বৃষ্টি তোমাকে দিলাম পর্ব-২১

0
770

#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-২১

ঘুম ভাঙল একটা মিষ্টি সুরে। একটানা কোনো পাখি সুরেলা গলায় গাইছে। শোওয়া থেকে উঠে বসল ধারা। তার পরনে নীল রঙের একটা জামা। এই জামা সে কখন পরল? চারদিকে তাকাল সে। কাঠের ঘর, কাঠের মেঝে। সে যে ঘরটায় শুয়ে আছে সেটা দোতলার ওপরে। বড় বড় দুটো জানালা আছে ঘরে। জানালার বাইরে সবুজ গাছাপলার সারি দেখা যাচ্ছে। দরজাও আছে তিনটা- একটা বারান্দায় যাওয়ার, একটা বাথরুমের, অন্যটা বাইরের যেটা বন্ধ। বৃষ্টি হয়েছিল বোধহয়, বাতাসে স্নিগ্ধ ঘ্রাণ।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ধারা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দরজার দিকে। গ্রীল নেই বারান্দায়। প্রকৃতি তাই আরও বেশি কাছে মনে হচ্ছে। যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। এ কোথায় এসে পড়েছে সে? কেমন করে এলো? কিছু মনে পড়ছে না কেন?

একটা পুরুষকণ্ঠের ডাক শোনা গেল। চমকে তাকাল সে।

এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার দরজা ধরে৷ তামাটে গায়ের রঙ, দোহারা গড়ন, লম্বাটে মুখ, হালকা দাড়িগোঁফ আর ভীষণ সুন্দর একজোড়া চোখ। মুখে হাসছে না, হাসছে চোখ দিয়ে। চেনা লাগছে, কিন্তু চিনতে পারছে না ধারা। সে কী বলবে বুঝতে পারল না। ছেলেটাই এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন?”

ধারা দু’পাশে মাথা নাড়ল।

“ওহ!” হতাশ হলো ছেলেটা। পরক্ষনেই হতাশা ঝেড়ে ফেলে বলল, “আমি শাহেদ। শাহেদ কাপুর নই কিন্তু!” বলে হাসল। আবার বলতে শুরু করল, “আমার অন্য পরিচয় আপাতত না জানলেও চলবে। আস্তেধীরে জানতে পারবেন। বর্তমানে আমি আপনার দেখাশুনার দায়িত্বে আছি। এখন কেমন আছেন বলুন।”

ধারা কিছুই বুঝতে পারল না৷ বলল, “দেখাশুনার দায়িত্বে মানে কী? আমি এখন কোথায়? আর আপনি কেন আমার দেখাশুনা করবেন?”

শাহেদ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আপনাকে কী বলেছি? এখন কিছু জানতে হবে না। সব বলব আপনাকে। আপনার ভালোই হবে তাতে। শুধু এতটুকু বলুন যে শরীর কেমন লাগছে?”

“ভালো।”

“মাথায় কোনো যন্ত্রণা আছে?”

“না।”

“ভেরী গুড! আমি আকলিমা আপাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছি আর আকলিমা আপা আছেন আপনার সেবাযত্ন করতে। যা দরকার লাগে তাকে বলবেন।”

লোকটা বেরিয়ে যেতেই আকলিমা আপার দেখা পাওয়া গেল। মাঝবয়েসী পরিপাটি এক মহিলা। আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু লাগবে আপা?”

ধারা ক্ষীণ সুরে বলল, “না।”

“ক্ষুধা লেগেছে না?”

“হুম।”

“কী খাবেন বলুন।”

ধারা এত সহজ ব্যবহারেও স্বাভাবিক হতে পারছে না। বলল, “আচ্ছা আপনি কি জানেন আমাকে এখানে কে এনেছে?”

আকলিমা আপা হেসে বললেন, “শাহেদ ভাইয়া৷”

“কোথা থেকে?”

“তা তো আমি জানি না। আপনি বললেন না কী খাবেন?”

“যা আছে তাই খাব।”

ধারা ভেবেছিল তাকে হয়তো নিচে খেতে ডাকবে, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। খাবারের বিশাল ট্রে নিয়ে একটু পরেই আকলিমা আপা ঢুকল।

ঘরের একটা টি টেবিলে রাখল খাবারদাবার। অনেক কিছুই এনেছে৷ একটা বড় কাচের বাটিতে সুন্দর করে কাটা নানা রকম ফল, পাউরুটি, জ্যাম, টোস্ট, দুধ আর ডিম।

ধারার সত্যি খুব খিদে পেয়েছিল। অনেক কিছুই খেয়ে ফেলল। খাওয়ার পরপর তার ঘুম পেতে শুরু করল। কিন্তু এখন ঘুম পাচ্ছে কেন? একটু আগেই তো ঘুম ভেঙেছিল। আকলিমা আপা ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ঘুম পেলে শুয়ে পড়বেন চলুন। আমার হাত ধরে উঠুন।”

ধারা অসহ্য ঘুমে চিন্তা করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। আকলিমা আপার হাত ধরে বিছানায় যাওয়ার ছোট্ট জায়গাটা পার হতে মনে হচ্ছিল যুগ লেগে যাচ্ছে। ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক তবু একটা প্রশ্ন করছিল, “কী হচ্ছে তার সাথে?”

ডায়েরিটা বন্ধ করতে করতে জহুরুল হক বললেন, “আর ইউ শিওর?”

সামনে বসা সুদর্শন তরুণটি বলল, “হ্যাঁ শিওর। আমি সব অ্যানালাইসিস করেই বলছি।”

“এই যে ছেলেটা..রাশিক…ওর কোনো খবর পেলে?”

“হ্যাঁ। তার পরিচয় নিয়ে তেমন কিছুই ডায়েরিতে লেখা ছিল না৷ তাই খুঁজতে একটু ঝামেলা হয়েছে। তবে বের করতে পেরেছি। সে রাজশাহীতেই থাকে। এখানে একবার আসতে বলেছি।”

“ওর সাথে দেখা হলে কোনো উপকার হবে বলে মনে হয়?”

“হতেও পারে। অনেক কিছুই হতে পারে আসলে। হয়তো ছেলেটাকে দেখলে ধারা সামলে উঠবে। সুস্থ হয়েও উঠতে পারে।”

“ছেলেটা কি এখনো ওকে…”

“আরে নাহ। সে বিয়ে করে সংসার করছে। এতদিন বসে থাকবে নাকি?”

“তাহলে তো আরও শক পাওয়ার কথা মেয়েটার।”

“সেটাই তো দিতে চাচ্ছি। এভাবে আর কতদিন?”

“শাহেদ, যা করবে ভেবেচিন্তে করো। খুব জটিল কেস এটা।”

“হ্যাঁ। আমি ভেবেই করছি স্যার।”

“ঠিক আছে। আশা করি সফল হবে।”

“ইনশাআল্লাহ।”

ধারার ঘুম ভাঙল বিকেলে। যথারীতি পাখির কিচিরমিচির শব্দে। তলপেটে প্রচন্ড চাপ নিয়ে সে বাথরুমে ঢুকল। মাথাও ঝিমঝিম করছে। শাওয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল সে। অনেকক্ষণ ঠান্ডা পানির ধারা বয়ে গেল তার শরীরে। শরীর ভালো লাগতে শুরু করল।

বাথরুমটা বেশ সুন্দর। গোসল করার জায়গা আলাদা, একপাশে একটা দরজা দিয়ে যাওয়া যায় ছোট্ট ড্রেসিং রুমে। সেখানে কাবার্ডে জামাকাপড় ঝোলানো। একটা হালকা সবুজ রঙের শাড়ি ভারি পছন্দ হয়ে গেল ধারার। ব্লাউজ একদম মাপমতো। শাড়িটা পরে ফেলল সে। একপাশে আয়নার সামনে কাজলদানি থেকে কাজল লাগালো চোখে। আয়নায় নিজেকে দেখল বেশ কিছুক্ষণ। একটু যেন বদলে গেছে আদল। সে কোথায় আছে, কাদের মধ্যে আছে কিছুই জানে না। অথচ সেজন্য সে অস্থিরতা বোধ করছে না। মনে হচ্ছে এসব স্বাভাবিক। এটাই তো হওয়ার কথা।

খিদেয় পেট চো চো করছে। কিন্তু আকলিমা আপাকে দেখা যাচ্ছে না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল ধারা। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে রইল প্রকৃতির দিকে। কী একটা মনে আসতে আসতে আসছে না৷ হঠাৎ খেয়াল হলো ওর সাথে আরও কেউ আছে এখানেই। মানুষটা আর কেউ নয়, শাহেদ।

শাহেদ মুগ্ধ চোখে দেখছিল ধারাকে। তার বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে। সেই শুরুর দিন থেকেই ব্যথাটা করে। তবে দিন দিন ধরন বদলাচ্ছে। আগে খারাপ লাগল এত চমৎকার একটা মেয়ের অবস্থা দেখে৷ আর এখন খারাপ লাগে মেয়েটা দ্রুত সুস্থ হচ্ছে দেখে। পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলেই তো চলে যাবে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here