#বেলীফুল
পর্ব- ৩৩
মৌরি বিয়েটা নিয়ে খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেছে। সাজিদের ব্যবহার কেমন যেন ঠান্ডা। প্রথমবার বিয়ে করছে, যে উত্তেজনা থাকার কথা তার কিছুই মানুষটার মধ্যে নেই। মৌরির সাথে শুধু প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলে। এর বাইরে কখনো যদি মৌরি নিজেও কথা বলতে চায়, সাজিদ তেমন সাড়া দেয় না। এদিকে বিয়ে দোরের কাছে। বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে না। সাজিদদের তেমন আত্মীয় নেই, অল্প কয়েকজনকে নিয়ে আসবে তাদের বাড়িতে। বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। মৌরির বাবার ইচ্ছে ছিল ধুমধাম করে বিয়ে দিতে। তেমন সামর্থ্যও তার আছে। কিন্তু এলাকার লোকজনের কর্মকান্ডের নমুনা দেখে সেই ইচ্ছে মিটে গেছে। এমনিতেও লোকজন নানা কথা বলছে। বাবা মেয়ে মিলে নাকি সাদাসিধা ছেলেটাকে হাত করেছে। কী নোংরা এদের মানসিকতা!
গায়ে হলুদের দিন সকালবেলা মৌরি সিদ্ধান্ত নিল সে সাজিদের সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলবে। এখনো খুব দেরি হয়ে যায়নি। সে সাজিদকে ফোন করে বলে ফেলেছে তার সাথে দেখা করতে। সেজন্য একটা রেস্টুরেন্টে এসেছে মৌরি। সাজিদ এখনো আসেনি। সরাসরি ক্লাস থেকে আসার কথা তার। বোধহয় দেরি হচ্ছে কোনো কারণে।
সাজিদ আসল পুরো আধঘন্টা দেরিতে। মৌরির পাশে বসতে বসতে বলল, “স্যরি! দেরি হয়ে গেল। আসলে…”
“ঠিক আছে, সমস্যা নেই। অনেকদিন পর বের হয়েছি তো, খারাপ লাগছিল না।”
“ওকে! ডেকেছ কেন বলো।”
মৌরি যেন কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। তার মুখে খানিকটা বিষাদের ছায়া। বিয়ের কথা হওয়ার পর অনেকটা সামলে নিয়েছিল মেয়েটা। হারানো লাবণ্য ফিরে আসছিল চোখেমুখে। এখন আবার একটা আঁধারের প্রলেপ পড়েছে মনে হচ্ছে। সাজিদের খানিকটা চিন্তা হলো। হয়েছেটা কী?
মৌরির মেহেদি পরা হাতে বিয়ের আংটি জ্বলজ্বল করছে। দারুণ সুন্দর লাগছে। সাজিদের মনে চলো তার পছন্দ ভালো। গয়নার দোকানে সেদিন একজোড়া চিকন সোনার বালা দেখে এসেছে। খুব পছন্দ হলেও অত টাকা ছিল না কেনার। টাকা জমিয়ে বালা জোড়া মৌরিকে কিনে দিতে হবে। খুব সুন্দর লাগবে ওর হাতে।
মৌরির কথায় ঘোর ভাঙল তার, “আপনি কি বিয়েতে রাজি নন?”
সাজিদ হেসে বলল, “আমি কি বাচ্চা মেয়ে যে আমাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হবে?”
“সেটা না৷ আমি জানতে চাচ্ছি আপনি কি আমাকে পছন্দ করে বিয়ে করছেন নাকি শুধুই মানবতার খাতিরে?”
“তোমার এরকম কেন মনে হচ্ছে যে আমি মানবতার খাতিরে বিয়ে করতে যাচ্ছি?”
“ঠিক জানি না। সব ঠিক আছে, তবু কী যেন ঠিক নেই। আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি বিয়েতে খুশি।”
সাজিদ একটু থমকে গিয়ে বলল, “বিষয়টা আসলে তা না…”
“দেখুন, আপনার যদি মনে হয়ে থাকে আপনার সাথে বিয়ে না হলে আমি ভেসে যাব বা আমার কোনো গতি হবে না, তাহলে ভুল ভাবছেন। এতকিছুর পরেও আমি কিন্তু বিয়ে কীভাবে হবে বা মরে যাব কি না ইত্যাদি কথা ভাবিনি। আমার একটাই চিন্তা ছিল, ঘুরে দাঁড়ানোর চিন্তা। আপনাকে আমি পছন্দ করি বলেই বিয়েতে রাজি হয়েছি। কিন্তু কারো করুণার পাত্রী হয়ে আমি বাঁচতে পারব না।”
“আমি তোমাকে করুণা করছি না মৌরি! তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। বিয়ে একসময় করতেই হতো, বাবার তোমাকে পছন্দ ছিল, আমিও তোমাকে বেশ পছন্দ করি। সেজন্য বিয়ে করতে চেয়েছি। করুণা টরুণা মাথায় আসেনি কখনো। আমার ঠান্ডা ব্যবহারের কথা যদি বলো তার কারণ অন্য। তোমাকে হয়তো বলা উচিত ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা এমন যে আগ বাড়িয়ে বলা মানে শুধু শুধু ঝামেলা সৃষ্টি করা।”
“বুঝলাম না।”
“তোমার অতীত তো জানি, আমার জীবনেও এমন অনেক কিছু থাকতে পারে যেটা তুমি জানো না।”
“এখন জানতে চাই।”
“বলছি। বিয়ের আগে আসলে সব বিষয়ে পরিষ্কার থাকা উচিত।”
“একদম!”
সাজিদ ইলার পুরো ঘটনাটা মৌরিকে খুলে বলল। নিজের একপাক্ষিক ভালোবাসার অনুভূতিগুলোও বলে দিল, গোপন করল না কিছুই। বলা শেষে নিজেই কেমন অবাক হয়ে গেল। এই কথাগুলো কাউকে সে বলবে এটা কল্পনাও করেনি।
এদিকে মৌরির মুখ দেখেও বোঝা যাচ্ছে না সে ঠিক কী ভাবছে। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর মৌরি বলল, “আপনি এখনো তাকে ভালোবাসেন?”
“প্রশ্নটার উত্তর আমার নিজের কাছেও অস্পষ্ট। তার সাথে আমার খুব অল্পদিনের পরিচয়। আবার সেরকম সম্পর্কও হয়নি বলে তার খুব বেশি স্মৃতি মাথায় জমা নেই। সে তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সুখে থাক এটাই চাই, তাই চাহিদাটাও নেই। তবে ভুলতে সময় লাগছে এই যা! জীবনে কাউকে তেমনভাবে পছন্দ করিনি বলে বোধহয় অনুভবটা একটু বেশি ভোগাচ্ছে।”
“বুঝেছি।”
“এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন কী করা যায়। আপনি যদি মনে করেন এই ঘটনার জন্য বিয়ে করবেন না তাহলে সেটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার।”
মৌরি খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেল। তার অতীতের কাছে সাজিদেরটা বলতে গেলে কিছুই নয়। তবুও সে না করবে কেমন করে? তার না করার ইচ্ছেও নেই। বরং একটা নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে চলে এলো। সাজিদের মনে জায়গা করে নেবার।
***
তুলন ইদানীং নিয়মিত কলেজে যায়। যাওয়াটা শুরু করেছিল বাসায় থাকতে বিরক্ত লাগে বলে। প্রায় সবকিছুই তার কাছে নতুন। এতদিন সে কলেজে শুধু পরীক্ষা দিতে এসেছে। এখন ক্লাস করতে এসে অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে তার।
ক্লাসে ছেলেমেয়ে খুব বেশি আসে যে তা নয়। যারা আসে তারা খুবই সিরিয়াস। স্যারদের প্রতিটা কথা পারলে খাতায় তুলে নিয়ে যায়।
তুলন আগে জানত না তার কলেজের স্যার ম্যামরা আসলে এত ভালো। এত সুন্দর করে একেকটা টপিক বোঝায় যে কখন ঘন্টা চলে যায় খেয়ালই থাকে না। তুলন পড়ে গণিত নিয়ে। বরাবরই সে ম্যাথে ভালো ছিল। অনার্সেও অবধারিতভাবে তাই গণিত নিয়ে পড়া শুরু করেছে। কিন্তু উড়নচণ্ডী হয়ে গিয়েছিল বলে বারবার রেজাল্ট খারাপ করে এসেছে। শুধু মাথাটা ভালো বলেই পাশ করে করে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত আসতে পেরেছে। এখন আবার তার পড়ার প্রতি আগের ভালোবাসাটা ফেরত আসছে।
এমনিতে সে ক্লাস চুপচাপ থাকে, তেমন বন্ধুবান্ধবও হয়নি। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তবে ভূমি নামের একটা মেয়ে তাকে খুব পছন্দ করে। নিজেই যেচে কথা বলতে আসে। শুধু ওর সাথেই একটু আধটু কথা হয় তুলনের।
একদিন ক্লাসে অতি জটিল একটা ম্যাথ সবার চেয়ে কম সময়ে সলভ করে ফেলেছিল বলে মেধাবী হিসেবে মোটামুটি পরিচিত হয়ে গেছে ক্লাসে। তারপর থেকে কেউ কেউ তুলনের কাছে ম্যাথ বুঝতে আসে। তুলনও বোঝায় সুন্দর করে। আর এসব ব্যাপার হয়েছে মাত্র এক মাসের মধ্যে।
আজ কলেজে আসার ইচ্ছে ছিল না, ইলার সাথে থাকার কথা ছিল। প্রচুর ব্যস্ততা ওদের বাড়িতে। গায়ে হলুদের প্রোগ্রাম হবে ছাদে। সেখানেও কাজ পড়ে আছে। তবে ইলার মা তুলনকে পাঠিয়ে দিলেন ইলার সাথে পার্লারে। ইলা বসে গেল রূপচর্চায়৷ এদিকে তুলনের আর ভালো লাগছিল না। ইলা কয়েকবার করে বলল তাকে অন্তত ফেসিয়াল আর চুল স্ট্রেইট করে নিতে। তুলন রাজি হলো না। ইলার অনেক সময় লাগবে। ততক্ষণে সে ভাবল কলেজ থেকে ঘুরে আসবে। আজ মাত্র একটা ক্লাস।
ক্লাসে এসে বসে জানতে পারল ক্লাস হবে না। তুলনের মেজাজ খারাপ হতে হতেও হলো না। পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে রইল সে। ভূমির দেখা পাওয়া গেল তখন। ভূমি তুলনের পাশে বসে বলল, “তোমাকে একটা কথা বলার জন্য খুঁজছিলাম।”
“বলো।”
“তুমি কি এখন কোনো জবে ঢুকতে চাও?”
“কেমন জব?”
“খুব বড় কিছু না, ছোট্ট একটা পদ। একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে প্রাইমারি শাখায় অংক টিচারের চাকরি। আমার ভাইয়ার স্কুল। ভালো ম্যাথ টিচার পাচ্ছে না। তুমি এত সুন্দর করে বোঝাও! চাইলে চাকরিটা করতে পারো।”
তুলনের প্রস্তাবটা পছন্দ হলো। তার কিছু একটা করার ইচ্ছে কয়েকদিন থেকেই জোরালো হচ্ছিল। বাবার কাছে টাকা চাইতে খুব লজ্জা লাগে। ভাবিরাও কেমন যেন ব্যবহার করে এখন। নিজের একটা ইনকাম থাকলে অতকিছু পাত্তা দেবে না সে। বলল, “কোথায় স্কুল?”
“এই কাছেই। তুমি ওখানে ক্লাস শেষ করে এখানে ক্লাস এটেন্ড করতে পারবে।”
“আচ্ছা একবার স্কুলটা দেখে কথা বলে নেই, তারপর ডিসিশন নেব।”
“সেটাই ভালো। যাবে এখন?”
“না গো। আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে আজ। আগামী সপ্তাহে যাই?”
“আচ্ছা আগামী রবিবার ক্লাস শেষে তৈরি থাকবে কেমন?”
“ঠিক আছে। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভূমি।”
ভূমি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “ধন্যবাদ দিতে হবে না। তুমি খুব ভালো তুলন। তোমার জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে আমার।”
তুলন কিছু না বলে তাকিয়ে রইল ভূমির দিকে। তার জন্য কেন কারো কিছু করতে ইচ্ছে করবে জানে না সে। পৃথিবী বোধহয় অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতিগুলো পুষিয়ে নেবার চেষ্টা করে।
***
কানন নিজের বাড়িতে শিফট করেছে দিন পনেরো আগে। আগের ফ্ল্যাটটা অবশ্য এখনো ছাড়েনি, আপাতত সেখানে ইলাদের বাড়ির মেহমানদের জায়গা হয়েছে।
কাননের বাড়ি প্রায় নতুনের মতোই লাগছে। নতুন রং করা হয়েছে, বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে মেইন গেট থেকে দালান পর্যন্ত নুড়ি বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। বার্নিং করা ফার্নিচারগুলো নতুনের মতো চকচক করছে। একতলা বাড়ির ওপর খোলা ছাদ। ইলা চেয়েছিল ছাদে বাগান করবে। কানন তাই কিছু ফুলের গাছ লাগিয়েছে। বাকিটা ইলাই এসে করুক। তবে সে একটা কাজ করেছে। ছাদে একটা দোলনা বসিয়েছে। ইচ্ছে করে এমন সাইজের দোলনা কিনেছে যে দু’জন চাপাচাপি করে বসতে পারে। বিয়ের আগে আগে তার রোমান্টিসিজম বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে কতকিছু ভেবে একাই হাসে। এদিকে বাড়ি আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। তাদের হাশি তামশায় টেকা যায় না!
কানন ছাদে উঠে এসে ইলাকে ফোন করল। বেশ কয়েকবার ডায়াল করেও পেল না। এ হয়েছে আরেক জ্বালা! ইলা এখন এমন ভাব ধরে যেন বিয়ে আর কোনোদিন কারো হয়নি। তার একারই হচ্ছে প্রথম। এত কিসের ব্যস্ততা তার! কানন একা হাতে সব কাজ করেও সময় বের করে কথা বলতে, আর ইলার সবসময়েই কাজ। কাননের মনে হয় ইচ্ছে করেই এমন করে ইলা। কয়েকদিন ধরে বলছে ছবি তুলে দিতে, নয়তো ভিডিয়ো কলে আসতে। শেষ দেখেছিল ওই বাড়ি থেকে আসার সময়। কতদিন দেখা হচ্ছে না! কিন্তু ইলা ধানাই পানাই করে যাচ্ছে! তার মা নাকি নিষেধ করেছে বিয়ের আগে দেখা করতে। ছবি দেখা বা ভিডিয়ো কল নাকি দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার মতোই!
ইলা মুখে চারকোল মাস্ক লাগিয়ে বসে আছে। মোবাইল সাইলেন্ট করা ছিল। হাতে নিতেই মিসড কলগুলো দেখল। মেসেজ করল কাননকে, “কোনো দরকার?”
কানন তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল, “মানে কী? দরকার ছাড়া ফোন করা যাবে না?”
“উহু, আমি বিজি।”
“কী করছ এমন?”
“রাজকার্য।”
“ফাজলামো করো?”
“না তো! আপনি আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন ভিডিয়ো কলে। এখন আসতে পারি। বাসার বাইরে আছি।”
“সত্যি? আমি দিচ্ছি তাহলে ভিডিয়ো কল।”
কানন খুব আশা নিয়ে ওপাশে কল ধরার অপেক্ষা করছিল। ইলা কল ধরল। তার মুখের কালো মাস্ক ততক্ষণে শুকিয়ে টানটান হয়ে এসেছে। কথা বলা সম্ভব না। ইলা শুধু চোখ পিটপিট করতে থাকল। কানন বিস্ফারিত চোখে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খট করে ফোন রেখে দিল। মেসেজ দিল, “ফোনই করব না তোমাকে আর। ভালো থেকো।”
ইলার উত্তর, “আচ্ছা। দোয়া করবেন যেন স্বামীর বাড়িতে সুখে শান্তিতে থাকতে পারি।”
কাননের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেল। আর মেসেজই দিল না সে।
(চলবে)