#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৭.
কাকভেজা শরীরেই বিছানায় বসে পরলো টিকলি। বিছানার এক কোণায় আধশোয়া অবস্থায় ফোন চালাচ্ছিলো টায়রা। বিছানা কেপে উঠতেই সে তাকালো। ভেজা শরীর নিয়ে বিছানায় বসতে দেখে টায়রা বিরক্ত হলো। গম্ভীর গলায় বলল,
‘বিছানা ভিজে যাচ্ছে।’
টিকলির কোনো হেলদোল পাওয়া গেলো না। টায়রা ভ্রু কুচকে তাকালো। এবার খানিক উঁচু গলায় বলল,
‘বিছানা ভিজে যাচ্ছে তো।’
তখন হঠাৎ টিকলির চোখ থেকে টপ করে পানি পরলো তার মসৃণ হাতের উপর। টায়রা থেমে গেলো। রাগ-ক্ষোভ অভিমান ভুলে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে টিকলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল,
‘কি হয়েছে?’
টিকলি অতর্কিতভাবে ঝাপটে ধরলো টায়রাকে। বাধন ছাড়া কান্নায় মত্ত হতে হতেই হেচকি উঠে গেলো। ঘরময় কেঁপে উঠলো টিকলি আর্তনাদময় বেদনার অভিসারে। টায়রার বুকে অঘটন ঘটার পূর্বাভাস। টিকলিকে বুক থেকে সরিয়ে টায়রা তাড়াতাড়ি ঘরের কাঠের দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে এলো। এরপর আবার টিকলিকে জড়িয়ে ধরে বসলো। টিকলির কান্নার বেগ বাড়লো। টায়রা দিশেহারা পথভ্রষ্ট পথিকের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।
টিকলি কাদে না। খুব বেশি যখন কষ্ট পায় তখন এভাবে চিতকার করে কাদে। বোনকে কাদতে দেখে টায়রার চোখ বেয়েও পানি পরলো। ওই যে বলেছিলাম, টায়রা প্রচুর কাদতে পারে। কিছুক্ষণ পর টিকলির কান্নার মাত্রা কমলো। টায়রা তখন শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে আমাকে বল? কে বকেছে তোকে? আমি দেখে নিবো তাকে।’
টিকলির থেকে উত্তর পাওয়া গেলো না। টায়রা উৎকন্ঠা নিয়ে টিকলির হাত পা ভালো করে দেখে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় গিয়েছিলি এই বৃষ্টির মাঝে? বল না বল। কেউ কিছু করেছে? খারাপ কিছু হয়েছে তোর সাথে? শরীরের কোথাও কেউ হাত দিয়েছে? কাদছিস কেনো? একবার নামটা বল দেখ আমি কি করি….’
‘আমি আদরকে ভালোবাসি।’ টিকলি কাদার মাঝেই আস্তে করে বলল। টায়রা শুনলো না টিকলির কথা নিজের মতো কথা বলতে যাওয়ার মাঝেই টিকলি আরেকবার জোরে বলল, ‘টায়রা, আমি আদরকে ভালোবাসি।’
টায়রা থেমে স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে থাকলো টিকলির দিকে। টর্নেডোর মতো আশেপাশে সব ঘুরপাক খেলো। মুখের বাক শক্তি হারিয়ে শুধু এক নিমিত্তে তাকিয়েই থাকলো। টিকলি আবার বলল,
‘আমি আজ উনার সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলাম।’
‘তুই আমাকে একবারও বললি না টিকলি?’ টায়রার করুণ গলা। চোখের পাতা বন্ধ করে ঠোঁট চেপে টিকলি বলল,
‘আমি ভেবেছিলাম উনার সাথে দেখা করার পর তোকে সব বলবো।’
‘তো কানতাছোস কেন? ভালোবাসছোস দেখা করছোস এখন দেখমু প্রেমও হয়ে যাবো। এখন আইসে কান্নাকাটি করতাছোস কেন? আমি তো আর তোর কেউ না।’
টায়রা তেজস্বী গলায় বলল। টিকলি কোনো উত্তর না দিলে টায়রা আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘ আদর ভাই তোরে ভালোবাসে না? কথা বলোস তোরা ফোনে? নাম্বার কেমনে পাইছোস? যোগাযোগ কেমনে?’
টিকলি উদাস চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলো, ‘উনি ভালোবাসে কিনা আমি জানিনা।’
‘যোগাযোগ কেমনে হইলো? নাম্বার পাইছস কেমনে?’ টায়রা ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো।
‘মামাজান আমাকে যে নিউরোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে গেছিলেন সেই ডাক্তারই উনি ছিলেন।’
‘ওহ! এরপরই সব হয়ে গেলো? এরজন্যই তোমার এতো ঘন ঘন ফোন আসে? আর বারবার উনি উনি করোস কেন? জামাই লাগে তোর?’ টায়রা ধমক দিয়ে বলল।
‘তুই আমার সাথে মজা করতাছোস? ফাইযলামি লাগতাছে এসব তোর কাছে?’
টিকলির রাগী গলা। হাই তুলে টায়রা উত্তর দেয়,
‘বিরক্ত লাগতাছে। প্রথমে ভাবলাম না জানি কি হইছে? আর এখন শুনি লাভ কেস। ধ্যাত আমার ইমোশন গুলার বারোটা বাজায় দিলি।’
টিকলি বৈরাগী চোখে তাকিয়ে থাকলো বারান্দা গলিয়ে আকাশের দিকে। খুব ধীর গলায় বলল, ‘তুই বুঝতে পারছিস না টায়রা।’
‘কি বুঝতে পারছি না?’
টায়রার দিকে একাচ্ছন্ন নয়নে তাকিয়ে টিকলি জবাব দিলো, ‘এই সেই পাত্র যার সামনে আমি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট সেজেছিলাম।’
অবাক বিষয়তৃষ্ণা শূন্য দৃষ্টিতে টায়রা তাকিয়ে থাকলো। স্বগতোক্তি করে বলল, ‘কি বলস?’
‘হুম।’
‘সত্যি?’
‘হুম। আজ যখন রেসটুরেন্টে গেলাম দেখা করার উদ্দেশ্যে তখন দেখি মাস্ক পরা অবস্থায় সেই লোক। পরে মাস্ক খুলতেই দেখলাম উনি।’
‘কিন্তু তাতেই বা কি হয়েছে? এতে এতো কাদা-কাদির কি আছে?’
‘উনি আমাকে চিনার পর বিনাবাক্যে রেসটুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছেন। সমস্যা টা এইখানেই। চলে কেনো গেলো সে?’
‘দেখ, তুই যেমন তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে কেদে ফেলেছিস। ঠিক তেমনি সেও হয়তো তোকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছিলো। পুরুষ মানুষতো আর যখন তখন কাদতে পারে না? তাই হয়তো নির্বাকে চলে গিয়েছে।’
‘সত্যি কি তাই?’
‘হতেই পারে?’
‘যদি এমন না হয়। আমাকে চেনার পর যদি সে আর আমার সাথে কথা না বলে? ওই মিথ্যা বানোয়াট প্রেগন্যান্সি এবং বয়ফ্রেন্ডের কথা সত্যি ভাবে তখন?’
টিকলি রুদ্ধ গলায় বলল। বলতে গেলেই চাপা হয়ে এলো গলা। মন খারাপেরা আবারো বাধ ভাঙলো।টায়রা হতাশ চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
‘হ, সবাই তো তোমার মতো বলদ।’
টায়রা আবার বলল, ‘আর শোনো মেয়ে, তুমি একদম আমার সাথে কথা বলবা না। তুমি আমার থেকে লুকায়ছো এত্তোবড় ঘটনাটা। বিশ্বাসঘাতকতা করছো।’
‘এমন করিস না বোন। আমি অনেক সরি। আপু ভেরি ভেরি সরি।’
________________________________
ঝুম বৃষ্টিতে আদর রেসটুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নির্লিপ্ত পায়ে কাদা মাড়িয়ে হেটে হেটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে লেগে গেলো প্রায় দু-ঘন্টা। কাকভেজা হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসতেই মনোয়ারা খানের মুখোমুখি হলো। মায়ের অবাক চোখের কৌতুহল ভরা দুটি মনি। আদর এক পলক তাকিয়েই আবারো অনুরাগহীন পায়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।
ভাই এসেছে খবরটা পেয়েই ভাইয়ের খোঁজে আদরের ঘরে চলে এলো আর্দ্র। আদর নিরবচ্ছিন্ন নিরবতায় বসে ছিলো একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের নিজের কালো চেয়ারটাতে। আর্দ্র ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কি করো ভাইয়া? কি হইছে?’
ক্লান্ত গলায় আদর বলল, ‘কি হবে? হওয়ার মতো তো কিছু নেই।’
‘কোথা থেকে আসলে?’
‘কাজে গিয়েছিলাম একটা।’
‘ওহ। আচ্ছা, তুমি কি প্রেমে পরলা নাকি?’
কপালে হাত দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল আদর। আর্দ্রের কথায় কপাল থেকে হাত নামিয়ে ভ্রু কুচকে বলল, ‘হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
আমতা আমতা করে আর্দ্র উত্তর দিলো, ‘না মানে। তোমার ফোনে দেখলাম আরকি।’
‘কি দেখলি?’
‘কাল যখন তুমি ওয়াশরুমে ছিলে তখন দেখলাম মনতাঁরা নামে সেভ করা একটা নাম্বার থেকে কল আসলো।’
আদর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো এলোমেলো হয়ে গেলো। নিরস দেহটা নিছকই প্রাণহীন বনে গেলো। চেয়ারের হাতলে এলিয়ে দিলো মাথা। প্রথম দিনই মনতাঁরা নামে টিকলির নাম্বার সেভ করে রেখেছিলো। কেনো রেখেছিলো কে জানে! কিন্তু মন শুধু এটাই জানে এই তাঁরা ফোন করলেই আদরের বুকপাটাতন জ্যোৎস্নানাথ পাওয়ার উদ্দেশ্যে মেতে উঠতো। গোলাপে গোলাপে ছেয়ে যেতো দ্বিজরাজের বাগান। সৌন্দর্যে ভরে উঠতো যেই পয়োনিধি কুৎসিত।
আর্দ্র চলে যেতে নিলেই আদর অনুভবশূন্য গলায় ডাকলো,
‘আর্দ্র।’
পেছন ফিরে তাকিয়ে আর্দ্র জবাব দিল, ‘জি ভাইয়া।’
‘সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েটা টিকলি। তোর তো জানার খুব ইচ্ছে ছিলো তাই জানিয়ে দিলাম।’
আর্দ্র বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো। যেনো এই দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে এক্ষুনি অবাকতারা একে একে জড়ে পরবে। টালমাতালা গলায় আর্দ্র বলল, ‘কি? টিকলি…’
আর্দ্রকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদর কঠোর গলায় বলল, ‘এই নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। নিজের ঘরে যা।’
,
টিকলি ফ্রেস হয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই আগমন ঘটলো শায়লা আক্তারের। মায়ের দিকে গোয়েন্দা নজরে তাকিয়ে থাকলো টায়রা। শায়লা আক্তার ধমকে বললেন,
‘এমনে চ্যারা চোখে তাকায় থাকোস কেন? মনে হয় চুরি করতে ঢুকছি।’
‘নাহ তুমি তো সচরাচর আসো না আমাদের ঘরে।’
‘আমাদের ঘর? ঘর লেইখে দিছি নাকি তোদের? কত টাকায় বিক্রি করলাম?’
টিকলি বিরক্ত গলায় বলল, ‘মা, কিছু বলবা? বললে বলো তা নাহলে এক কাপ কফি দাও। মাথা ব্যথা করতাছে।’
শায়লা আক্তার মেয়ের পাশে বসলেন। মেয়ের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মধুমিশ্রিত গলায় বললেন,
‘কান্না করছস নাকি? চোখ মুখ ফোলা কেনো? তখন মনে হলো কারোর কান্নার আওয়াজ শুনলাম।’
‘না মা। কান্না করবো কেনো? এমনি সাইনাসের ব্যথা বেড়েছে। তুমি কি বলতে এসেছো বলো না।’
‘হুম। শোন মা, তোর বাবা একটা পাত্র দেখেছে…’
শায়লা আক্তার কথা শেষ করার আগেই টায়রা চেঁচিয়ে বলল, ‘কি? বাবা আবার পাত্র দেখেছে?’
কটমট করে শায়লা আক্তার বললেন, ‘নাহ, ছেলেবাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে। আর তুই এতো লাফায় উঠোস কেন? বিয়ে কি তুই করবি?’
‘অবশ্যই আমার লাফায় উঠতে হবে কারণ টিকলির থেকে আমি মাত্র এক বছরের ছোট। সে হিসেবে টিকলির বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার বিয়ে দেওয়া তোমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্ব আমি মেনে নিতে পারিনা। কারণ আমি এতো তাড়াতাড়ি আমার বিন্দাস লাইফ শেষ করে দিতে পারিনা বোন ছাড়াও থাকতে পারিনা আবার জামাই ছাড়াও থাকতে পারিনা। ইশশ..কি যন্ত্রণা! কি করলে এই সব একবারে পাওয়া যাবে আইডিয়া দাও তো আম্মু।’
‘ঠাটায় একটা চর মারার পর আইডিয়ারা হাটি হাটি পা পা করে এমনেই চলে আসবে আম্মাজান।’ দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল শায়লা আক্তার।
‘আমি এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছি না মা। প্লিজ এসব বিয়ে বিয়ে খেলা বন্ধ করো। একটু শান্তি দাও। তা নাহলে দু’চোখ যেইদিকে যাবে আমি সেদিকে চলে যাবো।’ টিকলির অকপটে জবাব।
‘সাথে আমারেও নিস। এই মাসুম বোনটারে ফেলায়ে এক একা যাইস না। ভয় পাবি। সাথে আমার অভিশাপও লাগবো।’ টায়রা কাদো কাদো হয়ে বলল।
টিকলি বিরক্ত হয়ে বলল,
‘সবসময় ফাইযলামি করলে কানের তিন আঙ্গুল নিচে খাবি একটা।’
,
সেদিন রাত থেকেই ধুমিয়ে জ্বর এলো আদরের। জ্বরে পাগল প্রায় আদরের সেবা যত্নে নিয়োজিত সর্বকাছের মা মনোয়ারা খান। কেদে বুক ভাসাচ্ছেন তিনি ক্ষনে ক্ষনে। ছেলের জ্বর হয়না প্রায় দু’বছর যাবৎ। হঠাৎ করে এই মাত্রাতিরিক্ত জ্বর হওয়ার কারণ কেউ ধরতে না পারলেও মনোয়ারা খান কান্নাভেজা গলায় বললেন,
‘আরো বেশি করে বৃষ্টিতে ভিজ। জ্বর তোর আসবে না তো কার আসবে।’
মায়ের কথা আদরের কানে গেলো না। দেয়ালে দেখা গেলো একটা টিকটিকি ঘুরে চলেছে অবিরাম। আদর আধো চোখ দিয়ে তা দেখে মৃদু হেসে জ্বরের ঘোরে নিচুগলায় বলল,
‘মা দেখো টিকটিকি। মিস. টিকটিকি।’
মনোয়ারা খান কিছুক্ষণ হাবুলের মতোন তাকিয়ে থেকে বিলাপ পেরে কেদে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত জ্বরের কবলে পরে তার ছেলেটা পাগল হয়ে গেলো? টিকটিকি দেখিয়ে বলছে মিস. টিকটিকি। হায় আল্লাহ! এই দিন দেখানোর আগে আমার মরণ কেনো হলো না? আমাকে তো কোনোদিন কেউ বলেনি মিস. মনোয়ারা খান আর একটা টিকটিকিকে মিস? এতো সম্মান??
চলবে❤️