#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-২
কয়েকদিনের গরমের অবসান ঘটিয়ে ভোরবেলাতে বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। বছরের প্রথম বৃষ্টি। আমি ঘুম ফেলে উঠে এলাম জানালার কাছে। কপাট খুলে দিতেই বৃষ্টির ঝাপটা এসে পড়ল গায়ে। ঠান্ডা পানির কণাগুলো এসে গায়ে লাগতেই জুড়িয়ে গেল শরীর মন। আমাদের বাড়িতে অনেক গাছ। বৃষ্টির তোড়ে সেসব গাছ নুয়ে নুয়ে পড়ছে। মাটির সতেজ ঘ্রাণ বের হয়েছে। কী অপূর্ব!
পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে এলে আবার শুয়ে পড়েছি কাথা গায়ে দিয়ে। উঠতে বেশ দেরি হয়েছে। তখনো বৃষ্টি পড়ছে। আজ বুঝি সারাদিনই বারিধারা চলবে।
সকালের মেন্যুতে খিচুড়ি, ডিমভাজা, আর কয়েক পদের ভর্তা ছিল। পেটভরে খেয়ে এক কাপ ধুমায়িত কফি নিয়ে বসলাম জানালার কাছে। আজ বোধহয় আমাকে টেনেও ওঠানো যাবে না। নীলচে কালো মেঘ চিরে বিদ্যুতের চমক বারে বারে প্রকৃতিকে ঝলসে দিয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণচূড়ার নরম ফুলগুলো ঝরে লাল হয়ে আছে পুরো উঠোন। কিছুদিন পর কদম গাছটা ছেয়ে যাবে সোনালি ফুলে। এখন সে হালকা সবুজ পাতা উজ্জ্বল হয়ে আছে।
কতক্ষণ বসে আছি জানি না, ঘোর ভাঙল মেয়েদুটোকে দেখে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আজও এসেছে কৃষ্ণচূড়া কুড়োতে। তবে এরা আজ একা নয়, এদের সাথে গতকাল খেলছিল যে ছেলেটা, সেও এসেছে। তাজা ফুলগুলো কুড়িয়ে দিচ্ছে দু’জনের হাতে। কী মজা করে ভিজছে ওরা! খুব ইচ্ছে হলো বৃষ্টিতে ভেজার। গলা শুকানোর মতো অনুভূতি! আমি আর এবার রিস্ক নিয়ে তাদের ডাকলাম না। বাচ্চাদুটোর মতো এই বড়জনও যদি দৌড় লাগায় তাহলে কেমন হবে!
বৃষ্টি থেমে গেল দুপুরের পর। দুপুরে ঘুম দেব ভাবছিলাম, কিন্তু রাশিকের মেসেজ আসছে। ঘুম আর আসার সুযোগ পেল না।
আমি তাকে আমার বৃষ্টি প্রীতির কথা জানিয়েছি। সে কেমন যেন কাটখোট্টা, নাহ ঠিক কাঠখোট্টা নয়, একটু বেশি বাস্তববাদী। বিভূতিভূষণের আরণ্যক তাকে পড়তে বলেছিলাম, পড়ে বলেছে এই অতি বৃক্ষপ্রেমের অনুভূতি তার মাথায় বা মনে এক ইঞ্চিও ঢোকেনি!
অথচ রাজনীতি, অর্থনীতির মোটা মোটা বই অনায়েসে সপ্তাহে দুটো তিনটে পড়ে ফেলে!
আজ বলল, “বৃষ্টি মানে আমার কাছে যন্ত্রণা বুঝলেন? অফিসে আসার সময় জামাকাপড় ভিজে গেছে। সেই কাপড় শুকিয়েছে এসির বাতাসে। এরমধ্যেই গলা বসে গেছে। ফোনে আমার গলা শুনলে মনে হবে নাঁকি সুরে ব্রহ্মদত্যি কথা বলছে।”
এই লোক মাঝেমাঝে এত হাসাতে পারে! মেসেজটা দেখে হেসে ফেললাম। লিখলাম, “একটু শোনাবেন?”
“আগে কতদিন ফোনে কথা বলার কথা বলেছি, আপনি রাজিই হলেন না। আর আজ কথা বলবেন! আর পারা গেল না। এজন্যই বলে মেয়েরা কী চায় নিজেরাও জানে না।”
আমি আর ওই প্রসঙ্গে গেলাম না। সোশ্যাল মিডিয়াতে চেনা কারো সাথে ফোনে কথা বলতে কেন যেন খুব অস্বস্তি হয়।
প্রসঙ্গ ঘোরাতে বললাম, “এখন কী পড়ছেন?”
“বাংলাদেশের পুরাকীর্তি নিয়ে পড়ছি৷ পড়তে গিয়ে বুঝতে পারছি এ বিষয়ে বলতে গেলে কিছুই জানি না।”
“ভালো তো!”
“আপনিও কিছু পড়ে ফেলুন। আলোচনা করা যাবে।”
“দেখা যাক!”
‘আচ্ছা বাই।”
“বাই!”
ঘুম উড়ে গেছে। এখন কী করি? একবার লাইব্রেরিতে যাওয়া যায়। অনেকদিন যাই না। পুরাকীর্তির কোনো বই পেলে নিয়ে আসা যাবে।
আমাদের শহরটা উঁচু বলে বৃষ্টির পানি জমে থাকে না৷ বৃষ্টির দিন বিকেলে যখন দিনের আলো মরে আসে, আশেপাশের দোকানগুলোতে জ্বালানো হয় রঙ বেরঙের বাতি, পিচঢালা ভেজা পথ চকচক করে সেই আলোয়, তখন হাঁটতে কী দারুণ লাগে!
মায়ের বকবকানি সত্ত্বেও ছাতা ছাড়া বেরিয়ে গেলাম। হিমেল হাওয়া খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম লাইব্রেরিতে। এটা আমার অতি পরিচিত জায়গা। সেই ছোট্টবেলা থেকে লাইব্রেরির ঘ্রাণ নিয়ে বড় হয়েছি। কতশত বই! কতশত স্মৃতি!
লাইব্রেরিয়ান মিনি আপা আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন, “কতদিন পর এলে তুমি!”
আমি হাসলাম। সত্যি কতদিন পর এসেছি!
“কেমন আছেন মিনি আপা?”
“আছি ভালোই। তোমার খবর বলো।”
“আমিও ভালো আছি।”
“বই নেবে?”
“হ্যাঁ। কিছুদিন বাড়িতে আছি। পুরাকীর্তি নিয়ে বই আছে কোনো?”
“আছে তো! কত বড় হয়ে গেছো মেয়ে। বড়দের বই পড়ো। আগে তো লুকিয়ে প্রেমের বই নিয়ে পড়তে।”
হেসে ফেললাম দুজনে।
হঠাৎ দেখি সেই পাশের বাসার ছেলেটি এসেছে। বইয়ের তাকের ফাঁকে বই খুঁজছে। আমি যখন বইটা নিয়ে মিনি আপার ডেস্কের সামনে এলাম তখন সে তার তিনটে বইয়ের এন্ট্রি করাচ্ছে। ইশারায় মিনি আপাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনটা বই কেন? লাইব্রেরির নিয়ম একটা বইয়ের বেশি নেয়া যাবে না৷ মিনি আপাও আমাকে ইশারায় তিনটা লাইব্রেরি কার্ড দেখালেন। বইগুলো তখন খেয়াল হলো। দুটোই বাচ্চাদের বই। তার মানে ওই মেয়েদুটোর। আর একটা নিজের।
বাইরে যখন বের হলাম তখন আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মা নিশ্চয়ই আমাকে বকছে এতক্ষণে, কেন ছাতা নিয়ে বের হলাম না। ভিজতে অসুবিধা হতো না, কিন্তু বইটার কী করি? বৃষ্টির তোড় এত বেশি যে একটা রিকশাও নেই পথেঘাটে।
সেও পাশে দাঁডিয়েছিল। নিজেই পরিচিত হতে এলো, “আমি বর্ষণ। আপনাদের পাশের বাড়িতে নতুন এসেছি।”
আমি একটু অবাক হলাম৷ আমায় দেখল কখন? বললাম, “আমি ধারা। আপনাকে দেখেছি সকালে। ভিজে ভিজে ফুল কুড়োতে এসেছিলেন।”
বর্ষণ হেসে ফেলল। একটা রিকশা তখন কাছে চলে এসেছে। সন্ধ্যার আঁধার ঘনায়মান। বর্ষণ বলল, “আমাদের বাড়ি তো পাশাপাশি, চাইলে আমাকে সাথে নিতে পারেন। আর না যেতে চাইলে আপনি চলে যান, আমি পরের রিকশায় আসছি।”
কেন যেন বলে ফেললাম, “না না, চলুন একসাথে যাই।”
এখনকার অটোরিকশাগুলোতে অনেকখানি জায়গা থেকে। গা ঘেঁঢাঘেঁষি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দু’জন বসেছিও দুই প্রান্তে। তবু একটু অস্বস্তি হচ্ছে। ছেলেটা তো প্রায় অপরিচিত। তার ওপর এমন আবহাওয়া! আমার অবাক লাগে, বাসে পুরো অপরিচিত মানুষদের পাশে বসে বহুদূর পর্যন্ত জার্নি করতেও অস্বস্তি লাগে না, রিকশায় কেন? উত্তর পেয়ে গেলাম সাথে সাথেই। বাস একটা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, যেখানে রিকশায় শুধু দু’জন এতটুকু জায়গায় বসে যেতে হয়৷
সে আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল, “আমার বোনদুটো পাগল। আগে নাকি আপনাকে দেখে দু’বার পালিয়েছে। তৃতীয়বার তাই আমাকে নিয়ে গেছে।”
“কিন্তু পালাল কেন? আমি সুন্দর করে ডেকেছিলাম।”
“আমরা আগে যে বাড়িতে থাকলাম তার পাশের বাসার বুড়োর বড় বাগান ছিল। দুই বোনেরই ফুলের খুব শখ। দুটিতে যখনই যেত তাড়া খেয়ে ফিরত। তাই ভেবেছে আপনিও এমনই করবেন।”
“ওহ তাই বলুন! ওরা যে আপনার বোন সেটা বুঝিনি। অনেক ছোটো।”
“মা বাবার খুব শখ ছিল মেয়ের। শেষ বয়সের বাচ্চা। একসাথে ডাবল মেয়ে পেয়েছে। কিন্তু শখ মিটেও গেছে। দুটিতে এত পাজি!”
“একটু দুষ্টুই হয় এখনকার বাচ্চা।”
“তা বটে! আপনি কোথায় পড়েন?”
“যশোর ইউনিভার্সিটিতে। আপনি?”
“পড়াশুনা শেষ।”
“খুব ভালো! আমার শেষই হচ্ছে না।”
“হা হা! শেষ না হওয়াই ভালো। আমি দেখুন না শেষ করে বেকার বসে আছি।”
“চাকরি করার ইচ্ছে?”
“নাহ। ভাবছি একটা কম্পিউটার ফার্ম খুলব।”
“শুরু করে দিন।”
“পুঁজি নাই। একটু দাঁড়িয়ে নেই।”
“কিভাবে?”
“এটা ওটা করে কিছু টাকা জমাচ্ছি।”
“বেশ ভালো।”
“হুম।”
চলে এসেছি। বর্ষণের বাড়ি আগে, তাই সে নেমে গেল। যাওয়ার আগে ভাড়াটাও দিয়ে গেল আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু