#বৃষ্টি_তোমাকে_দিলাম
পর্ব-৯
বাবা দাওয়াত দিয়ে এসেছিলেন সেদিন। বর্ষণরা সবাই আজ আসবে আমাদের বাড়িতে। সকাল থেকেই মা নানা পদের রান্নাবান্না করলেন৷ আমিও হাত লাগালাম তাতে। নিজে সেমাই আর কেক বানালাম। ওরা দুপুরের দিকে এলো। আমি তখনো গোসল করিনি। কাজ করে ভূত হয়ে আছি। তাদের ঢুকতে দেখে জামাকাপড় নিয়ে দৌড়ে ঢুকেছি বাথরুমে।
গোসল করে বের হয়ে দেখি আমার ঘরে বর্ষণ বসে আছে। হয়তো আমার খোঁজে এসেছে। সদ্য গোসল করেছি বলে ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে গাল আর পিঠের ওপর। ছেলেটা কেমন করে যেন তাকিয়ে রইল। আমিও স্বাভাবিক হতে পারছি না। কয়েক সেকেন্ড একদম গলায় কাটার মতো বিঁধে রইল।
চিনি রিনি লাফাতে লাফাতে এসে আমাকে বাঁচাল। “খেতে ডাকছে! তাড়াতাড়ি আসো!”
বর্ষণ দ্রুত উঠে চলে গেল। আমি চুলটুল মুছে ঠিকঠাক হয়ে খেতে গেলাম৷ খেতে খেতে অনেক আড্ডা, গল্প হলো। দুই পরিবার বেশ মিলেমিশে গেল আজকের আড্ডার পর। কিন্তু আমার বর্ষণের দিকে তাকাতে লজ্জা লাগছে৷ ওভাবে তাকিয়ে ছিল কেন?
মায়ের সাথে বর্ষণের মা বর্ষা আন্টির বেশ খাতির হয়ে গেল এরই মধ্যে। দু’জনের পছন্দও প্রায় এক। ভালোমন্দ খাওয়ার পর মা পান খান। বর্ষা আন্টিও পান মুখে দিয়ে বসে গেলেন গল্পে। বাবা আর চাচা পুরানো দিনের আলাপে মশগুল হয়ে গেলেন বসার ঘরের সোফায়। চিনি রিনি আমার পুরানো একটা পুতুল পেয়ে সেটা নিয়ে খেলতে বসে গেল। আমি বর্ষণকে নিয়ে আমার ঘরে এসে বসলাম। হাতে কোকের গ্লাস।
কথায় কথায় বর্ষণ বলল, “ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমাদের একটা গানের দল ছিল। খুব সিরিয়াস ছিলাম আমরা। কিন্তু দলটা ইউনিভার্সিটি পর্যন্তই টিকল, তারপর কে কোথায় হারিয়ে গেল!”
“তার মানে তুমি গান জানো?”
“একটু আধটু।”
“প্লিজ শোনাও না!”
সে হেসে বলল, “অবশ্যই শোনাব, কিন্তু এভাবে বললে গাইতে পারি না যে! অনেকদিন চর্চাও নেই। যখন গানের মুড থাকবে তখন শোনাব নাহয়।”
আমি আর চাপাচাপি করলাম না। নানা রকমের কথা হতে থাকল। বর্ষণ জানাল তার মা বাবা নাকি চায় তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে। আন্টির একা সংসার সামলাতে ভালো লাগছে না৷ আগে কলোনীর মধ্যে থাকত, লোকজনে ভর্তি জায়গা। এখন একা হয়ে গেছেন। চাচ্ছেন ছেলেটাকে বিয়ে দিয়ে দিতে।
বললাম, “করে ফেলো বিয়ে। বয়স তো হয়েই গেছে।”
“তা হয়েছে ঠিক, কিন্তু আমার চালচুলো নেই, কিসের বিয়ে?”
“সব হয়ে যাবে। ফেমাস রাইটার হতে আর বেশি দেরি নেই!”
বর্ষণ লাজুক মুখে হাসল। হাসলে খুব সুন্দর লাগে ছেলেটাকে। দুই গালেই টোল পড়ে। এমনিতে হালকা দাড়ি থাকে গালে, আজ ক্লিন শেইভ করে এসেছে। হঠাৎ ক্লিন শেইভ করলে ছেলেদের বাজে দেখা যায়, একে সেরকম লাগছে না৷ বরং কিউট ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে। এইটুকু ছেলে বিয়ে করবে ভেবে হাসি পেয়ে গেল!
“হাসো কেন?”
“এমনি। বাদ দাও। কেমন মেয়ে পছন্দ সেটা বলো, আমিও মেয়ে দেখি।”
সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, “আমার সেই মেয়েই পছন্দ যে আমাকে আমার মতো ভালোবাসবে।”
“আর কিচ্ছু চাই না?”
“কিছুই না। সত্যি বলছি।”
“দেখা যাবে বিয়ের সময়ই।”
বর্ষণ গাঢ় স্বরে বলল, “যারা পাওয়ার আশা করে না তারাই সবচেয়ে ভালোটা পায় জানো?”
“হয়তোবা। পছন্দের কেউ কি নেই?”
বর্ষণ প্রশ্নটার উত্তর এড়িয়ে গেল। বলল, “এই অসময়ে এত বৃষ্টি হচ্ছে কেন বলো তো? ওয়েদারের মাথামুণ্ডু একেবারে গেছে! পুরো শীতকাল কাটল ফ্যান ছেড়ে! এখন গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি!”
“একদম!”
“আজ অবশ্য বেশ গরম লাগছে।”
“বাইরে বাতাস আছে। চলো বাইরে যাই।”
আমরা বাড়ির বাইরে গেলাম। বাড়ির পেছনদিকে বকুলতলায় একটা সিমেন্টের বাঁধানো বেঞ্চ আছে। সেখানে গিয়ে বসলাম দু’জন। একটা কোকিল ডাকছে অসময়ে। বর্ষণ বলল, “ওয়েদারের সাথে কোকিলের মাথাও গ্যাছে!”
হেসে ফেললাম দু’জন।
“পরশু চলে যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ।”
“খারাপ লাগছে না?”
“বাড়ি ছেড়ে প্রতিবারই যেতে খারাপ লাগে। ইচ্ছে হয় পড়াশুনা ছেড়ে দেই। কিন্তু পড়তে যে হবেই।”
“হুম।”
আর কথা খুঁজে পেলাম না। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম আমরা। এমনিতে একটা মানুষের সাথে কথা না বলে চুপ করে পাশাপাশি বসে থাকাটা অস্বস্তিকর। কিন্তু একটুও খারাপ লাগল না আমার। আমি জানি, বর্ষণেরও খারাপ লাগছিল না। মৃদু বাতাস, পাতার ঝরে পড়া, পাখিদের ডাক, অলস বিকেলের ঝিমিয়ে পড়া রোদ, সব মিলিয়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল যে পুরোটা মন দিয়ে উপভোগ করতে পেরেছি।
একটা ব্যাপার বিরক্ত লাগছিল প্রায়ই। বর্ষণের মোবাইলের টুংটাং। এত কার মেসেজ আসে বাপু! সেও দেখলাম একটু গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে মেসেজ দেখে। টুক করে উত্তর দিয়ে আবার কথায় মন দিচ্ছে। কিন্তু এই মেসেজের যন্ত্রণা থামছে না। আমি এক পর্যায়ে প্রশ্ন করে বসলাম, “কার এত জরুরি মেসেজ আসছে?”
সে মাথা চুলকে বলল, “পাঠিকা। ডাই হার্ড ফ্যান। প্রপোজ করেছে চারবার।”
কথাটা শুনে গা জ্বলে গেলেও বললাম, “ভালো তো!”
“হ্যাঁ৷ আমার লেখা মেয়েরা একটু বিশেষভাবেই পছন্দ করে।”
“ওহ।”
“তুমিই তো বলো আমি সেলিব্রিটি হয়ে যাব। দেখবে মেয়েদের লাইন লেগে গেছে।”
“খুব ভালো।”
“ধারা, তুমি কি রাগ করছ?”
“রাগ করব কেন?”
“না মানে একটু মিথ্যে বললাম কি না!”
“মানে?”
সে উঠে একটু দূরে গিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “কথা হচ্ছে প্রকাশকের সাথে। কোনো নারীর সাথে না। তোমার সাথে মজা করতে মজাই লাগে তাই আরকি…”
“উফ! কী খারাপ তুমি!”
“তুমি বিশ্বাস করো কেন এমন আজগুবি কথা?”
“তোমার মেয়ে ফ্যান থাকবে সেটা স্বাভাবিক।”
সে একটু ধীর স্বরে বলল, “হয়তো। কিন্তু ফ্যান হলেই গল্প করতে হবে তা তো নয়। সবার জন্য ভালোলাগা আসে না এটা হলো সত্যি।”
আমি আর কথা খুঁজে পেলাম না। সে উদাস গলায় গাইল,
“কী নামে ডেকে বলব তোমাকে…মন্দ করেছে আমাকে ওই দুটি চোখে….”
কী সুন্দর কন্ঠ! শুনতে শুনতে হারিয়ে গেলাম কোনো এক মাতাল হাওয়ার তোড়ে।
রাতে একটা কথা মাথায় বারবার পাক খেতে থাকল, কেন? আজকের অলস হয়ে চুপচাপ বসে থাকা বিকেলটা ভালো লাগল কেন? বর্ষণ পাশে ছিল বলে? নাকি বিকেলটা সুন্দর ছিল বলে? এমন বিকেল তো কতই আসে। কখনো উপভোগ করিনি কেন? বর্ষণ পাশে ছিল না বলে? কিন্তু সে-ই কেন? অন্য কেউ পাশে থাকলে কি এমন হতো না? উত্তর না হতে পারে, কারণ আগে এমন কখনো হয়নি।
নিজের মনের রসায়ন নিজেই বুঝতে পারি না। এলোমেলো প্রশ্নে ডুবে রাতের আঁধারের কোলে ঢলে পড়ি ঘুমের জগতে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু