#বেলির_কথা (২৬)
জায়নামাজ থেকে উঠে বেলি আলমারিতে কি যেন খুঁজে।কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পায়না।হাবিবা এগিয়ে এসে বলে,
‘কি খুজছো ভাবি?’
‘আপু আমার ডায়েরি খুঁজে পাচ্ছিনা।’
‘কিসের ডায়েরি?’
‘আমার জীবনের ডায়েরি।ছোটবেলায় ভাই আমাকে এটা উপহার দিয়েছিল।তখন থেকে আমি জীবনের বিশেষ মুহুর্ত,কষ্ট, অভিমানের সব কথা ডায়েরিতে লিখতাম এতে মন হাল্কা লাগতো।আজকে আমার কলিজাকে খুঁজে পাচ্ছিনা,এটাও লিখতে হবে আমার।’
‘তুমি শান্ত হও।’
পুরা আলমারিতে খুঁজে ও ডায়েরি না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো বেলি।বেলি কান্নারত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ডায়েরি টাও হারিয়ে গেলো নাকি?’
হাবিবা চিন্তিত হয়ে বেলির দিকে তাকিয়ে রইলো।বেলি মাথা চেপে বসে রইলো।প্রচুর মাথাব্যথা করছে তার।
হাবিবা গিয়ে বেলির পাশে বসে,
‘অসুস্থ লাগছে তোমার?’
‘জানিনা।’
হাবিবা বেলির কপাল ধরে দেখে শরীর অনেকটা গরম।বেলি বলে,
‘আপু আমার প্রচণ্ড শীত লাগছে জ্বর আসতেছে মে বি।’
‘তুমি শুয়ে পড়ো ভাবি।আমি ডাক্তার আনি?’
‘আপু আমার মেয়েটা কোথায় চলে গেলো?মায়ের কথা কি একটু ও মনে পড়ছেনা?ডাক্তার না এনে মেয়েকে এনে দাও আমায়?’
বেলির বাচ্চামি আবদারে হাবিবার চোখ ছলছল হয়ে আসে।প্রথমে ভাইয়া আর এখন হেনা।কোথায় যে গেলো?
.
.
হেনা অনবরত কাঁদছে।সে কত বড় ভুল করতে যাচ্ছিল আল্লাহ সহায় হয়েছেন।নেহা হেনাকে থামতে বলে,
‘আচ্ছা আমরা যে পালিয়ে এসেছি এটা রাফি দেখেনি তো?’
‘রাফি’ নামটা শুনে হেনা ভয় পেয়ে উঠলো।হেনা ভাবলো মায়েরা ঠিকই বলে।হেনা ই ভুল ছিল।
রাফির সাথে হেনার পরিচয় ক্লাস টেন থেকে।একদিন হেনা একা স্কুলে যায়,সেদিন ই রাফির সাথে দেখা হয়।রাফি পরিচয় দেয় সে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট।তারপর থেকে মায়ের অগোচরে হেনা স্কুলে গিয়ে মাঝে মাঝে টুকটাক কথা বলতো।রাফি হেনার জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। তারপর মন দেয়া নেয়া।বেলিকে এ ব্যপারে কখনো জানায়নি।স্কুলের কথাবার্তার মধ্যেই প্রেম সীমাবদ্ধ ছিল।আর রাফি ও হেনাকে কখনো অন্যান্য প্রেমিকের মতো দেখা করা,আড়ালে কথা বলা এসব কিছুই বলতোনা।আস্তে আস্তে হেনা বুঝতে পারে রাফি অনেক ভালো ছেলে।কলেজ উঠার পর ও হেনা রাফির সাথে দেখা করতো।এজন্য বেলির সাথে হেনা আসতে চায়তো না।
কথা ছিল রাফির সাথে হেনা পালিয়ে যাবে আর বিয়ে করে নিবে।বিয়ে করে ফেললে বেলি কখনো দ্বিমত করবে না।বেলির চেয়ে রাফিকেই বেশি আপন মনে হতো হেনার।
সকালবেলা হেনা বইয়ের ব্যাগে তার কিছু কাপড় নিতে যাওয়ার সময় আলমারি থেকে ডায়েরি টা পায়।তার জীবনে কখনো এমন ডায়েরি চোখে পড়েনি।পড়বে কিভাবে?হেনা আলমারি থেকে কখনো কাপড় নিত না।বেলি ই সব বের করে হেনাকে পড়তে বলতো। হেনা ডায়েরিটা ব্যাগে নিয়ে নেয়।সময় করে পড়ে নিবে।
.
কলেজ শেষে হেনা রাফির সাথে চলে যাবে এটাই ভেবে নেয়।রাফির ব্যপারে সবাই না জানলে ও কলেজের বেস্টফ্রেন্ড নেহা জানতো।নেহাও হেনার সাথে ছিল।হেনা অপেক্ষা করতে থাকে কবে কলেজ ছুটি হবে আর সে চিরদিনের মতো মায়ের বন্দীশালা থেকে মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াবে।একেকটা মিনিট যেন ঘন্টার মতো মনে হয় হেনার কাছে।
রাফি আগেই বলে রেখেছিল কোথায় সে অপেক্ষা করবে।এদিকে হেনাদের ক্লাস শেষ,আজকে নির্দিষ্ট সময়ের তুলনায় কলেজ আগেই ছুটি হয়ে গেছে।হেনা খুব খুশি।নেহাকে নিয়ে রাফির দেয়া নির্দিষ্ট জায়গায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
.
নেহা আর হেনা দূর থেকে দেখতে পায় রাফি যেন কার সাথে ফোনে কথা বলছে।হেনা এগিয়ে যেতে নিলে নেহা হেনার হাত ধরে বলে,
‘শোন?আমার না রাফিকে দেখে কেমন যেন সন্দেহ লাগতেছে।’
‘কি বলিস?’
‘হ্যা ঠিকই বলছি।চল আগে আমরা আড়ালে গিয়ে সে কার সাথে এভাবে কথা বলছে সেসব শুনি?’
নেহা হেনাকে নিয়ে আড়ালে যেতেই যা যা শুনে নেহার পায়ের তলার মাটি সরে যেতে চায়।রাফি ফোনে বলছে,
‘বস মেয়েটা এখনো আসেনাই।আসলে আমি আর দেরী করবো না।’
নেহা ফিসফিস করে বলছে,
‘বস টা কে?’
‘জানিনা তো।আমাকে ত এ ব্যপারে কখনো বলেনি?’
রাফি আবারো বলে,
‘বস এ মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর।আগেরগুলার চেয়ে অনেক সুন্দর।দেখলেয় তুমি মাথা ঠিক রাখতে পারবেনা।আমাকে কিন্তু আগের চেয়ে টাকা বেশি দিতে হবে।’
অপাশ থেকে কি বলে হেনা নেহা কেউ ই শুনতে পায় না।
‘না বস দশলাখ দিতে হবে।অনেক ট্রাই করে বিশ্বাস অর্জন করেছি,অনেক কষ্ট হয়ছিল বস।মেয়েটার হাত পর্যন্ত ধরা হয়নি।আমি কল রাখছি মেয়েটা হয়ত এসে পড়বে, এতক্ষণ এ হয়তো ওদের কলেজ ছুটি দিয়ে দিছে।’
নেহা হেনা রাফি দেখার আগেই আড়াল থেকে সরে পড়ে।তারপর দুজনে একে অপরের হাত ধরে দৌড়াতে থাকে।দৌড়াতে দৌড়াতে তারা একটা গাড়ি পায়।সেটা করেই কলেজ হোস্টেলে চলে আসে।নেহা হোস্টেলে থাকে।আর কিছুক্ষণ পর রাত নেমে আসবে তাই হেনা আর বাসায় যায় না।আবার যদি রাফির সাথে দেখা হয়ে যায়?সে ভয়ে।
এদিকে বেলি হেনার সব ফ্রেন্ডকে কল করেছিল।তখন নেহাকে ও করেছিল নেহা তখন সত্যিটা বলতে গেলে, হেনা বলে,
‘ মাকে যেন কিছু না বলে।এমনিতেই মা তাকে ভালবাসে না।আর এসব বললে মেরেই ফেলবে।’
তারপর নেহা বেলিকে মিথ্যা বলেছিল।
.
হেনা বেলির ডায়েরি টা নিয়ে পড়তে বসে।
একেরপর এক পাতা উল্টায় আর বেলির জীবনের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভাসে।হেনা চোখের জল ছেড়ে দেয়।নেহা এসে তখন হেনাকে শান্তনা দেয়।
‘যা হবার হয়েছে এবার আন্টিকে একটা কল করি?’
নেহার সাথে যোগাযোগ করার জন্য তার বাবা একটা ফোন দিয়ে গেছিলো।হেনা সেদিন সব ফ্রেন্ড এর, মানে যাদের যাদের ফোন আছে সবার নাম্বার কালেক্ট করে বেলিকে দিয়েছিল।
বেলি যে নাম্বার থেকে নেহাকে কল করেছিল সে নাম্বারে নেহা কল করে।
হাবিবা ফোন রিসিভ করে,
তখন নেহা সালাম দিয়ে হেনার কথা বলে।হাবিবার মন শান্ত হয়ে যায়।বেলিকে সব বলে।বেলি খুশি হয়ে শুয়া থেকে বসে যায়।
আর বলে,
‘আমি এখনি আমার মেয়েকে নিয়ে আসবো।’
‘তুমি অসুস্থ যে।রাতে যাওয়া ঠিক হবে?সকালে নিয়ে আসবো।’
‘না যা হবার হবে,আমি এখনি যাব।’
হাবিবা হাসিব,হাবিবার বর,বেলি আর ড্রাইভার আংকেলকে সহ গাড়ি নিয়ে বের হয়।হেনাদের কলেজের হোস্টেলে এত রাতে ডুকার নিয়ম নেই।বেলিরা অনেক বলে কইয়ে হোস্টেলে ডুকে।
হেনাকে দেখে বেলি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।হেনা ও বেলিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।বেলি বলে,
‘এভাবে মা কে কষ্ট দিতে তোমার খারাপ লাগেনা।এত পা*ষা*ণ তুমি?’
হেনা কেঁদে কেঁদে বলে,
‘ তোমায় আর কোনোদিন কষ্ট দিবো না।’
নেহাকে বেলি আদর করে।তারপর হেনাকে নিয়ে বাসায় চলে আসে।তারপর হেনার মুখে সব শুনে বেলি স্তব্ধ হয়ে যায়।আল্লাহ সহায় ছিল বলে আজ কতবড় বিপদ থেকে বেচে গেছে হেনা।তারপর হেনা বেলির ডায়েরি টা ফিরিয়ে দেয়।
বেলি তখন বলে,
‘রাফিকে আমাদের ফলো করতে হবে,নিশ্চয় এদের গ্যাং অনেক বড়।তুমি আপাতত রাফির সাথে আগের মতো ই কথা বলবে।আর বলবে আমার অসুখ ছিল বলে সেদিন দেখা করোনি।আমি অলওয়েজ তোমার সাথে থাকবো।’
হাবিবা বলে,
‘আর ও কত মেয়েকে এমন করেছে আল্লাহ জানে।মেয়েগুলাকে যে বাঁচাতে হবে।’
_____________
বেলিদের কলেজ থেকে ট্যুরে যাবে সবাই।বেলিরা ও যাবে।বেলি সাথে হাবিবাদের কেও ইনভাইট করেছে।সবাই গাড়ি ভাড়া করলে ও বেলিরা তাদের গাড়ি করেই যাবে বলে সীদ্ধান্ত নেয়।ট্যুর টা অন্যবিভাগের হওয়ায় রাতযাপন হোটেলে করতে হবে।
হেনা খুব খুশি।এরকম বেড়াতে তার ভীষণ ভাল লাগে।কলেজ থেকে দুইটা বাস ভাড়া করা হয়েছে।সকাল সকাল তারা সবাই রওনা দেয়।কলেজের বাসগুলো আগে যাচ্ছে আর বেলিদের গাড়ি পরে।
.
গাড়ি চলছে আপন গতিতে।গন্তব্য শেষ হতে আর বেশি সময় নেই।হঠাৎ সামনে এক গাড়ির সাথে আরেক গাড়ির সং*ঘর্ষ হয়ে গেলো।সবার গাড়ি থেমে গেলো,যে গাড়ি দুইটার সং*ঘর্ষ হয়েছে দুই গাড়িতেই কোনো যাত্রী ছিলনা শুধুই ড্রাইভার।ড্রাইভার রা আহত হওয়ায় তাদের হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল।আপাতত কিছু সময়ের জন্য গাড়ি চলাচল বন্ধ।
কিন্তু বেলির সেদিকে মন নেই সে গাড়ির কাচের ভেতর থেকে নিখুঁতভাবে একটা মানুষকে লক্ষ্য করছে।বেলি দূরে আছে তবুও মনে হচ্ছে মানুষটা কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে আছে।
হঠাৎ লোকটি পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিল।দূর থেকে বেলি সেটা খেয়াল করে।কি যেন মনে করে অজান্তে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে বেলি।লোকটির পিছনে জোরে জোরে হাটে।আর তখন লোকটির কন্ঠস্বর বেলির কানে ভেসে আসে।
‘আমার বেলিফুলের মালা,আমার বেলিফুলের মালা।’
লোকটি কি যেন খুঁজতে খুঁজতে,রাস্তার মাঝেই বেহুশ হয়ে পরে যায়।
চলবে..
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)
#তাহরীমা
(আসসালামু আলাইকুম।আপনাদের হয়ত প্রশ্ন থাকতে পারে যে বেলি সে বয়সে অনেক স্ট্রং ছিল অথচ হেনা এমন কেন?আমি বলবো সবাই এক হয়না।বুঝক্ষমতা কারোর বেশি হয় আবার কারোর কম।
গল্পটি কেমন লাগছে মতামত দিবেন?)