#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৩য়_পর্ব
খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠে,
– সময়টাও ঠিক মতো বলতে পারলি না, এক বছর নয়, এক বছর দুই মাস তের দিন। যখন আমার তোকে সবথেকে বেশি দরকার ছিলো, তখন আমি তোকে কাছে পাই নি। তোর কাছে আব্রাহাম কোনোদিন তোর ছেলে ছিলোই না, ও শুধুমাত্র এক রাতে ভুল ছিলো। তুই তো ওকে এবোর্ট করতে চেয়েছিলি। সত্যি বলতে আজ থেকে কয়েকমাস আগেও যদি তুই এই কথাগুলি বলতি আমি মেনে নিতাম। আমি হয়তো তোর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তোকে ক্ষমা করে দিতাম, তোর সাথে পরিবার সাজানোর কথাও ভাবতাম। কিন্তু আজ না, কাল তোর দাদীজান আবার যখন আদেশ দিবে তুই আবার আমাকে একা করে দিবি। আফটার অল, তুই কোম্পানির মালিক বলে কথা। এতো সব কিছু পেয়ে সেগুলো ছেড়ে দেওয়ার মতো সাহস কি আদৌ আছে তোর?
– আমি সত্যি বলছি, তুই একবার আমাকে বিশ্বাস করে দেখ। আমি দাদীজানকে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু উনার অন্যায় আবদার আর মেনে নিবো না। প্লিস রাইসু।
– রাইসু না রাইসা। রাইসা ইসলাম, আমার সাথে তোর কোনোদিন কোনো ছিলো ও না, হবে ও না। ভালো তো বেসেছি, তার শাস্তিও পাচ্ছি। তাই অহেতুক আর কথা বাড়াবো না। আমার তাড়া আছে, নিজের সময় নষ্ট করিস না।
বলেই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আবরার হাত টেনে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। কানে মুখ লাগিয়ে বলে,
– বড্ড বেশি অভিমান জমে গেছে, আজ হয়তো আমার কথায় তোর বিশ্বাস হবে না। কিন্তু কথা দিচ্ছি তোর অভিমানগুলোকে আবার ভালোবাসায় পরিণত করবো। নিজেকে তোর এবং আব্রাহামের যোগ্য প্রমাণ না করা অবধি আমি যাচ্ছি না। আমি এজন্য ভালোবাসি না যে তুই আমার বাচ্চার মা, আমি তোকে ভালোবাসি কারণ তুই আমার রন্ধ্রে মিশে আছিস। তোকে যে আমার চাই, খুব করে চাই। তুই আমার হতে বাধ্য।
রাইসা কোনো রকম ধাক্কা মেরে আবরারকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়। আবরার টাল না সামলাতে পেরে খানিকটা দূরে সরে যায়। রাইসার রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
– নিজের পাওয়ারের গরম অন্যখানে দিস, আমার কাছে না। কিসের বাধ্য? আমি তোর কাছে কোনো কিছুর জন্য বাধ্য নই। আজ স্পষ্ট শুনে রাখ, আমার জীবনে তোর অস্তিত্ব নেই। আমি তোকে ভালোবাসি না। চলে যা এখান থেকে প্লিজ।
– সেটা সময় বলে দিবে।
রাইসা কথা না বাড়িয়ে গটগট করে সেখান থেকে চলে গেলো। আবরার রাইসার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে আশ্বস্ত করে,
– আমি পারবো, আমাকে যে পারতেই হবে। প্রমিস করসি, যদি তোর মনে নিজের জন্য জায়গা না করতে পারি তবে আর কোনোদিন তোর সামনে আসবো না। কিন্তু আমি এতো তাড়াতাড়ি হাল ছাড়বো না।
এক সপ্তাহ পর,
সকাল ১০টা,
একটা জরুরি কাজের জন্য অয়ন সামির সাথে দেখা করতে এসেছে। মাস খানিক হয়ে গেছে অয়ন সামির সাথে দেখা করে নি। এখানে এসে জানতে পারে সামি আপাতত দেশে নেই। যেকারণে সামির বড় ভাই আসফির সাথেই মিটিং টা কমপ্লিট করতে হবে। আবরারের অবর্তমানে আনোয়ার কোম্পানি এন্ড লিমিটেড এর সাথে প্রজেক্টটা অয়নকেই কমপ্লিট করতে হবে। এতোদিন পর অয়নকে দেখে আসফি তাকে জড়িয়ে ধরে।
– বেশ শুকিয়ে গেছিস, খাওয়া দাওয়া কি কিছুই করছিস না?
– আর খাওয়া দাওয়া, প্রাপ্তির হাতের রান্নার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর লোকমান কাকার রান্নাও ভালো লাগে না। তোমার খবর বলো, শুনলাম বিয়ের পর নাকি ভাবি তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ করিয়ে দিয়েছে।
– আর গার্লফ্রেন্ড, এতোদিনের যত মেয়ে ফ্রেন্ড ছিলো তাদের ব্লকলিস্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। বু মানেই প্যারা।
– যাক প্যারাটা কারো লাইফে তো আছে।
– তুই কি আর বিয়ে শাদি করবি না?
– যদি কোনোদিন আমার মায়াবতী ফিরে আসে, তখন? তখন তাকে কি উত্তর দিবো বলো? তার অবর্তমানে অন্যকাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছি জানলে আরোও রেগে যাবে ও। আমি ওর স্মৃতি আঁকড়ে ভালোই তো আছি।
– সত্যি ভালো আছিস তো?
– তুমি কি কথাই বলবে? নাকি মিটিং শুরু করবে?
– আচ্ছা, আচ্ছা চল।
অপরদিকে,
আজ এক সপ্তাহ হয়েছে, নিশানের বন্ধুর সাহায্যে এই কোম্পানিতে জব পেয়েছে প্রাপ্তি। একজন কলিগ সামিয়ার সাথে একটা ছোট বাসায় থাকছে সে। মেয়েটি খুবই ভালো, একা একা এতো ভাড়া দেওয়াটা কষ্টকর হয়ে গিয়েছিলো তাই প্রাপ্তিকে তার সাথে থাকতে প্রস্তাব দেয়। শহরে অন্য কোথাও থাকাটাও সুবিধার মনে হচ্ছিলো না দেখে প্রাপ্তিও রাজি হয়ে যায়। প্রতিদিনের মতো নিজ ডেস্কে বসে কাজ করছিলো তখন প্রাপ্তির সিনিয়র এসে জানায়,
– খুশবু, তোমাকে বস ডাকছে মিটিং রুমে। কাল যে ফাইলটা তোমাকে দিয়েছিলেন ওইটাও সাথে নিয়ে যেও। ফাইলটি কমপ্লিট হয়েছে?
– বস তো ক্লাইন্টের সাথে মিটিং এ আছেন। এখনই কি যাবো আমি?
– হ্যা, ফাইলটা ক্লাইন্ট দেখতে চেয়েছে। তুমি গেলেই বুঝবে।
– ঠিক আছে।
মিটিং রুমে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকেই প্রাপ্তি বললো,
– মে আই কাম ইন, স্যার?
– আরে খুশবু, ভেতরে আসো।
ফাইলটি ভেতরে ঢুকতেই প্রাপ্তির হাত পা জমে গেলো, মাথাটা মূহুর্তে ফাকা হয়ে গেছে। ভেতরে বসে থাকা মানুষটি যে তার খুব পরিচিত। চার মাস পর মানুষটিকে দেখছে সে। আজ যার কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় এই শহরে তার আগমন, সেই মানুষটির সাথে অতর্কিতে তার দেখা হয়ে যাবে এটা তো জানা ছিলো না। মানুষটা বড্ড শুকিয়ে গেছে, যে চোখের ভাষা এক সময় বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিলো তাকে আজ সেই চোখ যেন গর্তের কোটরে চলে গেছে। লোকটাকে দেখে আজকেও মায়া লাগছে। যার রাগ জিদের পুরো ঘর কাঁপতো, আজ বড্ড শান্ত লাগছে লোকটাকে। তার জীবনে তো নতুন মানুষ চলে এসেছে তবে কেনো এতোটা উদাসীন লাগছে তাকে! আসফির কন্ঠস্বর ঘোর ভাঙ্গায় প্রাপ্তির।
– দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো, ফাইলটা উনাকে( অয়নের দিকে ইশারা করে) দাও।
– জ্বী স্যার।
এতোক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলেও প্রাপ্তির বলা “জ্বী স্যার” যেন ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে অয়নের। বারংবার প্রাপ্তিকে পাবার আশা এতোটাই নিরাশ করেছে যে আজ আবার সেই আশাটুকুকে পুনোরায় সজাগ করতে মন চাইছে না। চোখ তুলে যদি দেখে মানুষটা ভুল তখন কি করবে? মস্তিষ্কে প্রাপ্তির কথা এতোটাই গেঁথে গেছে যে নিজেই নিজেকে পৃথিবী থেকে আলাদা করিয়ে ফেলেছে। সারাক্ষণ মনে হয় আশেপাশে প্রাপ্তির ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়েছে সে, আবার আশাহত হবার মতো মনের জোর আর যে নেই। তবুও মাথা উঁচিয়ে সামনে বসে থাকা মানুষটির দিকে তাকায় সে। মানুষটি যে আর কেউ নয় প্রাপ্তি, তার মায়াবতী। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে এক মূহুর্ত না দেরি করে জড়িয়ে ধরলো তার মায়াবতীকে।
– প্রাপ্তি, তুমি ফিরে এসেছো। সত্যি ফিরে এসেছো তুমি? কেনো ছেড়ে গিয়েছিলে আমায়? তোমার রাগ হয়েছিলো আমার উপর আমায় বকতে পারতে, তুমি যা শাস্তি দিতে আমি মাথা পেতে নিতাম। তুমি জানো, এই চার মাস পাগলের মত খুঁজেছি তোমায়। কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি?
অয়নের কাছ থেকে কোনো মতে নিজেকে ছাড়িয়ে বলতে লাগলো প্রাপ্তি,
– আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে স্যার। আমি প্রাপ্তি নই, প্লিজ পাবলিক প্লেসে এমন অসভ্যতা করবেন না।
– প্রাপ্তি এভাবে কেনো বলছো? আমার প্রাপ্তিকে আমি অন্ধকারের মাঝেও চিনে নিবো। তুমি এভাবে কেনো বলছো?
– আবার বলছি আমি প্রাপ্তি নই। আমি আপনাকে চিনি না।
এবার মেজাজ খারাপ হতে লাগলো অয়নের। প্রাপ্তি কেনো নিজেকে তার থেকে আড়াল করতে চাইছে? এতোটা রাগ জমে আছে যে সে অয়নকে চিনতে চাইছে না। নিজেকে সংবরণ করে অয়ন আবার প্রাপ্তির কাছে যায়, তার হাত দুইটি প্রাপ্তির গাল আলতো করে ছুয়ে বলে,
– প্রাপ্তি, তুমিও জানো আমিও জানি তুমি ই আমার প্রাপ্তি তাহলে কেনো অস্বীকার করছো তুমি? রাগ হচ্ছে বলতে পারো, এভাবে আমাদের সম্পর্কটা অস্বীকার তো করো না।
অয়নের হাত দুটো ছিটকে চেঁচিয়ে উঠে প্রাপ্তি,
– বারবার অসভ্যতা কেনো করছেন?? আমি প্রাপ্তি নই আমার নাম খুশবু। আপনি বারবার কেনো জোর করে যাচ্ছেন। আমি আজকের আগে আপনাকে দেখিও নি। স্যার, এইযে আপনার ফাইল। প্লিজ আমি আসছি।
বলেই মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলো প্রাপ্তি। দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে, পানি ছেড়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। সে তো চেয়েছিলো এই মানুষটির সাথে জীবন কাঁটাতে। চলে গিয়েও ফিরে আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু এই মানুষটার জীবনে তো অন্যকার আগমণ ঘটে গেছে। কেনো ফিরবে সে? এক সপ্তাহ আগে তার এনগেজমেন্ট ও হয়ে গেছে। তাহলে আজ তাকে দেখে এতোটা অনুনয় কেনো করছিলো। কেনো তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো, মানুষটা ভাল নেই। গোলকধাঁধার মধ্যে নিজেকে যেনো আউলিয়ে ফেলেছে প্রাপ্তি।
অপরদিকে,
নিজেকে কিছুতে শান্ত করতে পারছে না অয়ন। তার মায়াবতী তাকে চিনতে চাইছে না। অয়নকে উত্তেজিত দেখে আসফি মিটিং রুম ফাকা করে ফেলে। অয়নের কাঁধে হাত রেখে তাকে বলে,
– তোর কোথাও ভুল হচ্ছে, মেয়েটি প্রাপ্তি নয়। ওর নাম খুশবু। এই এক সপ্তাহ হয়েছে ও এখানে জয়েন করেছে। ও তো ঢাকাতেও থাকে না, তোর কোথাও ভুল হচ্ছে।
– দুজন মানুষ এক চেহারার কিভাবে সম্ভব ভাই?
– সেই প্রশ্ন যে আমাকে ভাবাচ্ছে না তা নয়।
– এর শেষ আমি দেখে ছাড়বো। তুমি শুধু আমার একটি কাজ করে দিবে।
– বল কি কাজ?
আসফির সাথে কথা বলে সেখান থেকে বেরিয়ে পরে অয়ন। ডেস্কে এসে জানতে পারে সিকদার কোম্পানির প্রজেক্টটার দায়িত্ব প্রাপ্তিকে দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্তি খুব ভালো করে জানে এটা কার কারসাজি। তবে নিজেকে দূর্বল করবে না সে। অয়নকে এবার আর বিশ্বাস করবে না সে। প্রজেক্টের কাজ করতে করতে রাত ১১টা বেজে যায় প্রাপ্তির। একে তো সামিয়া চলে গেছে, উপরে রাত,, এই রাতে একা একা বাসায় যাবে কিভাবে এটা নিয়ে একটা চিন্তায় পড়ে গেলো প্রাপ্তি। অফিস থেকে বের হতেই কেউ একজন পেছন থেকে প্রাপ্তি মুখ চেপে ধরে। প্রাপ্তি কিছু বুঝার আগেই, কালো কাপড় দিয়ে চোখ মুখ বেঁধে তাকে একটি গাড়িতে উঠানো হয়। প্রাপ্তি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গোঙ্গাতে লাগলো। বেশ কিছু সময় পর গাড়িটি কোথাও থামলো। প্রাপ্তিকে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে ধাক্কা মারে অচেনা লোকটি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায় প্রাপ্তি। অচেনা লোকটি তখন প্রাপ্তিকে….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি