বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-২৪

0
1499

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

২৪.
রাত তখন একটা বেজে পাঁচ মিনিট। ফোনের ওপাশে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। কারোর ভারী নিঃশ্বাসের স্পন্দনে উত্তাল ঢেউয়ের গভীর নিরবতা। আদর কথা বলল প্রথম,

‘বাহ! এতো তাড়াতাড়ি ফোনকল? আমি তো ভেবেছি আরো দু-চারদিন লাগবে।’

টিকলি জোরালো শ্বাস ফেলল। যাক, শেষ পর্যন্ত ঠিক ঠাক নাম্বারে কল করতে পেরেছে। ক্লান্ত গলা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো,

‘আপনি এমন কেনো ডাক্তার?’

আদরকে জড়ীভূত ধরলো। মিনিট খানিক নিরব থেকে বিরবির করলো, ‘আহ! ডাক্তার! কি মধুর!’

‘কিছু বললেন?’
‘নাহ।’
‘এতো রাতে ফোন করলাম বিরক্ত হননি?’
‘আমি এখনো হসপিটালে।’
‘এতো রাতেও?’
‘হুম।’
‘বাড়ি ফিরবেন কখন?’
‘এইতো দেখি। কখন ফেরা যায়।’

এরপর ওপাশে পিনপিনে নিরবতা। আদর চেয়ারে হেলান দিয়ে মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো, ‘তো নাম্বার পেলেন কীভাবে?’

টিকলি ভ্রু কুচকে বলল,

‘ঢং করেন? আপনি নিজেই তো লিখে দিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ দিয়েছি। কিন্তু সেটা অতিমাত্রায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছাড়া তো কারোর বুঝার কথা না।’

‘আপনার কি আমাকে বোকা মনে হয় ডাক্তার?’

টিকলি গলায় তেজের রেশ টেনে বলল। আদর হেসে বলল, ‘নাহ। আপনি তো ভীষণ বুদ্ধিমতী। এবার বলুন তো দেখি কীভাবে কীভাবে পেলেন?’

‘আপনি আর কথা বলবেন না তো।’
‘ওমা, কেনো?’
‘আপনি জানেন আমি সাড়ে দশটায় প্রেসক্রিপশন টা খুলেছিলাম। আর এখন একটা পনেরো বাজে। এ পর্যন্ত আমি একেকজনকে ফোন ই দিয়েছি। যাকেই বলি আদর সাহেব বলছেন সেই বলে এতো রাতে মশকরা করছেন। পাগল ফাগল উপাধিও পেয়েছি। কোন কোন নাম্বারে ফোন দেইনি বলুন, ০১৭৬১২১৩৫৩০, ০১৭৬১২১৩৫৩১, ০১৭৬১২১৩৫২৮,০১৭৬১২১৩৫২৯, ০১৭৬১২১৩৫২৪। একটা নাম্বারও কাজে লাগেনি।’

আদর মনোযোগ দিয়ে শুনলো টিকলির সব কথা। খানিক বাদে বলল, ‘কিছু পেতে হলে তো কিছু হারাতেই হবে টিকলি। সব কিছু কি এতো সহজেই হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়? আপনার কি মনে হয় আমি এতো সহজে আপনাকে ধরা দিবো?’

‘কিন্তু আমি তো ধরে ফেলেছি ডাক্তার।’ টিকলির গলা নরম হলো। আদর চেয়ারে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ‘এক্সপ্লেইন করুন তো দেখি কীভাবে নাম্বারটা বুঝলেন?’

‘আপনি যে প্যাচানো লোক সেটা তো ভালো করেই জানি। যখন দেখলাম কোনো নাম্বার ই কাজে লাগলো না। তখন খাতা নিয়ে বসে বিভিন্ন ভাবে মিলানো চেষ্টা করলাম এরপর আবার ফোন লাগাতে শুরু করলাম। এরপর মাত্র কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেলাম। শূন্য জীবনে ভাসে এক আকাশের সাত রং, ০১৭। ছয় ঋতুতে আসছে বারো মাস আর এক ফাল্গুন, ৬১২১।
হঠাৎ জীবন পথ খুঁজে তিন গলির মুখে, পাঁচ রাস্তার মোড়ে। দুটোই রাস্তার সাথে সংযোগ। আর পাঁচ রাস্তার মোড়ে তিন গলি আছে। এটুকু মিলে হবে আট। তাই না ডাক্তার?’

আদর হাসলো, ‘হুম। তারপর?’

‘সারা মাসে অক্লান্ত পরিশ্রমে ফুরোয় দিন তোমার কফি মগে। এখানে ৩০ এর সাথে ২৪ গুন করে হবে ৭২০। ০১৭৬১২১৮৭২০ এই হলো আপনার নাম্বার।’

আদর বাহ্বা দিয়ে বলল, ‘বাহ! ইম্প্রেসিভ! আপনার আই-কিউ তো দারুন টিকলি। বোকা ভাবতাম কিন্তু প্রচুর বুদ্ধিমতী আপনি। দু দিনে বের করে ফেলেছেন।’

আনমনে টিকলি ধীর গলায় বলল, ‘ভালোবাসলে এসব একটু আকটু আই-কিউ বের করা যায় বাদর সাহেব।’

আদর পুরো কথা শুনেনি তবে শেষে বাদর কথাটা ঠিক শুনেছে। রাগী কণ্ঠে বলল, ‘এই কি বললেন আপনি?’

থতমত খেয়ে টিকলি জবাব দিলো, ‘বলছিলাম যে আমি দুদিনে বের করিনি। আজকেই প্রেসক্রিপশন টা খুলেছি।’

‘তাহলে তো আরো দারুন। ব্রিলিয়ান্ট এর উপর ব্রিলিয়ান্ট। তবে নিশ্চয়ই এখনো ওষুধ গুলো কিনেন নি? তাড়াতাড়ি কিনে ফেলবেন। মাথা ব্যথা বাড়বে নাহয়। এই দুদিনে আরো মাথা ব্যথা করেছিলো কি?’

‘আপনাকে দেখে সব দৌড়ে পালিয়েছে ডাক্তার।’

‘আহা! কি বিরবির করছেন মিস. টিকটিকি? জোরে বলুন না।’

টিকলি চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘এই…’

আদর হাসলো। হঠাৎ কিছু মনে পরেছে এমনভাবে বলল, ‘আচ্ছা আপনার যে ঠান্ডার সমস্যা বলেননি তো। যে দুই তিনদিন নিঝুম দ্বীপে একসাথে থাকলাম সে কয়দিন তো তেমন….’

আদরের কথা সমাপ্ত করতে না দিয়েই টিকলি বলল,

‘আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন। যেদিন আমরা নিঝুম দ্বীপে গেলাম সেদিন আমার ডাস্ট অ্যালার্জির কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিলো বলে আপনি কি বকাটাই না দিলেন। ধুলোবালিতে ছিলাম এবং রাতে আরেকবার গোসল করেছিলাম বলে ঠান্ডা লেগে গিয়েছিলো।’

‘ওহ হ্যাঁ মনে পরেছে।’

‘আচ্ছা ডাক্তার, আপনি আমাকে আপনার ফোন নাম্বার কেনো দিলেন? তাও এভাবে?’

টিকলি ভ্রু কুচকে ঠোঁট টিপে প্রশ্ন করলো। আদর বিহ্বল হয়ে গেলো। চেহারা হয়ে উঠলো বিবর্ণ। এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে? সে নিজেও তো জানে না কেনো সে নাম্বার দিয়েছে। আদর কথা ঘুরাতে বলল,

‘আপনি এতো কার সাথে কথা বলেন টিকলি? আপনি এতো ফোন কলে বিজি থাকেন কেনো?’

আদরের কণ্ঠ কেমন জানি একটু অভিমানের ছোঁয়া। টিকলি বলতে চাইলো আমার ফোন কল বিজি থাকলেই আপনার কি ডাক্তার? কিন্তু আদরের ওই কোমল ললিত নরম কণ্ঠে সে অভিভূত হয়ে গেলো। বলল,

‘কোথায়? আমার ফোন কল তো বিজি থাকেনা ডাক্তার। আপনাকে এ কথা কে বলেছে?’

‘আপনার মামা। চেম্বারে ঢোকার আগে আপনি কারোর সাথে কথা বলছিলেন যার কারণে আপনার দেরি হয়েছে।’

টিকলি হেসে দিলো। বলল, ‘আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম।’

আদরের ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, ‘ফ্রেন্ড?’

‘জি বান্ধবী।’

আদরের বুক কেনো যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড্ড ক্লান্ত গলায় বলল, ‘ঘুমোবেন না?’

‘হুম। আপনি বাড়ি যাবেন কখন?’
‘দেখি। বাড়ি যাওয়া খুব প্রয়োজন। ওদিকে আর্দ্র এক্সিডেন্ট করেছে।’
‘আল্লাহ! কীভাবে?’
‘বাইক এক্সিডেন্ট। দেখেন না কেমন তিড়িং বিড়িং করে সবসময়। পায়ে অনেকটা ইনজুরি হয়েছে। হাটতে পারছে না।’
‘ইশশ…একটু দেখে চলবে না? আজকে টায়রাও অসুস্থ হয়ে পরেছে।’
‘কীভাবে?’
‘ওর তো হেমোফোবিয়া আছে। রাস্তায় কে যেনো এক্সিডেন্ট করেছিলো। রক্ত দেখে বাসায় এসে বমি করেছে।’

আদর ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ভাবলো। ছোট করে বলল, ‘ওহ। খেয়াল রাখবেন। কি করছে টায়রা এখন?’

‘ঘুমোচ্ছে। আচ্ছা ডাক্তার হেমোফোবিয়াকে ডাক্তারি ভাষায় কি বলে?’

‘ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ বা নিউরোকার্ডিও জেনিক সিনকোপ।’

‘উফফ..কত্ত কঠিন নাম। এতোকিছু মনে রাখেন কীভাবে?’

‘ডাক্তারদের মনে রাখতে হয়। এর জন্যই তো আমরা ডাক্তার।’

টিকলি চোখ সরু করে বলল, ‘ভাব ধরছেন?’

আয়েশী ভঙ্গিতে আদরের জবাব, ‘হুম।’

টিকলি আর কথার উত্তর দিলোনা। বারান্দা গলিয়ে আসমানে তাকালো। আকাশে অনেক তাঁরার মেলা। তাঁরাদের মিলনায়তনে যোগ দিয়েছে চাঁদ। রুপালি আলো। চারিপাশে চমক আর চমক। শুধু ভালোলাগা। টিকলি চোখ বন্ধ করে বলল,

‘আপনার কাছ থেকে আকাশ দেখা শিখেছি। আকাশ দেখা যে এতো সুন্দর হতে পারে জানা ছিলোনা।’

আদর ঠোঁটের কোণায় সন্তুষ্টির হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘তবে এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেক রাত হলো।’

‘আচ্ছা। শুভ রাত্রি।’

টিকলি ফোন রেখে দিতেই আদরের মনে পরলো তার সরি বলা হয়নি। তড়িঘড়ি করে সে বলল, ‘হ্যালো হ্যালো কেটে দিয়েছেন? ‘

‘নাহ বলুন শুনছি।’

আদর বড় করে শ্বাস নিলো। হঠাৎ কি যেনো হলো বুকের ভেতর তবলা বাজলো। ধামাধাম। আদর এলোমেলো হলো। সেই এলোমেলো থেকে অগোছালো কণ্ঠে বলল,

‘চিরকুট টাতে কিন্তু শুধু আমার নাম্বার লিখা ছিলোনা কিছু অজানা অনুভূতিকে প্রহরী হিসেবে সাজিয়ে নিয়োজিত রেখেছিলাম।’

টিকলির ঠোঁট প্রসারিত হলো। কান থেকে আস্তে করে ফোন রেখে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হেসে দিলো। ভালোবাসার একেকটা ছন্দ, স্বপ্ন, দৃশ্যকাব্য মনের ক্যানভাসে রঙিন হয়ে ধরা দিলো। টিকলি স্বপ্ন বুনলো। কল্পনা করলো আগামী দিনের তার ভালোবাসার দিনগুলি।

চোখের সামনে ফোন ধরে আদর কিছুক্ষন থ হয়ে বসে থাকলো। বলতে চাইলো কি? আর বলে ফেলল কি? নিজের এই অকর্মায় নিজেই লজ্জিত হয়ে পরলো। এই সরি টাই শনি। যতবার সরি বলতে গেছে কিছু না কিছু ভুল হয়ে যায়। আদর ভেবে পায়না, সে কেনো টিকলিকে সরি বলতে পারেনা? শুধুমাত্র টিকলিকেই কেনো?

_________________________________

ভোরের সূর্যের কোমল আলো ঘর ছুতেই আর্দ্রর বুঝে আসলো সকাল হয়ে গেছে এবং সারারাত তার ঘুম হয়নি অজানা কোনো বুককাঁপা উত্তেজনার কারণে। নরম কমলা সূর্যের আলোতে আর্দ্র নিজের বাম হাতের দিকে তাকালো। কেনো তাকালো কে জানে। কাল বিকালের পর থেকে এই হাত দিয়ে সে কিছুই ধরেনি। এমন কি বাথরুমের চাপ এলেও বাথরুমে যায়নি। কি যন্ত্রণা! শেষমেষ পায়ের সাথে সাথে কি মাথাটাও গেলো?

হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আর্দ্রর চোখে খেলে গেলো উড়নচণ্ডী, চাপাবাজ, পকপক করা টায়রার মুখচ্ছবি। এই হাতটাই টায়রার কোমড়ে রাখা হয়েছিলো। সেকেন্ড মিনিট গড়িয়ে অনেক্ষণ ওই কোমড়ের অধিকার পেয়েছিল। আর্দ্রর দিশেহারা লাগলো। অগোছালো জীবনটা আরো বেশি অগোছালো হয়ে উঠলো।

তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। আদর ঘুমু ঘুমু ক্লান্ত চোখে ঘরে ঢুকতেই দেখলো বিছানা জুড়ে অন্য কারোর বিচরণ। আর্দ্রকে দেখে আজ কোনো কড়া কথা কিংবা বকা দিলো না। নিঃশব্দে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আর্দ্রর সামনে বসলো। আর্দ্র একাচ্ছন্ন নয়নে তখনো তাকিয়ে দেখছিলো বাম হাত। আদর বলল,

‘এখন পায়ের অবস্থা কি?’

আর্দ্রের দিক থেকে কোনো ফিরতি উত্তর এলো না। আদর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে নাক ছিটকে বলল,

‘কিরে? বামহাতের রেখা গুনছিস নাকি? ছি ছি ছি! শেষমেষ বাম হাত? এমন ভাবে দেখছিস মনে হচ্ছে এখনি খেয়ে ফেলবি। ইয়াক! এক কাজ কর এভাবে দেখা বাদ দিয়ে একটু চেটে টেস্ট নিয়ে নে।’

আর্দ্র হুশে ফিরে তাড়াতাড়ি হাত নিচে নামিয়ে উঠে বসতে গেলেই পায়ে চাপ পরলো। সাথে সাথে কুকরিয়ে উঠলো। আদর বিরক্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফার্স্ট-এইড বক্স নিয়ে আসলো। ড্রেসিং করতে করতে বলল,

‘অসুস্থ বলে আজকে কিছু বললাম না। যে কয়দিন অসুস্থ আছিস সে কয়দিন আমার সাথে থাক। কিন্তু এরপর থেকে নিজের রুমে যাবি।’

আর্দ্র খুশি হয়ে বলল, ‘হোয়াট আ বড় অফার….’

,

সকাল দশটা বাজতেই বাড়িতে আগমন ঘটলো নিভার। আদর সকালে নাস্তা করছিলো। আর্দ্র রিমোট চেপে চ্যানেল পাল্টাচ্ছিলো এবং মনোয়ারা বেগম ছোট ছেলেকে পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। নিভা ডুকতেই মনোয়ারা বেগম চিল্লানো সুরে বললেন,

‘নিভা…তুই?’

নিভা আস্তে করে ভেতরে ডুকে আর্দ্রের পাশে সোফায় বসলো।

চলবে❤️

বড় পর্ব চাইলে এক দুইদিন পরপর দিবো। আর প্রতিদিন গল্প চাইলে ছোট পর্ব হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here