বৃহন্নলার ডিভোর্স শেষ পর্ব মাহাবুবা বিথী

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
শেষ পর্ব
মাহাবুবা বিথী

বুকটা ঢিব ঢিব করছে। আল্লাহপাকের কাছে রুমি সাহায্য চায়। এই মূহুর্তে রুমির শরীরের সমস্ত রক্ত বিন্দু জমাট বেঁধে আছে। নিশ্বাসটাও যেন আটকে রয়েছে। রুমের বারান্দায় গ্রীল ছিলো না। ওর ইচ্ছে হচ্ছিলো ওখান থেকে নিচে লাফ দিবে। কি সব আজে বাজে চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে সত্যিই যদি শয়তানটা রুমে ঢুকে পড়ে রুমি ওকে এটাই বলবে।
একসময় নক করা বন্ধ হয়ে যায়। তবুও রুমি ওর কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বসের এহেন কুদৃষ্টি নোংরা আচরণের পরও রুমি চাকরি ছাড়তে পারছে না । কত জায়গায় সিভি জমা দিয়েছিলো কিম্তু চাকরি হয়নি। আত্মীয় থাকার সুবাদে এখানে ওর চাকরি হয়েছে। বসের আতঙ্কের কারনে অফিসের কাজে ভালভাবে মন দিতে পারে না। কাজের ছুতোয় বস বার বার রুমে ডেকে পাঠায়। অফিস ছুটির পরও কাজের নামে আটকে রাখে। মানুষ নামের ঐ অমানুষ প্রাণীটির ভিআইপি লেবেলে যাতায়াত রয়েছে। ক্ষমতার জোরে রুমির মতো কত অসহায় মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে সমাজপতিরা সে খোঁজ রাখে না।
ওরাই আবার সমাজে বড় বড় কথা বলে বেড়ায়। নারী দিবসের দিন ব্যানার ফেস্টুন উড়ায়। পাল্লা দিয়ে কেকও কাটা হয়। যার কেক যত বড় সে নারীদের ততবেশী সম্মান দেয়।
বাস্তবতা সম্পূর্ন ভিন্ন। যার ক্ষমতা যতবেশী নারীদের উপর তার নির্যাতনের মাত্রাও বেশী। এই পৃথিবী থেকে নারীদের উপর এমন অত্যাচার কবে বন্ধ হবে রুমির মতো মেয়েরা জানে না।
এমন সময় রুমির মা ফোন দিলো,
—-হ্যালো রুমি কেমন আছিস?
রুমির খুব কান্না পাচ্ছিলো,তারপর ও গলাটা যথাসম্ভব নরমাল করে মাকে বললো,
—-আমি ভাল আছি
—-তোর গলাটা এমন শোনাচ্ছে কেন?
—-না,মা আমি একদম ঠিক আছি। কাজের চাপ যাচ্ছে তাই হয়ত অমন শোনাচ্ছে।
—-তোরা আগামিকাল আসছিস তো?
—-সেরকমই কথা ছিলো। আমি এখন রাখি মা।
—-ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ।
রুমির আসলে কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

দুপুরে লাঞ্চের সময় রুমির ফুফু সহ অফিসের বাকি কলিগরা হোটেলে এসে পড়ে। তখন রুমির ফুফু রুমিকে জিজ্ঞাসা করে ,
—–রুমি, আলম ভাই ও আমি তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তায় ছিলাম। আলম ভাইয়ের কাজ এখানেই ছিলো আর আমরা বাকিরা ইনানী বিচের ঐদিকে আমাদের কাজ ছিলো। কাছাকাছি থাকাতে মাঝখানে আলম ভাই এসে তোমার দরজায় নক করেছিলো। তোমার সাড়া না পেয়ে উনি খুব চিন্তায় ছিলেন। তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?
—-হ্যাঁ ফুফু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
তখন আমাদের আর এক কলিগ রিতা বিরক্ত হয়ে বললো,
—–স্যারের খোঁজ নিতে আসার দরকার ছিলো না। ওর তো সকালে তেমন জ্বর ছিলো না। শুধু শরীরটা দুর্বল ছিলো।
রুমি দেখলো রিতা ম্যাম খুব বিরক্ত হয়েই রুমির ফুফুকে এই কথা গুলো বললো।
যাক আলম সাহেব রুমে এসে একটা ভদ্রতার মুখোশ পড়ে রুমিকে বললো,
—–আমি আপনার খোঁজ নিতে এসেছিলাম। দরজায় নক করেছিলাম। আপনি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
—–স্যার আপনার কাজের ডিস্টার্ব করে আমার জন্য কষ্টটা করা উচিত হয়নি।
উনি যেন একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
—-কি বলেন আফটার অল আপনি আমার অফিসের একজন employee. আপনাদের ভাল মন্দ দেখার দায়িত্ব আমার। জ্বরের কারনে আপনার কাজটা ঠিক মতো হলো না। এটাই আফসোস।
রুমির ইচ্ছে করছিলো ওনার ভদ্রতার মুখোশটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। কিন্তু আত্মরক্ষার জন্য এটা সম্ভব নয়। তাই মুখে ভদ্রতা এনে বললো,
—-সরি স্যার, আমি আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার pending কাজগুলো করে নেওয়ার চেষ্টা করবো।
তারপর আলম রুমির ফুফুকে বললো,
—-নাজনীন রুমির কাছ থেকে কাজ বুঝে নিও।

পরদিন সবাই ঢাকায় চলে আসতে সন্ধা হয়ে গেলো।
বাসায় ঢুকার সাথে সাথে রুমির মা রুমিকে দেখে চমকে উঠে বললেন,
—এই দুদিনে তোর চেহারার হাল এমন হয়েছে কেন?
—- মা আমি ওখানে কাজ করতে গেছিলাম। অফিসের বেতনতো এমনি এমনি দেয় না। কাজের পাশাপাশি অনেক প্যারা খেয়ে তারপর বেতনটা হাতে পাই। চেহারা নিয়ে চিন্তা না করে দোয়া কর যাতে সব প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে চলতে পারি।
—তোর খুব কষ্ট হয়েছে না মা?
—-তাড়াতাড়ি খেতে দাও। খুব ক্ষুধা লেগেছে।
—-ফ্রেস হয়ে আয় টেবিলে খাবার দিয়ে দিচ্ছি।
রুম্মান বললো,
—-অনেক দিন পর কক্সবাজারে গেলি আপু কেমন লাগলো?
—-এমনি বেড়াতে গেলে ভালই লাগতো। কিন্তু চাকরি মানেই নানারকম প্যারা। আর কপালগুনে মেয়ে মানুষের প্যারার শেষ নাই।
রাতে ডিনার সেরে এক মগ চা নিয়ে রুমি বারান্দায় বসলো। এমন সময় মোবাইলে টুংটাং শব্দ, তাকিয়ে দেখে রায়হান মেসেজ পাঠিয়েছে।
—-এই কয়দিন অনলাইনে ছিলেন না?
—-না, নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলাম।
—-ঢাকার বাইরে ছিলেন?
—হ্যা অফিসের ট্যুরে কক্সবাজারে গিয়েছিলাম।
—আপনার কাছে তো ট্রিট পাওনা আছে।
—কিসের জন্য?
—-চাকরি পেলেন, খাওয়াবেন না?
—যে ভারী চাকরি আমার তার আবার খাওয়া।
—-ওসব বললে শুনছি না। কবে খাওয়াবেন বলুন।
—-এখন একটু অফিসের ব্যস্ততা আছে। সময় করে একদিন খাওয়াবো।
রায়হান একটু আবেগ নিয়ে বললো,
—-রাজকন্যার কাছে আমার একটা আবেদন ছিলো।
—-এই মূহুর্তে কোন আবেদন গ্রহন করতে পারবো না। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। জার্ণি করে এসেছি। সকালে অফিস আছে। রাতও অনেক হলো বারোটা বাজে। আপনিও শুয়ে পড়ুন। গুড নাইট।
রুমির এখন কাউকে বিশ্বাস করতে মন চায় না।বনের পশুকেও বিশ্বাস করা যায় কিন্তু মানুষকে বিশ্বাস করতে রুমির বড্ড ভয় হয়।

পরদিন অফিসে গিয়ে মারিশার কাছে শুনলো,
—-রুমি তোমাকে তো মনে হয় আবার ফিল্ডে যেতে হবে।
—–তাই। কোথায় যেতে হবে তুমি কি জান?
—–না জানি না, তবে শুনতে পাচ্ছি দিনাজপুরের দিকে যেতে হবে। ঐ দিকে প্রচন্ড শীত পড়ে। যদিও এখন ফেব্রুয়ারী মাস। রাতে ভালই শীত লাগে। তুমি প্রস্তুতি নিয়ে যেও।
একটু পর নাজনীন রুমিকে ডেকে পাঠালো। নাজনীন রুমিকে বললো,
—রুমি শরীর কেমন আছে?
—-ভাল আছি।
—শোন রুমি তুমি তো কক্সবাজারের কাজটা ঠিক মতো করতে পারোনি। এখন বসের সিদ্ধান্ত তোমাকেই দিনাজপুরের কাজটা সুপারভাইজ করতে যেতে হবে। অসুবিধা নাই। আমিনুল তোমার সাথে যাবে। ও খুব ভাল ছেলে। আর ওখানে অলরেডি আমাদের টিম কাজ করছে। দাঁড়াও আমিনুলের সাথে তোমায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।
রুমি আমিনুলের সাথে পরিচিত হলো এবং ওকেই হানিফের টিকিট কাটতে দিলো।
বাসায় এসে সব গুছিয়ে নিয়ে রুমি মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলো। রাত এগারোটার বাসে ওরা উঠলো। রুমি আর আমিনুল পাশাপাশি বাসের সিটে বসলো। আমিনুলের পাশে বসে এভাবে যেতে রুমির খুব অস্বস্তি হচ্ছে। আজকাল কাউকে বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না।
সকাল সাতটায় ওরা দিনাজপুর সদরে পৌঁছে গেলো। রুমি আমিনুলের ব্যবহারে খুব অবাক হলো। ওরা যে পাশাপাশি বসে গেলো একবারের জন্যও আমিনুলের গায়ে স্পর্শ লাগলো না। ছেলেটার প্রতি রুমির শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো। মেয়েদের এতো সম্মান দিয়ে আমিনুল কথা বলে যেটা দেখে ওর মাকে দেখার রুমির খুব ইচ্ছে হলো। কোন মায়ের পেটে এমন ছেলে জন্মেছে? অথচ ওর বস তার জঘন্য উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারলো না বলে রুমিকে এখন ফিল্ডে পাঠাচ্ছে। রুমি মনে মনে ভাবলো,”বরঞ্চ বসের কুদৃষ্টি থেকে বেঁচে বাইরে কাজ করছে এটাই রুমির বেশ ভাল লাগছে। রুমি কাজ শিখতে পারছে”।
সাতদিনের কাজ রুমি আর আমিনুল চারদিনে শেষ করে ঢাকায় ফিরে আসলো। যে প্রতিষ্ঠান এই মাইক্রোক্রেডিটের রিসার্চের কাজ করিয়েছে তারা রুমির কাজ খুব পছন্দ করেছে। আমাদের দেশের মাইক্রোক্রেডিটের পলিসি পৃথিবীর অনেক দেশেই গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। তাই ওরা রুমিকে ওদের অফিসে রিক্রুট করতে চায়। রুমি কমার্সে পড়াশোনা
করাতে কাজ করতে সুবিধা হয়েছে।
এদিকে ওর বসের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসলো। আলমসাহেবের এক মাত্র মেয়ে শায়লা তার ব্যর্থ প্রেমে আঘাত পেয়ে নিজের হাতের রগ কেটে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। অনেক ব্লিডিং হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে। মেয়েটার জন্য রুমির কষ্ট হলো। তারপরও যদি আলমসাহেব নিজেকে শুধরে নেয় আল্লাহপাকের কাছে রুমি এই প্রার্থনা করলো। কারণ অন্যের জন্য গর্ত খুড়লে সেই গর্তে নিজেকেই পড়ে যেতে হয়। হয়ত অনেকে মানতে চায় না কিন্তু এটাই জীবনের কঠিন বাস্তবতা।সেদিন বাসায় ফেরার পথে রুমি প্রিমিয়াম থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে গেলো। রুমির মা দেখে বললো,
—কিরে কোন সুসংবাদ আছে মনে হচ্ছে?
—-হ্যাঁ, মা আমার আর এই অফিসে কাজ করতে হবে না। একটা আমেরিকান কোম্পানীতে এখন থেকে কাজ করবো। আফ্রিকায় এখন আমার পোস্টিং হবে।
রুম্মান বললো,
—-বিদেশি কোম্পানী বলে বেতনও বেশী হবে আপু?
—তা হয়ত হবে।
জীবনে অনেক পরীক্ষা আল্লাহপাক করেছেন কিন্তু রুমিকে আজ অনেক বড় প্রাপ্তিও দিয়েছেন। রুমি আজ তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহ পাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করে চোখের পানি অঝোরে ছেড়ে দিলো।
আফ্রিকা যাওয়ার আগে রুম্মান আর আসিফের বিয়েটা রুমি পাকা করে গেলো। আসিফদের পরিবার খুব আগ্রহ দেখিয়ে রুম্মানকে বউ করে নিতে চাইলো। রুম্মানের ভাই পিএইচডি ডিগ্রীধারী বোন একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি করছে এমন পরিবারে আত্মীয়তা করতে পেরে ওরা অনেক খুশী হয়।
রুমি রায়হানের সাথে আর সম্পর্কে জড়াতে চায়নি। যখন রুমির আগ্রহ ছিলো রায়হানের কাছে তখন রুমির কোন মূল্য ছিলো না। রায়হান ভেবেছিলো রুমি অতি সাধারণ একটা মেয়ে। ওতো রায়হানের যোগ্য নয়। তাই রায়হান তখন বিদেশে পাড়ি জমায়। দুর্ভাগ্যবশত রায়হানেরও ডিভোর্স হয়ে যায়। তারপর দেশে এসে রুমির প্রতি আগ্রহ দেখায়। ততদিনে রুমির মনটা ভেঙ্গে গেছে। মন একবার ভেঙ্গে গেলে তাকে আর জোড়া লাগানো যায় না। তবে রুমির এতো লড়াই বৃথা যায়নি। রুমির পায়ের তলার মাটিটা অবশেষে শক্ত হয়েছে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।

“বুঝতে পারিনি সেদিন
এই তুমিটা আমার তুমি নও
সময়ের স্রোতে আমার জীবন হতে স্মৃতির
বুনোটে হারিয়ে যাও
আমিতো ছিলাম তোমার অনাদৃত প্রেমের উপন্যাসের পান্ডুলিপি
তোমাকে লিখা আমার প্রেমপত্রগুলো আজ
প্রস্তর খন্ডের শিলালিপি”।

বিঃদঃ(জানিনা গল্পটা আপনাদের কেমন লেগেছে তবুও জীবন থেকে নেয়া গল্পটা একটু কল্পনার মিশেলে শেষ করলাম। আপনাদের আগ্রহে আমার গল্প লেখা শুরু যেদিন আপনাদের আমার গল্প ভাল লাগবে না তখন হয়ত আমিও লিখবো না। আপনাদের ভাল লাগাই আমার উৎসাহ। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে আমার লেখাকে শাণিত করতে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করছি)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here