বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-২৮

0
1514

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

২৮.
ফোনটা এলো প্রায় সপ্তাহ খানিক পর। তখন মাঝরাত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছন্দপতন। তুমুল বেগে বৃষ্টি থেমেছে এই একটু আগে। ধীরে ধীরে টুপটাপ একটা দুটা ফোটা বৃষ্টির সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে টিকলির মন খারাপ অনুভূতিরা। আকাশে অজস্র মেঘের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে উঁকি দেয় রুপালি আলোর অধিকারী সুধাংশু। বাড়ির পাশের হিজল গাছের লাল ফুল চুইয়ে পানি পরছে। দু ‘তলার বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে জেগে উঠেছে জারুল গাছ। পাতার ফাঁক-ফোঁকর গলে পানি ক্রমাগত নিগড়ে পরছে টিকলির ঘরের বারান্দায়। টিকলি হাত বাড়িয়ে গোলাপি ফুলগুলো ছিড়লো। ফুলের কলি ফোটাতে ফোটাতে আনমনা চোখে জনমানবহীন ভিজা রাস্তার বাকলে তাকিয়ে রইল।

টায়রা ঘুমিয়ে গেছে। রাত প্রায় দেড়টা এখন। টিকলির হাতের মুঠোয় থাকা মুঠোফোন টা কেঁপে উঠলো। এতোরাতে কে ফোন দিতে পারে ভাবতেই টিকলি ভ্রু কুচকে ফোনের স্কিনে তাকালো। প্রায় সাথে সাথেই যেনো নিশ্চল হয়ে এলো বা’পাশের হৃদপিন্ডের ধুকধুকানি। অভাবনীয় বিস্ময় সূচক চোখে তাকিয়েই থাকলো।

ফোনটা এসেছেলো অতর্কিতভাবে। ঠিক তেমনে কেটেও গেলো আকস্মিক। কেটে যেতেই ওপাশ থেকে আর ফোন করা হলো না। সেকেন্ড গড়ালো মিনিট গড়ালো টিকলি চেয়ে থাকলো আরেকবার ফোনের আশায়। মিনিট দশেক পর আশা গুলোকে সত্যি প্রমাণিত করে ফোনটা আবার এলো। টিকলি দেরি করলো না। ইশশ..সাতটা দিন অপেক্ষা করেছে কখন একটা বার লোকটা ফোন দিয়ে কথা বলবে। চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে টিকলি শ্বাস আটকে বসে রইল। পিনপিনে নিরবতায় কেটে গেলো প্রায় তিন মিনিট পনেরো সেকেন্ড। টিকলি রুদ্ধশ্বাসে এবার বলল,

‘হ্যালো।’

ওপাশ থেকে তখন কেউ খুব ক্লান্ত নরম অনেক দিনের অপেক্ষার গলায় বলল,

“In the end of rain, The love is beginning.”

টিকলির শরীর কেঁপে উঠলো অপ্রত্যাশিত মোহনায়। অপ্রতিরোধ্য গলায় কিছু বলতে গেলেই দেখলো গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না। কোনো এক অশরীরী তার গলা চেপে ধরেছে। বিদ্রোহ জানাচ্ছে আদর টিকলির প্রেমছন্দে। টিকলি ভয়ে আরো একবার কেঁপে উঠলো। মনে মনে খুব করে বলল, ‘এবার যেনো প্রেমের ছন্দপতন না হয়।’

অনেক কষ্টে টিকলি বলতে পারলো, ‘কি বললেন ডাক্তার?’

‘বৃষ্টিশেষে প্রেমের শুরু।’

আদর আবার বলল খুব করুণ গলায়,

‘আপনার মনে আছে টিকলি! প্রথম যেদিন আমাদের গল্পটা শুরু হলো? প্রথম যেদিন আপনার সাথে আমার দেখা রেসটুরেন্টে, ঠিক সেদিনও কিছুক্ষন আগেই বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো। আপনার মনে আছে! সদরঘাটে কাদায় পড়া থেকে আপনাকে বাচিঁয়েছিলাম! সেদিনও কিছুক্ষন আগেই বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো। আপনার মনে আছে প্রথম যখন লঞ্চে আপনার মুখ দেখলাম আপনি আমার বুকে এসে পরলেন ঠিক তার কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো। মাতাল হাওয়ায় উন্মাদ ছিলো চারিপাশ। আপনার মনে আছে নিঝুম দ্বীপ ঘুরে এসে ঢাকা ফিরতেই যখন আমরা আলাদা হয়ে নিজেদের পথ ধরলাম তখনও বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো।’

টিকলি ঠোঁট চেপে ধরে থাকলো। বুকের সান্নিপাতিক মনের আওয়াজ কান পর্যন্ত পৌছালো না। একাগ্রভাবে আদরের কথায় মনন করলো। শরীর জুড়ে বয়ে গেলো যুদ্ধে জয়লাভ করার তকমা। সত্যি কি জীবনটা এতো সুন্দর! আদর ডাকলো,

‘টিকল…..’

টিকলি চোখ বন্ধ করে মুগ্ধস্বরে বলল, ‘হুম।’

‘আপনি কিছু বলবেন না?’

টিকলি চুপ হয়ে গেলো। কি বলবে! সারাক্ষণ মনের মাঝে, টায়রার সামনে, বুকের ভাঁজে লুকিয়ে চুরিয়ে বলছে এই একটা কথা। ‘আমি আদরকে ভালোবাসি।’ অথচ এখন এ কোন বোবায় ধরলো তাকে? কেনোকিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। কেনো শুধু শুনতে ইচ্ছে করছে? আদরের ওই ভালোবাসাময় বাণী? এতো মধুর লাগে কেনো কানে?

‘আপনি কি আমার উপর অভিমান করে আছেন?’

আদরের প্রশ্নে টিকলির গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,

‘হুম বাদর ডাক্তার। আমি খুব অভিমান করেছি। অতি অভিমানে আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। কেনো আপনি ফোন করতে এতোটা সময় নিলেন? কেনো? আপনার সেই প্যাচমোচড় নাম্বার বের করে ফোন লাগাতেও তো আমি এতোটা সময় নেইনি।’

আদর মুচকি হেসে বলল,

“অভিমান যেখানে সিক্ত হয় মনমাতানো অনুভূতি সেখানেই সৃষ্টি হয়।”

টিকলির চোখের দুয়ার বন্ধ হলো বিহ্বল এই বাক্যে। বশীভূত হয়ে উঠলো সরল অন্তঃকরণ। অবচেতন মনে শুধু একটা শব্দই বলতে পারলো,

‘তাই?’

‘আমি বিশ্বাস করি।’

‘এতোটা দেরি কেনো করে ফেললেন ডাক্তার?’

টিকলির অসহায় গলায় আদর দ্বিগুন অসহায়ত্ব নিয়ে বলল,

‘জানেন সেইদিন রেসটুরেন্ট থেকে ফিরে আসার পর আমার মাত্রাতিরিক্ত জ্বর হয়েছিলো। দুদিন বিছানায় পরে থাকার পর যখন নিজের কাজে ফিরে আসলাম। তখন দেখি আমার কোনো কিছুতেই মন বসছে না। অপারেশন করতে গিয়ে দেখি রোগীর পাশের জায়গায় আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে আশ্বস্থ করছেন। আমার মনে বল জোগাচ্ছেন। পেসেন্ট দেখতে গেলে বিরক্ত লাগা শুরু করে। ক্লাস করাতে গিয়ে লেকচার দিতে পারিনা। সব ভুলে যাই। শুধুমনে হয় ক্লাসের কোথাও না কোথাও আপনি বসে আছেন। আমাকে দেখছেন, শুনছেন। এই যে এখন, এখন আমি হাসপাতালে। আমার রাউন্ডে যাওয়ার সময় অথচ আমি যেতে পারলাম না। নিশ্চল পা গুলো হাত দুটোকে সচল বানিয়ে আপনাকে ফোন দেওয়ালো এবং অবাধ্য মুখ এতোগুলা কথা বলিয়ে দিলো। আমাকে কি কোনোভাবে বেহায়া লাগছে না?’

টিকলি হেসে উঠলো জোরে। আদর মুগ্ধ হয়ে শুনলো হাসির ধ্বনি। এরপর বলল, ‘কবে আসবেন?’

‘কোথায়?’

‘আমার কাছে?’

‘আপনার কাছে কেনো যাবো?’

‘ওমা, আসবেন না?’

‘না, একদম না।’ টিকলি ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে উত্তর দিলো।

‘আচ্ছা, তুলে নিয়ে আসবোনি।’

টিকলি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মারাত্মক! সাতদিনে মারাত্মক পরিবর্তন এসে গেছে।’

‘এমন অবস্থায় ওরকম একটু একটু হয় মিস টিকটিকি।’

‘কীরকম কীরকম ?’

‘বলে বুঝানো যাচ্ছে না। যাই হোক, আচ্ছা আপনার কি বয়ফ্রেন্ড ছিলো বা আছে কিংবা কখনো… ছিলো?’

আদর ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো। টিকলি রেগে উত্তর দিলো,

‘আপনি আসলেই একটা গর্দভ।’

আদর হাসলো। বলল,

‘আর আপনি বোকা, বুদ্ধিহীন নারী। নাহ, বুদ্ধিহীন না। দুইটা রোল প্লে করেছেন তো তাই দুরকম মনে হয়েছে। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মহিলা হিসেবে যতটা মানসিক বিকারগস্ত, বুদ্ধিহীন, চঞ্চল, ঝগড়াটে মনে হয়েছে টিকলি হিসেবে ঠিক ততোটাই সুন্দর, বুদ্ধিমতী, নরম এবং শান্ত মনে হয়েছে।’

‘তাই?’

‘হুম।’

‘আর আপনাকে ফালতু বেয়াদব লোক হিসেবে অহংকারী, দাম্ভিক, অভদ্র এবং ঝগড়ুটে মনে হয়েছে কিন্তু বাদর ডাক্তার হিসেবে ঠিক ততোটাই শান্ত, কোমল, ভদ্র, গাম্ভীর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।’

আদর কিছুক্ষন নিঃশব্দে হেসে ধীর কণ্ঠে বলল,

‘আপনি তো কিছু বললেন না টিকলি? উত্তর দিলে কি খুব দোষের হবে?’

টিকলি ঢোক গিলল। এবারও বলতে পারলো না। উলটে বলল, ‘খেয়েছেন?’

হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আদর বলল, ‘নাহ।’

‘সেকি! এখনো খাননি কেনো? রাত দুটো পার হয়ে গেছে। খেয়ে নিন এক্ষুনি।’

‘বাড়ি ফিরে খাবো।’

‘কখন ফিরবেন?’

‘এইতো এক্ষুনি।’

‘তাহলে যান। কথা বলে খিদে বাড়াবেন না। পরে অসুস্থ হয়ে যাবেন।’

আদর গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো, ‘হুম।’

‘তবে রাখি?’

‘আচ্ছা রাখুন।’

আদর ফোন রাখতে গেলেই টিকলি ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো,

‘ডাক্তার শুনুন, আমি না আপনার শুকতারা হতে চাই! শুকতারা কি আমার কাছে বিক্রি করা যাবে?’

আদরের মনগভীর শীতল হলো। মন খারাপের মেঘ কেটে গিয়ে ঝরঝরা হাসিখুশি নতুন সূর্য উঁকি দিলো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে আদর বলল,

‘শুকতারা যে বেঁচা যায় না টিকলি। শুধু জমানো যায় আর কেনা যায়।’

‘তবে আমি কিনে নিতে চাই ডাক্তার। আর কেউ যেনো না পায়।’ টিকলি আচ্ছন্ন ভরপুর কণ্ঠে বলল।

‘শুকতারা গুলো আমি আপনার নামেই লিখে দিয়েছি টিকলি। আপনি যে আমার সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষ মহারানী। আর আমি আপনার রাজ্যের সামান্য এক কুঠিয়াল প্রজা।’

টিকলির চোখ ছলছল করে উঠলো। ভেজা গলায় বলল,

‘এতো সুখ কি আমার কপালে সইবে? নাকি রাত পোহালেই শেষ হয়ে যাবে ডাক্তার?’

‘আপনি কি কাদছেন টিকলি?’

‘নাহ, আমি ফ্যাচফ্যাচ করে কাদি না। একটু চোখ ভিজে উঠেছিলো।’

‘ওহ। একদম কাদবেন না। কক্ষনো না। আর সুখ আপনার কপালে সইবে না মানে? সুখকে ধরে বেধে আপনার কাছে নিয়ে আসবো।’

টিকলি হাসলো। এরপরও অসহায় গলায় বলল,

‘সমস্যা তো আরেক জায়গায় আছে ডাক্তার।’

‘কোন জায়গা?’ আদর ভ্রু কুচকালো।

‘আপনার আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে বিয়ে ভেঙেছি। এরপর তো আপনার বাবা আমার বাবাকে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো। আপনাদের ফ্যামিলিরও আমাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা এবং আমাদের ফ্যামিলিরও।’

কথাগুলো বলেই টিকলি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। আদর কপালে কিছু ভাঁজ ফেলে বলল,

‘এ কয়দিন আপনাতে এতো বিভোর ছিলাম যে এসব মাথায়ই আসেনি। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো। আমি সামলে নিবো।’

এতো করুণ মুহুর্তেও আদরের কথা শুনে টিকলি হাসলো। এরপর বলল, ‘যদি আপনি না পারেন?’

‘তবে তো আপনি আছেন আমার শুকতাঁরা আমার মনতাঁরা।’

তখন রাস্তার ধারে ধারে ভেজা পাতার হাট বসেছিলো। গাছের ডালে ডালে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করা পানি। একফোঁটা টিপটিপ করে পরা বৃষ্টি। হিজল লাল ফুল আর জারুল গোলাপি ফুল মিলেমিশে প্রকৃতি মনোমোহর। টিকলি চোখ বন্ধ করে উপভোগ করলো। বলল,

“আপনি আমার অভিমান রাজা আমার গম্ভীর রাজা। সারাক্ষণ যার একমাত্র কাজ অকারণে মহারানীর উপর অভিমান করা।”

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here