিখিনী আজ কাপড় পরেছে। অনেকক্ষণ সাওয়ার নেওয়ার পর ইচ্ছে হলো কাপড় পরতে। তাই মায়ের আলমারি থেকে কলা পাতার কাপড়টা নিয়ে গোছল সেরে পরে নিলো।
শিখিনী আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের প্রতি তাকাতেই লজ্জা লাগছে। হঠাৎ করে কাপড়টা পরে ঠিক করল তো সে! চুলটা চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে নিলো। এখনো টপটপ পানি পরছে। নিজেকে আরেকবার আয়নায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলো, ভীষণ সুন্দর লাগছে তাকে। চোখে গাঢ় কাজল দিলো। ঠোঁটে ভ্যাজলিন লাগালো। ব্যস, এতটুকুই তার সাজ। এরচেয়ে বেশি প্রেম পছন্দও করে না!
শিখিনী যে প্রেমের বিরহে জ্বলছে, সেটা বোধহয় শিখিনূর মন ব্যতীত কেউ জানে না। ভুলটা তারই।সে ওভাবে প্রেমকে না বললেও পারত। ছি ছি! কী ভাষায় সে প্রেমের সাথে কথা বলেছে।
শিখিনী চলে যাওয়ার পর কিংশুক বিস্ময় চোখে যামিনীর দিকে তাকালো। দেখতে তো বেশ নরম, সহজ মনে হয়। কিন্তু এত কঠিন সুরে কথা!
যামিনী কিংশুকের হাত ধরে নীচু স্বরে, “আসলে দা’ভাই, শিখি আপু আজ বেশ আপসেট। তার তোমার সাথে তো পরিচয় নেই। সেজন্য কথা বলেনি। চলো তুমি ফ্রেশ হয়ে নিবে।
কিংশুক যামিনীর রুমে এসে পোশাক পাল্টে গোছল করে নিলো। বাড়তি নতুন পোশাক নিয়েই সে আজ এসেছে। আজকের রাত এই বাসায় সে কাটাবে। বিভাবরী বেগমের সাথে বিশেষ কথা আছে কিংশুকের। আয়নার সামনে চুলগুলো মুছতে মুছতে খেয়াল করল, তার দাড়ি আরো ঘন হয়েছে। বড় হচ্ছে।
এতগুলো দিন, বছর কেটে গেল। নিজের প্রতি কোনো যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। তবুও, প্রকৃতি তাকে যথেষ্ট মাশআল্লাহ্ সুন্দর চেহারা উপহার দিয়েছে। উচ্চতায়, গড়নে, ফর্সায় কোনো অংশে কম নেই। এটা ঠিক, সে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা খুব কমই পড়েছে। তবে, জ্ঞান বুদ্ধিতে মাশাআল্লাহ। আর আমরা সবাই জানি, সবাই পার্ফেক্ট মানুষ হতে পারে না।
টাওজার আর টি-শার্টে নিজেকে প্রথম দেখে হেসে দিলো কিংশুক। যামিনী দূর থেকে নিজের ভাইকে পর্যবেক্ষণ করছিল। ভাইয়ের দেখে নিজেই মুচকি হেসে বলল, ” কী ব্যাপার ভাইয়া। কী হয়েছিল তোমার হ্যাঁ, মুচকি মুচকি হাসছ যে?
কিংশুক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “কিছুই না।”
“আচ্ছা, চলো খাবে।”
“এখনি?”
” এতদূর থেকে এসেছ, ক্ষিদে পায়নি? তাছাড়া, এখন খাওয়ার সময়, সাখাওয়াতও চলে এসেছে, চলো আমরা একসাথে খাবো।
যামিনীর হাত ধরে নিজেকে ঠেকিয়ে বলল, আচ্ছা, ফুফি আম্মা কখন আসবে? তাকে ছাড়া খেতে কীভাবে বসি!”
ফুফি! যামিনী অবাক চোখে তাকালো কিংশুকের দিকে।বিস্ময় কণ্ঠে বলল,
“ফুফি, কে ভাইয়া?কাকে বললে? ”
কিংশুক আর কিছু লুকালো না। যে কাজে এসেছে, সেটা তো এক সময় প্রকাশ করতে হতোই। তাই যামিনীকে বলে দিলো,
” আসলে, বিভা আন্টিই আমাদের ছোটবেলার হারিয়ে যাওয় ফুফি আম্মা। ”
বিভাবরী বেগম ফিরেছেন। কিংশুকের সাথে সালাম বিনিময় করেছেন। সবাইকে খেতে বসতে বলে তিনি শিখিনীর রুমে গেলেন।
“শিখি।”
শিখিনী বিছানায় পা গুছিয়ে বসে ছিলো। মায়ের ডাকে মুখ তুলে তাকায়।
“চলো খাবে।”
শিখিনী এক পলকে বিভাবরী বেগমের হাত ধরে বলল,
“আম্মু, তুমি আমার প্রতি নারাজ নও তো।”
“কেন নারাজ হবো?”
শিখিনী মাথা নীচু করে রাখল। বিভাবরী বেগম হেসে বললেন, ” যুথির সাথে আমার বাজারে দেখা হয়েছিল। তোর নামে নাশিল দিলো। বলল যে তুই ওকে বাসায় ঢুকতেই দিসনি। তখনি ধারনা করেছিলাম তুই নিশ্চয় কিছু কাণ্ড করেছিস। এত এত খাবার একদিনে কেউ রান্না করে? বোকা মেয়ে! চল খেতে।
বিভাবরী বেগমের পিছন পিছন শিখিনী হেঁটে এসে খাবার টেবিলে বসল। ভাগ্যিস সময় মত কাপড়টা বদলে নিয়েছিল। নয়ত, মায়ের সামনে তাকে আরো লজ্জিত হতে হতো।
সাখাওয়াতের সামনে যামিনী, আর শিখিনীর সামনে বিভাবরী বেগম বসলেন, অপরপাশে কিংশুক বসেছে।
বিভাবরী বেগম সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। সবাই খাওয়া শুরু করলেও শিখিনী খাওয়াটা ছিলো দেখার মত। একের পর এক আইটেম নিয়ে খেতেই লাগল। চারপাশে সবাই তাকে তাকিয়ে দেখছে সেদিকে খেয়াল নেই। মাথা নীচু করে নুজের মত খেয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
যামিনী প্রথমে শিখিনীরখাওয়া দেখে অবাক হয়ে গেল। এতদিন সে এতখাবার শিখিনীকে খেতে দেখেনি। এরপর বিভাবরী বেগম একটু অসস্তিতে পরে গেলেন। মেহমানের সামনে শিখিনীর এত খাবার খাওয়াটা এই প্রথম। কিছু বলতেও পারছিলেন না তিনি!
তবে, কিংশুকের মুখের ভাব দেখে কিছুই বুঝা গেল না। সে কী ভাবছে শিখিনীর আচরনে। বেশ উপভোগ করছে বিষয়টাকে সে।
মনে মনে ভাবছিল, এত খাওয়ার ফলেই মেয়েটা এত গুলো মুলো, তবে একেবারেও মোটাও নয়। ভীষণ ভালো লাগছে শিখিনীর খাওয়ার দৃশ্য দেখে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখছে আর নিজে খাচ্ছে। এর মাঝে বিভাবরী বেগম কিংশুকের প্লেটে আরো খাবার উঠিয়ে দিয়েছেন, সেটাও খেয়াল হয়নি।
সাখাওয়াতও খাচ্ছে, তার বোনের হাতের রান্না মাশাল্লাহ।তার উপর পছন্দের আইটেম। না খাওয়াটা তার কাছে পাপ হবে। শিখিনীর পরিস্থিতি দেখে অবশ্য যামিনী আর সাখাওয়াত লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিলো।
শিখিনীর গতরাত থেকে এ পর্যন্ত না খাওয়া, তাই ক্ষিদেটা একটু বেশিই ছিলো। তাই খাওয়ার সময় আনমনে প্রেমকে শ্বাসাচ্ছিল আর খাচ্ছিল।
খাবার পরে বিভাবরী বেগম শোফায় গিয়ে বসলেন। সাথে কিংশুক। টেবিলে বাকী তিনজন মিলে টুকিটাকি কথা বলছিল আর বোরহানি খাচ্ছিল ধীরে ধীরে। সাখাওয়াত তার স্কুলের গল্প বলছিল। যামিনীও বলছিল, শুধু শিখিনী সব শুনে যাচ্ছিল।
প্রাথমিক আলাপ আলোচনা শেষে কিংশুক বলল, “বিভা আন্টি, আমি কিছু কথা বলতে চেয়েচিলাম।”
“হ্যাঁ, বলো কী বলবে?”
কিংশুক একটু দম নিয়ে বলল, ” আসলে, বিষয়টা এমন যে, আপনি কীভাবে নিবেন। আমি কিংশুক, কিংশুক মাতুব্বর, বাহার মাতুব্বরের ছেলে। মানে, আপনার ভাইপো আমি ফুফি আম্মা।
বিভাবরী বেগমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। আচমকা কথাটা আমলে নিতে পারলেন না। চোখ মুখ কঠিন হয়ে এলো।
কিংশুক আবার শান্ত হয়ে বলল, ” ফুফি আম্মা, আমরা তখন ছোট ছিলাম, কী হয়েছিল আমার তেমন ভাবে মনে নেই। এতগুলো বছর চলে গিয়েছে। সকল পরিস্থিতি আগেও মতও আর নেই।সেদিন আপনাকে দেখেই সামান্য চিনতে পেরেছিলাম, বাসায় গিয়ে শিওর হয়েছিলাম, কিছু বলিনি আর! তবে, এখন আমি আমাদের বাসায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।তাই আমার আশা যে, বা আপনার কাছে অনুরোধ করছি, আপনি আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবেন।
কিংশুকের কথা শেষ হতেই বিভাবরী বেগম উঠে দাঁড়ালেন, কঠিন স্বরে বললেন, ” আমি আর ঐ বাসায় কোনোদিন পা রাখব না কিংশুক। তুমি এসেছ বাসায়, বেড়াও। তবে, এসব বিষয়ে আমি চট কোনো কথা বলতে চাই না, ক্ষমা করো আমায়।
বিভাবরী বেগম চলে গেলেন রুমে। কিংশুক হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাকীরা নিশ্চুপ বিভাবরী বেগমের যাওয়ার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল!
চলবে…