#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-১৬
বর্ষণের সাথে কথা বলা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছি মাসখানেক। সে অনেকভাবে চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করার, কিন্তু আমি সাড়া দেইনি৷ তবে দূর থেকে চেষ্টা করে গেলেও সে একবারও এখানে এসে আমার মান ভাঙানোর চেষ্টা করেনি৷ কেন করল না? আমি উত্তর খুঁজি, আবার মনে হয় এই ভালো। বিশ্বাসঘাতকটার সাথে আমি এমনিতেও আর যোগাযোগ রাখতে চাই না।
নীনার ব্যাপারে বর্ষণের সাথে কোনো কথা হয়নি। আমার রুচি হয়নি বলার। আর হয়নি সাহস। কী করে বলব, তুমি কি এতদিন আমার বন্ধুর সাথে প্রেম করেছ? যে কথাগুলো আমাকে বলতে সেসব তাকেও বলেছ? আমি পারিনি প্রশ্নগুলো করতে।
নীনার সাথেও কথা বলার রুচি ছিল না৷ নীরা আপু জোর করে কথা বলিয়ে দিলেন একদিন। আমাকে বললেন, “ওই মেয়ে তো দোষ করেনি, না জেনে করেছে সব। তুই কেন ওকে অন্ধকারে রাখবি? তাছাড়া বর্ষণের সাথে ওর সম্পর্ক তোর বিয়ের পরে নয়, অনেক আগেই হয়েছে। তাই বলা যায় তোদের দু’জনের একসাথে সম্পর্ক ছিল ছেলেটার সাথে। সে তোকে বিয়ে করেছে, ওকে ধোঁকা দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে! তুই কেন দিতে দিবি? নীনা তোর বেস্ট ফ্রেন্ড না?”
“কিন্তু আমি পারছি না ওর সাথে কথা বলতে!”
“আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসি। আগে ওর দিক থেকে ঘটনা পুরোটা জানব, তারপর তোর কথা বলব। তোকে বলতে হবে না, আমি নিজেই বলব।”
নীনা এলো। ওর হাসিখুশি মুখটা আমার বিষের মতো মনে হতে লাগল। যদিও ওর কোনো দোষ নেই, তবুও! ও হয়তো রাত জেগে আমার স্বামীর সাথে প্রেমালাপ করে। না জেনে করে, তবু করে তো! এটা ভাবলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে।
আমাকে দেখে ও জিজ্ঞেস করল, “তুই দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছিস কেন ধারা? খাওয়াদাওয়া করিস না?”
আমি জবাব দিলাম না। নীরা আপু বলল, “তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করি নীনা? আমরা তো তোমার প্রেমিককে দেখেছি। কিভাবে পরিচয় হলো বলবে?”
নীনা খুব আগ্রহ নিয়ে বলে গেল। তার বর্ষণের সাথে পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে লেখা পড়ার সূত্রে। বর্ষণকে সে আগে থেকেই চিনত। বিভিন্ন গ্রুপে তার লেখা পড়ত। কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও বলেনি এত বড় ফেসবুক সেলিব্রিটি তার সাথে কথা বলবে কি না ভেবে। কিন্তু একদিন আমার সাথে মিউচুয়াল দেখে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিয়েছে সাহস করে। আমার সাথে অ্যাড থাকলে ওর সাথেও কথা বলা উচিত।
বর্ষণ রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। নীনা মাঝে মাঝে মেসেজ দিত, সেসবের উত্তর দিত বর্ষণ। প্রথমদিকে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু কিছুদিন পর হঠাৎ তার আগ্রহ বেড়ে যায় নীনার প্রতি। তাকে হালকা পাতলা ফ্লার্ট করতে শুরু করে। নীনাও যেহেতু দুর্বল ছিল, প্রেম হতে দেরি হয় না। সেই থেকে দু’জনার প্রেম চলছে।
নীরা আপু প্রশ্ন করলেন, “তোমার কি কখনো মনে হয়নি ছেলেটা খারাপ হতে পারে? তোমার সাথে সাথে অন্য মেয়েদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে পারে?”
নীনার মুখটা একটু অন্ধকার হলো। সে একটু চুপ থেকে বলল, “কখনো হয়নি তা না। তবে ও সত্যিই আমাকে ভালোবাসে। আর কারো কাছে যাবে না। লুবনা নামের এক মেয়ে বলে বেড়ায় সে নাকি ওর প্রেমিকা। এটা নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়েছে। কিন্তু পরে জানতে পেরেছি মেয়েটার প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হয়নি বলে এমন করে। লেখকদের যে কত ঝামেলা!”
আমার বুকটা ভেঙে যেতে শুরু করল। লুবনাকে নিয়ে প্রথমে আমাকেও একই কথা বলেছিল বর্ষণ। কী দারুণ অভিনেতা!
নীনা বলে চলেছে, “আরেকবার ঝামেলা হয়েছিল সুমি নামের কোন মেয়েকে নিয়ে। সে ওকে দুলাভাই বলে কমেন্ট করেছিল। তারপর কি আজেবাজে কথা! এসব আসলে হেটার্সটা করে বুঝলে! যাদের পাঠক কম তারা মেয়েগুলোকে টাকা দিয়ে এসব করতে বলে।”
আমার বুকে কাঁপুনি ধরে গেল। দুলাভাই বলা মেয়েটা আবার কে? সুমি বলে আমার তো কোনো কাজিন নেই! আমি অসহায় চোখে নীরা আপুর দিকে তাকালাম। আপু চোখের ইশারায় আমাকে শান্ত থাকতে বললেন।
নীনাকে বললেন, “তোমাকে একটা কথা বলার আছে নীনা।”
“বলুন আপু।”
“ধারার বিয়ে হয়েছে এই ঈদের পরদিন।”
নীনা ভীষণ চমকে গেল। ওর মুখে একইসাথে ফুটে উঠল আনন্দ আর অভিমান। “সত্যি ধারা? বিয়ে করে আমাকে বলিসনি?”
আমি শুকনো গলায় বললাম, “হ্যাঁ।”
নীরা আপু বললেন, “ধারা তোমার বিয়ের ছবিগুলো দেখাও নীনাকে। কিছু মনে করো না নীনা, ছবিগুলো তোমার ভালো লাগবে না। কিন্তু দেখতে হবে।”
“মানে?” বুঝতে পারল না নীনা কথাটা। হাত বাড়িয়ে আমার মোবাইল নিয়ে ছবিটা দেখেই চিৎকার করে উঠল। “কী এসব? এটা কি বর্ষণ? বর্ষণ আহমেদ? তোর হাজব্যান্ড ধারা? কী করে হয়? আমি কি ভুল দেখলাম? ধারা বল না…এটা কি আমার..” কথা আটকে গেল ওর। মেঝেতে বসে পড়ল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছবির দিকে।
নীনার কী হয়েছিল আর দেখতে পারিনি। ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে চলে গিয়েছিলাম। নীরা আপু রাতে খুঁজে বের করে ঘরে নিয়ে এসেছে। আমার জীবনে আরো এক পরত আঁধার নেমেছে।
মা বাবাকে কিছু বলিনি। কিছু যে হয়েছে সেটা তারা বুঝেছে, কিন্তু আমার কথা বলার ধরণে জিজ্ঞেস করতে পারেনি। আমি সব ঢেকে রেখেছি এখন পর্যন্ত। কেন, তা অবশ্য জানি না।
নীনা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সেদিনের পর। বমি আর জ্বরে কাহিল হয়ে পড়েছিল। ওর মা বাবা এসে নিয়ে গেছে হল থেকে। শেষ দেখা হয়নি আমাদের। হওয়া উচিতও ছিল না৷ আমরা বোধহয় পরোক্ষভাবে একে অপরের কষ্টের কারণ!
ফাইনাল পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। আমার কিছুই পড়তে ইচ্ছে করে না। প্রতিদিন বইপত্র নিয়ে বসি, ঘন্টার পর ঘন্টা বসেই থাকি, কোনো শব্দ মাথায় ঢোকে না। মাথায় হিজিবিজি চিন্তা ঠোকরাতে থাকে ঠিক কাঠঠোকরার মতো।
প্রথম পরীক্ষার দিন সকালে ঠিক করলাম এবার পরীক্ষায় বসব না। দিলেও ফেল, না দিলেও। কষ্ট করে দিতে যাব কেন?
সেদিনই ব্যাগ গুছিয়ে বাড়িতে রওনা দিলাম। ওদিকটা গুছিয়ে আসি, এদিকটা তারপর দেখা যাবে।
★
বাড়িতে পা দিয়েই অদ্ভুত শান্তির ছোঁয়া লাগল গায়ে। শুধু পাশের বাড়ি থেকে চোখ সরিয়ে রাখলাম জোর করে। ওই আঙিনা আমার নয়!
মা আমাকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, “কিরে! তোর না আজ পরীক্ষা ছিল? কোনো ঝামেলা হয়েছে ক্যাম্পাসে?”
আমি কাছে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। অনেক কেঁদেও বুকের ভেতর শক্ত হয়েছিল যেসব কান্না সেসব মায়ের বুকে উগড়ে দিলাম। মা ভীষণ অস্থির হয়ে প্রথমটায় নানা প্রশ্ন করছিলেন। পরে কী ভেবে চুপ হয়ে শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন।
অনেকটা সময় পর একটু থিতু হয়ে আমি উঠলাম। খুব কাহিল হয়ে পড়েছি কেঁদে কেঁদে। গোসল করে মায়ের হাতে ভরপেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷ মা আর প্রশ্ন করলেন না এর মাঝে।
অনেকদিন পর বাড়িতে এসে লম্বা ঘুম হলো। সন্ধ্যার পর উঠে মায়ের কাছে গিয়ে বসলাম৷ বাবা তখনো ফেরেনি। আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে বললাম, “তোমাকে একটা শক্ত কথা শুনতে হবে মা।”
“বল।”
“তোমরা আমাকে হুট করে বিয়ে দিয়ে দিলে তার আগে খোঁজখবর করেছিলে? আমি নাহয় ছেলেটার প্রতি দুর্বল ছিলাম, কিন্তু এভাবে দুম করে বিয়ে করে ফেলতে চাইনি। আরও কিছুদিন মিশে চরিত্রটা বুঝে তারপর কথা এগিয়ে নিতাম। কিন্তু তোমরা বিয়ে পরিয়ে দিলে!”
মায়ের মুখ শুকিয়ে গেল। বলল, “কী হয়েছে খুলে বল।”
“ও আমাকে চিট করেছে মা। তুমিই বলো, যে একসাথে একাধিক মেয়ের সাথে বিয়ের পরেও সম্পর্ক রাখে তার সাথে থাকা সম্ভব? আমাকে তুমি ওর সাথে মানিয়ে নিতে বলো না মা। আমি পারব না।”
মা পাথরের মতো বসে রইল। শূন্য দৃষ্টি। বেশ কিছুক্ষণ পর অস্ফুটে বলল, “বর্ষণ এমন? ওকে কত ভালো মনে হয়েছিল। আদব কায়দা, কথাবার্তা, ফ্যামিলি…কিন্তু…”
মায়ের ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। আমার গলা ধরে আসছে। বলতে ইচ্ছে হলো, “তোমরা ভুল করোনি৷ আমার অদৃষ্টে এমন লেখা ছিল বলে হয়েছে। আমি তোমাদের দোষ দিতে চাইনি, বলে ফেলেছি কথাটা।” কিন্তু বলতে পারলাম না। উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম। এখান থেকেও মায়ের ফোঁপানির শব্দ আসছে। মাকে কোনোদিন এভাবে কাঁদতে শুনিনি আমি। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম তাকে।
রাতে বাবাকে সবটা জানানোর পর বাবা একেবারে চুপ হয়ে গেলেন। রাতে কেউ কিছু খেতে পারলাম না। ঘুমও এলো না কারো চোখে।
খুব ভোরে বাবা আমার ঘরে এসে আমার মাথার কাছে বসলেন। বললাম, “বাবা!”
“বলো মা।”
“তুমি নিজেকে দোষী ভেবো না বাবা।”
“আমারই তো ভুল রে মা। বন্ধুর ওপর অগাধ ভরসা ছিল। যা বলেছে সেটাই বিশ্বাস করে নিয়েছি। বাইরে খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করিনি।”
“এখন খোঁজ নাও বাবা। আমি বর্ষণকে প্রমাণসহ ডিভোর্স দিতে চাই।”
“দেখছি আমি।”
★
আমার আসার খবর বর্ষণ কী করে পেল জানি না। দুপুরের দিকে এসে হাজির। আমি সামনে গেলাম না। দরজা আটকে বসে রইলাম। মা ওকে কিছু বলল না। ঘরের কাজকর্ম করে গেল নির্বিকারে। রাত পর্যন্ত বসে রইল বর্ষণ। আমার ঘরে বার কয়েক ধাক্কাধাক্কি করে কীসব বলার চেষ্টা করল। আমি দরজা খুললাম না। শেষে রাতে ফিরে গেল বাড়িতে।
পরদিন সকালে ওর বাড়ির সবাই এলো। মায়ের সাথে বর্ষা আন্টির কী কথা হলো শুনতে আগ্রহ হয়নি বলে সামনেও যাইনি। শুধু জানালা দিয়ে দেখেছি চোখমুখ লাল করে আমার শ্বাশুড়ি ফিরে যাচ্ছেন তার দুই মেয়েকে নিয়ে।
সেদিন রাতে মা আমার ঘরে এসে বললেন, “তোর বাবা অনেক কিছু জেনেছে খোঁজ করে।”
“কী জেনেছে মা?”
মা বেশ খানিকক্ষণ নিজের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে বললেন, “বর্ষণ আগে থেকেই বিবাহিত ছিল। ওর বিয়ে হয়েছিল ওর চাচাতো বোনের সাথে। বিয়ের পর প্রচন্ড ঝামেলা হয়েছিল দু’জনের মধ্যে। সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল পরিবারের সবার সাথে। এক পর্যায়ে তিক্ততায় টিকতে না পেরে বর্ষণরা তাদের থেকে আলাদা হয়ে যায়। এরপরেই বাড়ি করে এখানে আসে। এজন্যই বিয়েতে ওদের কোনো আত্মীয় আসেনি। যদিও তখন তারা বলেছিল আত্মীয়দের সাথে জমিজমা নিয়ে ঝামেলা চলছে বলে তারা আসছে না।”
আমি ধাক্কাটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম বলে বোধহয় একেবারে ভেঙে পড়লাম না। শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “ওদের কি ডিভোর্স হয়েছিল?”
মা ছোট্ট করে উত্তর দিল, “না।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু