বেলির_কথা (০৫)

#বেলির_কথা (০৫)

__
স্কুলের বেঞ্চে রামিম বসে রয়েছে।আনমনে কি যেন ভেবে চলেছে।রামিম আগেই চলে এসেছে ক্লাসে।তাই পুরা ক্লাসে সে একায় বসে আছে।

রিয়া ও আজ আগে এসে গেছে।যদিও প্রতিদিন বেলিদের সাথে আসে।কিন্তু আজ সে ইচ্ছে করে একা এসে গেছে।বাড়ি বলে এসেছে স্পেশাল পড়া আছে।মধ্যবিত্ত পরিবারে রিয়া পরিবারের বড় মেয়ে।

রিয়া নিজের ক্লাসে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে দেখলো রামিম একা একা বসে আছে।সে নিজেদের ক্লাসে না গিয়ে রামিম এর ক্লাসে ডুকলো।
‘উহুম।’

গলার স্বর দিয়ে একটু জানান দিলো যে কেউ এসেছে।রামিম তাকিয়ে দেখে রিয়া।
‘কিছু বলবে?’
‘হ্যা না মানে?’
‘বলো?’
‘একা বসে আছেন যে?’
‘তাতে তোমার কি?’
‘আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলেন কেন?আমি কি এতই খারাপ?’

রামিম রিয়ার মুখের দিকে তাকায়।
‘আমি কি তা বলেছি?’
‘আপনি নিশ্চয় বেলির কথা ভাবছেন?’
‘নাহ।’
‘আমি জানি।জানেন সেদিন বেলি ইচ্ছে করেয় আপনাকে গোবর মেরেছিল যাতে আপনার শার্ট নষ্ট হয়।আমাদের যেতে যেতে সত্যিটা বলেছিল।’

রামিম এবার ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘বেলি এমন মেয়ে নয়।’
‘হি হি ওর দুই রূপ জানেন না যে?’

রিয়া আরো একটু মিষ্টি মিশিয়ে বেলির বদনাম করলো ব্যস রামিমের এবার বেলির প্রতি ঘৃণা তৈরি হলো।
‘একটা কথা বলি?আপনি আবার এসব বেলিকে বলিয়েন না আমি আপনার ভাল চাই আপনার কষ্ট দেখতে পারছি না বলেই,আসলে আপনার মন খারাপ মুখটা আমার দেখতে একদম ভাল লাগেনা?’

রামিম এবার রিয়াকে বলে,
‘কি বলতে চাও স্পষ্ট বলো?’
‘বলতে চাইছি কোথায় আপনি সুন্দর ছেলে আর কোথায় বেলি একটা কালি।আপনার সাথে আর যাইহোক বেলি মানায় না।আপনার সাথে মানাবে কোনো পরীর মতো মেয়ে।এই আমার মতো।’

ভুলে ‘আমার মতো’ এটা বলে জিভ কাটে রিয়া।

রামিম রিয়াকে আগাগোড়া পরখ করে দেখে।হুম ফর্সা গায়ের রঙ।গোলগাল চেহারা,লম্বা চুল।উড়না ভাল করে দেয়নি।সত্যি ই তো! রিয়া অনেক সুন্দরী।তবে বেলিকে এমন দেখার সৌভাগ্য হয়নি রামিমের।বিশেষ করে চুল।সব সময় স্কার্ফ করে থাকবে,লম্বা হাতা স্কুলের ড্রেস পড়বে।আসলেই বেলি তো রামিমের যোগ্য ই না,গেয়ো ধরনের।
শুধু শুধু এতদিন তার পিছনে পড়ে ছিল।

রামিম এসব ভাবছে।আর রিয়া চলে যেতে নিলে রামিম বলে,
‘আমি যদি তোমাকে ভালবাসি, তুমি ও কি আমায় ভালবাসবে?’

রিয়া কথাটাতে খুব লজ্জা পায়।তবে মনে মনে সে খুব খুশি হয়।এই রূপের জন্য ই অসাধ্য সাধন করা সম্ভব হয়েছে।

‘কি হলো এতক্ষণ তো খুব বলছিলে?পারবে আমাকে আপন করতে?’

রিয়া কলম এগিয়ে ইশারা করে রামিমের হাত দেয়ার জন্য।রামিম ডান হাত এগিয়ে দিতেই রিয়া লিখে ‘ভালবাসব নয়,ভালবাসি আমি’।

এটা লিখে রিয়া বের হয়ে যায়।তারপর নিজের ক্লাসে চলে যায়।আজ তার অনেক খুশির দিন।
_______
‘বেলি,বেলি?’
‘জ্বি আম্মা?’
‘নে ভাত গুলো তোর ভাইকে দিয়ে আয়।তাড়াতাড়ি চলে আসিস?’
‘আচ্ছা।’

বেলিদের বাসা থেকে একটু দূরের বিলে শাহেদ বিভিন্ন শাক সবজি করেছে।ধানের পাশাপাশি সে জমিতে টমেটো,মরিচ,শসা,মিষ্টিকুমড়া করেছে।
.
বেলি হেটে ভাইয়ের সামনে আসে।
‘এসেছিস?’
‘হ্যা।’
‘নিচে রেখে তাড়াতাড়ি যা গা,স্কুলে যেতে হবেনা?’
‘যাব তো?একটু দেখি সবকিছু।’
‘আচ্ছা দেখ,আর যাওয়ার সময় এই মিষ্টিকুমড়ার শাক গুলো আম্মারে দিস।’
‘আচ্ছা।’

বিলের ধারে রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে ভরে গেছে।বেলি দেখে বলে,
‘ভাই আমারে কিছু ফুল পেড়ে দাও না?’
‘কই ফুল?’
‘অই যে?'(হাত দিয়ে ইশারা করে)
‘এই কাজের সময় তোর আর চাওয়ার কিছু খুঁজে পাইলি না?আমি আবার গাছে উঠবো?’
‘আচ্ছা থাক লাগবে না।’

এই ‘লাগবে না’ কথাটায় যে হাজার লাগবে শব্দ জড়িয়ে থাকে সে একমাত্র যে অতি আপন সেই বুঝবে।

‘দাঁড়া! আমার বোন চেয়েছে লাখ টাকার জিনিস তো না।ফুল ই তো এখানেই দাঁড়া।’

বেলি খুশি হয়ে যায়।শাহেদ গাছে উঠে ফুল ছিঁড়ে আনে।
‘নে ধর?’
‘তুমি আমার খুব্ব ভাল ভাই।’
‘নে শাক,ভাল করে ধর।আর সাবধানে যাস?’
‘আচ্ছা।’
.
.
পথ দিয়ে হেটে আসে বেলি।পিছন থেকে কেউ ডেকে বলে,
‘অ বেলি শুনিস নি কথা?’

বেলি থেমে যায়।তাকিয়ে দেখে জলিল কাকার ভাইয়ের ছেলে।বেলি মোটামুটি সবাইকেই চিনে।
‘কিসের কথা বলেন ভাইজান?’
‘আমার কাকা মারা গেছে,আইজ সকালে।’

বেলির চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসে।’মৃত্যু’ শব্দটি সে সইতে পারেনা।নিজের হোক পরের।একটা মানুষ দুনিয়াতে ছিলো আর নিঃশ্বাস ফুরিয়ে গেলে নাকি কবরে রেখে আসবে,তাও একা।বেলির এটা মানতেই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

বেলি বলে,
‘জলিল কাকার সাথে তো সেদিন ই দেখা হলো?’
‘হ কাকার অভাবের সংসার আছিলো,ম্যালা কষ্ট কইরা দিন ফালাইতো।আল্লাহ ভরসা।তোর বাপের বন্ধু আছিল,তাই খবরটা তোদের দিলাম,তোর আম্মারে কইস।’
‘আচ্ছা ভাইজান।’

সারাটা পথ বেলি কেঁদে কেঁদে আসে।ঘরের সামনে এসে ও বেলি চোখ মুছে।বেলির মা বেলিকে এভাবে কাঁদতে দেখে ভয় পেয়ে যান।
‘কি হয়ে ছে বেলি,কথা বল?’
‘আম্মা।’

বেলি আবারো ফুফিয়ে কাদে,
‘তোর ভাই আবার তোকে মেরেছে?ওর সাহস তো কম না দেখছি।ঘরে মারে মারে এখন বিলের মাঝে ও বোনের গায়ে হাত তুলে?আজ ভাত দিবো না,আসুক বাড়িতে।’

বেলি মায়ের মুখ চেপে ধরে।বেলির এমন কান্ডে বেলির মা চোখ বড় করে তাকায়।বেলির হাত সরিয়ে বলে,
‘আমার মেয়ের চোখের জল আমি সহ্য করতে পারিনা।’
‘ভাই আমাকে মারে নি।’
‘তাহলে?কাঁদছিস কেন?’
‘জলিল কাকা নাকি আর নেই,আব্বার মতো চলে গেছে।’

এই বলে বেলি মাকে জড়িয়ে ধরলো।বেলির মা চুপ করে রইলো।এমন একটা খবরে মাকে চুপ থাকতে দেখে বেলি অবাক ই হয়।

বেলি মাকে ছেড়ে বলে,
‘আমি কাকারে শেষবারের মতো মুখটা দেখে আসি?’
‘নাহ।’

এমন সোজাসাপ্টা উত্তরে বেলি সন্তুষ্ট হয়না।তবুও মা যেটা বলে ভালর জন্য ই তো বলে।
.
বেলি আজ আর স্কুলে গেলো না।তার কিছুই ভাল লাগছিল না তাই।বেলির মা ও আর জোর করেনি।কিন্তু মাকে আজ বেশি ই গম্ভীর দেখাচ্ছে এমন তো কখনো ই দেখে না?
.
.
রাতে সবাই খেতে বসলো।বেলির মা বলে,
‘শাহেদ কি শুনেছিস খবর টা?’

শাহেদ শান্ত স্বরে বলল,
‘হ্যা শুনেছি।পরশু দেখা হলো তোমাকে তো বললাম ই।’
‘হুম’

বেলি চুপ করে আছে।সে জানে এখানে জলিল কাকার কথা ই বলছে।

ভাত খেয়ে বেলি শুয়ে পড়ে।জানালা খুলে দেয়।জানালা দিয়ে চাঁদকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।চাঁদ টা কত সুন্দর।আল্লাহর সৃষ্টি সবকিছু ই এত সুন্দর (মাশা আল্লাহ)।

বেলির মা রুমে এসে জানালা খুলা দেখে বলে,
‘রাতে এভাবে জানালা খুলা রাখবি না।দিনকালের ঠিক নেই।তাছাড়া ঘরে মশা ও ডুকছে।বন্ধ করে দে?’

বেলি উঠে জানালা বন্ধ করে দেয়।তারপর বেলি ঘুমিয়ে পড়ে।মায়ের সাথে আর কথা বলেনা।
.
গভীর রাতে বেলির ঘুম ভেঙ্গে যায়।কেমন যেন ছোট ছোট করে কে যেন কথা বলছে, এত রাতে কে কথা বলে?
বেলি উঠে বসতেই দেখে বেলির মা জায়নামাজ এ।তাহলে আওয়াজ টা এখান থেকেই আসছে।
বেলির মা মোনাজাত করছে।মাঝেমাঝে কান্না ও করছে।

বেলি বসে বসে ভাবছে।প্রতিদিন কি মা এভাবে নামাজ পড়ে নাকি?হয়ত পড়ে।আজ ঘুম ছুটে গেছে বলেই দেখলো।কিন্তু মা কাঁদছে কেন?
বেলি আস্তে আস্তে গিয়ে মায়ের পাশে বসে।

ততক্ষনে বেলির মায়ের মোনাজাত শেষ হয়ে যায়।
‘না ঘুমিয়ে এখানে বসেছিস কেন?’ বেলির মা বলে।

‘তুমি কাঁদছ কেন আম্মা?’
‘কই না তো?’
‘আমাকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করে এখন নিজেই মিথ্যা বলছো?’

বেলির মা বলে,
‘আল্লাহ নাকি এসময় বান্দাদের দুঃখের কথা শুনতে আসে।তাই আল্লাহর সাথে আমার কিছু কথা শেয়ার করতেছি।’

‘কি কথা?কিসের দুঃখ তোমার?’
‘দুঃখ নেই আলহামদুলিল্লাহ।তবে আমার সন্তানদের যেন আল্লাহ ভাল রাখেন।অনেক বড় করেন জীবনে, সেজন্য আল্লাহকে বলছি।’
‘তুমি আমাদের এত ভালবাসো?’
‘মা তো সন্তানদের ভালবাসবেই।’
‘আচ্ছা আসো ঘুমাই?’

বেলি উঠে যেতে নিলে বেলির মা তার হাত ধরে আবারো বসায়।আর বলে,
‘বেলি! আজ তোকে একটা সত্যি কথা জানাই?’
‘কি কথা আম্মা?’
‘তুই কথাগুলা কাউকে বলবি না আর,আজ শুনবি আবার আজকেই কথাগুলোকে দাফন দিবি।এটা মানতে পারলে বলবো।’
‘আচ্ছা বলো?’
‘এখন যার ব্যপারে কথা বলবো মানুষটা আজ মারা গেছে।আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে বেহেশত নসিব করুক।’
‘আমিন।’

বেলি অধীর আগ্রহে বসে থাকে।কি এমন কথা যা আম্মা এতদিন বলেনি?জলিল কাকা মারা যাওয়ার পর বলছে কেন?

বেলির মা বলে,
‘তোর আব্বার মৃত্যুটা স্বাভাবিক হয়নি।’

বেলি চমকে তাকায় মায়ের দিকে.

চলবে..

#তাহরীমা

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here