#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-১৯
টুম্পাকে ফোন করতে একটু ইতস্তত বোধ করছিলাম। কী বলব ফোন করে? এদিকে রাশিক তাড়া দিচ্ছে৷ এত কিসের তার তাড়াহুড়ো কে জানে! বর্ষণকে আজ দেখলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে দেখলে কেমন যেন শূন্য শূন্য বোধ হয়। ফাঁকা লাগে সবকিছু। বর্ষণের ভেতরটাও কি বদলেছে একটু? আমার কথা বলতে ইচ্ছে হয় না ওর সাথে। আমাকে দেখে সেই এগিয়ে এলো। একটু হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ?”
আমি ভদ্রতা করে উত্তর দিলাম, “ভালো। তুমি?”
“এইতো।”
“তুমি কি অসুস্থ?”
বর্ষন নাক টেনে বলল, “জ্বর-ঠান্ডা এই-ই। তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে ধারা? অল্প একটুক্ষন কথা বলব। আমরা যতটুকু সময় একসাথে কাটিয়েছি তার পুরোটা মেকি নয় নিশ্চয়ই!”
“আবার নতুন কোনো চাল?”
সে হাসল। সেই আগের মতো গালে টোল পড়া স্নিগ্ধ মিষ্টি হাসি! আমি গললাম না, তবে মনটা তরল হলো খানিকটা।
“চাল নয়। বলতে হবে না কথা। আমি খারাপ লোক। তুমি ভালো থাকো। আসছি।”
সে চলে গেল। আমায় দিয়ে গেল অনেকটা মন খারাপ।
সেদিনই রাতে ফোন করলাম টুম্পাকে। এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলাম যেন ওর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে আমি ফোন করেছি আমাকে আগে সতর্ক করে দেবার জন্য।
টুম্পা মেয়েটা দুঃখী। প্রথমদিন নিজের চিন্তায় থাকায় ওর গলার নিষ্প্রাণ ভাবটা ধরতে পারিনি। আজ শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। টুম্পার বয়স আমার চেয়ে কম বলে আজ তুমি করেই বলছি। ওকে এটা সেটা বলতে শুরু করলাম আসল কথা বলার আগে।
জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার বাড়ির লোক কী বলে? বর্ষণের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে আবার বিয়ে করবে?”
“আরে ধুর! বিয়ে করব না আর। তাছাড়া বর্ষন আমাকে ছাড়বে না। কিছু একটা করে আটকেই রাখবে।”
“এত শিওর হচ্ছেন কেন?”
“আমাকে কষ্ট না দিলে ওর পেটের ভাত হজম হবে না গো।”
“কেন ওর তো আরও অনেক প্রেমিকা আছে।”
“তাতে কী? আমাকে ঠিকই প্রয়োজন হয়। আমার থেকে দূরে থাকে বলে সে কি রাগ তার! খুনখারাবি করতে জানলে আমার বাড়ির লোককে খতম করে দিত!” বলে হাসল টুম্পা।
“তোমাকে প্রয়োজন মানে?”
বোঝা গেল টুম্পা এসব কথা বলার কাউকে পায় না। গলা খাদে নামিয়ে বলল, “ওর সাথে দেখা করতে হয় লুকিয়ে৷ আমি চাই না, খুব জোরাজোরি করি রোজ। যখন আর সামলানো যায় না তখন দেখা করি।”
“কিভাবে?”
“ক্লাস বাদ দিয়ে। ও আসে। একসাথে সময় কাটাই, মাথা ঠান্ডা করে, তারপর চলে যায়।”
“তোমার বাড়ির লোক জানে না?”
“জানলে মেরে ফেলবে!”
“তুমি ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছ কেন?”
টুম্পা একটু চুপ থেকে বলল, “জানি না। না দিয়ে পারি না।”
“তুমি ওকে খুব ভালোবাসো তাই না?”
টুম্পা উত্তর দিল না।
“আর বর্ষণ তোমাকে ভালোবাসে?”
টুম্পা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “প্রতিনিয়ত কাছে রাখতে চাওয়া আর কাছে রেখে ক্ষতবিক্ষত করাকে যদি ভালোবাসা বলতে চান তো বাসে। বিধ্বংসী ভালোবাসা। এমন যেন কারো না হয়।”
“তুমি খুব চাও সে ভালো হয়ে যাক?”
“চাইব না? কিন্তু হবে না কোনোদিন। অনেক চেষ্টা করেছি।”
“আরেকবার চেষ্টা করো।”
“কিভাবে?”
“আমি একটা বুদ্ধি দিতে পারি। সুইসাইডের নাটক করো।”
টুম্পা হেসে বলল, “সেই ভয় দেখাতে দেখাতে পুরানো হয়ে গেছে।”
“না সিরিয়াসলি করবে। ভয় দেখাবে না।”
“সুইসাইড করব!”
“আরে না। নাটক করবে। বাড়ির লোককে ম্যানেজ করে এমন ব্যাবস্থা করবে যেন বর্ষণ সত্যি ভাবে তুমি মরে গেছ।”
“আমি মরে গেলে সে ঠিক হবে? ধুর!”
“আমি তোমাকে বলি কী কী করবে, তারপর নাহয় ভেবো।”
“আচ্ছা।”
আমি টুম্পাকে রাশিকের প্ল্যানটা বললাম। টুম্পা একটু ভেবে বলল, “করা যায়, কিন্তু কাজ হওয়ার সম্ভাবনা কম।”
“করেই দেখো না!”
টুম্পা মেয়েটা যে বেশ কাজের সেটা বোঝা গেল দু’দিন পর রাতে। খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে সে রাতে। হঠাৎ টুম্পার মেসেজ এলো। সে একগাদা হাসির ইমো পাঠিয়ে লিখেছে, “আপু, ঔষধ লেগেছে ভালোই।”
“কী কী হয়েছে বলো।”
“আপনার কথামতো ওকে একটা লম্বা চিঠি পাঠিয়ে অফ হয়ে গেছি। ফোনটোন সব বন্ধ। আজ বাবাকে অনেক বুঝিয়ে বর্ষণদের বাড়িতে খবর পাঠিয়েছি যে আমি মরে গেছি বিষ খেয়ে। কবর দেয়া হয়ে গেছে। ও তো পাগলের মতো ছুটে এসেছে এখানে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিজছে। অনেকবার ঢুকতে চেয়েছে, ঢুকতে দেয়া হয়নি।”
“ঢুকতে চাইছে কেন? সন্দেহ করেছে কিছু?”
“না। বাবা বলেছে আমার কবর দেয়া হয়েছে বাড়ির পেছনে। সেটা দেখতে চায়।”
“আমার কেমন লাগছে টুম্পা!”
“আপনারই তো বুদ্ধি। বুক ধড়ফড় করছে আমার। গা শিরশির করছে। থ্রিলার সিনেমা দেখছি মনে হচ্ছে। আমি বসে আছি ঘর অন্ধকার করে। জানালার ফুটো দিয়ে দেখা যায় ওকে। সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে আমার জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।”
“যেদিন দেখা হয়েছিল ওর সাথে সেদিন খুব ঠান্ডা জ্বর ছিল দেখেছিলাম।”
টুম্পা বেশ কিছুক্ষণ পর জবাব দিল, “আপু! আগে বলেননি কেন? জ্বর এলে এতক্ষণ ভিজে নিউমোনিয়া বাঁধিয়ে ফেলে যদি?”
“আমার মনে পড়ল মাত্র।”
“আমি ভালো করে দেখেছি। মনে হচ্ছে কাঁপছে। এখন কী করব আপু?”
বুঝলাম ঘাবড়ে গেছে খুব।
আমি ফোন করলাম টুম্পাকে। বললাম, “এখন দেখা দিয়ে প্ল্যান নষ্ট করো না। তোমাকে ভূত সেজে ভয় দেখাতে হবে…”
টুম্পা শুনল না। কল কেটে গেল। এরপর অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও পেলাম না তাকে।
অনেক রাতে টুম্পার ফোন থেকে ছোট্ট একটা মেসেজ এলো, “ও আমাদের ড্রইংরুমে বসে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। এত অনুতপ্ত হতে কখনো দেখিনি।”
★
বর্ষণের সাথে এরপর আমার দেখা হয় মাসখানেক পর। সে হেসে বলল, “আজ কথা না বলতে চাইলেও বলতে হবে ধারা। তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলে মনে আছে? বন্ধুত্বটা কিন্তু আমি মন থেকে করেছিলাম।”
“কী বলবে?”
“চলো বসি। সেই পার্কে যাবে?”
“চলো যাই।”
পার্কে গিয়ে জারুল গাছটার নিচেই বসলাম।
বর্ষণ বলল, “আমার দিক থেকে তোমাকে কিছু বিষয় ক্লিয়ার করে বলি। আসলে সবাই যা দেখে বা ভাবে সবসময় সেটা নাও হতে পারে। আমি একসময় অনেক মিথ্যে বলেছি, যার কারনে আমার সম্পর্কে সবার কাছ থেকে আলাদা রকমের ভুলভাল কথা শুনবে। যাহোক, মিথ্যে বলা আমি কিন্তু ছেড়ে দিয়েছি। গত এক মাসে একটাও মিথ্যে বলিনি।”
“সেরকম হলে তো ভালোই।”
“ক্রেডিট তোমার ধারা। সেজন্যই তোমার কাছে কনফেস করতে এসেছি সব। অন্যায় তো কম করিনি তোমার সাথে। ডিভোর্সি নামের ট্যাগটা তোমার নামে শুধুমাত্র আমার শয়তানির কারনে লেগেছে। না করেছ সংসার, না পেয়েছ ভালোবাসা।
এখন আর সেসব বলে তো লাভ নেই, কিছু কথা বলি যেগুলো বললে হয়তো তোমার একটু স্বস্তি হবে।
আমার ভেতরের মানুষটা আসলে খারাপ না। খারাপ লোকেরা লিখতে পারে না, ভালোর মতো ভাবতে পারে না। আমার ভালো বোধগুলো হারিয়ে গিয়েছিল নোংরামির আড়ালে।
তুমি কখনো কোনোকিছুর নেশায় পড়েছ?”
আচমকা প্রশ্নটা ধরতে পারলাম না। “নেশা মানে?”
“এই ধরো চা-কফি, পান, সিগারেট এধরনের কিছু?”
“হ্যাঁ চায়ের নেশা তো আছে।”
“নেশা জিনিসটা ভয়াবহ! আমার ছিল মেয়েদের সাথে কথা বলার নেশা আর মিথ্যে বলার নেশা। এই নেশা অন্যসব নেশার মতোই তীব্র। ভীষণ তীব্র। আমি প্রচন্ড ভালোবাসি টুম্পাকে। কিন্তু এই নেশার টানে সেই ভালোবাসাকেও আমি দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছি। টুম্পা কষ্ট পাবে জেনেও মেয়েদের সাথে কথা বলা বন্ধ করতে পারিনি। আর মিথ্যে বলা থামাতে আরও পারিনি। একটা মেয়ের সাথে কথা বললে ওকে বলতাম তিনজনের সাথে কথা বলছি। আমি অনেক চেয়েও নিজেকে আটকাতে পারিনি ধারা। টুম্পার জন্য মন পাগল পাগল করলেও ওর সাথে বেশিদিন থাকতে পারিনি খারাপ স্বাভবগুলোর কারনে। একসময় ওকে ছাড়তে হলো, কিন্তু এসব ছাড়তে পারলাম না।
তোমার সাথেও যা করেছি এই নেশা থেকে করেছি। আমার সুস্থ বোধ অনেকবার বলেছে এমন না করতে। কিন্তু আমি পারিনি। তোমার বান্ধবী নীনা, কী ভালো একটা মেয়ে! সহজ সরলও। ওর সাথে মিথ্যে প্রেমে বিবেকের দংশন খুব হতো, সেই সাথে মিথ্যে বলার আনন্দ হতো শতগুণ।
তুমি ভাবতে পারো? জীবনের বড় একটা সময় মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে কেটে গেল?
সেদিন টুম্পার মরার খবর শুনে এত ভয় পেয়েছিলাম, যত ভয় জীবনে পাইনি। মনে হচ্ছিল পাপের ঘড়া ভর্তি হয়ে গেছে, শেষ বিচারের দিন চলে এসেছে। সব শাস্তি আজ হয়ে যাবে।
সেদিনের কান্নাগুলো আমার সত্যিকার কান্না ছিল। চাচা চাচীরা এখনো মানতে রাজি না, কিন্তু টুম্পা জোর করেই আমার সাথে চলে এসেছে। আমার মোবাইলটা সেদিন ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ঠিক করিনি আর।
একটা সুস্থ জীবন কাটাচ্ছি এই এক মাস ধরে।”
“কী বলছ তুমি এসব বর্ষণ? টুম্পা যে বলেছিল তোমার বাবা মায়ের ঝামেলা, তোমাদের তিন বন্ধুর সংগঠন সেসব?”
“মিথ্যে। বললাম না, টুম্পাকে অনবরত মিথ্যে বলে গেছি! তোমার কি একবারও আমার পরিবার দেখে মনে হয়েছে সেখানে কোনো অশান্তি থাকতে পারে? পুরো দোষ শুধুমাত্র আমার ছিল। আমি আমার মা বাবাকেও ভিলেন বানিয়েছি। সবাইকে সবার সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছি। আর বন্ধুদের নিয়ে আমার কোনো সংগঠন নেই।”
“হে খোদা!”
“তোমাকে সব না বলে ভালো লাগছিল না। তাই জোর করে নিয়ে এলাম। কিছু মনে করো না ধারা।”
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। বর্ষণ উঠে চলে গেল। ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল। কী সত্য, কী মিথ্যা জানি না, শুধু জানি এখান থেকে পালাতে হবে। এই ঘোরপ্যাঁচ আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে!
★
রাশিক আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বলছে কথাটা। আর বলছে রাজশাহী গিয়ে ঘুরে আসতে। বিয়ের আগেই সে তার পরিবারে সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। যেহেতু একবার ধোঁকা খেয়েছি, তাই সে চায় না না জেনেশুনে আমি সম্পর্ক এগিয়ে নেই।
যদিও আমার একদম ইচ্ছে ছিল না, তবু বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে একটু হাপ ছাড়ার ইচ্ছে হলো। তাই রাশিককে মেসেজটা পাঠিয়ে দিলাম, “আসছি আমি। আগামীকাল রওনা দেব।”
রাশিক উত্তর দিল, “শিওর?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার মা বাবা দেবে?”
“জানি না। না দিলেও যাব।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু