#বিলম্বিত_বাসর
#পর্ব_২
#Saji_Afroz
.
.
.
দরজা ঠেলে আবেশের রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো সীমা। আবেশের কোলে আদুরেকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো সে।
এদিকে সীমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের কোল থেকে আদুরেকে নিচে নামিয়ে সীমার উদ্দেশ্যে আবেশ বললো-
এভাবে কেউ নক না করে আসে!
-আসলে আমি বুঝতে পারিনি দরজা খোলা। দুঃখিত।
-হুম।
-তা রাতে বাসর কি করিস নাই? সকাল সকাল এতো এনার্জি পেলি কি করে?
.
কথাটি বলে মুখ টিপে হাসতে লাগলো সীমা।
তার কথা শুনে মুখটা ফ্যাকাসে করে আবেশ জবাব দিলো-
করেছি আবারো করবো। তোর কিরে! আর তুই কি আমার তালতো বোন হস যে এসব দুষ্টুমি করবি? খালাতো বোন খালোতো বোনের মতোই থাক। এখন যা।
-আরে বলতে এসেছিলাম নতুন ভাবি কে খালাম্মা ডাকছেন।
.
মাথায় ঘোমটা টেনে সীমার উদ্দেশ্যে আদুরে বললো-
হুম চলো?
-নাকি বলবো এখনো উঠোনি তোমরা?
-না না চলো।
.
.
.
সীমার সাথে আদুরে রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই ফাতেমা বেগম বললেন-
উঠেছো তুমি?
-না উঠেনি। ঘুমের মাঝে হেটে এসেছে।
.
সীমার কথা শুনে বিরক্তিভরা কণ্ঠে ফাতেমা বেগম বললেন-
আহ! যখন তখন এসব ভালো লাগেনা। দেখি বউ মাকে একটা পিড়ি পেতে দে।
.
খালার কথামতো আদুরের জন্য রান্নাঘরের এক কোণা থেকে একটি পিড়ি নিয়ে আসলো সীমা। সেই পিড়িতে আদুরে বসতেই ফাতেমা বেগম তার উদ্দেশ্যে বললেন-
ঘুম হলো?
-খালাম্মা কাল রাতে কি ঘুম হবার কথা!৷ বাসর রাত বলে কথা। অবিবাহিত হয়েও আমি জানি আর তুমি কিনা এটাই জানোনা?
.
ভ্রু জোড়া কুচকে ফেললেন ফাতেমা বেগম। গম্ভীর গলায় তিনি বললেন-
এই তুই যা এখন এখান থেকে।
-আমি আর কোনো কথা বলবোনা।
-না বললেও তোকে যেতে হবে। যাবি?
.
চুপচাপ রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সীমা।
শান্ত গলায় আদুরে বললো-
জ্বী আমার ঘুম হয়েছে।
-শুনো মা, তোমাকে কিছু কথা বলি। আবেশ হলো আমার বড় ছেলে। তুমি এই বাড়ির বড় বউ। তাই তোমার উপর কিন্তু দায়িত্ব বেশি।
-জ্বী।
-কয়েকদিন আরাম করো এরপর কিন্তু নিজের দায়িত্ব নিজেকেই বুঝে নিতে হবে।
-জ্বী।
-কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে বলবা। আমি থাকবো তোমার পাশে সবসময়।
-জ্বী।
-আজ দুপুরে তোমার বাসা থেকে মানুষ আসবে। সুন্দর করে সেজে থাকবে কেমন?
-জ্বী।
-ঠিক আছে এখন আসো তুমি। মোরশেদাকে দিয়ে নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি আমি। ও হচ্ছে..
-আমি জানি। উনার সম্পর্কে অনেক শুনেছি।
.
.
.
নিজের রুমে প্রবেশ করতেই কাজের মহিলা মোরশেদাকে দেখতে পেলো আদুরে। কাল যেভাবে রুমটা সাজানো ছিলো এখন আর নেই।
সবার আগে গল্প পেতে আমার গল্প পেইজের সাথে থাকুন।ফুলে সাজানো সেই বিছানাটাও নেই। অথচ এমন একটা বাসর ঘরের কতোই না স্বপ্ন ছিলো তার!
মোরশেদা আগের চাদর সরিয়ে নতুন চাদর বিছিয়ে দিচ্ছেন খাটের উপরে। তা দেখে আদুরে বললো-
আপনি মোরশেদা খালা?
.
আদুরের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিয়ে মোরশেদা বললেন-
হু।
-ভালো আছেন?
-আছি।
.
মোরশেদাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো কারণে সে বিরক্ত। কিন্তু কেনো? যাক এই বিষয়ে তার না ভাবলেও চলবে। ভাবার বিষয় হলো আবেশকে দেখা যাচ্ছেনা রুমে৷ সে গেলো কোথায়?
.
.
.
পুকুরপাড়ে বসে আছে আবেশ। একটু আগে যদি সীমা না আসতো তাহলে ভুল কিছু হয়ে যেতে পারতো।
ভুল কিছু? এটাকে কি ভুল কিছু বলা যায়?
বৈধ সম্পর্ক, বৈধ বিয়ে তার আদুরের সাথে। তাহলে তারা একে অপরের কাছে আসাটা অবশ্যই ভুল কিছু নয়। না ভুল কিছুই। অবশ্যই ভুল কিছু৷ আর কারো কাছে না হলেও তার কাছে ভুল। তাই নিজেকে সামলে রাখতে হবে তার। আদুরেকেও কিছু বুঝতে দেয়া যাবেনা। এসবের জন্য নিশ্চয় আদুরে তাকে ছেড়ে যাবেনা! ছিলোইতো ৬বছর শারীরিক কোনো সম্পর্ক ছাড়া তারা। ভালোবাসায় কি শারীরিক কোনো সম্পর্ক থাকা বাধ্যতামূলক? অন্তত আবেশ তা মনে করেনা।
.
-কিরে ভাই?
.
সীমার ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো আবেশ। সীমার উদ্দেশ্যে সে বললো-
আদুরে কই?
.
সিড়ির উপরে আবেশের পাশে বসে সীমা বললো-
তোর বউ এর দেখাশোনার করার দায়িত্ব দিয়েছিস নাকি আমাকে?
-আরে তুইতো তাকে নিয়ে গেলি।
-সেটা খালার কাছে নিয়ে গেলাম। ওখানেই আছে বোধহয়। আমি বেশি কথা বলি কিনা, তাই খালা আমাকে বেরিয়ে যেতে বললেন।
.
সীমার কথা শুনে হাসলো আবেশ। মুখটা বাকিয়ে সীমা বললো-
হাসেন। আমি হেনস্তা হয়েছি শুনলেইতো আবার আপনার হাসি পায়।
-হু পাইতো। তুই যে আমার শত্রু তাই আর কি।
.
আবেশের কথা শুনে ফুঁসতে থাকলো সীমা। সেদিকে খেয়াল না দিয়ে আবেশ বসা থেকে উঠতে উঠতে বললো-
আমি যাচ্ছি। আমার বউ এর কাছে।
.
.
.
-কোথায় ছিলে?
.
আদুরের করা প্রশ্নে শার্টের কোলার ঠিক করতে করতে আবেশ জবাব দিলো-
পুকুরপাড়ে।
-অনেক শুনেছি তোমার কাছে এই পুকুর পাড়ের কথা। আমিও যাবো।
-তা অবশ্যই যাবে তবে এখন নয়।
-কেনো?
-নতুন বউ তুমি। শান্ত, লক্ষি মেয়ের মতো বসে থাকো। সব বুঝিয়ে বলতে হবে তোমাকে?
-শান্ত আমি না। তা জেনেই কিন্তু বিয়ে করেছো তুমি। আমারও ক্লান্ত লাগছিলো। নাহলে যা কাল রাতে তুমি করেছো এর জন্য…
.
থেমে গেলো আদুরে।
টেবিলের উপরে রাখা খাবারের ট্রে এর দিকে নজর পড়লো আবেশের। কথা ঘুরিয়ে সে বললো-
মা পাঠিয়েছে নিশ্চয় খাবার?
-হু।
-খেয়েছো?
-না খাইয়ে দাও। দিবেনা?
.
আদুরের কথা শুনে মৃদু হেসে বললো আবেশ-
কেনো নয়!
.
.
.
বেলা ১২টা বাজলো। ফাতেমা বেগমের বাড়িতে বাড়ি ভর্তি মানুষ গমগম করছে। নতুন বউ দেখতে গ্রামের প্রায় সকলেই ভিড় জমিয়েছে।
.
খাটের উপর চুপটি করে ঘাপটি মেরে বসে আছে আদুরে। গোলাপি রঙ্গের কাতান শাড়ি পরে মুখের উপর ঘোমটা টেনে বসে আছে সে। এই বাড়ির নিয়ম নাকি এইরকমই।
ছোট, বড়, বৃদ্ধা অনেকেই তাকে দেখতে আসছে। তার মুখের উপর থেকে ঘোমটা সরিয়ে তারা বলছেন, “মাশাআল্লাহ”। তাদের কাউকেই সে চিনছেনা। অবশ্য চেনার কথাও না। তাই তার পাশে বসে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে সীমা।
সকলেই কিছু না কিছু উপহার সাথে করে নিয়ে এসেছেন। যারা আনেনি তারা তার হাতে টাকা গুজে দিচ্ছে। আর ছোটরা নানাধরনের চকলেট। আদুরের অবশ্য চকলেট গুলো দেখেই বেশি খুশি লাগছে। তার চকলেট খুব পছন্দ কিনা!
.
প্রায় এক ঘণ্টা হলো এসব চলছে। প্রথমে বিষয়টা মজার মনে হলেও এখন এক ধরনের অস্বস্থি কাজ করছে আদুরের।
আচমকা ঘোমটা সরিয়ে সে বললো-
কিছু মনে করবেন না কেউ। আমার খুব বেশি গরম লাগছে। আমাকে একবারেই দেখে নিন আপনারা।
.
আদুরের কাছে এসে মোরশেদা বললেন-
আবেশের মায়ের কথার এতোটুকু দাম নাই তোমার কাছে? কি কইছিলো সে? যতক্ষণ মানুষ আসবো তোমাকে ততক্ষণ ঘোমটা টাইন্না চুপচাপ বসে থাকতে হইবো। বলেনাই?
-জ্বী৷
-তাইলে? এহুনি ঘোমটা টানো।
.
বাধ্য মেয়ের মতো মোরশেদার কথামতো ঘোমটা টেনে নিলো আদুরে। এই অদ্ভুত নিয়মের কথা আগে জানলে কোনো একটা ব্যবস্থা সে নিশ্চয় নিতে পারতো!
.
.
প্রায় ৪৫মিনিট পর সীমা বললো-
ভাবি আর কেউ আসবেনা। তুমি ঘোমটা খুলতে পারো।
.
সীমার কথা শুনে ঘোমটাটা বিছানার এক পাশে ফেলে দাঁড়িয়ে পড়লো আদুরে।
গানের তালে বলতে লাগলো সে-
আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে!
.
-আমাদের ছেড়ে তুই বড় আনন্দে আছিস তাইনা?
.
দরজার পাশে নিজের মা, বাবা ও ভাইকে দেখতে পেয়ে তাদের কাছে ছুটে গেলো আদুরে। নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে সে বললো-
হুম আনন্দেই আছি। ভেতরে এসো তোমরা।
.
-এমনিতেই অনেকটা দেরী হয়ে গিয়েছে। আগে খাবারটা খেয়ে নিক। তারপর নাহয় গল্প করা যাবে।
.
সামনে দাঁড়ানো শ্বাশুড়ির কথা শুনে মাথা ঝাকালো আদুরে।
ফাতেমা বেগম আবারো বললেন-
সীমাকেও আসতে বলো। ওদিকটা সামলাতে হবে।
.
.
মাত্রই মা বাবা এলো! আর ওমনিতেই তাদের নিয়ে গেলো। একটু পরে খাবার খেলে কি এমন অসুবিধে হতো? বাবা আর ভাইয়ের সাথে একটু কথাও বলতে পারলাম না।। আর পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ কিন্তু আমি রয়েছি একা। কারো কোনো খেয়াল নেই আমার প্রতি। এই আবেশেরই নেই।
.
নিজের মনে কথাগুলো বলে চলেছে আদুরে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ তার চোখ চেপে ধরলো। কিছু না ভেবেই আদুরে বলে উঠলো-
আবেশ?
.
-এ কি! তুই নিজের জামাইয়ের স্পর্শও চিনিস না!
.
পাড়ার বান্ধবী সিমরানের গলার আওয়াজ শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে আদুরে বললো-
তুইতো আমার সাথে সবসময় থাকতি। তোরটাও চিনলাম না।
-বারেহ! আমি কি আর তোকে ওভাবে স্পর্শ করতাম নাকি?
-কিভাবে?
-ন্যাকা! ভাইয়া নাহয় বিয়ের আগে নিরামিষ ছিলো। কিন্তু কালতো তার আমিষ হওয়ার কথা। বাসর রাতের পরে তুই আমাকে জিজ্ঞাসা করছিস কেমন স্পর্শ! তা কাল কি কি হলো?
.
মুখটা ফ্যাকাসে করে আদুরে বললো-
কিছুই না।
-মজা নিচ্ছিস?
-না। তুই খেয়েছিস?
-পরের টেবিলে খাবো। আগে সবটা খুলে বল।
.
আদুরের মুখে সবটা শোনার পর সিমরান বললো –
সকালে যেহেতু ভাইয়া স্বাভাবিক আচরণ করেছে তাহলে কাল রাতে সত্যি তার খারাপ লেগেছে।
-হু।
-কিন্তু বাসর রাতের মতো একটা স্পেশাল রাতে তার এমন আচরণ মানা যায়না। তোদের জন্যতো আরো বেশি স্পেশাল।
-হুম।
-আচ্ছা এমন নাতো? ভাইয়া নিজেই কাল লজ্জা পেয়েছে। উনিতো আবার ম্যান্দামার্কা স্বভাবের।
-ওই তুই খেতে যা! বেশি বকবক করিস না।
-আচ্ছা শুন।
-কি?
-বলছিলাম আজ রাতে কি হয় দেখ। সকালে যেহেতু ভাইয়ার লজ্জা কেটেছে রাতে নিশ্চয়…
-সিমরান তুই থামবি!
.
.
.
রাত ১১টা হতে চললো। তবুও যেনো কাজের শেষ নেই। সারাদিনের এতো খাটনাখাটনির পরেও যেনো ক্লান্তি এসে ভর করছেনা। আবেশের খুশিতে নিজে সুখ খুঁজে পাচ্ছেন ফাতেমা বেগম।
তার স্বামী ১বছর হলো ইন্তেকাল করেছেন। স্বামীর ফ্যাক্টরির দেখাশোনা করছে এখন আবেশ। কিছুদিন পর আয়ানও তার সাথে যোগ দিবে। আয়ানের জন্যও একটা বউ আনবেন ঘরে। দুই ছেলে ও তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে গমগম করবে পুরো বাড়িটা ভাবতেই মুখে হাসি ফুটলো তার।
আদুরেকে নিয়ে তার বড় আশা। আবেশের সব দুঃখ সে ভুলিয়ে দিতে পারবেতো?
.
.
.
সকালের কথা মনে হতেই বারবার শরীরে শিহরণ জেগে উঠছে আদুরের। আবেশের স্পর্শ যেনো একটা মায়া। যে মায়ায় জড়ালে একটা নেশা হয়ে যাবে। আর এই মায়ায় জড়াতে চায় আদুরে। হোক না নেশা!
আচ্ছা, এখন কি আবেশ কাছে টেনে নিবে তাকে? কাল রাতে, আজ সকালে যা হয়নি আজ রাতে কি তা হবে! ভাবতেই অন্যরকম এক ভালো লাগা কাজ করছে আদুরের মাঝে।
.
(চলবে)