বিভাবতীর জীবন পর্বঃ৭

0
2767

#বিভাবতীর_জীবন
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃ৭

–” ভেঙ্গে যাওয়া জিনিস হয়তো জোড়া দেওয়া যায়।
বিশ্বাস আর কখনও জোড়া দেওয়া যায় না চাচি!”

–” এভাবে সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি! আল্লাহ তোমাকে সুখে রাখুক মা, আল্লাহ বিচার করবে দেইখো। ওদের কারোরে আল্লাহ সুখে রাখবে না। তোমার মত সরল মাইয়াটার সাথে যারা এমন করছে তারা কোনদিন সুখে থাকতে পারবে না। দেইখো তুমি ও নিজের জীবনে সুখে শান্তিতে ঘর করতে পারবে!”

বিভা প্রতিউত্তরে হেসে দিল। এ জীবনে মানুষ কেন বারবার সুখের কথাটাই উচ্চারণ করে? জীবনে সুখের জন‍্য বিয়েটাই কি সব? বিভা ফোনটা কেটে দিয়ে এগিয়ে এসে সোফায় বসে পরল। খানিকটা অশান্ত মনকে শান্ত করার জন‍্য বিভা গান ছেড়ে দিল। খানিকটা প্রশান্তির প্রয়োজন এই মুহুর্তে। এই কষ্টের মুহূর্তটাকে ভুলতে হলে কিছুটা প্রশান্তি দরকার।

দেখতে দেখতে মাস খানেক পেরিয়ে গেছে বিভার এই বাড়িতে আসার পর। বিভার মা নিজেই বিভার সামনে আসেন না কথা বলতে, বিভা ও বাহিরে বাহিরে সারাদিন কাটিয়ে দেয়। বাড়িতে যাওয়ার তার কোন ইচ্ছে নেই, সারাদিন বাইরে থেকে রাতটা তার বাড়িতেই কাটে।
কখনও সময় করে ভার্সিটিতে যেতে হয় তাকে।
সময়টাকে নিজের মত কাটাচ্ছে। বাড়িতে এলে বাবাই তাকে সময় দিচ্ছে, মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে মা কিছুটা ইচ্ছে করেই পাশ কাটিয়ে যান। মনে হয় তার ভিতরে রাগের পরিমান করা কিছুটা এখনও আছে।
এই তো সেদিন ডাইনিং টেবিলে বসে বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিভা মাকে ডেকে বলল –

–” মা তুমি আমাদের সাথে খাবে না?”
উত্তরে তিনি কিছুই বললেন না, চুপচাপ বাবা-মেয়ের খাবারে খাবার বেড়ে পাশের রুমে চলেগেলেন।
বিভা মায়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এবং একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। আসা অবধি না সে কথা বলেছে না মা কথা বলছে। বিভা কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা, বাবার ও মায়ের উপর একটা তীব্র রাগ আছে। সেটা বিভার বাবার মুখ থেকেই শুনেছে আর রাগটা তাকে ঘিরেই আছে।
বিভা কোনরকমে খাবার খেয়ে উঠে আসলো। গলা দিয়ে আর নামবে না।
______________________________________

পাড়া-প্রতিবেশিদের মধ‍্যে একটা নিত‍্যদিনেই নতুন নতুন টপিক থাকে। পাড়ায় কিছু ঘটলেই এঘর থেকে ও ঘরে একটা হইচই পরে যায়। বিভার ফিরে আসা নিয়ে কিছুটা আলোচনা হলেও কমে গিয়েছিল এখন আবার ও সেই কথা উঠেছে কিন্তু এবার বিভার বিয়ে নিয়ে। বিভার কি বিয়ে হবে না? ডিভোর্সি মেয়েদের নাকি এখন নতুন একটা নিয়ম বেড় করেছে শর্ট ডিভোর্সি আর লং ডিভোর্সি।
শর্ট ডিভোর্সি মেয়েদের বিয়ে করতে অসুবিধা নেই লং ডিভোর্সি মেয়েদের বিয়ে করতে অসুবিধা। রিসেন্ট বা এক দু বছরের মধ‍্যে ডিভোর্স হয়েছে এদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিলেই ভালো পরে নাকি ভালো ছেলে পাওয়া যায় না।
এখন সবার মুখে সেটাই চলছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ের ব‍্যাবস্থা করতে।

পাত্র দেখতে শুরু করেছেন বিভার মা, কথাগুলো মিথ‍্যে না ইদানিং তাই হচ্ছে। বিভার জন‍্য আজ একটি বিয়ের ঘর নিয়ে আসছে ঘটক। ছেলের আগে একবার বাগদান হয়েছিল সব ঠিক ছিল কিন্তু সমস‍্যাটা ছিল মেয়েটাকে নিয়ে মেয়েটা বিয়ে ঠিক হওয়ার মধ‍্যেই পছন্দের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে। বিভার জন‍্য অন্তত খারাপ হবে না।
ছেলের পক্ষ থেকে ডিভোর্সি ও কোন সমস‍্যা নেই শুনেই তিনি রাজি। এসে দেখে যাক মেয়েকে মেয়ে তো তার দূর্বল নয় যথেষ্ট সাবলম্বি। বিভার ও কিছুটা কাজ কমেছে,
কাজ সেরে বাড়িতে এসে দেখল মা সব ঘুছিয়ে নিচ্ছে।
বিভা আসতেই তিনি ডেকে বললেন-

–” রেডি হয়ে নে,লোক আসছে দেখতে।”
বিভা কিছুটা অবাক হয়ে বলল-

–” কারা দেখতে আসছে? আর কেন? ”

–” তোকে দেখতে আসছে, ছেলে ভালো একটা কোম্পানিতে আছে, ছেলেরা একটা নরম মনের মেয়ে চায়। আর কিছুই চায় না,”

–” মা, আমি এই মুহূর্তে কোন বিয়ে করতে পারবো না!”

–” বিয়ের কথা বললেই বিয়ে হয়ে যায় না। রেডি হয়ে নে।”
বিভা মায়ের কথামত পরিপাটি হয়ে সেখানে গেল রুমে প্রবেশ করেই সে খানিকটা লজ্জিত হয়ে পরল।
ছেলে, ছেলের সঙ্গে এসেছে তার বাবা, মা, বোনের জামাই, এত এত লোকের সামনে বিভা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বসল।
এতগুলো লোক তার দিকে চেয়ে আছে। বিভা কারোর মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারল না। উপস্থিত লোকজনদের একজন একজন করে কথা বলছেন। বিভা মাথা নিচু করে সব উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই সব করতে হচ্ছে তার চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছে সে। উপস্থিত সবাই যে বিভার মায়ের আতিথেয়তা আর বিভাকে পছন্দ হয়েছে তার কিছুটা মনে হলো ছেলের বাবা আর ছেলের বোন জামাইয়ের কথায়। বিভা অস্বস্তি নিয়ে উঠতে চাইলে ও পারছেনা অনেক সময়ের পর ছেলের পক্ষ থেকে তার দুলাভাই বলে উঠলেন –

–” আপনি এখন ভিতরে যেতে পারেন।”
স্বস্তি পেয়েই উঠে চলেগেল বিভা। বিরক্ত লাগছে তার এভাবে পাত্র পক্ষের সামনে বসে তাকে তাদের কথার কত জবাব দিতে হয়েছে। ড্রয়িং রুম জুড়ে কথা চলছে। এর মধ‍্যেই ছেলেকে বিভার রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

বিভার রুমে এসে ছেলেটি একটি চেয়ারে বসে পরল। বিভা পাশে থাকা সোফায় বসতেই ছেলেটি গলাটা পরিষ্কার করে নিল। বিভা মাথা নিচু করে রেখেছে, ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই। যা ছিল ঐ একজনের জন‍্যই ছিল ঐ একজনকেই সে মন থেকে মেনে নিয়েছিল, বিভা কোন কথা বলছে না। ছেলেটি ও মনে হয় অস্বস্তিতে পরেছে সে কিছুটা নিচু গলায় বলল-

–” আপনার নাম টা কি?”

–” নাম তো ঐ রুমে বলেছি একবার, আবার বলতে হবে?”

–” কি করব বলুন, ওখানে আপনি ছাড়াও আর চারজন ছিলেন যাদের কথার কারনে আমি কিছু শুনতে পাইনি।”
বিভা কিছুটা চমকালো কারন ছেলেটি তথাকথিত ভদ্র ভাষায় মাথা নিচু করে রাখেনি, এখানে এসে ছেলেটি মাথা উচু করে তার সামনে মূচকি মূচকি হাসছিল এখন একদম হাসতে হাসতে বলল। বিভা কিছু বলল না, এবার ছেলেটি বলে উঠল –

–” আপনার কোন সমস‍্যা নাহলে একটা কথা বলবো?”

–” হুম বলুন,”

–” আমার মনে হয় আপনি এই বিয়েতে রাজি নন,”

–” কেন মনে হলো আপনার? ”

–” কারন আপনার মুখটা কেমন চুপসে গেছে, অনেকটা রাইসার মত। আমি যখনই ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইতাম ও ততদিনই মন খারাপ করে বসে থাকতো।”

–” আপনাকে কে বলল মন খারাপ করে বসে থাকলে মেয়েরা অসুন্তষ্ট থাকে? সচরাচর সব মেয়েই তো এভাবে থাকে। তাহলে আপনি কিভাবে বুঝবেন তার মনের অবস্থা।”

–” উমমম, কথাটা মন্দ নয় তবে আমার মনে হলো।
আচ্ছা যাইহোক আপনার একটা জিনিস আমার ভালো লাগলো। তা হলো আপনি অন‍্যমেয়েদের মত চুপ করে সাধু সেজে বসে থাকেননি একদম শক্ত জবাব দিচ্ছেন।”
বিভা খুব একটা কথা বলল না। ছেলেটি এবার বলল –

–” একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন? আসা অবধি আমি এত কথা বললাম আপনি কিছুই বললেন না। তার মানে আপনি রাজি নন এই বিয়েতে? আমার ধারণাই ঠিক।”
বিভা শক্ত চোখে তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে।
____________________________________

ছেলেটির মা বিভার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন –

–” আপনার মেয়ের নাকি কি সমস‍্যা ছিল! কি সমস‍্যা ছিল ওর? শাশুড়ির সঙ্গে বনিবনা হতো না, নাকি জামাইকে পছন্দ করতো না?”

–” আসলে আমার মেয়ে একটা ভুল করেছিল। মেয়েটা খুব ছোটছিল তো না বুঝেই বিয়ে করেছিল। সেই সংসারে তার শাশুড়ি বা ননদ কেউ সুবিধার ছিল না।”

–” পালিয়ে বিয়ে করেছিল? মানি প্রেমের বিয়ে ছিল?”

–” জী, আপা!

–” মহিলা কিছু একটা ইশারা করলেন মেয়ের জামাই আর তার স্বামীকে। প্রায় দশমিনিট পর উঠে পরলেন তারা বিভার রুম থেকে ছেলেটিকে ডেকে আনলেন।
বিভা এতক্ষণে ছেলেটির নাম শুনতে পারল ছেলেটির নাম সায়েম। সায়েম ছেলেটা বিভার মুখের দিক‍ে তাকিয়ে একটা মুচকি হেসে চলে যাচ্ছে। বিভাকে ডেকে তারা কথা বলে চলে যাচ্ছে কিন্তু সায়েমের মা বিভাদের সঙ্গে আর বেশি কথা বললেন না। তাদের বিদায় করে বিভা বারান্দায় এলো। গাড়িতে উঠার আগে সায়েমের মা খুব কড়া স্বরে বলে উঠলেন –

–” মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে এমন মেয়েকে বিয়ে করালে, মেয়ের অভাব পরে নাই। যে মেয়ে মা বাবারে না জানাইয়া অন‍্য ছেলের হাত ধরে পালিয়ে বিয়ে করে সে মেয়ে স্বামী সংসার ফালাইয়া পর পুরুষের সঙ্গে চলে যেতে দ্বিতীয়বার ভাববে না।”
বিভা চটকরে বারান্দা থেকে সরেগেল। ছি! কি একটা লজ্জা।

চলবে।
সবাই শেয়ার করুন বেশি বেশি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here