বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-১৫

0
1901

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ💖
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

১৫.
সুমধুর পরিবেশ পাড়ি দিয়ে, ইট-খোয়ার রাস্তা মাড়িয়ে, চারিপাশের সবুজবীথি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ ফেলে শা শা বায়ু কেটে ওরা এসে পৌছেছে চোয়াখালী বীচে।

উষ্ণ বালিতটে চিকচিক করছে সোনালী রোদ্দুর। সাদা বালুময় ভূমিতে পা রাখতেই ডেবে যাচ্ছে পা। সাগরের পাড়ে এক পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বকেরা। দলবেঁধে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে গাংচিল। নীল বারিধারার সমুদ্রের গা ঘেঁষে উড়ে চলে যাচ্ছে শঙ্খচিল সহ নাম না জানা সাদা পাখি। পুরো বীচ জুড়ে দূরত্ব বজায় রেখে গাছের সমাবেশ। সাদা বালুময় ভূমিতে সবুজ গাছের কি অপরুপ মিলন!

খানিকটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলো আর্দ্র ফোন হাতে। কিছুটা চিন্তিত সে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে বিরক্তি। সেই চোয়াখালী বন থেকে আসার সময় থেকে দেখে আসছে টায়রা। আর্দ্র কাউকে বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে।

সমুদ্রের কিছুটা কাছাকাছি দাড়িয়ে নোনাজলে পা ভেজানোর উল্লাসে মত্ত টিকলি। দূর থেকে নিমিত্তে তাকে চোখ দিয়ে ঘেরাও করে চলেছে এক যুবক। উপযুক্ত বয়সটাতে যৌবন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। পানির ঝাপটানিতে ভিজে গেছে শরীরের বেশ কিছু অংশ। আদরের চাহনি নিষিদ্ধ কোনো ভেজা স্থানে আটকাতেই সে তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। বেহায়া চোখটাকে বেশ কিছু গালাগাল দিয়ে সে হেটে চলল চারিপাশ।

আশেপাশের কিছু জায়গায় চলছে সল্ট হারভেস্টিং এর প্রস্তুতি। সমুদ্র উপকূলের লবণ চাষীরা বিভিন্ন আকৃতির বর্গাকার বা আয়তাকার জমির চারিপাশে বাধ নির্মাণ করে খানিকটা খুলে রাখে। জোয়ারের সময় পানি ওই জায়গায় প্রবেশ করার পর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সূর্যের তাপে পানি শুকিয়ে সেখানে লবণ দেখতে পাওয়া যায়।

টায়রা আর্দ্রর চারিপাশে কিছুক্ষণ চর্কির মতো ঘুরপাক করলো। আর্দ্র ধমক দিয়ে বলল, ‘এই? চুপচাপ দাড়ান বলছি।’

টায়রা দাঁড়িয়ে গিয়ে মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘আপনার সমস্যা কি?’

‘অনেক সমস্যা। আমি চোখে ধান্দা দেখছি।’

‘দেখতে থাকেন।’ বলেই টায়রা আবারো ঘুরপাক শুরু করলো। আর্দ্র চোখ মুখ কুচকে সে জায়গা থেকে সরে এলো। এরপর আবারো কাউকে ফোন লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। টায়রা এগিয়ে গিয়ে উঁকিঝুকি দিয়েও কিছু দেখতে না পেরে হতাশ হলো। অবহেলা গলায় আন্তাজে ঢিল মারার মতো করে বলল,

‘ও..গার্লফ্রেন্ড ফোন ধরছে না? ‘

আর্দ্র ভ্রু কুচকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো টায়রার দিকে। টায়রা তার দু’চোখ ভর্তি কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর আর্দ্র থমথমে কণ্ঠে জবাব দিলো,

‘ব্রেকাপ হয়েছে। চোয়াখালী বনে একদমই নেট পায়না। সেখানে সে কল দিয়েছিলো ভাগ্যবশত দুই দাগ নেট পাওয়াতে একবার কল ঢুকেছিলো। কিন্তু আমি ধরতে পারিনি। এরপর সে অনেকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু নেট এর জন্য ফোন বন্ধ পেয়েছে।’

‘তারপর ব্রেকাপ হয়ে গেলো?’ টায়রার অবাক গলা।

‘নাহ। কাল রাতে সে আমায় একটা মেসেজ পাঠিয়েছিলো, ‘Amake ki tumi nijer theke beshi valobasho?’ কিন্তু আমি মেসেজটা দেখেছি একটু আগে। উত্তরে পাঠিয়েছি, ‘Na।’ এটা সেন্ড হলেও এরপরের মেসেজ টা সেন্ড হচ্ছে না। পরের মেসেজ টা আমি লিখেছিলাম, ‘Ami tumake tumar thekeu beshi valobashi.’ এখন অবধি সেন্ড হয়নি। এদিকে ফোন দিচ্ছি ফোনও ঢুকছে না নেটওয়ার্ক এর জন্য। কি মুসিবত এ পরলাম! গার্লফ্রেন্ড আমার গেছে এইটা।’

আর্দ্রর বিরহিত মুখ করে বলল। টায়রা কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দম ফাটা হাসিতে ফেটে পরলো। আর্দ্র আগুন চোখে তাকিয়ে রইল। টায়রা হাসতে হাসতেই বলল,

‘ওহ মাই গড! সিরিয়াসলি? এই সামান্য সিলি একটা ম্যাটার নিয়ে ব্রেকাপ?’

আর্দ্র গমগমে মুখে দাড়িয়ে থাকলো। টায়রা কোনো রকম হাসি চেপে বলল, ‘এটাই কি প্রথম রিলেশন ছিলো?’

আর্দ্র একটু বিব্রত হয়ে বলল, ‘না। পনেরো নাম্বার রিলেশন ব্রেকাপ হলো।’

টায়রা আবারো অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। আর্দ্র রাগী গলায় বলল, ‘মিস. ফুটা টায়ার একদম হাসবেন না।’

টায়রা হাসি থামিয়ে বড় বড় চোখ মেলে বলল, ‘আবার? আবার আমার এতো সুন্দর নামটাকে বিকৃতি করলেন?’

আর্দ্র তাচ্ছিল্য ভাবে হাত নাড়ালো। টায়রা চোখ মুখ কুচকে বলল, ‘ভাদ্র আশ্বিন কার্তিক অগ্রহায়ণ।’

‘বাংলা মাসের নাম শিখছেন? ভালো তো। শিখুন শিখুন। তবে মাঝখান থেকে বলেছেন। বাংলা মাস বৈশাখ থেকে শুরু হয়। ডোন্ট ওয়ারি আমি শিখিয়ে দিবো।’

টায়রা দাঁত কটমট করে বলল, ‘এর জন্যই আপনার ব্রেকাপ হয়। যে ব্যবহারের নমুনা! আই উইশ আপনার আর কোনোদিন প্রেম বা বিয়ে হতো না।’

আর্দ্র আতংকিত গলায় বলল, ‘আল্লাহ এত্তো বড় অভিশাপ! আমি বাঁচমু না।’

,

ভেজা বিস্তৃত শুভ্র নির্মল সাদা বালুময় ভূমিতে পা ডুবিয়ে সাগরের তীর ধরে হেটে যাচ্ছিলো টিকলি। আদর দূর থেকে দেখছিলো কমলা রঙের জামার পার উড়না উড়িয়ে, বাতাসে সমুদ্রের পানির গন্ধ টেনে নিয়ে এক রমণী হেটে যাচ্ছে অভিমানী হয়ে। মুখে মন খারাপের রেশ। চোখ মুখ বড্ড অসুখী। চশমার আড়ালে ঢেকে থাকা অসহায় চোখগুলো আদর দেখতে পেলো না। তার চোখের ভাষা আদর পড়তে পারলো না। মনের খবরটাও নিতে পারলো না। হাটতে হাটতে টিকলি যখন আদরের কিছুটা কাছাকাছি। আদর তখন এক মনোনিবেশকারী যাদুকর গলায় একা একা বলল,

‘টিকলি? আপনার ওই অতলতল সমান্তরাল দু’ পাশ থেকে দু’গাছি চুলের উদ্ভব ঘটানো কপালটাতে টিকলি পরলে খুব সুন্দর লাগবে। চুলের ভাঁজে ভাঁজে মিশে যাবে টিকলির গন্ধ।’

আদরের এতো আস্তে কথা কি এতোদূর থেকে শুনতে পেলো টিকলি? সে হঠাৎ চোখ মেলে এক ঝলক তাকালো আদরের দিকে। আদরও তাকিয়ে রইল চোখে চোখ রেখে। টিকলি খুব কৌশলে চোখজোড়া সরিয়ে নিলো ওই সর্বনাশা চোখের উপর থেকে। আদরের ঘোর ভাঙলো। সে গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো এবার সোজা হয়ে দাড়ালো। খানিকটা এলোমেলো চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো এতোক্ষণের অজানা ঘটনা। কিছুক্ষণ ভাবাভাবির পর হঠাৎ আদরের অভীষ্ট মন অভিযোগ পেষণ করলো ঈর্ষা মনোভাব নিয়ে,

‘ওভাবে সে চোখ সরিয়ে নিলো কেনো? আদরের চোখ কি এতোটাই অসুন্দর নাকি আদর নিজে অসুন্দর?’

মনের এহেন অযুক্তিযুক্ত নিচুস্তরের মনোভাব দেখে আদর নিজেই কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকলো। ধমক দিয়ে মনকে বলল,

‘সমস্যা কি তোর? মন-মাইন্ড এতো নিচু কেনো? সময় থাকতে মন মানসিকতা উঁচু কর।’

ভেতর থেকে যেনো উত্তর এলো, ‘এ্যাহ… সত্যি কথা বললেই দোষ। ‘

‘এক চাপড়ে ঠিক করে ফেলবো। ওতো সত্যি কথা তোর বলতে হবে কেনো শুনি?’

______________________________

চোয়াখালী বীচ ঘুরতে ঘুরতে দুপুর হয়ে যাওয়ায় ওরা ফিরে এলো আবার নিঝুম দ্বীপ। উদ্দেশ্য দুপুরের খাওয়া দাওয়া। হোটেল দ্বীপ সম্পদ এ খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে আর্দ্র ক্লান্ত গলা ঠেলে বলল,

‘ভাইয়া এখন একটু রিসোর্টে যাই চলো। খুব টায়ার্ড লাগছে। গোসলও করা হয়নি।’

আদর একটু ভেবে বলল, ‘আচ্ছা চল। বিকাল দিকে আবার বের হবো।’ আদর টিকলিদের দিকে ফিরে তাকিয়ে আবার বলল,

‘আপনারা কি করবেন?’

টিকলি সারাদিনে এই প্রথম আদরের সাথে কথা বলল এবং খুব তেজি গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে,

‘যেহেতু আপনাদের সাথেই ঘুরছি তাহলে আপনারা যা করবেন আমরাও তাই করবো।’

আদর মিনিট খানিক তাকিয়ে থাকলো। এরপর গলা খাকারি দিয়ে বলল, ‘তবে রিসোর্টে চলুন।’

টায়রাই উঠে দাড়ালো সবার প্রথমে। ক্লান্ত শরীরটাকে ধাক্কা-ধাক্কি করে সামনের দিকে এলিয়ে দিয়ে এলোমেলো পা ফেলে চলে যেতে লাগলো।

,

বিকালের একটু আগে আগেই ওরা গেলো নিঝুম দ্বীপ জাতীয় উদ্যান অথবা ন্যাশনাল পার্ক। এখানে একটা ওয়াচ-টাওয়ার আছে। টায়রা খুব আগ্রহ নিয়ে দৌড়ে ওয়াচ-টাওয়ারে উঠলো। আর্দ্র পেছন থেকে ধমক দিয়ে বলল,

‘বেধে রাখা বলদ ছেড়ে দিলে যেমন পাগলের মতো ছুটাছুটি করে আপনি ওরকম ছুটাছুটি করছেন কেনো?’

টায়রা পেছনে তাকিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আবারো আমাকে বলদ বললেন?’

পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দুষ্টু হাসি হেসে আর্দ্র বলে, ‘বলেছি বুঝি?’

টায়রা কোমড়ে হাত রেখে ঝগড়ুটে গলায় বলে, ‘আমি ছুটাছুটি করি লাফাই আর যাই করি না কেনো আপনার তাতে কি?’

‘কিছুই না। করুন। যত ইচ্ছা ছোটাছুটি করুন। এবং এমনভাবে ছুটাছুটি করুন যাতে আপনি এই ওয়াচ-টাওয়ার থেকে ধুম করে নিচে পরে যান। ছোটাছুটি করে যদি নাই পরেন তবে তো ছুটাছুটির অসম্মান করা হলো।’

___________________________

উপরে পেজা তুলোর ন্যায় মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে ধবল সাদা আকাশটির বুকে। মেঘের ভেলায় ভাসমান সূর্যটি উঁকিঝুঁকি দিয়ে নিজের নরম তাপ বিকোচ্ছে। নিচে দেখা যাচ্ছে, বয়ে যাওয়া পানিতে কানায় কানায় ভরপুর নীল রঙের নদী। নদীতে ঝিকুচ্ছে বেধে রাখা চার-পাঁচটা নৌকা। সামনে তাকালেই দেখা যাচ্ছে পুরো নিঝুম দ্বীপ। সবুজ গাছ-গাছালিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে উল্লাসে মেতে আছে প্রকৃতি। সেই উল্লাসের উপহার হিসেবে ছড়িয়ে দিচ্ছে জোরালো হাওয়া। হাওয়ার কোলে ভেসে বেড়াচ্ছে দু একটা সাদা শিমুল তুলোর গুচ্ছ।

টিকলি আঙ্গুলের ডগায় তুলো নিয়ে মিস্টি একটা হাসি দিলো। গলায় ক্যামেরা ঝুলানো টায়রা সাথে সাথে ফট করে টিকলির ছবি ক্লিক করে চলে গেলো অন্যপাশে।

এদিক ওদিক তাকাতেই আদরের চোখ মুগ্ধতার সাগরে আটকে গেলো মহারানীর উপর। যেই মহারানী তুচ্ছ ছোট ছোট জিনিস নিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়। সাদা তুলো হাতে মহারানীর শুভ্র নির্মল চেহারা যেনো মিশে গেলো উচ্ছ্বাসে। মহারানীর ঠোঁটের কোলে মিষ্টি হাসি। আদরের মনটাও যেনো উল্লাসে মত্ত হলো। ভারি অবাধ্য মনটা হঠাৎ একটা অপ্রাকৃত কথা বলে উঠলো,

“প্রেমে পড়ার প্রথম ধাপ মুগ্ধতা কিংবা ঝগড়া।”

নিজের মনের এহেন অপ্রাসঙ্গিক বাক্যে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদর। আশ্চর্য! আজ তার মন এমন এমন কথা বলছে যে আদর নিজেই তার মনের উপর বিরক্ত এবং দ্বিধাবদ্ধ। এ কথা কেনো ভাবলো আদরের বেপরোয়া মন? এ কথা যে বড্ড বেশি অপ্রতিভ এবং অপ্রত্যাশিত। নিরর্থক এ কথাটি ক্রমেই আদররের মনকে ভাবনার সমুদ্রে ডুবিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দম আটকে মারা যাচ্ছে আশেপাশের সব বিষয়-বস্তু। উড়ে চলে যাচ্ছে হাওয়ার টিকলির কোমড় অবধি অবাধ্য রেশমি কেশ। আদরের মনের মনপাখিরা সেই অবাধ্য চুলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ই দিশেহারা হয়ে পরলো।

চলবে❤️

ভীষণ মাত্রায় এলার্জি থাকায় অত্যাধিক মাত্রায় ঠান্ডা লেগেছে আমার। নাক মুছতে মুছতে ছাল তুলে ফেলেও আপনাদের কথা ভেবে গল্প দিয়েছি😒

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here