বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-৪৪

0
1291

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৪৪.
বর্ষার গগন শরতের ন্যায় স্বচ্ছ। পেজা তুলোর ন্যায় শুভ্র মেঘের উড়াউড়ি তাতে। প্রকৃতি বিলাচ্ছে ঠান্ডা বৃষ্টি হাওয়া। রাহুল আর নয়ন একসাথে যাচ্ছে গুলশানের বড় আভিজাত্যপূর্ণ রুহুল হকের বাড়িতে। রুহুল হকের করুণ আবদার বিয়েটা যেনো এই বাড়ি থেকেই করা হয়। কিন্তু রাহুল কোনোমতেই রাজি নয়। রুহুল হক তখন বললেন অন্তত আজকের জন্য এসো। দুপুরের খাবারটা খেয়ে চলে যেয়ো। রাহুল বিয়ের আগে আর কোনো ঝামেলা চাইছে না। তাই অগ্যতা তাকে যেতে হচ্ছে সাথে একাকীত্ব দূর করতে নয়নকেও বগলদাবায় করে নিয়ে ছুটে চলেছে। রিক্সা দিয়ে যেতে যেতেই রাহুল খুব প্রফুল্লতার স্বরে বলছিলো,

‘জীবনে এই প্রথম বোধ হয় আমি যা চেয়েছি তা পাচ্ছি। বুঝলি নয়ন? আমার খুব খুশি লাগছে। এতোটা খুশি আমি এ জীবনে কক্ষনো হইনি।’

‘তাই? তাহলে চল এই খুশিতে একটা দারুণ কাজ করে ফেলি। আমিও বিয়ে করে ফেলি।’

রাহুল মজার ছলে নয়নের পেটে গুতা দিয়ে বলল, ‘পছন্দের কেউ আছে?’

‘আছে তো। প্রথমদিনই দিল কাইরে নিছে তোর শালী। চল না বন্ধু, একসাথে শুভ কাজটা সেড়ে ফেলি।’

রাহুল চোখ গরম করে তাকালো। ব্যাপক মাত্রায় রাগ দেখিয়ে বলল, ‘শালা! নজর ভালো কর। আমার কলিজার বোন লাগে।’

‘কলিজার বোনরে তো বিয়ে করতাছো।’

‘নাহ, কলিজাকে বিয়ে করছি আর টায়রা আমার কলিজার বোন।’

নয়ন গালে হাত দিয়ে বলল, ‘আমি প্রথমে ভেবেছিলাম তোর আর নিভার মধ্যে গিট্টু আছে।’

রাহুল হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়াবার ন্যায় বলল, ‘নারে! তুই সবসময় বেশি ভাবিস। ওর আর আমার মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু আপসোস আমার সেই খুব ভালো বন্ধুটাকেই আমার এতো খুশির খবরটা দিতে পারছি না।’

‘হুম’ বলে নয়ন চুপ হয়ে গেলো। রাহুল আবার বলল,

‘নাম্বারটা নিয়ে রাখার উচিত ছিলো বুঝলি? বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছি।’

,

দুপুরের জবরদস্ত খাওয়া দাওয়ার পর রুহুল হক একা রাহুলকে নিজের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি রুমে ডাকলেন। রাহুল চোখ মুখ শক্ত করে গিয়ে দাড়ালো। রুহুল হক চেয়ারে বসতে বললেন। নির্বাকে রাহুল চেয়ারে বসলো। রুহুল হক কাশলেন, পানি খেলেন এরপর অনেক্ক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,

‘তো কি ভাবছো?’

রাহুল ভ্রু কুচকে জানতে চাইলো, ‘কোন বিষয়ে?’

‘বিয়ে করছো। কিন্তু বউকে খাওয়াবে কি? বউকে রাখবে কোথায়? ব্যাচেলর বাসায় তো আর রাখতে পারবে না।’

রাহুল বাকা হেসে বুকে হাত ভাঁজ করে কথা শুনতে লাগলো। রুহুল হক গলা ঝেড়ে বললেন,

‘আমার ব্যবসায় বসো। আর কতদিন..’

রুহুল হককে থামিয়ে রাহুল বলল, ‘আমার ব্যাপারে আপনার না ভাবলেও চলবে। আমার ব্যাংকে চাকরি হয়েছে। সামনের মাস থেকে জয়েনিং। আর কিছু বলবেন?’

রুহুল হক অবাক হয়ে বললেন, ‘কবে হলো?’

‘পরসু খবর পেয়েছি।’

‘বাহ! একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?’

‘কতকিছুই তো জানেন না। সবাই কি আপনাকে সবকিছু জানিয়ে করছে? এ পৃথিবীর সবকিছু কি আপনার জানা?’

রুহুল হক থতমত খেয়ে স্থিত হলেন। ছেলেটা বড্ড বড় হয়ে গেছে। কি সুন্দর মারপ্যাঁচ দিয়ে কথা বলা শিখেছে! রুহুল হকের ভাবনার মাঝেই রাহুল উঠে চলে যেতে লাগলো। দরজার বাইরে পা রাখার আগেই রুহুল হক বলে উঠলেন,

‘শোনো? আমি ইচ্ছে করে আকিদাকে বিয়ে করিনি।’

রাহুল পেছন ঘুরে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘যেভাবেই হোক করেছেন তো? আমার মায়ের মৃত্যুর চল্লিশ দিন হওয়ার আগেই এই মহিলাকে বিয়ে করে এনেছেন। দিনটা আজও আমার চোখের সামনে ভাসে।’

রুহুল হক ভাবলেশহীন গলায় বললেন, ‘তবুও তোমার জানা দরকার। বিয়ে করছো। এখন বড় হয়েছো। সবকিছু জানার দরকার আছে তোমার।’

রাহুল পকেটে হাত দিয়ে দাড়ালো, ‘হঠাৎ আজই কেনো মনে হলো আমার সবকিছু জানার দরকার?’

‘জানি না। তবে কতকাল আর মনে মিথ্যে গল্প পুষে রাখবে। সত্যিটা জানার দরকার না তোমার?’

রাহুল বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘বলুন।’

রুহুল হক হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। শূন্যে তাকিয়ে করুন গলায় বললেন,

‘তুমি তো জানো তোমার মায়ের দু’কূলের কেউ নেই। শুধু ছিলো এক হতদরিদ্র খালা। সেই খালাও আমাদের বিয়ের পর পরই ইন্তেকাল করেন। শুধু রইল খালু। তোমার মায়ের আপন জন বলতে ছিলো সেই খালুই। আকিদা ছিলো তোমার মায়ের সেই খালাতো বোন।’

রাহুলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। এই কথা তার অজানা ছিলো। সে অবিশ্বাস্য গলায় বলল, ‘তাই নাকি? সত্যি?’

‘হুম। তোমার মায়ের মৃত্যুর পর তোমার মায়ের গ্রামে গিয়েছিলাম গরিব দুঃখীদের খাওয়াতে। মনে আছে তোমার? সেইখানেই ঘটলো বিপত্তি। সেইদিন রাতে ঝুম বৃষ্টি ছিলো। প্রবল বর্ষন মাথায় নিয়ে আমি রাতে পৌছুলাম তোমার মায়ের খালার বাড়ি। তোমার মায়ের খালার বিয়ে হয়েছিলো পাশাপাশি বাড়িতে। সেই সূত্রে একই গ্রামে থাকা। আমি যখন ওই বাড়িতে পৌছুলাম। দেখলাম চারিপাশে কান্নার রোল। বাড়ি হালকা পাতলা সাজানো। পাঁচ-ছয় জন মানুষ। সেইদিন নাকি আকিদার বিয়ে ছিলো। আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। তোমার মা মারা গেছে কিছুদিন হয়েছে। এই অবস্থায় বিয়ে কীভাবে করতে পারে? পরে শুনলাম আকিদার বাবার টাকার অভাব। মেয়ের ভরণপোষণ চালানোর মতোও ক্ষমতা নেই তার। মেয়ে বিয়ে দিবে কিন্তু বরপক্ষের যৌতুক মেটাতে পারেনি বলে বর বিয়ের আসর ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমাকে দেখেই আকিদা ঘরে দরজা বন্ধ করে ফাঁস দিতে গেলো। আমি তড়িঘড়ি করে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে দেখি গলায় উড়না পেচিয়েছে। আমি আকিদাকে বাঁচালাম। হতভাগা আমি তখনও জানতাম না এসব ছিলো সাজানো নাটক। আকিদাকে বাঁচানোর পর আকিদার বাবা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি কোনোমতেই বিয়ে করবো না। তখন পাশ থেকে সেই চার-পাঁচটা লোক বলে উঠল, বিয়ে করতে হবে। কুমারী মেয়ের গায়ে হাত দিছেন আবার বিয়ে করবেন না। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। আমি তো আকিদাকে বাঁচাতেই কোলে করে নামিয়েছি। ওরা কোনো কথাই শুনলো না। তিলকে তাল বানাতে উঠে পরে লাগলো। বলল, ‘পাঁচগ্রাম এক করবে। আমাকে জেলে পাঠাবে।’ আমার ভয় লাগলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তোমার মুখটা। আমি জেলে গেলে তোমার কি হবে? তোমার ভবিষ্যতের কি হবে? তুমি তখনো তোমার মায়ের মৃত্যুর ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারো নি। এমন অবস্থায় আমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকে কে দেখবে? ওদের চেচাঁমেচিতে আশেপাশে আরো কিছু লোক জড়ো হলো। ব্যাপারটা অনেক জটিল হয়ে গেলো। দুজন লোক আমাকে দুটো ঘুষি পর্যন্ত মেরে দিলো। আকিদা প্রথম থেকে খুব ভালো মেয়ে ছিলো। তোমাকেও খুব আদর করতো। আমি ভাবলাম আকিদাকে বিয়ে করলে তোমার খেদমত করারও মানুষ হবে। শেষে না পেরে আমাকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হলো। কিন্তু কে জানতো ভালো মানুষীর আড়ালে যে দুই বাপ বেটি এতো বড় ছক কষে রেখেছিলো। আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম ওরা কোনোদিন তোমার মায়ের ভালো চায়নি। তোমার মায়ের ভালো ওরা সহ্য করতে পারতো না। ওদের ইচ্ছা ছিলো প্রথমেই আকিদার সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার। বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে করে বিয়েটা করিনি।’

পুরো কাহিনি শুনে রাহুল ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল, ‘এই গল্পগুলো যে বানোয়াট নয় তার কি প্রমাণ?’

রুহুল হক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার। তবে আজ বলতে দ্বিধা নেই আমি তোমার মাকে এখন অবধি ভালোবাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি।’

রাহুল অবাক হলো। ভিষণ মাত্রায় অবাকতার সাথে সহসা মনটা হালকা হলো। হঠাৎই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষটাকে বাবা বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু করা হয়ে উঠলো না। কিছু একটা চেপে ধরলো যার কারনে গলা দিয়ে শব্দ বেরুলো না। ও তাড়াতাড়ি নয়নকে নিয়ে চলে গেলো।

_______________________________

জামিলুর রেজাকে সারাদিন বুঝিয়েও লাভ হলো না। তারা বিয়ের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পরলো টিকলি। তখন প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া অপরাহ্ন। আকাশের দূর সীমানায় ভেসে উঠেছে হলুদ দাগ। জোরালো বাতাস। টিকলি নিষ্ক্রিয় চোখে টায়রার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কি করবো? বাবা-মা তো কোনোমতেই মানতে চাইছে না।’

ভারী নিঃশ্বাস ফেলে টায়রা বলল, ‘জানি না। সাতদিন থেকে আজ একদিন চলে গেলো। হাতে সময় আছে মাত্র আর ছয়দিন। কাল পরসু বোধ হয় বিয়ের কেনাকাটাও শুরু হয়ে যাবে।’

‘আমি চোখের সামনে অন্ধকার দেখছি টায়রা। আমার বাইরে বের হওয়া একদম বন্ধ। আমি উনার সাথেও দেখা করতে পারছি না। এসব কথা ফোনে বলাও সম্ভব না।’

টায়রা চিন্তিত মুখে বলল, ‘আরেকটু চেষ্টা কর। কালকে পর্যন্ত দেখ। যদি কোনো কাজই না হয় তবে ফোনেই ভাইয়াকে সব বলে দিতে হবে। এছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখছি না। সব শুনে ভাইয়া কি রিয়েকশন দিবে তাও বুঝতে পারছি না।’

টিকলি হতাশ হয়ে নিরাশ মুখে বসে থাকলো। কিছুক্ষণ পর মাথা উঁচিয়ে বলল,

‘নিভাকে একটা ফোন দিবো? ওকে তো কিছুই জানানো হয়নি। দেখি ও যদি কোনো সাজেশন দিতে পারে।’

টায়রা মাথা দুলালো। টিকলি কল লাগালো নিভার নাম্বারে। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে বলা হলো,

‘কিরে কি খবর?’

‘ভালো না।’

নিভা ভ্রু কুচকে বলল, ‘ভালো না মানে? কি হয়েছে?’

টিকলির থেকে টায়রা খপ করে ফোনটা নিয়ে বলল, ‘টিকলির বিয়ে ঠিক করেছে বাবা-মা। আর ছয়দিন পরেই বিয়ে।’

নিভা হতবাক হয়ে গেলো। বিবেক বুদ্ধি লোপ পেয়েছে এহেন ধারায় অসহযোগ গলায় বলল, ‘কি? মজা করতাছস? হঠাৎ বিয়ে? বিয়ে কেনো? তাও এতো তাড়াতাড়ি? পাত্র কে?’

টায়রা চুপ থেকে সময় নিয়ে বলল, ‘রাহুল ভাইয়া। এখন তাড়াতাড়ি বিয়ে ভাঙার প্ল্যান দে।’

বাইরে তখন ঝড়ো হাওয়া। বাতাসের উদ্বেগে হেলে পরছে গাছ। ঝড়ছে পাতা। উড়ছে ধূলিকণা। নিভার কানে বজ্রপাতের মতো ঠেকলো কথাটা। স্তব্ধ হাত ঢিল হয়ে কান থেকে ফোন পরে গেলো সাদা মেঝেতে। তড়িৎ অনুপ্রভায় জ্বলসে যাচ্ছে হৃদয়। দানবের ন্যায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে বুক। নিভা কথা হারিয়ে ফেলল। এহেন ঘটনার আচম্বিতে সে নির্বাক হয়ে শরীর ছেড়ে বিছানায় বসে পরলো। মনটা রক্তাক্ত হচ্ছে। উত্তাপ হচ্ছে। জ্বলন্ত বহ্নিশিখায় পুড়ছে। নিভার পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। উদ্যমী হয়ে এই কণ্টকিত পৃথিবীকে পুড়িয়ে ছাড় খার করে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে প্রকাশ করছে মস্তিষ্ক। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছে সে। রাগে দুঃখে কষ্টে সে কাদতে পারছে না। ভেতর থেকে নিঃশ্বাসের একটা ফুসফুস শব্দ বেরিয়ে আসছে।
নিভার পেছনে এসে দাড়ালো নিভার মা আমিনা বেগম। নিভা তখনও উদভ্রান্তের মতো বিছানা খামচে ধরে ছিলো। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলো। আমিনা বেগম ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,

‘কি হয়েছে মা?’

নিভার থেকে উত্তর ভেসে এলোনা। তিনি আর ঘাটালেন না। বললেন, ‘রেডি হ মা। তোর খালামনি ডেকে পাঠিয়েছে। কিসব জরুরি আলাপ আছে নাকি।’

নিভা চকিতেই মায়ের দিকে তাকালো। উন্মাদের মতো বলল, ‘আদর ভাইয়াদের বাসায়?’

‘হ্যাঁ।’

নিভা বিরবির করে বলল, ‘খালামনির বাসায় যাবো। খালামনির বাসায় আমার যেতে হবে। টিকলির সাথে উনার বিয়ে হতে পারে না। উনার সাথে টিকলি কেনো? কীভাবে সম্ভব?’

_______________________________

দিনের আলো আধারের গহব্বরে হারিয়ে যাওয়ার আগামবার্তা। সন্ধ্যে নামার অপেক্ষা। শেষ আকাশে রক্তিম লাল আভা। আনন্দে ব্যাকুল নিঃশ্বাসের সাথে উত্তালতার ভারী হাওয়া। ওই তো…দূরে দেখা যাচ্ছে সন্ধ্যাতাঁরা। রাহুল স্মিত হাসলো। ছাদের দরজায় শব্দ হলো। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নিভাকে দেখা গেলো। রাহুল অবাক হলো। অভিনবত্ব চোখে তাকিয়ে থেকে অবিশ্বাস্য গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনি?’

রাহুল চোখ কচলালো। আবার তাকিয়ে নিভাকেই আবিষ্কার করে হেসে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ! কালই তো গেলেন। কই বলে যাননি তো আজ আসবেন।’

নিভা কথা বলছে না। অনর্গল ঘেমে চলেছে। সে মুখ হাতরে ঘাম মুছলো। শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। কথা বলতে গিয়ে দেখা গেলো, তার কণ্ঠনালিও ব্যাপক মাত্রায় কাঁপছে। নিভা প্রচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে একটু হতাশা। কিছুটা দিশেহারা।সাথে অনেকটা অসহায়তা। নিভা এলোমেলো পায়ে রাহুলের দিকে এগিয়ে গেলো। সে টলছে যেনো এক্ষুণি পড়ে যাবে। রাহুলের কাছে গিয়ে নিভা টলমলে চোখে তাকালো। বলহীন শরীরে পড়ে যেতে নিলেই রাহুলের কলার খামচে ধরলো। রাহুল নিভাকে ধরে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,

‘কি হয়েছে আপনার? নিভা? শরীর খারাপ? কথা বলুন।’

নব্য প্রস্ফুটিত ফুলের ন্যায় নিভা আরক্ত নয়নের সহযোগে তাকালো। রাহুল ভ্রু কুচকে চাইলো। নিভা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ভাঙা গলায় দৈবাৎ বলে উঠলো,

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিয়ে করবেন না! দয়া করে বিয়েটা ভেঙে দিন।’

রাহুলের কানে বিণৎ অদ্ভুত লাগলো কথাটা। সে বজ্রাহত হলো। তাজ্জব বনে গেলো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার মনে হলো সে ভুল শুনেছে কথাটা কিংবা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানবী তার খুব ভালো বন্ধু নিভা নয়। এ অন্য কোনো অসুস্থ মানবী বা অশরীরী আত্মা যা রাহুলকে ভয় পাওয়া এবং চমকে দেওয়ার মতো অপরিসীম ক্ষমতা রাখে। রাহুল নিভার গালে হালকা থাপড়ে বলল,

‘গেট আপ। আপনি কি ঘুমিয়ে আছেন? কি বলছেন এসব নিভা?’

নিভা রাহুলের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে কেদে দিলো। প্রচন্ডভাবে কামোম্মত্ত হয়ে রাহুলের কলার আরো শক্ত করে চেপে ধরে উচ্চস্বরে বলল,

‘কেনো বুঝতে পারছেন না? আমি আপনাকে ভালোবাসি। বুঝার চেষ্টা করুন। কেনো বুঝতে চাইছেন না?’

রাহুলের বুকে মাথা ঠেকালো নিভা। ছন্নছাড়া কান্নায় মজে উঠলো। রাহুলের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। কলার থেকে নিভার হাত ছাড়িয়ে নিলো আক্রোশে। রোষ-আগুন চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,

‘আমি বিস্মিত! এটা আমি আপনার থেকে আশা করিনি। বন্ধু নামে এতো বড় সুযোগ নিলেন। সব জেনেশুনে আপনি….’

রাহুল আটকে গেলো। প্রচণ্ড রাগে কথা বলতে পারা যাচ্ছে না। চলে গেলো সে তীব্র উষ্মা রাগ দেখিয়ে। জোরে জোরে শব্দ তুলল তার পদধ্বনি। নিভা ভেজা নয়নে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ছাদে বসে পরলো। এখন তাকে দেখাচ্ছে যন্ত্রমানবের মতো। ভঙ্গ হৃদয়ে যেই নারী বসে আছে নিথর দেহে। নিষ্প্রাণ চোখ দুটো দিয়ে গড়াচ্ছে না পানি। মুখে ফুটছে না কোনো বুলি। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অজানা পথের বাঁকে। নৈরাশ্য তার দু’চোখ। স্ফূর্তি-শূন্য ভালোবাসার ঘড়া। হতোদ্যম এক বুক আশা। মর্মপীড়িত প্রেমিক মন।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here