#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২১.
কারোর হাতের আবদ্ধে বন্ধ হওয়া চোখদুটোর সামনে তখন গভীর অন্ধকার। আগুন্তকঃ মানুষটার হাতের উপর হাত রাখলো টিকলি। বুঝার চেষ্টা চালালো, কে? এরপর খানিক নিচু স্বরে বলল,
‘ভাইয়া?’
ওপাশ থেকে মিটিমিটি চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেলো। টিকলি রাগার অভিনয় করে বলল, ‘ছাড়ো রাহুল ভাইয়া। আমি বোকা না যে চিনতে পারবো না।’
রাহুল ছেড়ে দাড়ালো এবং তার প্রথম কথাই ছিলো,
‘তুই এতো রোমান্টিক কবে হলি রে ভেবলি?’
টিকলি নাক ফুলিয়ে তাকালো। আবার এই জঘন্যতম ডাক! রাহুল বলল,
‘বাব্বাহ! কি সুন্দর গানও শিখেছিস আবার।’
টায়রা ভেটকিয়ে বলল, ‘আমার বোন গান আগে থেকেই পারে নতুন করে শিখতে হয় না।’
‘আরে…ময়নার মা যে। ইশশ..কত্তদিন পর তোর এই চাঁদ বদনখানি দেখলুম। বলি ময়নার বাপ ভালো আছে তো?’
টায়রা চিল্লিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার কাছে নালিশ ঠুকলো, ‘বাবা….কি বলছে দেখো?’
শায়লা আক্তার এগিয়ে এলেন। রাহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘আহারে…আমার বাচ্চাটা। কতদূর থেকে এলো আর তোরা কি শুরু করলি হ্যাঁ? ‘
টায়রা বিরবির করে বলল, ‘এখন আমরা শুরু করলাম? মানে ভাতিজার কোনো দোষ কোনোকালেই তার চোখে পরবে না।’
ফুফুকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে রাহুল বলল, ‘ঠিক বলেছো ফুফু। দেখো তো কেমন শুরু করেছে। তোমার মেয়ে তার ফাটাবাঁশের গলায় চিল্লিয়ে তোমার এই ভোলা ভালা বাচ্চাটার কান স্তব্ধ করে দিচ্ছে।’
টায়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আমি?’
টিকলি বিরক্ত নিয়ে উঠে পরলো বেতের চেয়ারটা থেকে। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
‘আমার ঘর থেকে ভিড় কমাও।’
টিকলি ঘরে গিয়ে গিটার রেখে আবার বারান্দায় আসলো। সবাই চলে গেছে। শুধু রয়েছে টায়রা, নিভা আর রাহুল রয়ে গেছে। নিভা এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলো। টায়রা হাসছিলো রাহুলের কোনো মজামাখানো কথায়। টিকলি কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলো।
এই মেয়ের কারোর সাথে উচ্চ গলায় ঝগড়া করতেও সময় লাগে না আবার হেসে খেলে কথা বলতেও সময় লাগে না। টিকলি নিভার কাধ ধরে বলল,
‘রাহুল ভাইয়া এদিকে তাকাও তো।’
রাহুল হাসতে হাসতেই তাকালো। বলল, ‘কি তাকাবো তোর দিকে? তোর দিকে ওতো তাকানোর কি আছে?’
টিকলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলো মিনিটখানিক। এরপর বলল,
‘এখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তুমি একটু কুশল বিনিময় করবে না? মেয়েটা একা একা বোর হচ্ছিলো আর তোমরা দুজন হে হে করে একা একা হেসে যাচ্ছো?’
এক পলক অবহেলায় নিভার দিকে তাকিয়েই চোখ সরালো রাহুল। বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?’
নিভা ইতস্তত বোধ করে জবাব দিলো, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি। আপনি?’
‘ভালো।’ রাহুল একবার টিকলির দিকে তাকিয়ে আবার টায়রার দিকে তাকালো। টায়রা নিভার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
‘কিরে মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেনো? আর ভাইয়া এগুলো কুশল বিনিময় হলো। আমি ইন্ট্রডিউস করিয়ে দিচ্ছি। ও হলো নিভা। আমাদের খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। আর নিভা উনি হলেন আমাদের মামাতো ভাই।’
নিভা এক পলক চাইলো। চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ রাহুলও তাকালো। নিভা চোখ সরিয়ে নিলো নিভৃতে।
_____________________________
প্রচুর পড়াশোনা করছে আর্দ্র। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সে পড়াশোনায় মজে রয়েছে দিন-রাত। সামনে BJS পরীক্ষা। অথচ আর্দ্রর মনে হচ্ছে তার কিছুই পড়া হয়নি। রীতিমতো শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আদর ঘরে ঢুকলো। রাত দশটা বাজে। আর্দ্র অবাক হওয়া গলায় বলল,
‘এতো তাড়াতাড়ি? সূর্য কোনদিকে উঠলো?’
‘আগে দেখে আয় চাঁদ কোনদিকে উঠেছে। আর তোর আমার ঘরে কিরে? খাস ও আমার ঘরে পড়িস ও আমার ঘরে ফোনও টিপিস আমার ঘরে শুধু গোসল টা নিজের ওয়াশরুম আর ঘুমানোর সময় নিজের বেডে ঘুমাস। আশ্চর্য!’
ভাইয়ের এই ঘরটা আর্দ্রর ভীষণ প্রিয় এবং ভাইকে নিরব ভাবে ভীষণ মিস করে বলে আর্দ্র প্রায় সবসময় ভাইয়ের ঘরে থাকে। এই ঘরে আদর আদর সুবাদ। আর্দ্রর ভালো লাগে। তার ইচ্ছে করে সবসময় ভাইয়ের কাছাকাছি থাকতে। ভাই সাথে থাকলে দুনিয়ায় কোনোকিছু তার কঠিন মনে হয়না বিরক্ত লাগে না নিষ্প্রয়োজন কিংবা নিষ্প্রভ মনে হয়না। ভাইয়ের কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে। ভাইয়ের এই ঘরটাতে পড়তেও ভালো লাগে৷ যদি ভাইয়ের মতো ব্রিলিয়ান্ট হওয়া যায় আর কি! বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে আর্দ্র গলা খাকারি দিয়ে বলল,
‘এই ঘরটা বাবা আমায় দিতে চেয়েছিলো। তুমি জোর করে নিছো। তাই সেই শোধ তুলতে আমি সবসময় এখানে থাকি।’
‘থাপ্পড় দিয়ে দাঁত কপাটি সব ফেলে দিবো। মিথ্যাবাদী একটা। এতো চাপা কই থেকে শিখছস? চাপাবাজ।’
আদরের কথা কানে যেতেই পড়া বন্ধ হলো আর্দ্রর। মিনিট দুয়েক গলায় বেজে রইল চাপাবাজ শব্দটি। চোখের পলক পড়তেই সামনে ভেসে উঠলো টায়রার ঝগড়াটে মুখখানা আবার কখনো গাল ফুলিয়ে থাকার মুখ তো আবার উচ্চ হাসিতে মাতোয়ারা প্রাণবন্ত সেই নারীর মুখচ্ছবি। আর্দ্র টপাস করে চোখ খুলল। জোর গলায় বলল,
‘একদম চাপাবাজ বলবে না। আমি চাপাবাজ না। আমি অতি শান্ত শিষ্ট ভদ্র নিরীহ একটা বাচ্চা।’
আদর আড়চোখে তাকিয়ে বিরবির করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকলো, ‘নিজের ঢোল নিজেই পিটায়।’
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো আর্দ্র ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। চোখ পাকিয়ে আদর বলল, ‘আমার ফোনে তোর কি? আর লক জানোস?’
আর্দ্র হে হে করে হেসে বলল, ‘সেদিন খুলার সময় দেখছিলাম।’
‘কি খুঁজোস ফোনে?’
খুঁজায় ব্যস্ত হয়ে আর্দ্র জবাব দিলো,
‘ওই যে টিকলির নাম্বার। কোথায়? ডিলিট করে দিয়েছো নাকি?’
‘হুম। রেখে কি লাভ?’
আর্দ্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল, ‘কেনো ডিলিট করেছো?’
আর্দ্রর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে আদর প্রশ্ন করলো,
‘তুই কি কাউকে কখনো ভালোবেসেছিলি আর্দ্র?’
ঠোঁট উল্টিয়ে আর্দ্র জবাব দেয়, ‘ভালোবাসা আবার কি ভাইয়া? এসব আমার আসে না। আমি অতি ভদ্র একটা পোলা। তুমি আমাকে পাকায় ফেলতাছো। এসব ভালোবাসা টালোবাসা আবার কি হ্যাঁ? আমি ছোট মানুষ না?’
আদর বিরক্তিতে বলল, ‘দূর ড্রামাবাজ, তুই বাইর হ তো আমার রুম থেকে।’
‘নাহ যাবো না। আমি এখন পড়বো।’
‘যা। তাড়াতাড়ি যা। আর গিয়ে মাকে বল খাবার দিতে।’
______________________________
আদরকে না দেখার আজ ত্রিশ দিন। ক্যালেন্ডারের পাতায় মার্ক করে রাখলো টিকলি। লাল সাইনপেন দিয়ে মার্ক করা বৃত্ত টা জ্বলজ্বল করে টিকলির দুঃখ জানান দিচ্ছিলো। টিকলির ফোনের দিকে তাকালো। ফোনের লক স্ক্রিন খোলার পর ই হোম ওয়ালপেপারে আদর আর তার ছবি ভেসে উঠলো। ছবিটা অপ্রত্যাশিত ভাবে তুলে ফেলা হয়েছিলো চোয়াখালী বনে হরিণ দেখতে গিয়ে। একপাশে আদরের মুখ আরেকপাশে টিকলি মাঝখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে হরিণরা ঘাটে জল খাচ্ছে।
টিকলি ফোনের উপর ছবিটায় হাত বুলালো। একবার দুইবার বারংবার। কিছু স্মৃতি তাজা করে রাখছে আদরকে। হঠাৎ টিকলির মাথায় টোকা পরলো। টিকলি তৎক্ষণাৎ ফোন অফ করে দিলো। পেছনে তাকাতেই দেখলো রাহুল দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিকলি ভয় পেয়ে তাকালো। রাহুল ভাইয়া কি কিছু দেখে ফেলল?
‘কিরে ভেবলি? ফোনে কি দেখিস? বয়ফ্রেন্ডের ছবি?’
টিকলি ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বুকে হাত দিয়ে দম নিয়ে রাগান্বিত ভাবে বলল,
‘ভেবলি ডাকবা না আমাকে।’
‘ভেবলি ভেবলি ভেবলি। তুই তো ভেবলি ই।’
রাহুল চোখ উল্টে বলল। এ বাড়িতে রাহুল আছে দুইদিন ধরে। টিকলি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকলো। মাথা ব্যথা করে উঠলো হঠাৎ। রাহুল জিজ্ঞাসা করলো,
‘তোর না মাথা ব্যথা? কমেছে?’
মাথায় এক হাত রেখে টিকলি জবাব দিলো, ‘নাহ ভাইয়া।’
‘একটা ডাক্তার দেখানো দরকার।’
প্রায় পাঁচ সাতদিন থেকে টিকলির জোরালো মাথা ব্যথা। ব্যথা আগেও হতো তবে অল্প। কিন্তু ইদানীং প্রচুর মাথা ব্যথা করছে। থাকতে না পেরে দুদিন আগে মাকে বলেছে। শায়লা আক্তার বলেছেন,
‘আর দুটো দিন দেখ। যদি মাথা ব্যথা না কমে তাহলে ডাক্তার দেখাবো।’
টিকলি রাহুলের কথার উত্তরে বলল, ‘দেখি। আর আমার ঠান্ডার সমস্যা প্লাস চোখের সমস্যা না? এর জন্য হয়তো মাথা ব্যথা করে।’
‘হুম। তবুও ডাক্তার দেখা। মাথার ব্যপার হেলাফেলা করতে নেই।’
রাহুল চলে যেতে ধরলো। টিকলি নিচু গলায় বলল,
‘রাহুল ভাইয়া, আজকে মনে হয় মামা আসবে।’
রাহুল পেছন ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকালো। গম্ভীর গলায় বলল, ‘আমি যখনি আসি তখনি তার আসতে হয়?’
টিকলি মাথা নিচু করে রাখলো। গমগমে মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রাহুল। টিকলি জানে মামা যতদিন এই বাড়িতে থাকবে রাহুল একবারের জন্যেও ঘর থেকে বের হবে না। বেচারা মামা টা কত কষ্ট করে আসে শুধু একমাত্র ছেলেকে দেখার জন্য। আর ছেলে তার……। টিকলি আর ভাবলো না। জোরালো দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো ক্যালেন্ডারে দৃষ্টি স্থাপন করলো।
,
রুহুল হক চা খাচ্ছিলেন। কাপে চুমুক দেওয়ার আগেই এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজলেন কিন্তু পেলেন না। টিকলি টায়রা সামনে বসে মামাকে দেখছিলো। মায়ের এই একটা মাত্র বড় ভাই টিকলি টায়রাকে ভীষণ আদর করে। মজা করে। তবে বেশ গুরুগম্ভীর। মায়ের আর ভাই বোন না থাকায় এই একমাত্র ভাইয়ের প্রতি তার দরদের শেষ নেই। আদরের কোনো কমতি নেই। চায়ের কাপ টা শব্দ তুলে টেবিলের উপর রেখে রুহুল হক বললেন,
‘টিকলি নাকি অসুস্থ? ‘
টিকলি ইতস্তত করে বলল, ‘কই মামাজান নাতো।’
রুহুল হক কপালে ভাজ ফেলে বলেন, ‘তোমার মা বলল যে, মাথা ব্যথা নাকি?’
‘হ্যা মামাজান তা করে।’
‘চলো তবে ডাক্তার দেখিয়ে আনি৷ আমি এজন্যই আরো এসেছি।’ এদিক ওদিক আড়চোখে তাকাতে তাকাতেই রুহুল হক জবাব দিলেন।
টায়রা শয়তানি করে ভাবুক গলায় বলল, ‘তাই মামাজান? কিন্তু বাবাও তো টিকলিকে ডাক্তার দেখাতে পারতো।’
রুহুল হক হকচকিয়ে বললেন, ‘আরে তোমার বাবা পারবে না। আমার কাছে একটা ভালো নিউরোলজিস্ট আছে। ইয়াং ডাক্তার। বেশ ভালো সম্পর্ক আমার তার সাথে। কাল নিয়ে যাবো। আজ বলে রাখছি।’
টিকলি মাথা নাড়ালো। কিছু বলল না। মাথা ব্যথা এতোটাই তীব্র যে একটু পর পর ই ঝিলিক মেরে উঠে। চুল টুল সব টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। চিপের দু’পাশে অসহনীয় জ্বালা পোড়া। রুহুল হক দু’তলার বাম কোণার ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’
টায়রার আবারো ফাইজলামি জবাব, ‘আমাদের ছাড়া আর কাকে লাগবে আপনার মামাজান?’
রুহুল হক মনে মনে বিরক্ত হলেন। টিকলি টায়রাকে ইশারায় চুপ করতে বলে মামার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘রাহুল ভাইয়া আছে মামাজান। আপনি যেই ঘরটায় তাকিয়ে আছেন সেই ঘরটাতেই আছে।’
রুহুল হক টিকলির দিকে একবার তাকিয়ে উঠে চলে যেতে লাগলেন নিজের ঘরের দিকে। আর যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
‘রাগ মানুষের ধ্বংসের কারণ। রাগ মানুষের দূরত্বের কারণ। রাগ মানুষের সম্পর্ক ভাঙার কারণ। রাগ ভুল বুঝাবুঝির কারণ। আর ভুল বুঝাবুঝি ভীষণ মারাত্মক, ধারালো এবং হিংস্র।’
চলবে❤️