বিভাবতীর জীবন পর্বঃ৫

0
2703

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ৫

-“চুপ, জগতের সবাই খারাপ তোরাই সাধু!”

–“আমরা সাধুই বটে আপনার মত বিচার না করেই হুট করে কোন কাজ করিনা! একবার ও ভেবেছিলেন ভাবির এখন কি অবস্থা? কোথায় আছে তিনি, কি করছেন এই মুহুর্তে? কিছু জানেন? এই অবস্থায় একটা মেয়ে আজ প্রায় আটদিন নিখোঁজ! একদিন ও আপনি ওনার খোঁজ করেননি, কিভাবে পারলেন এতটা দিন তার খোজঁ না নিয়ে থাকতে? মেয়েটা শহর থেকে এসেছিল শুধু আপনার কথা রাখার জন‍্য। অন‍্য মেয়েরা যেখানে একটা স্টেপ নিতে গেলে হাজার বার ভাবে সেখানে কতটা সরল মনে মেয়েটা আপনার কাছে এসেছিল। আর আপনি কিনা মেয়েটাকে না বুঝেই মা আর বোনের কথা শুনেই তাকে তারিয়ে দিলেন। ”

–” মা বোনের কথা শুনে মানে? কি বলতে চাস? আমি আমার বোনের কথা শুনে যদি চলি ও তোর সমস‍্যা কি?
তুই ওর পক্ষে হয়ে এত সাফাই গাইতে আসছিস কেন? কি হয় তোর?” সবুজ রায়হানের কলার ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে বলছে কথা গুলো।

–” আমার কিছু হয়না, মানুষ হিসেবে ও একটা মানুষের প্রতি মায়া থাকা উচিৎ তা বলছি।”

–” আরে রাখ তোর মায়া! মায়া দেখাতে আসছিস খুব।”
সবুজ রায়হানের গায়ে হাত তুলতে শুরু করে দিল। তুমুল বাকবিতণ্ডার মধ‍্যে রায়হানের মা আর সবুজের মা ও বোনের দৌড়ে নিজেদের ছেলেদের সরিয়ে নিলেও দুজনে যেন ক্ষ‍্যাপা ষাড় হয়েগেছে। সবুজকে জোর করে মিনা টেনে আনল। মিনা রায়হানকে দেখে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে কি দরদ। মিনা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বলল-

–” ভাইয়া ওদের কথা শুনিস না, কেউ ভালো চায় না আমাদের। একটু সুখের মুখ দেখছি এটা কেউ সহ‍্য করেনা। ঐ মেয়েটার চরিত্রের দোষ সবাই জানে তারপরও মেয়েটার হয়ে সাফাই গায়।”
ধরে ধরে দু পরিবার নিজেদের ছেলেদের টেনে নিয়ে আসলো। রায়হানের মা যেন লজ্জায় পরেগেলেন একদম সবুজের বউটা খুব ভালো, মেয়েটার খুব সরল! এমন মেয়ে এই ধরনের কোন কাজই করতে পারেনা। উনি বুঝাতে চাইলে পারছেন না সবাইকে কথাগুলো বলতে। বলার আগেই উনার ছেলের উপর দোষ দিয়ে দিল। লজ্জায় এখন মুখ খুলতে ও পারছেনা।
__________________________________

সীটে হেলান দিয়ে আজকাল বাহিরে তাকিয়ে থাকে বিভা।
পেটে হাত দিয়ে কখনও কখনও নিজে নিজেই কাদেঁ।
একদিন, এক সপ্তাহ, একমাস, পেরিয়ে ছয়মাস!
কত স্বপ্ন একটা গর্ভধারণ নিয়ে। প্রতিদিন যখন পেটের এই আকার ধারন করে তখন মনে একটা অন‍্যরকম আনন্দ হয়। মেয়েদের প্রথম আবদারের সময়টা থাকে বাবাকে নিয়ে পরের সময়টা স্বামীকে নিয়ে। একটা সময় আবদারের ঝুলিগুলো সরে গিয়ে হয়ে যায় নিজেরাই হয়ে যায় আবদার কারীর প্রধান শিকার। বিভা ও তো তেমন ছিল। বাবার কাছে যা পেত না মায়ের কাছে তা চাইতো।
স্বামীর কাছে আবদার তার ছিল খুবই ক্ষুদ্র!
একদম শেষ পর্যায় ক্রমে সে ও হতো আবদার কারীর শিকার। তাকেও কেউ শাড়ির আচঁল ধরে অথবা ওড়নার কোণায় টেনে টেনে বলতো। মা আমার এটা চাই ওটা চাই।
বেশিক্ষণ ভাবতে পারল না বিভা। বুকটা তার একটা হাহাকারে যেন জ্বলে যাচ্ছে। ভিষণ রকমের ভুল করেছে সে। যার সবচেয়ে বড় শিকার তার সন্তান। অন‍্যায় করেছে সে, আর ভোগ করেছে তার অনাগত সন্তান।

রেজওয়ান কেবিনের ভিতর ঢুকে দেখল বিভা বসে আছে বিছানায়। রেজওয়ানের দিকে তাকিয়ে সালাম দিতেই সে সালামের উত্তর নিল।

রেজওয়ান ভিতরে প্রবেশ করে বলল-

–” শরীর কেমন তোমার বিভা?”

–“ভালো ভাই,”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে রেজওয়ান বলল-

–” ফুফা বাইরে দাড়িয়ে আছেন, ফুফি ও এসেছেন। তোমার সামনে কিভাবে আসবে, কিভাবে মুখ দেখাবে তা ভেবেই আসতে পারছে না।”

–” লজ্জা পাওয়ার মত তো তারা কোন কাজ করেনি রেজওয়ান ভাই। আমি বরং তাদের লজ্জিত করেছি।
আমার কারনে তারা মুখ দেখাতে পারছে না।
লজ্জাটা তাদের নয় আমার পাওয়ার দরকার। আমি তাদের মূল‍্য দেইনি লজ্জা আমার পাওয়ার দরকার।”

–” দেখো বিভা বিষয়টা এখন এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে আসলে তোমরা কেউই দোষী নও। এটা তোমাদের ভাগ‍্যের দোষ! একটা জিনিস মনে রাখবে পৃথিবীতে সবাই সুখী হয়না, ওরকম সুখীই যদি সবাই হতো তাহলে পৃথিবীর মত জটিল হতো না। মানুষ আর স্বর্গ খুজতো না পৃথিবীতেই থেকে যেত আজীবন। প্রত‍্যেকের জীবনে সুখ, দুঃখ থাকে। সুখের থেকে দুঃখের পাল্লাটা কারোর ভারি থাকে। কারো বা খুব কম। এই যে এখন তুমি যে পরিস্থিতে আছো হয়তো সামনে তোমার জন‍্য এর চেয়ে ভালো কিছু আছে। ”

–” আমার জন‍্য আর বিশেষ ভালো কিছু আর আসবে না রেজওয়ান ভাই! আমার সুখ আমি আগেই হারিয়ে ফেলেছি। আমার কপালে আর সুখ আসবে না। যাদের নিয়ে জীবনে সুখের চিন্তা করেছি তারাই নেই জীবনে আমার আর কি সুখ থাকবে রেজওয়ান ভাই?”
রেজওয়ান আর উত্তর দিতে পারলো না। মেয়েটা কতটা গম্ভীর হয়েগেছে। হেসে হেসে দুষ্ট মিষ্টি কথা বলা মেয়েটা আর হাসে না।

এই তো বছর পাচেঁক বছর বয়স আগে বছর ষোলো কি সতেরো বছর কিশোরী কত দুষ্টুমি করতো। মিষ্টি হেসে সবার সঙ্গে কথা বলতো। প্রত‍্যেকটা কথায় ছিল একদম সরলতা মিশ্রিত। হঠাৎ রেজওয়ানের মনে হলো কেন বারবার সরল মনের মানুষগুলোই যত বিপদে পরে?
_____________________________

দুদিন থাকার পর রিলিজ দেওয়া হয়েছে হসপিটাল থেকে।
বিভাকে এসে ডাক্তার রিলিজ দিয়ে গেছে। বিভা রিলিজ পেপারে নিজে নিজে সাইন করল। বিভার বাবা এসেছেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। বিছানা পত্র সব গুছিয়ে হসপিটালের আয়া দের বুঝিয়ে দিচ্ছিল মিলি।
কাগজ-পত্র থেকে শুরু করে ঔষধ পত্র সব কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে সে। মিলি সব গুছিয়ে দরজার সামনে বিভার বাবাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠল –

–” দাড়িয়ে আছেন কেন ফুফা? ভিতরে আসুন!”
প্রতিউত্তর করলেন না মশিউর সাহেব। কেবিনে ঢুকে বিভার সামনে দাড়িয়ে রইলেন। বিভা তখন বারান্দার পাশে একটা চেয়ারে বসে ছিল। খুব মলিন চেহারায় বাইরে চেয়ে আছে সে। মশিউর সাহেব গলাটা একবার পরিষ্কার করে ঝেড়ে ডেকে উঠলেন –

–” বিভা মা!”
আজ তিন বছর বাদে বিভার সঙ্গে মা নামের সুন্দর একটা ডাক শুনতে পেল বিভা। খুব করুণ একটা ডাক, বাবা কি খুব কষ্টে আছেন। মলিন হওয়া চেহেরাটা নিয়ে পিছন ফিরে দেখল তার বাবা মশিউর রহমান চেয়ে আছেন ।
বারান্দার দিকে ফিরে বলল-

–” জ্বী বাবা বল,”

–” আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলবি না? আমি কি এতই খারাপ? ”
বিভা পিছন ফিরে অবাক চোখে তাকালো বাবার দিকে। তারপর তার কি হলো সে ঐ চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে বাবাকে দৌড়ে জড়িয়ে ধরল। তিনটা বছর পর আজ মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরেছে বুঝতেই মশিউর রহমানের খালি বুকটা কেমন ভরে উঠলো। বিভা কান্না করছে বাবার বুকে মাথা দিয়ে। সেই কান্না কোন অভিমান মিশ্রিত কান্না নয় বুক ভাসিয়ে হেচকি দিয়ে দিয়ে কাদঁছে সে। মশিউর সাহেবের বুকে মাথা দিয়েই সে কেদেঁ কেদেঁ বলছে –

–” বাবা তুমি খারাপ না, আমি খারাপ! আমি তোমার সন্তান হয়েও সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।
তোমার বিশ্বাসের মূল‍্যায়ন না করে আমি চলে গিয়েছিলাম। জানো তো বাবা আমি একটা কথা বেশ বুঝতে পারলাম আজ, তোমাদের বুক খালি করেছি বলেই হয়তো আমার সন্তান আমার কাছে নেই। আমার কলিজার টুকরো আমার কাছে নেই। আমি খুব বড় অন‍্যায় করেছি। এখন আমার সব সময় মনে হয় এই জীবনে আমার আর তেমন কিছু হবে না। কাদতেঁ কাদতেঁ বিভা খানিকটা চুপ থেকে বলল –

–“বাবা আমি কাকে নিয়ে বাচবোঁ? যার জন‍্য আমি সব ছেড়ে পালিয়ে আসছি সেই তো নেই। তোমার আর মায়ের অশ্রুর কারনে আমার এমন হয়নি তো? বাবা আমার ছয়মাস গর্ভে থাকা সন্তান নেই বলেই আমার এমন হাহাকার লাগছে। তোমার তো আঠারো বছর মানুষ করা সন্তান ছিলাম আমি। কত আদরে তুমি আমাকে বড় করেছো। কত স্নেহ কত মায়া মমতায় তুমি আমায় লালন-পালন করেছো।তোমার তো এর থেকে ও বেশি কষ্ট হয়েছিল! আমি তোমাদেরকে এত বড় আঘাত করে ফেললাম নিজের অজান্তে এত বড় আঘাত তোমাদের করে ফেললাম। যার সাজা আমি সারা জীবন বয়ে বেড়াবো!

চলবে।

[গল্পটি বেশি শেয়ার করার অনুরোধ রইলো। আর গল্প দেরী করে দেওয়ার জন‍্য দুঃখিত!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here