#বিদায়_বরণ
১৭ পর্ব
লেখা – মেহরুন্নেছা সুরভী
কিংশুকের কথা শেষ হতেই বিভাবরী বেগম উঠে দাঁড়ালেন, কঠিন স্বরে বললেন, ” আমি আর ঐ বাসায় কোনোদিন পা রাখব না কিংশুক। তুমি আমার বাসায় এসেছ, খুশি মনে বেড়াও। তবে, এসব বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না, ক্ষমা করো আমায়।
বিভাবরী বেগম চলে গেলেন রুমে। কিংশুক হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাকীরা নিশ্চুপ বিভাবরী বেগমের যাওয়ার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল!
সাখাওয়াত বিষয়টা ধরতে পারল না। শিখিনী ধীরে ধীরে নিজের মায়ের রুমে চলে গেল। যামিনী হতাশ মুখে নিজের ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
কিংশুকের চেহারাটা ভীষণ হতাশ দেখাল। খুব আশা নিয়ে সে এসেছিল। হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে বসে পরল কিংশুক। যামিনী কাঁধে হাত রেখে বলল, ” ভাই, আমি তোমায় বলেছিলাম, বিভা আন্টি কিছুতেই রাজি হবেন না। এতদিন যাবত তাকে আমি দেখছি। খুব কঠিন একজন মানুষ। আমাদের ভুল হয়ে গেল, আমি খুব কষ্টে রাজি করিয়ে ছিলাম আন্টিকে, যেন ইয়ামিনির জন্মদিনে আমাদের বাসায় যায়। তখন না হয় সব দেখা যেত। তুমি শুনলে না আমার কথা!
কিংশুক কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ” আমি জানি না, সত্যিটা বলে ভুল করলাম কিনা! কিন্তু এতগুলো বছর তো চলে গেল। ফুফি আম্মার মাঝে এখনো এত রাগ। এত ঘৃণা পুষে রেখেছেন নিজের মাঝে!”
“আমাদের ফুফি আম্মার দিক দিয়ে ভাবতে হবে ভাইয়া। সে নিশ্চয় ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন। তবুও আমরা চেষ্টা করব, ফুফি আম্মা যেন রাজি হয়ে যায়। ইনশাআল্লাহ, সব ঠিক যাবে।
“ইনশাআল্লাহ। ”
যামিনী হাতে হাত রাখে কিংশুক। আদৌও বিভাবরী বেগম সম্মত হবেন কিনা জানে না। তবে শেষ চেষ্টা তাকে করতেই হবে। সাখাওয়াত ভ্রু কুঁচকে এসে দুজনের সামনে বসল। কিংশুক হাসি মুখে সাখাওয়াতের খোঁজ খবর জিগ্যেস করল।
শিখিনী মায়ের রুমে গেল। রুমটা অন্ধকার, পর্দা টানিয়ে রেখেছেন। যেন বাহিরের আলো এসে আলোকিত না করতে পারে।
বিভাবরী বেগম নিজের বিছানায় বসে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। শিখিনী হাঁটু গেঁড়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বসে পরল। বিভাবরি বেগম নিজেকে সামলাতে পারলেন না। শিখিনীর মাথাটা কোলের মাঝে নিয়ে কেঁদে দিলেন।
শিখিনী মাথা তুলে তাকাল, বিভাবরী বেগম চোখের জল মুছে বললেন, দেখলি, কী বলল ওরা।
শিখিনী বিভাবরী বেগমকে থামিয়ে বলল, “মা, আমি জানি, আমি তখন যামিনীর সাথে কথা বলতে শুনেছিলাম কিংশুক ভাইয়াকে। আমি তোমাকে বলতে চাইনি, বুঝেছিলাম কিংশুক ভাইয়া হয়ত তোমাকে কিছু বলবে আজ!
বিভাবরী বেগম বললেন, ” আমি সাখাওয়াতকে কী বলব! এতদিন ওকে জানিয়ে এসেছি ওর নানা বাড়ি বলতে কোউ নেই, ও জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে। আমি এখন কী করব শিখি।
শিখিনী নিজের মায়ের চোখের জল মুছে পাশে বসে বলল, “মা, তুমি এটা নিয়ে এত ভাবছ কেন! সাখাওয়াতকে যা বলার আমি বলব। সাখাওয়াত সত্যিটা জানলে নারাজ হবে না আশা করি। আমি ওকে ঠিক বুঝিয়ে নিবো।
বিভাবরী বেগম কঠিন হয়ে বললেন, ” তারমানে তোরা চাস, নানাবাড়ি যেতে?”
শিখিনী একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিভাবরী বেগমের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। ঠোঁটে হাসি এনে বলল, ” মা, জ্ঞান হবার পর থেকে এ পৃথিবীতে তোমায়কে চিনেছি, তোমাকে একমাত্র আপন জেনেছি। তুমি আমাদের সব। নানা বাড়ি, দাদাবাড়ি বলে জীবনে কখনো কোনোদিন জানিনি! কে আছে, কারা আছে, সেটাও জানি না, আর জানতেও চাই না। আমি শুধু তোমাকো চিনি, তোমাকে জানি, আর আজীবন তুমিই আমাদের সব, তোমাকেই চিনব, তুমি ভালোবেসে মরতে বললেও হাসি মুখে মেনে নিবে। যেখানে তোমার স্থান নেই, সেখানে আমরা ভাগ বসাতে যাবো মা!
শিখিনী একটু দম নিলো, এরপর আবাট বলল,” মা আমার, যেখান থেকে তুমি চলে এসেছ, সে জীবনটা তোমার ছিল। আমি তখন ছোট ছিলাম, অনেক কিছুই মনে নেই। সে জীবনটা তুমি পার করে এসেছ। এখন তোমার ভয় করার সময় নয়, গর্ব করার সময়। আমরা আছি সাথে। আমরা তোমার গর্ব,আর আমার গর্ব তুমি! তুমি ভাবো, তোমার সেখানে যাওয়া উচিত কিনা, তোমার জীবন, তোমার পরিবার। তুমি তাদের গ্রহণ করবে কিনা, সেটা সম্পূর্ণ তোমার অধিকার। কারণ, সে সময়টা তুমি একা পার করে এসেছ, আমরা নই। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে, সেটাই সঠিক। আমরা তোমার সিদ্ধান্তে সব সময় খুশি। সাখাওয়াতকে আমি সবটা জানিয়ে দিবো। আমি জানি,আমার মা ভেঙে পরার মানুষ নয়। খুব স্ট্রং আমার মা। নিজেকে সামলে নেও। আমি চাই না, তুমি তাদের জন্য কাঁদো যারা তোমাকে বুঝেনি। আর এটা কিন্তু আমার অনুরোধ নয়, অর্ডার। মানতেই হবে হু।
বিভাবরী বেগম চোখের জল মুছে হেসে দিলেন। হেস মেয়ের গালে হাত বুলিয়ে দিলেন। মেয়ে তার আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।
হ্যাঁ, এখন আর সে কাঁদবে না। এখন কাঁদার সময় নয়। আবেক দিয়ে নয়, এখন সময় যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে।
অর্ধেক জীবনটা তো পার করেই দিলো। এখন আর সত্যি তার কিছু হারানোর ভয় নেই। আজ সে সফল। সন্তানদের মানুষ করতে পেরে সফল। এখন তার মাথা উঁচু করে তার বাবার সামনে গিয়ে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার সময়, সেদিন তার জীবন থেকে কী স্বর্গ কেড়ে নিতে চেয়েছিল।
বাবা-মায়ের প্রতি বিভাবরী বেগমের কোনো রাগ নেই।আছে শুধু অভিমান। একটা বার কী তার মেয়ের খোঁজ নিতে পারত না। জন্মদাত্রী মা মারা গেল, তবুও তাকে জানালো হলো না। বাবা বেঁচে আছে কিনা সেটাও সে জানে না। ভাইয়ের বউয়ের মৃত্যুতেও তাকে একবার জানালো না। সে অভিমানেই নিজ থেকে কখনো আগায়নি। যারা তাকে আপনজন ভাবে না, সে সেখানে কীভাবে আপন ভেবে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে তো পর, বিয়ের পর পরের ঘরে চলে গিয়েছে। পর হয়ে গিয়েছে। বোঝা নেমে গিয়েছে কাঁধ থেকে। তাহলে আর খোঁজ নিয়ে কেন দায়িত্ব বাড়াবে।
এসব ভেবে অভিমানে কখনো কেঁদেছে, কখনো বা নিজেকে সামলে কঠিন মনের মানুষ হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবুও মেয়ে মানুষের মন, নরম মাটির মত। গলবেই গলবে।
আজ এতগুলো বছর পর ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের পেয়ে পাষাণের মত উঠে আসলেন। নিজের রক্তকে পেয়েও কঠিন ভাবে মুখের উপর না করে দিলেন। ভীষণ খারাপ লাগল তার!
শিখিনী রুম থেকে বাহিরে এলো। সোফায় এখনো যামিনী, কিংশুক বসে আছে। শিখিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে যামিনী দাঁড়িয়ে বলল, ” শিখি আপু।”
যামিনীকে থামিয়ে শিখিনী বলল, ” তোমার ভাইকে নিয়ে রুমে যাও, রেস্ট করো। মাকে সময় দেও,যা সিদ্ধান্ত নিবে সেটাই আমার জন্য সঠিক, আশা করি সেটা সাখাওয়াতও বুঝে নিবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। রুমে যাও।
শিখিনী কিংশুকের দিকে একবার তাকাল। কিংশুক তার দিকেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তবে দুজনের কেউ কিছুই বলল না। সাখাওয়াতের উদ্দেশ্য বলল, ” ভাই।”
“হ্যাঁ, আপু?”
” আমার রুমে আসো, কথা আছে তোমার সাথে। যামিনী রুমে গিয়ে রেস্ট করো, যাই হোক, এতে আমাদের কোনো আফসোস বা ভাবান্তর নেই। সাখাওয়াত রুমে আসো আমার।
শিখিনীর পিছনে সাখাওয়াত চলে গেল। কিংশুক আপন মনে আবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। জীবনের মোর তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়ে দিলো!
চলবে…