#বেলীফুল
পর্ব- ৩৮ (শেষ পর্ব)
সাজিদ বাজার থেকে মৌরির দেয়া লিস্ট অনুযায়ী টুকিটাকি বাজার করে ফেলল। ফেরার পথে হঠাৎ একটা বাচ্চা ওর সামনে পড়ে গেল। হাড় জিরজিরে শরীর, চোখদুটো দুর্বল। কিছু টাকা চাইছে। দু’দিন নাকি কিছুই খায়নি। সাজিদের খুব মায়া হলো। প্রথমে কিছু টাকা দিতে গিয়েও থেমে গেল সে। ভাবল ছেলেটাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পেটভরে খাইয়ে দিলে কেমন হয়?
মৌরি ভেবেছিল খুব সুন্দর করে সাজবে। কিন্তু কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। নতুন একটা শাড়ি, কাচের চুড়ি, কাজল আর হালকা লিপস্টিক। যাক, এর বেশি সাজা সম্ভব নয়। সাজিদকে সারপ্রাইজ দেয়া হবে পেছনের বারান্দায়। আগে কিছু বুঝতে দেয়া যাবে না।
মৌরির বারবার ঘর আর বারান্দায় আসা যাওয়া করতে দেখে রইসুদ্দিন মনে মনে হাসলেন। দুটিতে ঠিক বনিবনা হয়নি তা নয়, তবে কোথায় যেন একটু কমতি আছে। সেটুকু পূরণ হয়ে গেলে আর দেখতে হবে না!
সাজিদ বাড়ি ফিরে ডাকাডাকি শুরু করল। মৌরি বের হয়ে এসে দেখল সাজিদ একটা বাচ্চাকে বাইরের কল থেকে পা ধুইয়ে ভেতরে নিয়ে আসছে। মৌরির দিকে তাকিয়েও তার কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। সে যে সাজগোজ করেছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই! মৌরির মনটা একটু খারাপ হলো। অবশ্য বাচ্চাটাকে দেখে অত ভাবাভাবির সময় পেল না।
সাজিদ বলল, “খাবার দাও মৌরি। আমরা দু’জন একসাথে খাব।”
মৌরি নিজেও খায়নি। ইচ্ছে ছিল সাজিদের সাথে খাবে। কিন্তু সেটা আর বলার পরিস্থিতি নেই। সে খাবার বাড়তে গেল।
খাবারের বহর দেখে সাজিদ আর বাচ্চা দু’জনেরই চোখ ছানাবড়া। সাজিদ বলল, “হঠাৎ এতকিছু!”
মৌরি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর ভাগ্যে ছিল, তাই এতকিছু রান্না হয়েছে আজ এখানে।”
সাজিদ প্রসন্ন হাসি হেসে খেতে শুরু করল। মৌরি যত্ন করে খাওয়াল দু’জনকে।
বাচ্চাটাকে দেখতে শুটকো হলে কী হবে, খুব খেতে পারে। একেবারে চেটেপুটে অনেকখানি খেল। প্রায় সাজিদের তিনগুণ। সব খাবারই প্রায় শেষ হয়ে এলো। খাওয়ার বহর দেখে সবাই অবাক হলেও কিছু বলল না। খেতে পায় না, খেয়ে নিক ভালো করে।
মৌরি ভাবল কেকটাও বাচ্চাটা থাকতেই কাটা হোক, নইলে সাজিদ যদি পরে মন খারাপ করে?
সে পেছনের বারান্দায় গেল কেক সাজিয়ে রাখতে।
মৌরি বের হয়ে যেতেই বাচ্চাটা বলল, “আফাও তো খায় নাই। খাওয়ায় দিয়েন।”
সাজিদ বলল, “তুই জানলি কিভাবে?”
বাচ্চাটা একগাল হেসে বলল, “না খাওয়া চেহারা দেখলে আমি বুঝি। আফায় আফনের লাইগা বইয়া আছিল।”
সাজিদ উঠে গেল মৌরি সত্যি খেয়েছে কি না দেখতে।
বারান্দা দেখে তার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। হয়েছে কি আজ? এসব কিসের আয়োজন?
মৌরি মোমবাতি সেট করছিল। সাজিদকে দেখে মন খারাপ করে বলল, “দিলেন তো সারপ্রাইজটা নষ্ট করে!”
“কই নষ্ট করলাম! আমি সারপ্রাইজড!”
“আচ্ছা! তাহলে বলেন আজকে কী?”
“কী?”
মৌরি দুই হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে রইল। ভাবটা এমন, আজ সাজিদ যদি না বলতে পারে কী দিন, তো একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে।
সাজিদ ততক্ষণে উঁকি দিয়ে কেক দেখে ফেলেছে। হেসে বলল, “ওহ আমার হ্যাপি বার্থডে!”
“জি!”
“থ্যাংস মৌরি!”
“ওয়েলকাম।”
“কিন্তু তুমি নাকি খাওনি?”
“কে বলল?”
“ওই পিচ্চি।”
“ও জানল কেমন করে?”
“জানি না। সত্যি খাওনি?”
“না।”
“চলো এখন খাবে।”
“উহু, এখন কেক কাটা হবে।”
“আগে খাবে চলো।”
“খাবার শেষ তো। ওকে নিয়ে কেকটা কেটে ফেলো, তারপর আমি ভাত বসিয়ে দেব।”
“আচ্ছা চলো সবাইকে ডেকে আনি।”
ডাকতে গিয়ে দেখা গেল বাচ্চাটা নেই, চলে গেছে। সে যেখানে বসেছিল সেখানে দুটো তাজা বেলীফুল পড়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর কেক কাটা হলো। রইসুদ্দিন কেক খেয়ে মৌরির রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করলেন৷ তায়িফ চাচাও চেটেপুটে কেক খেল। আর সাজিদ ভরপেট খেয়ে এক পিসের বেশি খেতে পারল না। তবে সে মৌরিকে দুটো কেক খাইয়ে ছাড়ল। কেক কাটার পর সবাই একটা একটা করে উপহার দিল সাজিদকে।
সাজিদের হঠাৎ চোখ জ্বালা করে উঠল। পানি ঠেকিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকল সে। ঠিক এক বছর আগেও সে একাকী একটা মানুষ ছিল। এমন সারপ্রাইজ সে জীবনের প্রথম পেল!
সবচেয়ে অবাক করা কান্ড হলো একটু পর। রান্নাঘরে গিয়ে দেখা গেল সবগুলো পাত্র খাবারে ভর্তি। যেন মাত্র কেউ রান্না করে রেখে গেছে। একটুও শেষ হয়নি!
***
তুলন কিছুদিন ধরে খেয়াল করে ক্লাসে একটা বাচ্চা খুব মনমরা হয়ে থাকে। এত সুন্দর পুতুলের মতো একটা ছেলে মন খারাপ করে থাকে দেখে তুলনের নিজেরও মন খারাপ হয়ে যায়। সে একদিন ক্লাস শেষে বাচ্চাটাকে থাকতে বলল।
সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর ওর বেঞ্চের পাশে বসে তাকে কোলে নিয়ে বলল, “তুতুন, তুমি সবসময় মন খারাপ করে থাকো কেন বলো তো? তোমাকে কি আমরা বকি?”
তুতুন কথা বলল না। আরও অনেকবার অনেকভাবে তাকে মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করা হলো, কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না।
শেষে তুলন ভাবল তুতুনের অভিভাবকের সাথে কথা বলতে হবে। হতে পারে কোনো মানসিক সমস্যার মধ্যে আছে বাচ্চাটা। পরিবারও শিশুদের ওপর অনেক সময় অতিরিক্ত চাপ দিয়ে ফেলে। কিংবা এমনও হতে পারে পারিবারিক পরিবেশ ভালো না।
একদিন সে তাই অফিসের খাতা থেকে তুতুনের বাবার নাম্বারে ফোন করে ফেলল। ভদ্রলোকের গলা শুনে বোঝা গেল খুব ব্যস্ত, তাই তুলন তাকে বলে দিল স্কুলে এসে যেন দেখা করে, সাথে যেন তার মাকেও নিয়ে আসে। মায়ের নাম্বারও খাতায় থাকার কথা ছিল, কিন্তু সেই জায়গাটা ফাঁকা।
পরদিন তুতুনের বাবা স্কুলে এলে তুলন তার সাথে দেখা করে বলল, “আমিই ওর ক্লাস টিচার। আপনাকে আসতে বলেছিলাম। তুতুন সবসময় মন খারাপ করে থাকে। আপনারা খেয়াল করেন না?”
ভদ্রলোক বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, “আসলে আমি সময় পাই না। এত ব্যস্ত থাকি! রাতে ফিরলে ওর সাথে তেমন কথা হয় না৷ ছেলেকে সময় দেয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে থাকলেও আমি আসলে কাজ আর সংসার দু’টো ব্যালেন্স করতে পারছি না।”
“ওর মা?”
“তুতুন বলেনি?”
“কী?”
“আসলে ওর মায়ের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। ওর মা আবার বিয়ে করেছে, আমেরিকায় সেটেল্ড। আমার কাছে ছেলেটা রয়ে গেছে।”
তুলন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এত সুন্দর একটা ছেলে এখন মা বাবার বোঝা। আপনিও দেখে রাখতে পারেন না, আর মা তো চলেই গেছে।”
লোকটা রেগে গিয়ে বললেন, “আপনি না জেনে কথা বলছেন কেন? আমার ছেলে মোটেও আমার জন্য বোঝা নয়। আমার কিছুদিন আগেই বাবা মারা গেছেন। সেজন্য তার বিজনেসের পুরোটা আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে, কিচ্ছু সামলে কুল কিনারা পাচ্ছি না। নয়তো তুতুন কিছুদিন আগেও এমন ছিল না। আমি যথেষ্ট সময় দিতাম।”
তুলনের মনে হলো কথা সত্যি। তুতুনের সমস্যাটা ইদানীং তৈরি হয়েছে।
সে বলল, “কিন্তু আপনি আরেকটা বিয়ে করলে তো তুতুন সেই বোঝাই হয়ে পড়বে!”
“আমি এমন মানুষ দেখেই বিয়ে করব যে ওকে মায়ের মতো যত্ন করে রাখবে। হ্যাঁ, জানি পুরোপুরি মা হওয়া সম্ভব না। ওর নিজের মা’ই তাকে দেখেনি, সেখানে অন্য মেয়ে…আসলে মেয়েরা….”
লোকটা কথা শেষ করল না৷ বুঝল তুতুনের টিচারের সামনে কথাগুলো বলা উচিত হচ্ছে না। তাই থেমে গেল। শেষে বলল, “আমার ছেলেটাকে একটু দেখে রাখবেন ম্যাম। আমিও চেষ্টা করব সময় দেবার।”
***
“মৌরি! এটা কী ছিল আমি জানি না, কিন্তু খারাপ কিছু কখনোই ছিল না৷ আমার মন বলে যা হয়েছে ভালো হয়েছে। ভালোর জন্য হয়েছে।”
মৌরি কী যেন বলবে বলবে করেও বলতে পারল না। সাজিদ ভীষণ আবেগে মৌরিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ধরে নাও ও আমাদের দোয়া করে গেছে! জানো শেষে আমাকে কী বলছিল? বলেছিল তোমাকে খাইয়ে দিতে। এখন খাবে চল।”
“ওই খাবার খেতে ভয় করছে।”
“কিচ্ছু হবে না মৌরি। ভালোবাসার দান খারাপ হতে পারে? আজকে আমরা জান্নাতি খাবার খাব।”
সাজিদ প্লেটে খাবার বেড়ে নিয়ে এল নিজ হাতে। মৌরিকে খাইয়ে দিল খুব যত্ন করে। মৌরির চোখে পানি চলে এলো বারবার। এত রহস্যের সন্ধান জানে না সে। তার তো শুধু এই মানুষটার মনের সন্ধান পেলেই চলবে।
রাত নামলে চারদিক যখন শুনশান হয়ে এলো, মৌরির কেমন যেন গা শিরশির করতে থাকল। সে ড্রইংরুমে গিয়ে বসল। সেখানে রইসুদ্দিন টিভি দেখছেন হাই ভলিউমে। একটা বাংলা হাসির নাটক চলছে। মৌরি নাটকের কাহিনীতে প্রায় ডুবে গেছে, তখন সাজিদ এসে বাগড়া দিল।
“এসব কী? ক’টা বাজে? দু’জন এক্ষুনি ঘুমাতে যাবে চলো।”
রইসুদ্দিন বিরক্ত হয়ে বললেন, “নাটকটা শেষ হোক।”
“উহু। রাত জাগা চলবে না। এখনই ওঠো। টিভি বন্ধ।”
সাজিদ জোর করে রইসুদ্দিনকে ঘরে পাঠিয়ে দিল। মৌরিকে বলল, “তাড়াতাড়ি এসো।”
মৌরি ঘরে ঢুকে চমকে উঠল।
যে ফুলগুলো দিয়ে বারান্দা সাজানো হয়েছিল সেগুলো দিয়ে এখন ঘর সাজানো হয়েছে। কখন করল সাজিদ এসব? খাটটা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ঢাকা।
বিয়ের অনেকগুলো দিন হয়ে গেলেও দু’জন সেভাবে কাছাকাছি আসতে পারেনি। কিসের যেন জড়তা সবসময় কাজ করে গেছে দু’জনার মাঝে। আজ যেন সব জড়তা ভাঙার দিন। একটা ভালোবাসার দিন।
সাজিদ বলল, “তুমি কি জানো, পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি এবং ভালো মেয়েটার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে?”
মৌরি উত্তরে বলল, “তুমি কি জানো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মনের এবং সুন্দর দেখতে ছেলেটাকে আমি পেয়ে গেছি?”
দু’জন হেসে উঠল একসাথে।
অনেক সময় পর, যখন রাত গভীর হয়েছে, চাঁদটা একাকী রাতের আকাশে ঝিলমিলে আলোবর্ষণ করে যাচ্ছে প্রবল আবেগে, ঠিক তখন রহস্যময় আগন্তুকের ফেলে যাওয়া দুটো সুগন্ধি বেলীফুল জায়গা বদল করে টেবিলের ওপর থেকে ঠাঁই নিল মৌরির জঠরে।
***
ইলা আর তুলন অনেকদিন পর একসাথে ছাদে এসেছে। সেই পুরানো আনন্দের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আজ তুলন কত ম্যাচিউরড! ইলা সংসারী। দুটো প্রাণোচ্ছল তরুণী জীবনের স্রোতে ভেসে বদলে গেল কেমন করে!
ইলার পরনে ছাইরঙা সুতির শাড়ি। সে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুলন, তুই কি এখন আগের মতো ক্রাশ খাস?”
তুলন মৃদু হেসে বলল, “ধুর পাগলি!”
“আমি খাই।”
“তুই? বিয়ের পর? বলিস কী?”
“হুম। প্রত্যেকদিন খাই। মাঝেমধ্যে একদিনে কয়েকবার।”
“হায় হায়! কার ওপর?”
“ওই একজনের ওপরই।” ইলার মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে। তুলন হাসে। বলে, “এখনো এত প্রেম!”
“থাকবে না? আরও বাড়ছে প্রতিদিন।”
ইলা খেয়াল করল তুলনের চোখদুটো স্বপ্নালু হয়ে উঠছে। সে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বলল, “তুই বিয়ে করবি কবে?”
“কে জানে!”
“পাত্র দেখব?”
“নাহ।”
“পছন্দের কেউ আছে?”
তুলন কথা বলল না। ফাঁকা দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল কোন দূরে। ইলা একটু অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “বল না! কাউকে ভালো লাগে?”
তুলন একটু ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি প্রেমে পড়ে গেছি রে ইলা! কিন্তু সে প্রেম ভয়ানক!”
“তোর এ পর্যন্ত করা সবগুলো প্রেমই ভয়ানক ছিল!”
“নাহ, আগে আমি ক্রাশ খেয়েছি, ছেলেগুলোকে বাজিয়ে দেখতে চেয়েছি। আর শেষবার খেয়েছি বাঁশ। কিন্তু এবারেরটা সত্যিকারের প্রেম। তুই বিশ্বাস করবি না ইলা। মানুষটাকে দেখলে আমার শরীরের সব পশম দাঁড়িয়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, আর একবার তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।”
“বলিস কী? তাহলে ভয়ানক কেন?”
“লোকটার একটা বাচ্চা আছে।”
“কিহ!”
“হ্যাঁ।”
“বিবাহিত লোকের প্রেমে পড়েছিস! ছি তুলন!”
“আরে ডিভোর্সড তো।”
“ও আচ্ছা!”
“হ্যাঁ।”
“তো তার কী ভালো লাগল?”
“তেমনভাবে কী ভালো লেগেছে জানি না। দেখতে ভালোই, গলার স্বর সুন্দর, খুব কেয়ারিং। আর বাচ্চাটা যা সুন্দর! সেই বাচ্চাটা আমার ক্লাসের। ওর সূত্রেই পরিচয়, কথা হওয়া। বাচ্চাটাকে নিয়ে আমাদের মাঝেমাঝে কথা হয়, স্কুলে এলে দেখা হয়। এমনিতে বাড়তি কোনো কথা হয়নি কখনো। কিন্তু আমি যে তাতেই কবে মরে গেছি নিজেও জানি না।”
“এখন কী হবে?”
“তুই কিছু বল৷ কী করব জানি না৷ এর আগে প্রেম করতে গিয়ে যা করেছি, তারপর সে ব্যাপারে বাসায় কিছু বলার সাহস আমার নেই। আর তারচেয়ে বড় কথা লোকটাকে বলব কেমন করে? কী করে কী হবে জানি না!”
ইলা তুলনের হাত ধরে বলল, “তুই চিন্তা করিস না তুলন৷ আমার ঘটনাটা দেখলি না? মনের মানুষটাকে কেমন পেয়ে গেলাম! তুই সত্যি তাকে চাইলে ঠিক পাবি দেখিস। আর ভালোবাসার কথা বলতে এত লজ্জা কিসের? না বললে সারাজীবন পস্তাতে হবে। তারচেয়ে বলে দিয়ে রিজেক্ট হলেও ভালো।”
“বলছিস?”
“হ্যাঁ।” ইলা তুলনকে জড়িয়ে ধরে বলল। “তুই এবার সুখী হবি, দেখিস।”
***
কানন ব্যাগ গোছাচ্ছে। কী থেকে কী নেবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার সবই এলোমেলো, ছন্নছাড়া। বিয়ের পরেও সে ধারার পরিবর্তন হয়নি। এক পর্যায়ে এসে সে হাক ছাড়ল, “ইলা….হেল্প করো না একটু…”
ইলা রান্নাঘরে কফি বানাচ্ছিল। কফির কাপদুটো টেবিলে রেখে বলল, “জানতাম এমনই হবে। আমি ছাড়া কী পারো তুমি?”
কানন কফি হাতে বেতের সোফায় গা এলিয়ে বসে বলল, “তুমি ছাড়া আমার জীবন অচল। চাকা ছাড়া গাড়ির মতো, হৃদয় ছাড়া ডলফিনের মতো, চোখ ছাড়া পাখির মতো…”
“পাগল ছাগল!”
“তুমি তোমার স্বামীকে পাগল বলতে পারো না ইলা। পাপ হবে।”
“পাগলকে পাগল বললে পাপ হয় জানতাম না তো?”
“এই ঐই…তুমি শার্টটা কোথায় পেলে? এটা তো আধঘন্টা ধরে খুঁজলাম।”
“চোখের মাথা খেয়েছ, পাবে কী করে?”
“ওগো শুনছো…”
ইলা বিড়বিড় করে বলল, “পুরো গেছে মাথা…”
“এই শোনো না…”
“হোয়াট?”
“তুমি আমার জীবনে কী সে বুঝে গেছি।”
“কী?”
“লবণ।”
“লবণ?”
“হ্যাঁ, ওইযে রাজার গল্পটা পড়েছিলে না? লবণের মতো ভালোবাসে…”
“চুপ করে বসো তো। কাজ করতে দাও।”
“একটু এখানে আসো না। কফিটা খেয়ে তারপর কাজ করো।”
ইলার প্রস্তাবটা পছন্দ হলো। সে কফি নিয়ে বসল কাননের পাশে। কানন আরেকটু কাছ ঘেঁষে বসে বলল, “এবার সিরিয়াসলি শুনবে তুমি আমার জীবনে কী?”
“না, আগ্রহী নই।”
কানন এক চুমুকে কাপ খালি করে ইলার কোলে ধপ করে শুয়ে পড়ে বলল, “আমি নিজেও জানি না।”
“এই সরো সরো, কাজ আছে আমার।”
কানন আরও গাঢ় করে ইলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমরা যাচ্ছি পরশু। কালকের পুরো দিন আছে। অনেক গোছগাছ করা যাবে। এখন একটু পতিসেবা করো। মাথা টিপে দাও।”
ইলা আর বাক্যব্যয় না করে কাননের মাথা টিপে দিতে শুরু করল। কানন খুব দ্রুত ঘুমাতে পারে। এবারও ঘুমিয়ে গেল। আশ্চর্য! ঘুমের মধ্যেও একটু পর ইলার হাতটা তার মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আর লাগবে না, তোমার হাত ব্যথা হয়ে যাবে।”
***
তুলন কফিশপের জানালা দিয়ে দেখল মুষলধারে বৃষ্টিতে বহুকষ্টে মাথা বাঁচিয়ে লোকটা ভেতরে ঢুকল।
তুলন উঠে দাঁড়াল তাকে দেখে। সৌম্য নামক লোকটা বলল, “আরে বসুন বসুন।”
দু’জনে বসল মুখোমুখি। তুলন বলল, “না এলেও পারতেন। হঠাৎ এত বৃষ্টি নামবে কে জানত!”
“না এসে কি পারি? আপনি ডাকলেন!”
কথার সুরটা একটু কেমন যেন। তুলন চোখ তুলে তাকাল। সৌম্যর দৃষ্টিও আজকে অন্যরকম লাগছে। সে কিছু বলার আগেই সৌম্য বলল, “আমি তুতুনের মায়ের সাথে চার বছর প্রেম করে বিয়ে করেছি ম্যাম! চোখের ভাষা বুঝব না? আপনি আমাকে কেন ভালোবাসেন বলবেন?”
তুলন মাথা নিচু করে বলল, “জানি না।”
সৌম্য বলল, “কথা হলো, আপনার বাসায় রাজি হবে?”
“জানি না।”
“কী জানেন?”
“জানি না।”
হো হো করে হেসে ফেলল সৌম্য। এই মানুষটা সবসময় ফর্মাল কথাবার্তা বলেছে তুলনের সাথে। আজ এত ফ্রি হয়ে গেল কেমন করে! এত মন খুলে কথা বলছে যেন তাদের কতদিনের পরিচয়! এই মানুষটা এতটা মনখোলা হতে পারে কে জানত!
সৌম্য বলল, “আমার কেন ডিভোর্স হয়েছে শুনবেন?”
“কেন?”
“কারণ আমি মানুষটা বেরসিক।”
“কে বলেছে?”
“যে ছেড়ে গেছে সে। তার নতুন স্বামী খুব রোমান্টিক।”
“আমার বিশ্বাস হয় না।”
সৌম্য আবার হা হা করে হাসল। খুব আনন্দ পাচ্ছে যেন৷ বলল, “আমাকে বিয়ে করলে এই শর্তে করতে হবে যে যতই বোর হন না কেন ছেড়ে যেতে পারবেন না।”
“আপনি যে বলেছিলেন আপনার ছেলেকে খুব যত্ন করবে এ-ই শর্তে কাউকে বিয়ে করবেন?”
সৌম্য একটু ঝুঁকে এসে বলল, “এই শর্ত আগেই পূরণ হয়ে গেছে তো। তুতুনের ক্লাস টিচার তাকে খুব আদর করে। ভাবছি তাকেই বিয়ে করে নেব।”
তুলন লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল।
ফেরার সময়ও দেখা গেল বৃষ্টি পড়ছে৷ সৌম্য রাস্তা পার হওয়ার সময় তুলনের হাত শক্ত করে ধরল। রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার পরেও হাত ছাড়ল না। যেতে যেতে বলল, “ভালোবাসার রূপ-রস-গন্ধ কিচ্ছু হয় না। শুধু অনুভব হয়। এই অনুভবটুকু আশ্রয় করে সারাজীবন কাটাতে হয়। অনেক স্যাক্রিফাইজ করতে হয় এই অনুভবের টিমটিমে বাতিটা জ্বালিয়ে রাখতে। আপনি আরো ভেবে সিদ্ধান্ত নিন।”
তুলন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি এই অনুভূতির সন্ধান জীবনে প্রথমবার পেয়েছি। তাকে কি আমি যেতে দিতে পারি?”
সৌম্য কিছু না বলে তাকিয়ে রইল তুলনের দিকে। তুলনের নাকের ডগায় এক বিন্দু পানি জমেছে। এই অদ্ভুত সুন্দর মেয়েটা কেন তাকে এত ভালোবাসে কে জানে!
***
“আচ্ছা সিলেটেও কি এমন বৃষ্টি থাকবে?”
“ওখানে আরও বেশি বৃষ্টি থাকবে। হরদম বৃষ্টি!”
“তাহলে ঘুরব কেমন করে?”
“ঘুরব কেন? চা বাগানের ভেতর আমাদের রিসোর্ট। দিনরাত বসে বসে বৃষ্টি দেখব।”
“অনেক মজা হবে তাই না?”
“হ্যাঁ তাই! এখন ঘুমাও তো। দেখো বাসের সবাই আরাম করে ঘুমাচ্ছে।”
ইলা ঘুমাল না। চোখ বুজে নিজের পূরণ হওয়া স্বপ্নগুলোর দিকে চেয়ে রইল অক্লান্ত দৃষ্টিতে। পৃথিবীটা বড্ড সুন্দর। শুধু মাঝেমাঝে কিছু অসুন্দর সময় আমাদের উপহার দেয়, অসুন্দর স্মৃতি জমা করে মাথায়, যাতে সৌন্দর্যটা আমাদের চোখে আরও মোহনীয় হয়ে ধরা দেয়।
শেষ রাতে বাস থেকে নামল তারা। ইলার চা বাগান দেখা হলো ভোরের দিকে। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। অপরূপ রাঙা আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র এক মানুষ মনে হতে লাগল তার। স্বপ্নের জীবন্ত রূপ দেখে অভিভূত সে হাজারো ধন্যবাদ দিল সৃষ্টিকর্তাকে। হঠাৎ কী মনে হতেই কাননের দিকে তাকাল সে। কাননও তার দিকে তাকিয়ে আছে ঘোর লাগা চোখে। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ভেসে যাওয়া চরাচরের অপরূপ লবণ্যের চাইতেও মায়াময় একটা মানুষকে কেমন করে লাগতে পারে?
(সমাপ্ত)
** গল্প শেষে সবার গঠনমূলক সমালোচনা আশা করব। অনেক কষ্ট করে শুধু আপনাদের জন্যই এই গল্প শেষ পর্যন্ত লেখা হয়েছে।**