#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#১২তম_পর্ব
চাঁদরটা পেছিয়ে দাঁড়াতেই যা শুনলো তাতে মাটির নিচের জমি খসে পড়ে রাইসার।
আবরার এমন কিছু বলবে তা কল্পনাতেও আনে নি। আবরার তখন রাইসার দিকে ফিরে বলে উঠে,
– আবেগ আর নেশার তাড়নায় ভুল করে ফেলেছি, পারলে ক্ষমা করে দিস। কাল রাতে নেশার ঘোরে মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে। আমিতো নেশায় ছিলাম কিন্তু তোর বুঝা উচিত ছিলো। যাই হোক ইটস জাস্ট এ মিস্টেক
-……
– সকাল হয়ে গেছে, কালরাতে এই হোটেলের রুমে কি হয়েছে এটা এখানে দফন হয়ে থাকবে। তাই তোর সম্মানের কোনো হানি হবে না,, কথা দিচ্ছি। চল কিছু খেয়ে তোকে বাড়ি পৌঁছে দি।
-…..
– যা, ফ্রেশ হয়ে নে। আমি লবিতে আছি।
বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আবরার। মূহুর্তে সব স্বপ্নগুলো যেন দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে গেলো। কাল রাতের সব কিছু একটা স্বপ্ন ছিলো, যেনো একটা মিষ্টি স্বপ্ন যা ভোরের তীব্র আলোতে ঝলসে গেছে। মুখের চাপা কষ্ট, আর্তনাদ নোনতা জ্বলের রুপে চোখের ধার দিয়ে বেয়ে পড়ছে। এখন যদি মরে যেতে পারতো সত্যি হয়তো ভালো হতো, এই নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে মেনে নিতে হতো না। কি দিয়েছে এই সো কল্ড ভালোবাসা তাকে, কষ্টের একটা পাহাড় যা সারাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। হবেই তো, দোষ যে তার। মেয়েদের ই দোষ, ভালোবাসলে দোষ, বিশ্বাস করলে দোষ। আজ একটা মেয়ে নেশায় ভুত হয়ে এমনটা করে সকাল বেলা বলতো “যাই হোক, ইটস জাস্ট এ মিস্টেক ” তবে এই সমাজ তাকে নষ্টা বলতো। আবার এখন তাকেও সমাজ নষ্টাই বলবে। অথচ তার বিশ্বাস, ভালোবাসায় কি কোনো খুদ ছিলো। হয়তো ছিলো, হয়তো সে অপাত্রে দান করেছে তার ভালোবাসা। তাতে বাস্তবতা পাল্টাবে না, এটা “ইটস জাস্ট এ মিস্টেক” ই থাকবে।
রাইসা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়, গোসল করে লবিতে যায়। আবরার খাওয়ার কথা বললেও সে কোনো কথা ছাড়াই সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। এভাবে সময় কাটতে থাকে। আবরার ফোন করলেও রাইসা তার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে না। এর মাঝে দেড় মাস কেটে যায়। রাইসার বিয়ের ডেট ফিক্স হয়ে যাওয়ার পর হুট করেই শরীর খারাপ হতে লাগে তার। বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর জানতে পারে সে একা নয়, একটা ছোট্ট অংশ তার মাঝে বড় হচ্ছে। ঐ সময় হিতাহিত জ্ঞানটুকু হারিয়ে ফেলে রাইসা। উত্তেজিত হয়ে ফোন দিয়ে বসে আবরারকে।
– বাহ! এতোদিন পর কি মনে করে ফোন দিলি? শুনলাম বিয়ে করছিস, বিয়ের দাওয়ার দিবি নাকি?
– আবরার আই এম প্রেগন্যান্ট। চার উইক চলে, আমি কি করবো বুঝছি না।
– তুই পিলস খাস নি? লাইক সিরিয়াসলি? কিছুদিনের মধ্যে আমাকে দাদীজান সিকদার কোম্পানির উত্তরাধিকার ঘোষণা করবেন। এখন এই স্ক্যান্ডালের কথা জানতে পারলে বুঝতেছিস কি হবে?
– আবরার এটা তোর ও। আমার একার নয়।
– এটা একটা ভুল ছিলো রাইসা। এক রাতের আবেগ ছিলো। এখন তুই নিজে ভেবে দেখ, তুই কি রেডি এই বেবির জন্য নাকি আমি রেডি? আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটুকু ও নেই। দায়িত্বের বোঝা কাধে নিয়ে একটা সমঝোতার সম্পর্ক বয়ে নেওয়া কতোটা কঠিন, ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া।
– বেশ, তোর আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
– রাইসু আমার কথা শোন। এখন ইমোশনাল হওয়ার সময় না। বুঝার ট্রাই কর প্লিজ।
– যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে। তুই ভালো থাকিস।
– আচ্ছা, বেশ আমরা দেখা করি? তারপর ডিসিশন নেই? প্লিজ, মাথা খারাপ করে কোনো কাজ করিস না
– বেশ যেটা ভালো মনে করবি।
– আমি ৩০০ফিটের দিকে আসছি, তুই ওখানে ওয়েট করিস।
এটাই আবরার আর রাইসার শেষ কথোপকথন ছিলো। এরপর রাইসা পুরো ৬ ঘন্টা ঐ জায়গায় অপেক্ষা করেছিলো। দুপুর গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামলো রাইসার মাঝে বেঁচে থাকা আশাগুলো অস্ত সূর্যের ন্যায় ডুবে গেলো। তারপরের ঘটনা তো কারোর অজানা নয়।।
রাইসার মুখে সব কাহিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলো অয়ন। দায়িত্ব পালন করার ভয়ে আজ নিজের সন্তানকেই অস্বীকার করেছে আবরার। আব্রাহাম, তার নিজের ছেলে অথচ সে জানেই না। এখন এই ভাঙা পরিবারটাকে জোড়া লাগাতে হবে। এটা যে নিতান্ত জরুরি। তাই এক মূহুর্ত না ভেবে রাইসাকে ঠান্ডা মাথায় আবরারের এক্সিডেন্ট এবং বিয়ে সম্পর্কিত সত্যিটা বলে দিলো অয়ন। সব শুনে রাইসা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
– তোর দাদীজান তোকে কোনোদিন মেনে নেয় নি, আমাকে মানবে কিভাবে ভাবলি? আর আবরার সুস্থ হবার পর আব্রাহামকে পিতৃ পরিচয় দিবে এটার গ্যারেন্টি? থাক না ভালো আছি তো আমরা দুই মা-ছেলে। আর সত্যি বলতে আমি এই উত্তরাধিকারীর বাজে খেলায় আমার ছেলেকে জড়াতে চাই না। তুই আমার থেকে মহীমা সিকদারকে ভালো করে চিনিস। আমি আবরারের দয়া চাই না।
– ভাই সামনের মাসে ফিরবে। ওর তোমাকে দরকার কেনো বুঝছো না?
– যেদিন ও সেটার প্রমাণ দিতে পারবে সেদিন আমি বিশ্বাস করবো। আর এ নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।
অয়ন আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাড়ি চলে যায়। এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে তার পুরো পরিবার কিভাবে দেওয়া যেয় এই চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
দুই মাস পর,
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই বমি করছে প্রাপ্তি। শরীরটা দুই তিন ভালো যাচ্ছে না, ডাক্তার দেখাতে পারলে ভালো হতো। কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, মাসিক মিস হচ্ছে। কাউকে যে বলবে সেই সুযোগটুকু নেই। অয়ন কোম্পানি নিয়ে ব্যস্ত, উপর থেকে আবরার সুস্থতার পথে দেশে ফিরে আসবে এই সপ্তাহে। এদিকে রাইসা আর আব্রাহামকেও সামলাতে হচ্ছে। প্রাপ্তির দিকে তার নজর কই? এই নিয়ে খুব রাগ হয়, কিন্তু এই লোকটার প্রতি রাগ করার উপায় নেই। বড্ড বেশি ভালোবাসে যে তাকে। তাই একা একা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা ভাবে প্রাপ্তি। হুট করেই পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরলে হুশ ফিরে তার।
– কি ভাবছো?
– আমাকে নিয়ে ভাবার সময় আছে আপনার?
– তোমাকে নিয়েই তো ভাবি, আর কি নিয়ে ভাববো বলো। দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র বউ।
– তাই বুঝি? আজকে অফিস যাবেন না?
– হু যাবো, আচ্ছা রাতে তোমার জন্য খুব বড় সারপ্রাইজ আছে।
– কি সারপ্রাইজ?
– বললে তা সারপ্রাইজ হয়? রাতে জানবে
– ধুর, বলেন না?
– উহু, চলো খেতে চলো। আমি রেডি হয়ে নেই।
এই বলে অয়ন ফ্রেশ হতে চলে গেলো। আর প্রাপ্তির ভেবে ভেবে চুল ছেড়া হাল। খাওয়া দাওয়া শেষে অয়ন বেরিয়ে পড়ে। আর প্রাপ্তিও ডাক্তারের কাছে চলে যায়।
দুপুর ২ টা,
রিপোর্ট হাতে বসে রয়েছে প্রাপ্তি। আজ সে একা নয়, তার ভেতরে তার আর অয়নের ভালোবাসা বড় হচ্ছে। এই পরিবারটাই তারা দুজন এতোদিন কল্পনা করছিলো। আজ তাদের হাতে সুখের ঝুড়ি এসেছে। এই সুখ যেন পৃথিবীর সর্বোত্তম সুখ, সে যে মা হতে চলেছে। আজ তাদের বিয়ের ছয় মাস পূরণ হলো, মনে মনে ভাবছিলো কি গিফট অয়নকে দেয়া যায়। উপর ওয়ালা স্বয়ং পৃথিবীর সবথেকে বড় সুখ তাদের দিয়েছে। প্রাপ্তি রাতে এই খুশির খবরটা অয়নকে দিবে। হয়তো অয়ন সারপ্রাইজ দিতে যেতে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। এখন শুধু রাতের অপেক্ষামাত্র।
লোকমান কাকা দুপুরের দিকে মহীমা সিকদারের সাথে কথা বলে, কিছু কাজের লোককে ডেকে বলে দেয়,
– প্রাপ্তি মার কোনো অযত্ন যাতে না হয় তোমরা দেখবা।
– কেনো? উনি তো অয়ন স্যারের বউ।
– তো? এখন মালিক কে? অয়ন বাবা। তোমার কি মনে হয় প্রাপ্তি মা যদি এই তিন মাসের মধ্যে মা না হয় তাহলে সে মালিক থাকবে? আবরার বাবা ফিরে আসতেছে। তাই প্রাপ্তি মার কোনো অযত্ন করা যাবে না। এই সি.ই.ও হওয়া কি এতো সহজ? অয়ন বাবা এত কিছু কেন করতেছে? যাতে বড় ম্যাডাম খুশি হয়। প্রাপ্তি মারে সে কি ভালোবাসতো? সে তো প্রতিশোধ নিতে বিয়ে করছিলো। কিন্তু এখন বাসে, কেনো? কারণ প্রাপ্তি মা যত তাড়াতাড়ি এই পরিবারে উত্তরাধিকার দিবে তত পাকাপুক্ত ভাবে অয়ন বাবারে বড় ম্যাডাম মাইনে নিবে। এটাই তাদের ডিল। তাই যা বলি শোনো।
তাদের কথোপকথন পুরোপুরি প্রাপ্তি শুনে ফেলে। নিচে এসে অয়নের পছন্দের রান্না করতে এসে তাদের কথাবার্তা শুনে দাঁকড়িয়ে পড়ে সে। লোকমান কাকার কথাগুলো শুনে এক মূহুর্তের জন্য স্তব্দ হয়ে যায় সে। তাহলে কি এই কয়মাসের সুখ নিছক ছলনা ছিলো? ও শুধু উত্তরাধিকার পাওয়ার মাধ্যম কেবল অয়নের কাছে? না এটা সম্ভব নয়। অয়ন তাকে ভালোবাসে। এতো বড় ছলনা সে কখনোই করবে না তার সাথে। কিন্তু লোকমান কাকাও তো মিথ্যে বলবেন না। নিজের রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় প্রাপ্তি৷ ঝর্ণা ছেড়ে ধপ করে বসে পড়লো সে। কতো স্বপ্ন দেখেছিলো সে, সব যেন কাচের টুকরোর মতো ভেঙ্গে গেছে আজ। একজনকে আপন ভেবে আঁকড়িয়ে ধরেছিলো সে। সে ও তার সাথে এতো বড় ছলনা করলো। আজ প্রাপ্তির কাছে স্পষ্ট সে কেবলমাত্র একটি দাবার গুটি অয়নের জীবনে। কিন্তু তার অনাগত বাচ্চাটিকে এই দাবা খেলার গুটি হতে দিবে না সে। এই সিকদার ভিলায় এক মূহুর্ত থাকবে না সে। অয়নের ছায়াও পড়তে দিবে না সে বাচ্চাটির গায়ে।
সন্ধ্যা ৭টা,
রাজপথে হেটে চলেছে প্রাপ্তি। শরীর যেন চলতে চাচ্ছে না, গন্তব্য অজানা তবু হেটে চলেছে প্রাপ্তি। শুধু একটা নোট লিখে চলে এসেছে সে।
” আমাকে ক্ষমা করবেন অয়ন, আপনার সিকদার পরিবারের উত্তরাধিকার খেলার দাবার গুটি আমি আর হতে পারবো না। আল্লাহ যাতে আপনার সামনে আমাকে আর কোনোদিন না আনে। ভালো থাকবেন”
চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, দুঃখ আর কষ্টের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত প্রাপ্তি। ঘোলাটে লাগছে সবকিছু। সামনে একটি গাড়ি, অথচ নড়তে ইচ্ছে করছে না প্রাপ্তির। সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। গাড়িটি তার বেগে ছুটে আসছে প্রাপ্তির দিকে।
লোকমান কাকার ফোন পেয়েই বাড়ি এসে প্রাপ্তিকে না পেয়ে পাগলের মতো খুজতে লাগলো অয়ন। রুমে খুজতে খুজতে প্রাপ্তির লেখাটা হাতে পড়লো তার। ধপ করে নিচে বসে পড়লো সে। এই একটা ভয় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো তাকে তাহলে কি প্রাপ্তিকে হারিয়ে ফেললো সে? পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। সে যে পারবে না প্রাপ্তিকে ছাড়া থাকতে। এর মধ্যে রিয়াদের ফোন আছে অয়নের কাছে। ফোন ধরতেই
– স্যার একটা লাশ পাওয়া গেছে, আমার মনে হয় এটা ম্যাডামের লাশ।
সমাপ্ত
( অসমাপ্তিতে সমাপ্তি টানলাম। কিন্তু এখানে সমাপ্তি নয়, এ কেবল প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি। আপনারা যদি চান আগামীকাল থেকে #ভালোবাসার_উষ্ণতা গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায় শুধু করবো। আপনাদের গল্পটি কেমন লেগেছে জানাবেন। এতোদিন এতো ভালোবাসা দেবার জন্য ধন্যবাদ। দ্বিতীয় অধ্যায়টিকে এমন ভালোবাসা দেবার আবদার রইলো)
মুশফিকা রহমান মৈথি
১১তম পর্বের লিংক /