#বেলীফুল
পর্ব-৯
রইসুদ্দিনের ঘুম থেকে উঠে মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠল! ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল সে। বমি বমি পাচ্ছে৷ এসব কিসের লক্ষণ? সে কি মারা যাচ্ছে? খাটের হাতল ধরে বসে রইল সে। ধাতস্থ হতে সময় নিচ্ছে। কিন্তু ক্রমেই শরীর আরও বেশি অবসন্ন হয়ে পড়ছে। মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা। নিজের অজান্তেই শুয়ে পড়ল রইসুদ্দিন। নিজের বহুদিনের রুটিন ভেঙে।
শুয়ে শুয়ে অদ্ভূত সব দৃশ্য দেখতে লাগল সে। অতীতের ঘটনাগুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগল খন্ডচিত্র হয়ে।
সাজিদের জন্মের দিনটা! সায়মার কী ভীষণ প্রসব বেদনা হচ্ছিল! রইসুদ্দিন পাশে বসে ভয়ে কাঁপছিলেন৷ তার মনে হচ্ছিল অশুভ কিছু হবে। সায়মাকে যখন অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হলো, তখন তিনি মূর্ছা গেলেন৷ বহু চেষ্টায় তার জ্ঞান ফেরানো হলো। জ্ঞান ফেরার পর দেখতে পেলেন ফুটফুটে রাজপুত্রের মতো একটা ছেলেকে কোলে নিয়ে তার কাছে এসেছে নার্স। ছোট্ট বাচ্চা গভীর কালো চোখে তাকে দেখছে।
তারপর দৃশ্য পালটে গেল। অনেকগুলো বছর পরের কথা। সাজিদের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে। বরাবরের মতো চমৎকার রেজাল্ট তার। নিজের টাকায় মিষ্টি কিনে এনেছে। কী যে খুশির দিন! রইসুদ্দিন মিষ্টি খেয়ে সায়মাকে বললেন, “এক কাপ চা করো তো।”
সাজিদ আবদারের গলায় বলল, “আম্মু আমিও চা খাব৷ দুটো এলাচ দিও চায়ে।”
সায়মা চা বানাতে গেল। হঠাৎ দুম করে শব্দে চমকে দুজন রান্নাঘরে গেল। গিয়ে দেখে সায়মা পড়ে আছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তৎক্ষনাৎ হাসপাতালে নেয়া হলো। কিন্তু সব আরও আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আরও কয়েকদিন পরের কথা। সায়মার কবরের কাছে ফুল দিতে গিয়েছিলেন তিনি৷ গিয়ে দেখেন কবরের মাঝে ফাটল ধরেছে। কিছু অংশ হা হয়ে আছে। গাঢ় অন্ধকার কবরের ভেতর। এরপর থেকেই আর আলো সহ্য হয় না তার।
সাজিদ অনেকবার ফোন করেও বাবাকে পেল না। চিন্তিত হয়ে সে বাবার বাসায় রওনা দিল। একটা বাড়তি চাবি থাকে তার কাছে। সেটা দিয়েই দরজা খুলল। প্রথমটায় অন্ধকারে কিছু ঠাহর করতে পারল না। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করল সুইচবোর্ড। লাইট জ্বালিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। শোবার ঘরে বাবাকে পাওয়া গেল। নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে। সাজিদের বুকের ভেতরটা আচমকা আঘাতে মুচড়ে যেতে থাকল। কম্পিত পায়ে বাবার বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। একটা হাত রাখল বাবার বুকের ওপর। তারপর ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।
★
কানন অফিসে গিয়ে শুনল এক সহকর্মী মারা গেছেন, অফিস ছুটি। সহকর্মীর মৃত্যু কাননকে স্পর্শ করল না, কারণ লোকটাকে সে ঠিকমতো চেনে না। কারো সাথেই তার তেমন সম্পর্ক নেই। নিজের মতো মুখ বুজে কাজ করে, তারপর বাড়ি ফিরে যায়। হঠাৎ ছুটি পেয়ে কী করবে বুঝতে পারল না। বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। গন্তব্যহীন এলোমেলো যাত্রা।
আশেপাশের মানুষ দেখতে ভালোই লাগছে। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। সকালের সময়টাতে মানুষ ব্যস্ত থাকবেই। শুধু চায়ের দোকানের কিছু লোক খবরের কাগজ পড়ছে আলস্য নিয়ে।
সে খানিক এগিয়ে গিয়ে বসল একটা বাসস্ট্যান্ডের বেঞ্চিতে। সকালে কেউ এখানে বসে নেই। বেঞ্চের পেছনটায় লতাপাতার জঙ্গল। রাতে বোধহয় এখানে বসে গাঁজা খায় ছেলেপেলে। একটা বাদাওয়ালার কাছ থেকে দশ টাকার বাদাম কিনে ধীরেসুস্থে চিবুতে শুরু করল সে। সাথে মোবাইলটা কী মনে করে বের করল। ফেসবুকে ঢুকতেই ইলার মেসেজ, “কী করছেন?”
মেসেজ এসেছে গভীর রাতে। পাগল ছাগল মেয়ে। ধরে আচ্ছামতো ধোলাই দিলে ঠিক হয়ে যাবে। এই বয়সে এমন পাগল হয়ে বসে আছে!
এসন ভাবতে ভাবতেও কানন উত্তর দিয়ে বসল, “বাদাম খাই। খাবে?”
সাথে সাথে উত্তর এলো, “আপনি অফিসে বসে বাদাম খাচ্ছেন?”
“না বাইরে।”
“কেন?”
“এমনি।”
“কোথায় বলেন তো? আমি আসি?”
কানন মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে রাখল। আর ভালো লাগছে না৷ ফিরতি পথ ধরল সে। দুপুরে জন্য কিছু খাবার নিয়ে গিয়ে খেয়েদেয়ে লম্বা ঘুম দেবে। ঘুমানো ছাড়া সময় কাটানো কষ্টকর।
ফেরার পথে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল সে। হলুদ রঙের শাড়ি পরিয়ে রেখেছে একটা মেনিকুইনকে। কী সুন্দর লাগছে! পুতুলটার শরীরের গঠন কিছুটা ইলার মতো। ইলাকেও শাড়ি পরলে সুন্দর লাগে। এই শাড়িটা মানাবে খুব! কিন্তু সে ইলার জন্য কেন শাড়ি কিনবে? এই কাজটা করলে মেয়েটা আরও মাথায় চড়ে বসবে।
কানন হনহন করে এগিয়ে গেল দোকানের সামনে থেকে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু