#বিদায়_বরণ
২৩ পর্ব
#মেহরুন্নেছা_সুরভী
.
” তারপর, আমার ছোট বেলার পুতুল বউয়ের ভালোবাসার মানুষের নাম বুঝি প্রেম? তা কবে হলো তোমাদের বিয়ে?
কিংশুকের প্রশ্ন দুটো যেন শিখিনীর কানে বারবার বাজতে লাগল। পুতুল বউ! বিয়ে! প্রেম!
শিখিনী এবার হাতের বাধন আলগা করে দিলো। কিংশুক এখনো শিখিনীকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে। শিখিনী মাথা উঠিয়ে সরে যেতেই কিংশুক ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে নিলো। মুক্ত করে দিলো শিখিনীকে।
শিখিনী চোখের জল মুছে বলল, ” তোমার মনে আছে, তোমার সাথে আমার প্রথম দিনের সাক্ষাৎ?
প্রথম দিনের কথা উঠতেই কিংশুক মুচকি হাসল। প্রথম দিনের কথা তার মনে থাকবে না। সেটা কী হয়। বেশ মনে আছে। লাল শাড়ি পরিহিত সুন্দর একটি এলোমেলো চুলে উপর থেকে দৌড়ে নেমে দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। আশ্চর্য দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে অচেনা ছেলেটির দিকে(কিংশুক ছিল)
কিংশুক সেই অচেনা রমনীকে ভোরবেলা লাল বেনারসিতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল। শিখিনীর সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎই চোখের পলকে মেয়েটি দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করেই তার মুখের উপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
এরপর আর একনজর দেখা হয়নি কিংশুকের। একরাশ বিস্ময় আর হাতাশা নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল ব্যস্ত শহর ঢাকা থেকে।
তারপর দেখা এই সপ্তাহ আগে। মতুন রুপে। নতুন শাড়িতে। দ্বিতীয় বার শাড়িতে দেখেও চমকে ছিল কিংশুক। ভেবে নিয়েছিল, তার পছন্দের মানুষটি হয়ত শাড়ি পরতে ভীষণ ভালোবাসে।
– সেদিনের আগের সন্ধ্যা রাতেই আমাদের বিয়ে হয়। সেদিন ছিল আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম রাত। প্রেম, আমার জীবনে ছোট থেকেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল। ভবিষ্যতেও ওকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। আর আমি জানি, ও আমাকে ছাড়া থাকতেই পারবে না।
এতটুকু বলেই শিখিনী মুচকি হাসল। কিংশুক একদৃষ্টিতে শিখিনীর দিকে তাকিয়ে রইল। শিখিনীর সাথে তাহলে তার এমন একটি সকালে দেখা হলো। যে সকালের আগেই কিনা শিখিনী অন্যকারো পরিপূর্ণ ভাবে হয় গিয়েছে! এত দূর্ভাগা কপাল তার!
শিখিনীর কথায় কিংশুক যেন অর্ধেকটাই মরে গেল। বোধশক্তি হারিয়ে ফেলল। কিছু বলার ভাষা পেল না সহসা। শুধু শিখিনীর প্রশান্তির হাসির ছোঁয়ায় যে উজ্জ্বলতা এসেছে, সে দিকে তাকিয়ে রইল মুগ্ধ নয়নে।
– কিংশুক, তুমি আমাদের প্রেম কাহিনী শুনবে?
শিখিনীর ডাকে কিংশুক চমকে উঠে। চোখের চমশাটা খুঁলে চোখ ঘষা দিয়ে আবার পরে নেয়। কিংশুক বলল, হুম বলো।
শিখিনী উৎসাহ পেয়ে কিংশুকের হাত ধরে উপরের সিঁড়িতে বসালো। নিজেও পাশে বসল। এরপর বলতে লাগল,
– প্রেম হচ্ছে আনোয়ার আঙ্কেলের ছেলে। যাদের বাসায় আমরা ভাড়া থাকি, তাদের বাসাতেই আমি আর মা গিয়ে উঠেছিলাম। প্রেম আমার থেকে বড় ছিল। আমার কাছে সব সময় থাকত। আমায় নিয়ে খেলত, আমায় হাসাতো, কাঁদাতো। প্রেমের সঙ্গই আমায় তোমাদের শূন্যতা ভুলাতে পেরেছিল। আমি বড় হতে হতে প্রেমের শাসন বাড়তে লাগল। সারাক্ষণ নজরদারি আর অধিকার খাটানো। প্রেমের আশেপাশে আমি অন্য কাউকে দেখলে সহ্যই করতে পারতাম না জানো। একসময় আমরা বুঝতে পারি, দু’জন দু’জন ছাড়া চলেই না। কিন্তু, এরমাঝে প্রেম বছর তিনেক বিদেশ চলে যায়, ভীষণ খারাপ সময় কাটে আমার সেই তিন বছর। জানো, এক একটা দিন আমার কেঁদে কেঁদে চলে যেত। ভীষণ অভিমান হলো ওর প্রতি। এরপর ও হঠাৎ একদিন দেশে ফিরে এলো। আর আমার অভিমান ভাঙাল, আমরাও বিয়ে করে নিলাম। যদিও সেটা আবেগে হয়ে গিয়েছে। ও হ্যাঁ, আমার একটা ডায়েরি আছে, সেখানে অনেক লেখা আছে আমার আর প্রেমের বিষয়ে। তোমায় দিবো, পড়ে নিও।
-তোমাদের বিয়ের কতদিন হলো?
শিখিনীর কথা মাঝে হঠাৎ কিংশুকের প্রশ্নে শিখিনী কিছুটা থেমে গেল। ভেবে ভেবে উত্তর দিলো,
– একমাস, না প্রায় দেরমাস হয়ে এলো।
.
সন্ধ্যার সময়,
বিভাবরী বেগমের পাশে সিঁড়িতে বসেছিল শিখিনী। সামনে উঠোনে ইয়ামিনি খেলছে। সন্ধ্যে নামল প্রায়। বিভাবরী বেগম মাথায় তেল মালিশ করছিলেন।
হঠাৎ বাসার গেট ঠেলার আওয়াজ। শিখিনী শব্দ পেয়ে আচমকা ওদিকে ফিরে তাকাল।
প্রেম! প্রেম দাঁড়িয়ে আছে ব্যাগ কাঁধে। হেঁটে আসছে এক পা এক পা করে।
শিখিনী আনন্দে দাঁড়িয়ে গেল, আচমকা কেঁদে উঠল। চোখে খুশির জল নিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে প্রেমকে ঝাপটে।জড়িয়ে ধরল। প্রেমও আগলে নিলো শিখিনীকে। ব্যাগটা উঠোনে পরে গেল।
বিভাবরী বেগম দাঁড়িয়ে পরলেন। ইয়ামিনি অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল।
শিখিনীর চেঁচিয়ে উঠার আওয়াজ পেয়েই যামিনী ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো।
প্রেমের পিছনে প্রিয়মকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই যামিনীর হাত-পা অবশ হয়ে আসল।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। প্রিয়ম তার সামনে দাঁড়িয়ে!
প্রিয়ম সত্যি এসেছে। প্রিয়ম কী তার জন্য এসেছে? অদ্ভুত এক আনন্দ অনুভব করল যামিনী। প্রিয়মের সাথে চোখাচোখি হতেই দু’জনে মুচকি হাসল।
বিভাবরী বেগম সিঁড়ি থেকে নেমে এলেন। যামিনীর এবার দৃষ্টি পরল শিখিনী-প্রেমের উপর। আশ্চর্য হয়ে গেল। একরাশ বিস্ময় নিয়ে এগিয়ে গেল।
শিখিনী কেঁদে কেঁদে হেঁচকি তুলে ফেলল প্রেমকে জড়িয়ে। প্রেম না কাঁদলেও চোখের কোনে জল চলে এলো শিখিনীর আর্তনাদে।
– তুমি এতদিন কেন আসোনি। আমায় কী তোমার মনে পরেনি? তুমি এখনো এত পাষান কীভাবে থাকো প্রেম?
– আই এম সরি শিখি। আমি পারিনি এতদিন তোমার সামনে আসতে। আমার জন্য তুমি কষ্ট পেয়েছ, এটা আমি মানতে পারছিলাম না, ভুল করেছি আমি।
শিখিনী মাথা তুলে বলল, -নিজের কোনো ক্ষতি করোনি তো?
প্রিয়ম বলল, কী করেনি তাই বলো।ভাগ্যিস আমি সব জেনে নিয়েছিলাম।
প্রেম মুচকি হেসে শিখিনীর চোখের জল মুছে দিলো। চুলগুলো খোঁপা করে দিলো। মুখটা দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিলো।
প্রিয়ম পাশ থেকে প্রেমকে খোঁচা দিলো। সামনে বিভাবরী বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। শিখিনী মাথা নীচু করে প্রেমের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
প্রেম মাথা নীচু করে বিভাবরী বেগমের পা ছুঁতে হাত বাড়াতে গিয়েই বা হাতে শিখিনীর ধরে রাখার বাঁধনে থেমে গেল। মাথা ঘুরিয়ে শিখিনীর দিকে তাকাল। শিখিনী ধীরে ধীরে হাতটা ছেড়ে দিলো। ছেড়ে দিতেই প্রেম আচমকা বিভাবরী বেগমের পা জড়িয়ে বসে পরল।
-আরে আরে, কী করছ প্রেম।
-আন্টি, আমি জানি, আপনি খুব রেগে আছেন আমার প্রতি। আমার প্রতি রেগেই আপনি শিখিনী নিয়ে চলে এসেছেন। আপনি জানেন, আমি কত কষ্ট করে এই ঠিকানা পেয়েছি। প্লিজ আন্টি, আমি এতদিন অপরাধবোধে ভুগেছি। এতদিন শিখিকে রেখে থেকেছি। ক্ষমা চাওয়ার আগেই শুনি আপনি বাসা ছেড়েছেন। আমি ক্লান্ত আন্টি, ভীষণ ক্লান্ত। অন্তত, আপনার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আমায় ক্ষমা করে দিন। আমি এমন ভুল আর জীবনেও করব না, আপনাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি। পাগলিটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর আমিও ভালোবাসি শিখিনীকে।
বিভাবরী বেগম অসস্তিতে পরে গেলেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভাই আর জয়া খালাও বেরিয়ে এসেছেন। প্রেমের প্রতিটা কথা সবাই শুনছে। কী যে করে বসল ছেলেটা। কিংশুকের শার্ট ধরে উপর টানতে লাগলেন।
-ফুফি আম্মা, প্রেমকে নিয়ে ভিতরে আসুন।
পিছন থেকে কিংশুকের গলার আওয়াজ পেয়েও সবাই চমকে উঠল। বিভাবরী বেগম অসহায় চোখে তাকালেন। যামিনী কেঁপে উঠল কিংশুকেরর আওয়াজ পেয়েও।
বিভাবরী বেগম প্রেমকে ধরে ভিতরে প্রবেশ করলেন। সবাই গম্ভীর চেহারা নিয়ে ভিতরে চলে গেল। বাহিরে দাঁড়িয়ে রইল যামিনী আর প্রিয়ম।
এতক্ষণে যামিনী বুঝে ফেলেছি, শিখিনীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক। সেটা বুঝতে পেরেও বিষাদে ছেয়ে গেল তার মনটা। ভীষণ কষ্ট পেল মনে। এটা ভেবে আরো কষ্ট পেল, শিখিনীর জন্য তার ভাইয়ের হৃদয়ে ভালোবাসা সম্পর্কে অবগত সে। অথচ, কিংশুক কত স্বাভাবিক বিহেব করল। যদিও কঠিন হয়ে। তাহলে কী তার ভাই সব জানে শিখিনী -প্রেমের বিষয়ে!
এসব ভাবনার মাঝেও হঠাল ডান গালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ভড়কে উঠে। ভয়ার্ত চোখে পাশ ফিরে তাকায়। প্রিয়ম হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা তার গালে চুমু দিয়ে দিলো!
প্রিয়মের হাসিই বলে দিচ্ছে, সে বাজি যেতে গিয়েছে। এবার যামিনীর কথা রাখার সময় চলে এসেছে।
চলবে…