#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পব-৭
“জায়গাটা ঘুরে দেখা দরকার একদিন। তুমি আর কতদিন আছ?” বর্ষণ জিজ্ঞেস করল।
আমি ফোনের এপাশে খানিকটা অন্যমনষ্ক হয়ে বললাম, “তিনদিন।”
“তারপর ফুররর? আর দেখা হবে না?”
“নাহ। আবার ঈদের ছুটিতে আসব।”
“ওহ।”
মনে হলো তার মন খারাপ হয়েছে। খারাপ আমারও লাগছে। এই শহরটা যে এত প্রিয় সেটা দূরে না গেলে কী করে বুঝতাম? যখন চলে যাই তখন ঘাসের ডগা থেকে শুরু করে মোড়ের দোকানদার পর্যন্ত বড্ড আপন মনে হতে থাকে। আর অনিশ্চিত জীবনের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা, আবার ফেরা হবে তো এই আঙ্গিনায়?
বর্ষণ কী যেন বলছিল, খেয়াল করিনি। সে এর মাঝে ফোন কেটে আবার ফোন করেছে। কানের কাছে তীক্ষ্ণ আওয়াজটা পেয়ে চমকে উঠলাম। ফোন ধরে চেঁচিয়ে বললাম, “দিয়েছ কান নষ্ট করে।”
“মানে কী? তুমি হঠাৎ হারিয়ে গিয়েছিলে কোথায়?”
“ওহ সরি। অন্য ধ্যানে ছিলাম।”
“তা তো বুঝতেই পারছি।”
“তুমি কি কখনো বাড়ি থেকে দূরে থেকেছ বর্ষণ?”
সে একটু ভেবে বলল, “আমার আসলে বাড়ি থেকে দূরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।”
“ধরো যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে?”
“কেমন প্রয়োজন?”
“জীবন, জীবিকার প্রয়োজন।”
সে আরেকটু ভাবল। তারপর বলল, “দেখা করি চলো আজ। পরে এ নিয়ে কথা হবে। এখানে ঘোরার মতো কী কী আছে?”
“একটা ছোটো চিড়িয়াখানা আছে, হরিণ আর বানরে ভর্তি। একটা পার্ক আছে, ওটা খুব সুন্দর। কৃত্রিম নীল লেক আছে। তবে সবসময় মানুষে গিজগিজ করে। আর আছে সবুজপাঠ স্কুলের বিশাল মাঠ৷ মাঠের পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। সেটা অবশ্য একটু দূরে। এদিককার মানুষ ঘুরতে গেলে এসব জায়গাতেই যায়।”
“আচ্ছা পার্কে যাই চলো।”
“ওকে!”
“কয়টায় বের হবে?”
“চারটা?”
“ঠিক আছে।”
★
দুপুরের দিকে আকাশটা ঘোলাটে হয়ে এলো। ভাবলাম আজ আর কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। আমি মানুষ হিসেবে অত্যন্ত কুঁড়ে। কোথাও যাওয়া ক্যান্সেল হলে ঘুমুতে পারব বলে মন খুশি লাগতে থাকে। কিন্তু আজ কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে রইলাম বিছানায়।
মা কখন যেন এসে বসেছেন পাশে। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নির্নিমেষ। আমি উঠে বসে জিজ্ঞাস করলাম, “কী হয়েছে?”
“তুই চলে গেলে মনে হয় বাড়িটা একেবারে খাঁ খাঁ করে। কিচ্ছু ভালো লাগে না রে।”
মা’কে জড়িয়ে ধরে বললাম, “তাড়াতাড়ি চলে আসব আবার। এই ক’দিন পরেই তো ঈদ।”
মা মলিন হেসে বললেন, “তোর আর আসা হবে কবে? ইউনিভার্সিটি শেষ হতে হতে বিয়ে হয়ে যাবে, পর হয়ে যাবি চিরদিনের জন্য। আমরা দুটো বুড়োবুড়ি একাই পড়ে থাকব।”
“এজন্যই ছোটোবেলায় বলতাম ভাইবোন এনে দাও। তা তো দিলে না।”
মা কপট রেগে বললেন, “বেশি কথা বলে খালি।”
আমি হাসলাম। বললাম, “ঘরজামাই রেখে দাও।”
“দেখি পারলে রাখব।”
মা এত সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথাটা বললেন যে আমি খিলখিল করে হেসে ফেললাম। মা আমার পিঠে কিল বসিয়ে দিলেন। আমি মায়ের কোলে শুয়ে পড়লাম। আর তখনই কালো মেঘ সরে গিয়ে এক চিলতে রোদ টুপ করে ঢুকে পড়ল জানালা দিয়ে।
যাওয়ার সময় বর্ষণের দুই বোন খুব জোরাজুরি করা শুরু করল তাদের নিতে। শেষ পর্যন্ত তাদের দু’জনকেও নিয়ে আমরা ঘুরতে বের হলাম। আবহাওয়াটা এখন সুন্দর। না রোদ, না বৃষ্টি। ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে!
পার্ক বেশি দূরে নয়, হেঁটেই যাওয়া যায়। গিয়ে দেখি আজ একটু ফাঁকা আছে। চিনি রিনি ছোটাছুটি শুরু করে দিল। আমরা গিয়ে বসলাম একটা জারুল গাছের নিচে বেঞ্চে। গাছভর্তি বেগুনি জারুল ফুলে ছেয়ে আছ। এখান থেকে নীল লেকটা দেখা যায়৷ এখানকার মেয়র তার স্ত্রীর জন্য বানিয়েছিলেন। মহিলা মারা যাওয়ার পর জায়গাটা পার্ক বানিয়ে দিয়েছে।
বর্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা তখন বিদেশ। আমি ছোটো। এক রাতে মা আর আমি শুয়ে আছি, হঠাৎ কেমন অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি মা এপাশ ওপাশ করছেন। ভীষণ অস্থির। রাত তখনো অনেক বাকি। অসুস্থ মা’কে নিয়ে কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তখন বয়স চার কি পাঁচ। দরজার ওপরের ছিটকিনি নাগাল পাই না। পাশের বাড়িতে যাওয়ার উপায় বন্ধ। আমি প্রচন্ড আতঙ্ক নিয়ে পুরো রাত মায়ের হাত জড়িয়ে বসে রইলাম। একটা সময় মা নিজেই ধীরে ধীরে উঠে দরজা খুললেন। আমি পাশের বাড়িতে খবর দিতে গেলাম।
মায়ের ছোটোখাটো একটা স্ট্রোক হয়েছিল। সেবারের মতো তেমন ক্ষতি করেনি। কিন্তু খুব সাবধানে থাকতে হতো। সেই ছোট্টবেলায় আমার মস্তিষ্কে আতঙ্ক জমা হয়ে গেল। প্রায় রাতে ঘুম থেকে উঠে মায়ের নাকের নিচে আঙুল দিয়ে নিঃশ্বাস পড়ছে কিনা পরীক্ষা করা ডেইলি রুটিন হয়ে উঠেছিল।
সেদিন বাবা বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই এত ভয়াল রাত আমার কাটত না। তখন থেকে বাড়ির বাইরে থাকা আমি তীব্র অপছন্দ করি। যতটুকুই সামর্থ্য থাকুক, ডাল ভাত খেয়ে জীবন কাটাবার হলেও আমি রাজি, তবু আপনজন সাথে থাক। প্রতিটা বিপদে, প্রতিটা প্রয়োজনে যেন তাদের সাথে থাকতে পারি এটাই আমার ইচ্ছে। আর মায়ের থেকে দূরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমি এডমিশন টেস্টের সময়েও দূরে পরীক্ষা দেইনি। বিসিএস দেইনি দূরে পোস্টিং হলে যেতে পারব না বলে। বাবা আজও খোটা দেয়। আমি হাসিমুখে সহ্য করি।
তুমি হয়তো কথার কথা বলেছিলে। সবার পরিস্থিতি এক নয়। কাউকে কাউকে তো দূরে থাকতেই হবে। জীবন, জীবিকা কিংবা দেশের প্রয়োজনে! আমি তাদের একজন হতে চাই না এটাই হলো কথা।”
আমি ওর কথা শুনছিলাম মনোযোগ দিয়ে। প্রতিটা মানুষের জীবন নিয়ে আলাদা আলাদা চিন্তাভাবনা থাকে। কেউ উচ্চশিক্ষার জন্য, ভালো চাকরির জন্য পাগল হয়ে বিদেশযাত্রা করে, কেউ ঘরের কোণে পড়ে থাকতে ভালোবাসে পরিবারের সাথে থাকবে বলে। আমি কী তাহলে? আমার তেমন অ্যাম্বিশন নেই। আমি আসলো স্রোতের টানে ভেসে চলা খরকুটো, যাকে জীবন যেদিকে চালনা করছে সেদিকে যাচ্ছি। নিজের ইচ্ছে বলে কিছু কখনো করতে পেরেছি কি?
বর্ষণ কথা ঘুরিয়ে বলল, “জানো, জারুল ফুল নিয়ে একটা স্মৃতি আছে আমার।”
“কিসের স্মৃতি?”
“প্রাক্তন প্রেমিকার।”
“এই ফুল পছন্দ করত?”
“না। ওদের বাড়িতে ছিল এই গাছ। আমি দেখা করতে গেলে এটার নিচে দেখা হতো। আড়াল ছিল খানিকটা। কত স্মৃতি জায়গাটায়!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বর্ষণ।
“খুব মনে পড়ে বুঝি তাকে?” মুখে আন্তরিকতা ফোটানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেও আমার ভেতরে ভেতরে খুব রাগ লেগে গেল। মনে মনে বললাম, তোর অন্তরঙ্গ সময়ের স্মৃতি আমার কাছে বলছিস কেন ফাজিল কোথাকার!
“জায়গাটার কথা মনে পড়ে আসলে…ওর সাথে ব্রেকআপ হলো কেন শুনবে?”
একটুও শোনার ইচ্ছে ছিল না। তবু বললাম, “কেন?”
“ও চেয়েছিল আমি যেন বিসিএস দেই, বড় চাকরি করি। তার সব বোনের হাজবেন্ড নামী চাকরি করে, এদিকে আমি চেষ্টা করছি লেখালেখির। এটা তার পছন্দ ছিল না।”
“কিন্তু তুমি তো কম্পিউটার ফার্ম খুলবে বললে।”
“মিথ্যে বলেছি। প্রথমেই যদি বলতাম আমি লেখক বা বেকার তাহলে হয়তো কথাই বলতে না।”
আমার মাথা গরম হয়ে গেল। রাগ করেই বললাম, “আশ্চর্য তো! আমাকে তোমার ফালতু গার্লফ্রেন্ডের মতো মনে হয়? আমি তোমার ফ্রেন্ডশিপ করেছি তুমি এই আশায় যে বড় বিজনেস করবে একসময়? কী ভাবো তুমি আমাকে?”
“তুমি ভুল বুঝছ ধারা। এগুলো ছেলেমানুষী। আসলে…আসলে…আর তুমি ওকে ফালতু বলছ কেন?”
“তো আর কী বলব?”
আমার আচমকা রাগের তুবড়ি ফোটায় বর্ষণ যারপরনাই বিব্রত। গাল লাল হয়ে গেছে। আমি দেখেও দেখলাম না। সে ধরা গলায় বলল, “ইম্যাচিউর বিহেভ করছ কেন তুমি…”
আমি উঠে পড়ে বললাম, “তোমাদের ইচ্ছে হলে থাকো, আমি বাসায় যাব।”
“তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। এত অল্পতে রেগে যাওয়ার কী হলো? আমি তো খালি বললাম…”
আমি পুরো কথা না শুনে হাঁটতে শুরু করলাম। সেও একটু পর চিনি রিনিকে প্রায় টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আমার সঙ্গে চলল। কিন্তু কথা আর হলো না।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু