#বিদায়_বরণ
২২ পর্ব
#মেহরুন্নেছা_সুরভী
.
-আমি বিবাহিত কিংশুক। আপনাকে আমি বিয়ে করতে কখনোই পারব না। এই নিয়ে আমি ভীষণ দুঃখিত। এমন পরিস্থিতি হবে আগে জানলে আমি কখনোই গ্রামে আসতাম না।
শিখিনীর কথায় কিংশুক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কী বলছে তার পাশের মানুষটা। বিবাহিত! এই কথাটা বিশ্বাস করতে তার ইচ্ছে করছে না কেন?
কিংশুক আর শিখিনী পাশাপাশি বাসার পিছনের ছাদে যাওয়ার সিঁড়িতে বসে আছে। কিংশুকের সাথে কিছু কথা বলতেই শিখিনী ডেকেছে কিংশুককে।
কিংশুকদের বাসায় শিখিনীরা এসেছে আজ সপ্তাহ চলে। বেশ ভালোই সময় কাটছিল শিখিনীদের। খুব শীঘ্রই তাদের ঢাকায় ফিরতে হবে। বিভাবরী বেগমের চাকরির ছুটি এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে অলরেডি।
চলে যাওয়ার কথা উঠতেই ঘটে গেল যত অঘটন। বাহার সাহেব প্রস্তাব রাখলেন শিখিনীর সাথে কিংশুকের বিয়ের। যদিও এর প্রতিত্তোরে বিভাবরী বেগম এখনো কিছু বলেননি।
বিষয়টা বাহার সাহেবে নয়, কথাটা প্রথমে এসেছে জয়া বেগমের দিক থেকে। তিনি দু’জনের ভাব ভাবনা দেখে বলে দিলেন, দুজনের বিয়ে হলে মন্দ হয় না। কিংশুকের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে যেহেতু।
বাসার পরিবেশ তখন থেকেই অন্যরকম। ইয়ামিনি আর যামিনী অবশ্য বেশ খুশি। সেটা ওদের চেহারায় উজ্জ্বলতা স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। শিখিনী এই নিয়ে কিছুই বলেনি কারো সামনে। যা বলার সে কিংশুককে ডেকেই বলল। এতদিনে কিংশুকের সাথে তার সুন্দর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। বিয়ের বিষয়টা একমাত্র কিংশুক না বললেই আর আগাবে না। সেটা শিখিনী বেশ বুঝতে পারে। তাই নিজের মনে গোপন করা কথাগুলো সে কিংশুককে নির্দ্বিধায় বলতে পারল।
কিংশুক পাশে দাঁড়িয়ে পরল। শিখিনী চুপসানো কণ্ঠে বলল, কী হলো কিংশুক? কিছু বলছ না যে!
-চলো তো, ছাদে গিয়ে বসি। পরিবেশটা কেমন দমবন্ধ।
এই বলে কিংশুক সিঁড়িতে পা রাখল। শিখিনী তটস্থ হয়ে কিংশুকের ডান হাত চেপে ধরল।
-না, উপরে নয়। এখানেই ঠিক আছে।
কিংশুক একবার শিখিনীর দিকে তাকাল, আর একবার শিখিনীর ধরা হাতটার দিকে। এরপর নিজ থেকে হাতটা ছাড়িয়ে শিখিনীর হাত ধরে জোর করে উপরে উঠাতে লাগল।
– এসো উপরে।
– কিংশুক, ছাড়ো, আমি উপরে যাবো না, প্লিজ।
কিংশুকরা সিঁড়ির এক ধাপ উপরে পৌঁছে গেল। আর একধাপ উঠলেই ছাদের দরজা। শিখিনী আর আগাতে চাইল না।
-কিংশুক, ছাড়ুন প্লিজ। দোহাই লাগে।
কিংশুক ছেড়ে দিলো শিখিনীর হাতের বাধন।
-এই বারবার আপনি, তুমি! যেকোনো একটা নামে ডাকো। অদ্ভুত তো তুমি। এমন ভাবে ডাকো, যেন অপরিচিত একজন আমি তোমার।
-আচ্ছা, সরি। এবার থেকে আমার এমন হবে না। এখন আমার কথা শোনেন।
-আবার!
-আচ্ছা, আচ্ছা, শোনো।
শিখিনীরা দুই সিঁড়ির মাঝের ঢালু জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সামনের দেওয়ালে ছোট চারকোনা একটি গ্রিলের জানালা। জানালাটায় এখনো গ্লাস লাগানো হয়নি। জানালা দিয়ে তাকালে বাহিরের দিঘিটা দেখা যায় স্পষ্ট। এই দিঘিতে তিন চারবার গোছল করেছে শিখিনী। চারপাশটা ঘুরেও দেখা হয়ে গিয়েছে।
-কী হলো! বলো আর কী বলবে?
কিংশুকের কথায় শিখিনী অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণ সে যেসব কথা বলবে ভাবছিল, সবই গোলমেলে গেল শিখিনীর।
চুলগুলো খোঁপা দিয়ে কিংশুকের সামনাসামনি দাঁড়ালো।
– বিয়ের বিষয়ে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। প্লিজ তুমি এসব বন্ধ করতে বলো জয়া খালাকে।
– তুমি বেশি ভয় পাচ্ছ! বাবা এই নিয়ে ফুফিকে বলেছে। বড়রা যা মতামত দিবে…
– তুমি বুঝতে পারছ না, আমি বিবাহিত। আমি আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না।
– তুমি সত্যি বলছ শিখি?
শিখিনী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিংশুকের দিকে। কিংশুকের থেকে সামান্য দূরেই দাঁড়িয়ে নয়। এমন পরিস্থিতি সে মিথ্যে বলবে!
-কিংশুক! এই চিনলে তুমি আমাকে। আমি মিথ্যে বলব কেন?
কিংশুক কিছু বলার সাহস করতে পারল না। যতবার সে শুনছে শিখিনী বিবাহিত, তার বুকের ভিতর ততবারই কেউ ছুড়ি চালিয়ে দিচ্ছে । কত আশা করেছিল সে, তাদের বিয়ে হবে। সবটাই তাশের ঘরের মত ভেঙে গেল। দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। নিজের ভিতরটা শিখিনীর সামনে প্রকাশ করতে পারছে না যে কিংশুক। কেন সে ভালোবাসতে গেল শিখিনীকে!
কিংশুকের হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে শিখিনী বলল, দেখো কিংশুক, আমি জানি যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না। এতদিন পর দুটো পরিবারের মিলন হলো। কিন্তু তোমার আগেই আমার জীবনে এমন একজন এসে গেঁথে আছে যে, আমি চাইলেও তাকে দূরে ঠেলে তোমাকে বিয়ে করতে পারব না! প্লিজ, তুমি এই বিয়ের কথা বার্তা বন্ধ করো।
কিংশুকের অসহ্য লাগছিল। শিখিনীর থেকে পালিয়ে যেতে পারলে সে এখন বাঁচে। তাই হাতের বাঁধনটা ঝট করে ছুটিয়ে নিলো কিংশুক। কিংশুকের এমন ব্যবহারে শিখিনী হতবিহ্বল হয়ে গেল। কিংশুক কী এখন তাকে ঝাড়বে!
কিংশুক অপ্রস্তুত হয়ে ধীর কণ্ঠে বলল,
– আচ্ছা, আমি, আমি দেখব বিষয়টা। তুমি এই নিয়ে আর চাপ নিয়ো না।
শিখিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বুকের মধ্যে ধকধকানি বাড়ছে তার। একটু আগে যেভাবে কিংশুক হাত ছাড়তে জোর দেখাল, তাতে শিখিনীর সেদিনের প্রেমের রেগে যাওয়ার দৃশ্যটুকু ভেসে উঠল। অস্থির হয়ে উঠল সে। ভীষণ কান্না পেল। চোখে জল এলো। শিখিনী অস্বাভাবিক হয়ে পরেছে, সেটা কিংশুক ঠিক বুঝতে পারল। নিজের বোকামির জন্য নিজের প্রতি রাগ হলো।তাই শিখিনীর সামনে থেকে মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছি ল।
কিন্তু আচমকা শিখিনী এক পা পিছিয়েই কিংশুকের সামনে গিয়ে ঝাপটে ধরল কিংশুককে। কিংশুককে জড়িয়ে ধরেই কেঁদে দিলো শিখিনী। কিংশুক তাকে আবার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার ভয়ে শিখিনী যতটা সম্ভব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কিংশুকের শার্ট খামচে ধরে রাখল। অনেক কথা বলার বাকী তার। কিংশুক এমন পরিস্থিতি হবে, কল্পনাও করেনি। কী বলে সান্ত্বনা দিবে এখন সে!
– কিংশুক, আমি জানি, তুমি আমায় ভালোবাসো।তোমার চোখে ঠিক এমনি ভালোবাসা আমি প্রেমের চোখে দেখেছি। আমি জানি, তোমার পরিবারের মত তুমিও চাও, আমি তোমার বউ হই। কিন্তু আমি নিরুপায় কিংশুক। ভীষণ নিরুপায়। নয়ত, তোমার ভালোবাসা দূরে ঠেলে দেওয়ার সাহস আমি পাচ্ছি না।আমি আমার জীবনে আমার থেকেও বেশি মায়ের সুখের কথা ভেবেছি। সেই আমি এখন কীভাবে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো, কতবড় ভুল করেছি আমি! তোমার মত ফেরেশতাকে আমি কষ্ট দিচ্ছি। আমি, আমি জানি তুমি ভালো ছেলে, কিন্তু তোমাকে বিয়ে…
– কিন্তু আমাকে বিয়ে করা যায় না, তাই তো?
কিংশুকের এমন কথায় শিখিনী আর কথা বলার মত শক্তি পায় না। কিংশুককে এসব বলার পর, শুনার পর আর কী-বা বলার থাকতে পারে তার। একটুতেই তার এখন শ্বাস বেড়ে যায়। এখানে এসে ঠান্ডা লেগে সমস্যাটা আরো বেড়েছে। কান্না বন্ধ হলেও চোখের জল পরা কমছে না। কিংশুকের বুকের উপর কপাল ঠেকিয়ে আগপর মতই দাঁড়িয়ে রইল শিখিনী।
এত কাছে প্রেম ব্যতীত এই কিংশুকের কাছেই তার আসা। সেটার প্রেমের বিষয়ে। ইচ্ছে করছিল, প্রেমকে নিয়ে সবটা শেয়ার করতে। কিন্তু কিংশুক শুনতে নারাজ। কারণ, কিংশুকের কষ্ট হবে। কিংশুকের হৃদয়ে কী চলছে, সেটা হয়ত একটু পরিমাণ শিখিনী বুঝতে পারছে, তাই আচমকা জড়িয়ে ধরতে সে একবারও ভাবেনি।
শিখিনীকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করতে কিংশুক একটি সুযোগ খুঁজে বেড়াত সব সময়, কল্পনা করত নিজের মনে মনে। অথচ, আজ সেটা নিজ থেকে ধরা দিয়েছে, কিন্তু কিংশুকের হাতটা যেন অবশ পাথর। উঠতেই পারছে না।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শিখিনীকে নিজের বাহুডোরে আগলে নিলো কিংশুক। কিংশুকের আলিঙ্গন পেয়ে শিখিনী নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের সাথে ঠেসে রইল। কিংশুকের শক্ত বাঁধন তাকে অদ্ভুত অনুভূতির জানান দিলো।
– তারপর, আমার ছোট বেলার পুতুল বউয়ের ভালোবাসার নাম বুঝি প্রেম? কবে হলো তোমাদের বিয়ে?
প্রশ্ন দুটো যেন শিখিনীর কানে বারবার বাজতে লাগল। পুতুল বউ!
.
সন্ধ্যার সময়,
বিভাবরী বেগমের পাশে সিঁড়িতে বসেছিল শিখিনী। সামনে উঠোনে ইয়ামিনি খেলছে। সন্ধ্যে নামল প্রায়।
হঠাৎ বাসার গেট ঠেলার আওয়াজ। শিখিনী শব্দ পেয়ে আচমকা ওদিকে তাকাল।
প্রেম! প্রেম দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগ কাঁধে। হেঁটে আসছে এক পা এক পা।
শিখিনী আনন্দে, চোখে খুশির জল নিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে প্রেমকে জড়িয়ে ধরল। প্রেমও আগলে নিলো।
বিভাবরী বেগম দাঁড়িয়ে পরলেন।
শিখিনীর চেঁচিয়ে উঠার আওয়াজ পেয়েই যামিনী বেরিয়ে এলো।
প্রেমের পিছনে প্রিয়মকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই যামিনীর হাত-পা অবশ হয়ে আসল।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না যামিনী। প্রিয়ম তার সামনে দাঁড়িয়ে!
চলবে…