#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ💖
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
০৬.
কেবিনের মুখে ঢুকতেই ভাইয়ের জুতো আর প্যান্টে নজর পরলো আর্দ্রর। আহত গলায় সে বলল, ‘ভাইয়া, শরীরে কাদা লাগলো কীভাবে? তোমার নতুন জুতো!’
তরজমাকারী গলায় আদর বলল,
‘তুই হাওয়াই মিঠাই আনতে গেলি আমি তখন ঘাটে দাঁড়িয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন দেখলাম একটা মেয়ে! কাধে ভেনিটি ব্যাগ। দু’হাতে আবার দুটো মাঝারি সাইজের ট্রলি ব্যাগ। মেয়েটা ব্যাগের ভার সইতে না পেরে কাদার মাঝে পরে যাচ্ছিলো প্রায়। আমি গিয়ে তড়িঘড়ি করে তাকে বাঁচালাম। পরে দেখি…
‘পরে দেখো?’ আর্দ্র ভ্রু কুচকালো।
হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আদর বলল, ‘পরে দেখি এই সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়ে।’
আর্দ্র কিছুক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে শব্দ করে হেসে দিলো। ‘পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সি’ এই কথাটা শুনলেই তার ভীষণ হাসি পায়। আর্দ্র জিজ্ঞেস করলো, ‘চিনলে কীভাবে? মানে তুমি তো আর মুখ দেখোনি মেয়েটার।’
আড়চোখে তাকিয়ে আদর উত্তর দিলো, ‘আজও মাস্ক পরা ছিলো। একদম কাছ থেকে দেখেছি বলেই চিনেছি।মেয়েটার ডাকিনী ভয়েস শুনে পুরোপুরি শিউর হয়েছি। মেয়েটাই আগে আমাকে চিনতে পেরেছে।’
আর্দ্র হাসলো কতক্ষন। আদর তার শখের নতুন কালো সু জোড়া খুলল। ট্রলি থেকে প্যান্ট আর শার্ট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,
‘হাওয়াই মিঠাইয়ের সামনে ওমন হা করে দাঁড়িয়ে ছিলি কেনো?’
আদরের প্রশ্নে আর্দ্র একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। শুকনো কাশি দিলো। আসলেই তো সে ওই চাপাবাজ মেয়েটার দিকে ওমন হা করে তাকিয়ে ছিলো কেনো? বলতেই হবে মেয়েটা মারাত্মক লেভেলের বেয়াদব। মানে চূড়ান্ত লেভেলের বেয়াদবের চেয়েও এক ধাপ উপরে। বিরক্ত গলায় আর্দ্র বলল,
‘আর বলো না, একটা মেয়ে ঝগড়া শুরু করেছিলো। গিয়েছি আমি আগে বলে কিনা মেয়েটা আগে গিয়েছে এবং হাওয়াই মিঠাই তাকেই আগে দিতে হবে। এ তার একমাত্র দাবী। আমিও কম না। আমি আগে গিয়েছি সে আগে কেনো নিবে? ব্যস, ঝগড়া লেগে গেলো। এক পর্যায়ে ঝগড়া করার মাঝে মেয়েটা তার মাস্ক খুলে ফেলল। মেয়েটাকে দেখেই আমি মিনিট খানিকের জন্য অতল সমুদ্রে ডুবে গেলাম। সেই ডুবন্ত আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না কারোর হদিস, শুনিছিলাম না কারোর বাচ্য। শুধু চোখের সামনে দেখছিলাম অপরূপ সেই নারী।’
আর্দ্র একবার বলা শুরু করলে বেশি বলে ফেলে। নিজের অজান্তেই কখন কি বলে তাও সে জানেনা। এই যেমন এখন, এই কথাগুলো কিন্তু সে একদমই বলতে চায়নি। একদমই না মানে একদমই না। কিন্তু ওই যে কথা শুরু করলে মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে তার। তাই বলে ফেলে। কথাগুলো বলে আর্দ্র গোপনে জিহবা কাটলো। আদর ভাইয়ের কাধ চাপড়ে বলল,
‘তোর এখন যেই রিলেশনটা আছে এটা যেনো কত নাম্বার?’
চোখ মুখ খিচে আর্দ্র জানান দিলো, ‘পনেরো নাম্বার।’
আদর অবাক হলো। মুখশ্রী হয়ে উঠলো আগুনের গোলার ন্যায় লাল। মুখের ভেতর তিক্ত অনুভূতি হলো। আবার? আবার সেই পনেরো? ইশশ..এই পনেরো কেনো ছাড়ছে না আদরের পিছু? বারবার ভুলতে চায় সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে। কিন্তু কোনো না কোনো উপায়ে সেই বোকা মেয়ের কথা তার মনে আসছেই। কি করবে আদর? কীভাবে সুরাহা হবে এই সমস্যা? আর্দ্রর মুখপানে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় আদর বলল,
‘আর তোর থেকে তিনবছর বড় হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত একটাও প্রেম না করা আমি। তারউপর প্রেম চলাকালীন তুই অন্য মেয়েকে এক দেখায় অতল সমুদ্রে ডুবে যাস!’
আদর ঢুকে পরলো ওয়াশরুমে। আর্দ্র পেছন থেকে জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলল,
‘ভাইয়া, তুমি যেমন ভাবছো তেমন না। ওই ঝগড়ুটে চাপাবাজ মেয়েকে আমি মোটেও পছন্দ করিনা। শুধু ক্ষনিকের জন্য কি যে হলো ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।’
শেষের কথাগুলো আর্দ্র আস্তে আস্তে কাদো কাদো গলায় বলল। এরপর নিজের সিদ্ধান্তে অটল এমন জেদী গলায় বলল, ‘ওই চাপাবাজ মেয়েকে তো আমি দেখে নিবো। ও সুযোগ বুঝে আমার আগে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে পালিয়েছে। বেয়াদব মহিলা একটা।’
____________________________
লঞ্চের বারান্দার মতো সাইডে রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে ছিলো আদর। আকাশে মস্ত বড় এক রূপালী চাঁদ। রূপোর আলোয় চারিদিকের অথৈ নির্জনতার পানিতে চিকচিক করে চাঁদের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। আদরের এই উনত্রিশ বছরের জীবনে কখনো প্রেম আসেনি। ভালোবাসা হয়নি। বাতাসে সে প্রেম প্রেম ভাব পায় কিন্তু গন্ধ পায়না। কিন্তু আজ এই লঞ্চের সাথে চলমান সন্ধ্যার বাতাসটা যেনো ভারী স্নিগ্ধ এবং মোলায়েম! বলতে নেই, আজ হঠাৎ এই প্রথম আদর বাতাসে প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছে। সত্যি কি পাচ্ছে? নাকি মনের ভুল?
,
টিকলি দাঁড়িয়ে ছিলো রেলিং ঘেঁষে একমনে আকাশটার দিকে তাকিয়ে। আবহাওয়া ভালো নয়। বাতাস বইছে খুব জোরে। ঢেউ উঠছে অনেক বড় বড়। লঞ্চ চলছে আস্তে আস্তে। এবং একটু পরপর একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক হেলছে প্রবল ঢেউয়ের কবলে পরে।
টিকলিকে এক দেখায় কেউ চিনে উঠতে পারবে না। মেয়েটার নিখুঁত সুন্দর মুখখানা মনে রাখতে কারোর বার কয়েক তার দিকে গভীর নয়নে তাকাতে হবে। তার উপর যদি মাস্ক পরা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। মাস্ক পরা টিকলি এবং শুধু টিকলির মাঝে তফাৎ আছে। সহজে কেউ ধরতে পারবে না মাস্ক পরা মেয়েটি টিকলি ছিলো। আদরের সাথে যে দুইদিন টিকলির দেখা হয়েছে দু’দিন ই তারা দুজন মাস্ক পরা ছিলো। মাস্ক পরা অবস্থায় টিকলি সবসময় মাথায় স্কাপ দেয়। চোখে লেন্স পরে। আর এমনিতে সে স্বাভাবিক এবং চশমা পরে থাকে। তবে কেউ যদি অতি সূক্ষ্ণ ভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে এক দেখায় তার হাটাচলা দেখে বুঝে ফেলতে পারবে।
বড় এক ঢেউয়ের কবলে পরে লঞ্চটা আবার একটু বাম সাইডের দিকে হেলে পরলো। ব্যালেন্স না রাখতে পেরে টিকলি আছড়ে পরলো কোনো মানুষের উপর। মানুষটা তড়িঘড়ি করে প্রায় অবচেতনায় ধরে ফেলল অসর্তক সেই মেয়েটিকে।
,
রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লঞ্চটা একটু হেলে পরলো। আদর অনেক কষ্টে ব্যালেন্স রাখতে পারলেও নিজের উপর হঠাৎ কোনো ভারী বস্তু পরে যাওয়ায় সে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি করে ধরলো সেই আগুন্তক নারীকে। মেয়েটা আস্তে করে তার মাথা উঠালো। লঞ্চের নীল-সাদা আলোয় মেয়েটার মুখ আলোড়িত ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আদর দেখলো, সদ্য ফুটে উঠা ভোরের শিশিরে ভেজা গোলাপের ন্যায় মেয়েটার শ্রীময়ী মুখখানা। চোখে তার কালো রঙের চশমা মানিয়ে গেছে ফর্সা গায়ের রঙে। টিকলো নাকটা যেনো খুব সুন্দর করে বানিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। নিখুঁত সুন্দর লাল ঠোঁট দুটোর ভাঁজে ভয়ের ছাপ। ফোলা গাল দুটো আলুর মতোন। যেনো আলাদা করে এই ছিপছিপে মুখটার গালের অংশে মাংস লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু মেয়েটার চোখ আবিষ্কার করা গেলো না। চশমার আড়ালে মেয়েটার সূক্ষ্ম ব্যাক্তিত্ববান আঁখি দুটো ঢেকে গেছে খুব সন্তর্পণে । কিন্তু এই কপাল! এই কপাল এবং কপালের দু পাশ থেকে শুরু হওয়া গোছানো একগাছি চুল গুলো যেনো তার চেনা। খুব চেনা! কিন্তু এই মুহুর্তে মস্তিষ্ক ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। আদর আরেকবার তাকালো। তখনি এক গভীর মনপ্রাণ বলে উঠলো স্রোতশূন্যে গা ভাসিয়ে,
“সে নয় তো কোনো সাধারণ নারী,
সে ছিলো যে এক ব্যক্তিত্ববান রানী।”
টিকলি আস্তে আস্তে মেঝেতে পা ফেলে সোজা হয়ে দাড়ালো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই শ্যামল ছেলেটার পানে সে চোখ তুলে তাকিয়ে ছিলো অনেক্ক্ষণ। কপালের উপর দু একটা চুল অযত্নের সহীত পরে আছে তার। ভ্রুর নিচে এক জোড়া বুদ্ধিদীপ্ত, তীক্ষ্ণ, সতর্কমূলক চোখ। এই চক্ষু যখন চাহিয়া মেলিলো টিকলিরো পানে, টিকলির প্রাণভোমরা তখন টপাস করিয়া লুটিয়া পরিলো প্রায় মৃত হইয়ে। তার উঁচু এক নাক। যেনো হেলিকপ্টার গেলে নাকের সাথে ঘর্ষণ লাগবে। পুরু এক জোড়া ঠোঁট। যেই ঠোঁটের ভাঁজে রয়েছে গোলাপের সুগন্ধি। চাপা গাল দুটোর ভাঁজে না বলার অভিমানী কথা সাঁজে। চেহারায় দাম্ভিকতা এবং গম্ভীরতার ছাপ। কিন্তু কেনো জানিনা টিকলির মনে হলো এই অপরূপ সুন্দর পুরুষটিকে সে কোথাও দেখেছে। কোথাও! এই চোখ, কপাল এবং কপালের সাথে মিশে থাকা চুলগুলো তার বড্ড চেনা। বলিষ্ঠ মসৃণ ছেলের বুক, চওড়া প্রশস্ত কাধ। টিকলি কপালে ভাঁজ ফেলে চেনার চেষ্টা করলো। কিন্তু নাহ..পারলো না। অতঃপর সে নিচু মোলায়েম গলায় বলল,
‘সরি।’
আদর একটু অবাক হলো। এই মেয়ের মিস্টি গলার স্বরটাও তার কিছুটা চেনা চেনা লাগছে। অনেকটা সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েটার মতো। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? কোথায় সেই মেয়ে আর কোথায় এই মিস্টি দেখতে মেয়েটা! আদর বলল খুবই নরম সুরে,
‘ইটস ওকে। নো প্রবলেম।’
টিকলি চকিতেই তাকালো। এই কণ্ঠধ্বনি তার চেনা! অনেকটা সেই অভদ্র ছেলের মতোন। আদর আবারো বলল ভদ্র সুরে,
‘আপনার লাগেনি তো কোথাও?’
টিকলির মনের ভাবটা কেটে গেলো। কর্পূরের মতো উবে গেলো অচীন কোনো রাজ্যে। নাহ, আর যাই হোক এই ছেলে সেই অভদ্র লোকটা হতে পারেনা। দুনিয়ায় তো একই রকম দেখতে মানুষ আছে। আর কিছুটা ভয়েস মিল মানুষ হতে পারে না? সেই ছেলে কেমন কর্কশ গলায় কথা বলে আর এই ছেলে কি মিস্টি সুরে কথা বলছে! ওই লোকের মধ্যে সবসময় কাঠিন্যতা, গাম্ভীর্য, অহংকার ভাব। সবসময় মানুষকে হেয় করে খোঁচা দিয়ে অপমান করে কথা বলা। আর এই লোকের কথার সুরের মাঝে স্নিগ্ধতা, মোলায়েম, আবেশ! আস্তে করে টিকলি উত্তর দিলো,
‘নাহ লাগেনি। আপনার?’
আদর এবার নিশ্চিত, এই মেয়ে কিছুতেই সেই বোকা, অভদ্র, মেনারলেস মেয়ে হতে পারেনা। সেই মেয়ের গলা দিয়ে তো যেনো আগুনের ফুলকি ঝরে। আর এই মেয়ের গলার সুরে কোমলতা। ভেজা গন্ধরাজের ন্যায় মসৃণ। যেনো এক সূর্যমুখী ফুল। আর ওই মেয়ে তো একটা গাঁদা ফুল। আদরের মনও যেনো ওই মেয়েটার কথা কর্কশভাবে ভাবে। আদর মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘নাহ।’
তখনি ওদের দুজনকে ডাকতে এলো আর্দ্র ও টায়রা। মুখোমুখি হতেই আর্দ্র ও টায়রা বিপন্ন-বিস্ময়ের গলায় তর্জনী আঙ্গুল উঁচিয়ে দুজন একসাথে বলে উঠলো,
‘আপনি?’
মাঝখান থেকে এতো সুন্দর পরিবেশটায় এমন কর্কশতার গলায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদর ও টিকলি।
চলবে❤️
গঠনমূলক মন্তব্যের অনুরোধ রইল 💖