#বেলীফুল
পর্ব-১৫
কানন ফিরেছে জ্বর নিয়ে। এসব অসুখ বড় ভোগায়। তাকে দেখার একটা লোক নেই, এমন বিচ্ছিরি রোগ কেন হবে যার জন্য সেবাযত্ন প্রয়োজন? মূলত কোনো এক ঝড়বৃষ্টির রাতে যখন যে ভীষণ জ্বরে ভুগছিল, মৃত্যুচিন্তাটা তখনই মাথায় আসে। তারপর তো বহুবার চেষ্টার পরেও মরণ ধরা দিল না। বেঁচে থাকার ক্লান্তিতে সে ক্লান্ত। কেউ রাগ করে বলবার পর্যন্ত নেই, কে বলেছিল ভিজতে? একটা মেয়ে ছিল, যাকে আজ সকালেই খুব অপমান করে ফেলেছে সে। এখন সে-ই বা আসবে কেন! যন্ত্রণায় কাননের মনে হলো মাথা ফেটে যাবে!
সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। সকালে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে খায়নি, দুপুরে খাওয়ার কথা মনেই ছিল না৷ আর এখন কিছু রান্না করে খাওয়ার শক্তি নেই। বুক শুকিয়ে আসছে, অথচ একগ্লাস পানিও যেন বহুদূরের পথ। গায়ের তাপে ওর নিজেরই হাসফাস লাগছে! আচ্ছা আজ রাতে তো সে মরে যেতে পারে! ঝামেলা চুকে যেত তাহলে! ইলা কি একবার আসবে না আজ? অবশ্য ইলা এলেও দিনে আসে। এত রাতে আসার প্রশ্নই ওঠে না!
এলোমেলো চিন্তায় কখন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল কানন৷ অদ্ভূত সব হিজিবিজি স্বপ্নের রেখা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল কোন বহুদূরে! একটা ভাঙা দালানের পাশে, যার ইটের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে ভয়াল দর্শন সরীসৃপ। তার হাত ধরে সেখান থেকে পালিয়ে আসা মেয়েটা। কে যেন এই মেয়েটা? কোথায় দেখেছে তাকে সে?
কলিংবেলের শব্দে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। চোখ খুলে কাননের মনে হলো মেয়েটা ইলা। ইলাকে তার ভীষণ প্রয়োজন। ইলার তাকে প্রয়োজন হোক, বা না হোক! কিন্তু এখন কে এসেছে? ঘড়ির দিকে তাকাল কানন। রাত সাড়ে নয়টা। তবু মনে হচ্ছে কলিংবেল ইলা বাজিয়েছে। বহু কষ্টে শক্তি জড়ো করে সে উঠে দাঁড়াল। খালি গায়ে কাথা জড়িয়েই দরজা খুলতে গেল।
***
সাজিদ বইটা নিয়ে অনেকক্ষণ হলো জানালার পাশে বসে আছে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। তার হাতের বইয়ের নাম ‘বৃষ্টি বিলাস’। প্রচ্ছদে শাড়ি পরা একটা মেয়ে লাল ছাতা মাথায় হেঁটে যাচ্ছে। এই বইটা দিয়ে ইলা কী বোঝাতে চাচ্ছে? গতকাল বৃষ্টির সময় ইলা আর সে একসাথে ছিল। ইলা কি তাকে পছন্দ করে? বা তারচেয়ে বেশি কিছু? সেটা বোঝাবার জন্যই বইটা দেয়া? ভালোলাগায় সাজিদের মন আচ্ছন্ন হয়ে আসে। বইটা এখন সে পড়বে না। মনে মনে বই পড়ার একটা দৃশ্যপট কল্পনা করে নেয় সে। ঝুম বৃষ্টির দিনে সে আর ইলা পাশাপাশি বসে থাকবে, ইলার হাতে থাকবে কফির কাপ, তার হাতে এই বইটা। এক কাপ থেকেই দু’জনে এক চুমুক করে কফি পান করবে, আর সে জোরে জোরে পড়ে শোনাবে বইটা। আচ্ছা ইলা যদি কফি না খায়? সে তো চা খেতে পারে না। এক কাপ থেকে কী করে দু’জনে একসাথে খাবে?
বড্ড বেশি রোমান্টিক চিন্তাভাবনা! তবে সাজিদ বাঁধা দিল না ভেসে আসা ভাবনাগুলোকে। জীবনের প্রথম এমন অনুভূতি হচ্ছে তার। আজকের বৃষ্টিও রঙিন মনে হচ্ছে! কাচের গায়ে লেপ্টে থাকা পানির কণাগুলো সড়কের রঙ বেরঙের বাতির আলোয় লাল-নীল-সবুজ দেখাচ্ছে। সাজিদের মনের রঙও আজ তাই!
বাবা একটু সুস্থ কবে হবে? তাহলে বাবাকে সাথে নিয়ে যাওয়া যেত ইলাদের বাড়ি। তায়িফ চাচা বিয়ে বিয়ে করতে করতে মাথা খারাপ হয়ে গেছে! তার বিয়ের মতি হয়েছে শুনলে কত খুশি হবে ভাবা যায়!
***
ইশরাতের আজ ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। বৃষ্টিবাদলায় বাস পাওয়াই দুষ্কর। তার মধ্যে মহিলা দেখলে লোক বোঝাই বাসগুলো দাঁড়ায় পর্যন্ত না। অগত্যা অনেকক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার পর একটা সিনএনজি পেয়ে চলে এসেছেন৷ তার শাড়ির নিচটা কাদাপানিতে একেবারে নোংরা হয়ে গেছে। শরীরও ভেজা ভেজা। হাঁচি আসছে ক্রমাগত। সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে যাবেন, হঠাৎ ওপরতলার প্রতিবেশির সাথে দেখা। ভারিক্কি চালের মহিলার নাম মিসেস রেহানা।
মিসেস রেহানা এগিয়ে এসে বললেন, “এত দেরি করে ফেরেন অফিস থেকে?”
“আজকে দেরি হয়ে গেছে ভাবি।”
“আপনাকে সেই কবে থেকে খুঁজছি কথা বলব বলে, পাচ্ছিই না!”
“কী কথা ভাবি?” সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় ইশরাত। “চলুন যেতে যেতে কথা বলি।”
“হ্যাঁ আমিও ওপরেই যাচ্ছি। চলুন।”
রেহানার কথায় মন নেই ইশরাতের। সে ভাবছে কখন গিয়ে জামাকাপড় বদলে শুকনো কাপড় পরতে পারবে। বিকেলে কিছু খাওয়া হয়নি, খিদেয় মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
“আপনার মেয়েটার কথা বলতাম ভাবি। আপনারা তো চলে যান, ও কী করে সারাদিন জানেন?”
ইশরাতের কান খাড়া হয়ে ওঠে মুহুর্তেই। ইলার কথা কী বলবেন উনি! মেয়েটা এত লক্ষী যে তিনি কোনোদিন ভাবেননি কেউ ওকে নিয়ে কিছু বলতে পারে!
ইশরাত একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “মেয়েটার পড়াশুনায় মন নেই। ওই হাতের কাজ নিয়ে থাকে। আর একটু মিশুকে তো, ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।”
“হ্যাঁ। ঘুরে বেড়ানো ভালো, কিন্তু আপনাদের সামনের ফ্ল্যাটে যে ছেলেটা থাকে তার কাছে এত কী দরকার? রোজ রোজই দেখি ওই ফ্ল্যাটে ঢুকছে যখন তখন। যুবতী মেয়ে, আশেপাশে এমন ছেলে থাকলে একটু সাবধানে থাকতে হয় ভাবি। আমাকে কুটিল ভাববেন না। সেরকম হলে চারদিকে চাউর হয়ে যেত। নজরে পড়েছে বলে আপনাকেই বললাম। মেয়ে আপনার, দায়িত্বও আপনার। আসছি।”
ততক্ষণে ওরা চলে এসেছে ওপরে। ইশরাত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মূর্তির মতো। মিসেস রেহানা চলে গেছেন ওপরে। এত অপমানবোধ হচ্ছে! মেয়েটাকে এত বিশ্বাস করলেন আর সে তাকে এমন ছোট করে দিল লোকের সামনে? স্বাধীনতা দিলে অপব্যবহার করতেই হবে? তার মেয়ে তো কত বুঝদার ছিল!
আসলে তারই ভুল। ইলার বয়সই বা কত! ভুল করারই বয়স। তার উচিত ছিল দেখে রাখা। নিজের ক্যারিয়ার দেখতে গিয়ে একটামাত্র মেয়ের দিকে ভালোমতো নজর দেয়া হয়নি কখনো। মেয়েটা ভালো বলে। নয়তো এই বয়সী মেয়ে কত কী বাজে নেশায় পড়ে যায়!
তিনি কি আগে ছেলেটার ফ্ল্যাটে যাবেন? ওর সাথে কথা বলে আসবেন? ছেলেটাকে যতদূর দেখেছেন তার বেশ ভালো আর বুঝদার মনে হয়। নাকি মেয়ের সাথে আগে বোঝাপড়া করা উচিত? ইশরাত দ্বিধা নিয়ে দুই ফ্ল্যাটের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলেন।
(চলবে)