বেলীফুল পর্ব-৩৫

0
1863

#বেলীফুল
পর্ব- ৩৫

দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে কানন কতদূর তৈরি হলো দেখতে এল কোয়েল৷ ঘরে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল সে গালে হাত দিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি জুতোর দিকে।

“কিরে তোর কী হয়েছে?”

কানন কেমন উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে বলল, “আপা, ভয় ভয় লাগছে।”

“হায় হায়! কিসের ভয়?”

“বিয়ে করার পর তো রেস্ট নেবার সুযোগও পাব না। সারাদিন শুধু কাজ করতে হবে।”

“মানে?”

“ইলা এমনিতেই আমার ফ্ল্যাটে গেলে এত কাজ করাত! বিয়ে করলে কী হবে কে জানে!”

“তো তুই জুতোর দিকে তাকিয়ে বসে আছিস কেন?”

“এত চকচকে জুতো আমি অনেকদিন পরি নাই।”

“তো?”

“আমার জীবনটা এলোমেলো থেকে চকচকে হয়ে যাবে আপা।”

“তো?”

কানন কোয়েলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল, “আপা, আমি আমার অগোছালো জীবনটা অনেক মিস করব।”

কোয়েল ঝটকা দিয়ে উঠে গিয়ে বলল, “ছাগল কোথাকার! তাড়াতাড়ি রেডি হ। নইলে তোকে রেখে চলে যাব।”

“আমাকে রেখে গেলে বিয়ে করবে কে?”

“কতগুলো ব্যাচেলর আছে না বরযাত্রীতে? আমার ছোটো দেবরটাকেই দিয়ে দেয়া যাবে।”

“না আপা। আমি আসতেছি তো…” কানন দ্রুত জুতো পরে নিল।

গাড়িতে সে বসেছে দুলাভাই আর আপার মাঝখানে। কোলে তুশি। তুশি পরেছে শাড়ি। ইলার জন্য যেরকম শাড়ি কেনা হয়েছে সেরকমই। এছাড়া কোনোভাবে তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে সেফটিপিনের একটা দোকান লাগিয়ে তাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়া হয়েছে। সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে, তবু সে খুশিতে টইটম্বুর।

দুলাভাইয়ের কথা শুনে কানন বুঝল এরই মধ্যে আপা সব বলে দিয়েছে তাকে। এজন্যই বলে মেয়েদের পেট পাতলা!

দুলাভাই ফিসফিস করে বলল, “তাড়াতাড়ি একটা বাচ্চা নিয়ে নিবা। তাহলে দেখবে আবার এলোমেলো জীবনে ফিরে গেছো।”

কানন মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়। তার বেশ পছন্দ হলো উপদেশটা। ইলাকে আজই বলতে হবে।

***

সাজিদ শেরওয়ানি পরে বের হয়ে এলে তায়িফ চাচা কাছে এসে কী যেন পড়ে ফু দিয়ে দিলেন। সাজিদ জিজ্ঞেস করল, “এটা বিয়ের রেওয়াজ?”

“না বাবা। নজর যাতে না লাগে তাই দোয়া পইড়া দিলাম।”

সাজিদ হাসতে হাসতে বলল, “আমি কি মেয়ে?”

তায়িফ চাচা মুখ ভেঙচি দিয়ে দেখতে গেলেন রইসুদ্দিন তৈরি হয়েছেন কি না।

রইসুদ্দিন খুব শখ করে পাঞ্জাবি পায়জামা বানিয়েছেন ছেলের বিয়ের জন্য। আর তার খুবই খুশি লাগছে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর এতদিন পর তার সংসারে কোনো নারীর ছোঁয়া লাগবে। একটু আবদার করা যাবে, শাসন পাওয়া যাবে। যত্ন করার মানুষ হবে। সংসারটা ছন্নছাড়া থেকে গোছানো হবে। নতুন বউয়ের পর নতুন শিশুও আসবে। ভাবতে যে কি আনন্দ হচ্ছে তার!

ছেলেকে দেখে হেসে ফেললেন তিনি।

“কী হয়েছে বাবা?” সাজিদ জিজ্ঞেস করল।

“খুশি লাগছে।”

“বিয়ে আমার আর তোমার খুশি লাগছে?”

“বিয়ে মানেই তো খুশি।”

“তোমাকে একটা বিয়ে করিয়ে দেব এরপর।”

রইসুদ্দিন ভুরু কুঁচকে বললেন, “বেয়াদব ছেলে! তাড়াতাড়ি বের হ। দেরি হয়ে যাবে যেতে।”

***

মৌরি নিজেই সাজতে বসল। শখ করে জীবনে যেসব শিখেছে তার একটা হলো সাজ। কিছুদিন হলো ট্রেন্ড চলছে নো মোকআপ লুক। একেবারে সাদামাটাভাবে বিয়েতে বসে গেলে খারাপ দেখাবে। এখন মেকআপ করতে হবে এমনভাবে যাতে অদ্ভুত না দেখায়, আবার একেবারে সাজেনি তাও না মনে হয়।

মৌরির বিয়ের শাড়িটা লাল কাতানের। ভারী শাড়ির সাথে গহনাগুলো তুলনামূলক হালকা। সাজগোজের পর নিজেকে দেখতে বেশ ভালোই লাগল। বহুদিন পর শখ করে কারো জন্য সাজল মৌরি। ওই মানুষটা কি দেখে খুশি হবে?

ওর কিছু বোনেরা দুষ্টুমি করে শরবতে লবণ, মরিচ, হলুদ দিয়ে রেখে দিয়েছে। মৌরি চুপিচুপি গিয়ে সবগুলো ফেলে দিয়ে নতুন করে মিষ্টি শরবত বানিয়ে রাখল।

বর যখন এলো, তখন জানালার ফাঁক দিয়ে এক নজর দেখে নিল মৌরি৷ তার বিশ্বাস হয়ে গেল, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটার সাথেই তার বিয়ে হতে যাচ্ছে!

***

ইলা স্টেজে বসে বসে হাঁপিয়ে গেল। এখনই এই অবস্থা হলে পরে কী করবে ভেবে পেল না। এখনো বরযাত্রী আসেনি। মেকআপটা বোধহয় গলেই যাবে। ছবিগুলো হবে ভূতের মতো।

তাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বর নাকি ট্যারা হয়ে যাবে এত সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। ইলারও ইচ্ছে বিচ্ছু লোকটাকে একটা ঝটকা দেবার। কিন্তু সে কোথায়?

ওর গহনাগুলো দারুণ হয়েছে। কাননদের বাড়ি থেকে পাঠানো প্রতিটা তত্ত্ব এত সুন্দর যে ছুঁয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। কোয়েলের পছন্দের তুলনা হয় না। প্রতিটা জিনিস বেছে বেছে কিনেছে সে। ইলা কখনো এত গহনা পরেনি। এক জোড়া ছোট্ট সোনার দুল পরে কাটিয়ে দিয়েছে পুরো বাইশটি বছর৷ হঠাৎ এত সাজগোজ সে করছে ঠিকই, কিন্তু মনটা সাদামাটাই রয়ে গেছে। কে জানে বিয়ের পর কী হবে? পরিবর্তন ইলা মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে কিছু করতে তার খুব কষ্ট হবে। সেই কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারবে না।

বর চলে এসেছে। সবাই হুড়মুড় করে দেখতে চলে গেল। ইলার চোখে পানি চলে এলো। মাত্র ক’টা দিন আগেও সে ভাবেনি সেই অদ্ভুত ছেলেটা তার হয়ে যাবে।

***

বিয়ে পড়ানোর সময় হঠাৎ মৌরি জ্ঞান হারাল। আসলে অতিরিক্ত উত্তেজনা তার সহ্য হচ্ছিল না৷ এমনিতেও স্নায়ু দুর্বল হয়ে গেছে। জ্ঞান ফেরানো হলেও কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ দেখাল তাকে।

বাড়িতেই যেহেতু বিয়ে, পাশের ঘরেই বরপক্ষ বসেছিল। খবরটা শুনে সাজিদ আর রইসুদ্দিন মৌরির ঘরে চলে এলেন।

তাদের বিয়েটা হলো নাটকীয়ভাবে।

সাজিদকে দেখে মৌরি একটু যেন সামলে নেবার চেষ্টা করল। সাজিদ ওর পাশে বসে একটা হাত ধরে বলল, “ভয় নেই। আমি আছি তো। তুমি সিগনেচার করে দাও।”

বাম হাত সাজিদের হাতে রেখে মৌরি সই করে দিল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কান্নাগুলো জমিয়ে রেখে দিল কোনো একদিনের জন্য, যেদিন এই মানুষটাই তাকে দায়িত্ববোধ ছাড়াও খুব ভালোবেসে আপন করে নেবে।

***

কানন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এটা সেটা বললেও দেখা গেল কবুল বলার সময় কিংবা কাবিননামায় সই করার সময় এত দ্রুত করল যে আশেপাশের সবাই মুখ টিপে হাসতে শুরু করল। কী তাড়া তার!

ইলা কাবিননামায় সই করতে গিয়ে কান্নাকাটি করে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলল। অনেক কষ্টে তাকে সামলানো গেল। ওয়াটারপ্রুফ মেকআপও দেখা গেল একটু নষ্ট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত কোয়েলের এক বিউটিশিয়ান বান্ধবী সাজ উদ্ধার করতে সক্ষম হলো।

বিয়ে শেষ হলে এক বুজুর্গ ব্যক্তি বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “বিয়েবাড়িতে মনে রাখার মতো কাহিনী হইতে হয়। নাইলে ওইটা বিয়ে মনে হয় না।”

***

অন্যান্য রাতের মতোই সেদিনের রাত নামল। তবে নবপরিণীতদের শুভেচ্ছা জানাতেই বোধহয় ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল।

ফুলেল বাসরের স্নিগ্ধ পরিবেশে কত কালের প্রতীক্ষার অবসান ঘটে গেল! পূর্ণতা পেল ভালোবাসার। প্রেম নামক স্বচ্ছ কাচের জারে শিশিরের ফোটার মতো একটু একটু করে জমা হতে থাকল মিষ্টি স্মৃতিগুলো।

(আপনারা কি বুঝতে পারছেন গল্প প্রায় শেষের দিক? আর দুটো কি তিনটে পর্ব হবে। বিয়ের পর্ব কেমন লাগল বলুন তো?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here