ভালোবাসার রংমশাল পর্ব-১১

0
2512

#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১১
#সিফাতী সাদিকা সিতু

সাম্যর খুব কাছের বন্ধু ছিল মারুফ। কলেজ পর্যন্ত একসাথে পড়াশোনা করলেও সাম্য রাজশাহী ভার্সিটিতে চান্স পেলে সে চলে যায়।মারুফ ঢাকাতেই পড়ে।সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চললেও সাম্য হঠাৎ খবর পায় মারুফ আত্মহত্যা করেছে!সাম্য পাগলের মতো ছুটে এসেছিলো। কেউ কোনো কারণ জানতে পারে না।ভালো পরিবারের একটা ছেলে এভাবে আত্মহত্যা করবে তা কেউ মেনে নিতে পারেনি।মারুফের পরিবারের পাশে দাঁড়ায় সাম্য।একদিন সে মারুফের ঘর থেকে মারুফের ফোনটা পায়।মারুফের ফোন ঘাটার পর তার মাথায় বজ্রপাত হয়!নিঝুমের সাথে মারুফের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো!সাম্যর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।”নিঝুম অরন্যে” নামের আইডির সমস্ত মেসেজ, নিঝুমের ছবি গুলো দেখে সাম্য ছুটে গিয়েছিল নিঝুমের কাছে। নিঝুম অস্বীকার করে। সে নাকি এসবের কিছুই জানে না। নিজের আইডি বের করে সাম্যকেও দেখিয়েছিল।সাম্য নিঝুমকে বিশ্বাস করে নি।সাম্য পারতো অনেক কিছুই করতে।বড় মা, বড় বাবার জন্য কিছু করতে পারে নি।পাচঁ বছর ধরে নিরবে,নিভৃতে যাকে ভালোবেসে এসেছে সেই মানুষটার কারনে মারুফ আত্মহত্যা করেছে!সাম্য নিঝুম,মারুফের সমস্ত মেসেজ গুলো পরেছিলো।ফেসবুকেই প্রেম হয় ওদের,এক সময় নিঝুম জানায় মারুফকে সে ভালোবাসেনি,নিঝুমের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। কিন্তু মারুফ তা মেনে নিতে পারিনি।সে নিঝুমকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল। নিঝুমের দেয়া ধোঁকা মানতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছে।মারুফ ছোট থেকেই খুব ইমোশনাল ছিলো।খুব নরম মনের ছেলে।পরিবারের ভীষণ আদরের ছেলে ছিলো সে।

আজ তার সামনে আসল সত্যিটা এসেছে দাড়িয়েছে।সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে সেই কখন,রাত নেমেছে। সীমা চলে গেছে অনেক আগেই।সাম্য এখনো বসে আছে একি অবস্থায়।পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই! অথচ আজ তার চোখ বেয়ে কেন নোনাজল গড়াচ্ছে? নিজের ভালোবাসাকে এতোদিন ধরে ভুল বুঝে এসেছে, কত অপমান করেছে,নিজেও ধুঁকে ধুঁকে মরেছে তীব্র কষ্টে। আজ কোন মুখে দাড়াবে সে নিঝুমের সামনে।ওই মায়াবী মুখটাকে সে বিশ্বাস করেনি,কেন করতে পারেনি?সাম্য যেন দুমড়ে মুচড়ে গেল।আজ তার ভালোবাসার জয় হলেও সে হেরে গেল নিজের কাছে।নিঝুমের ওপর থেকে সমস্ত ঘৃণা উঠে গিয়ে নিজের ওপর ভর করলো।সে একটুও ভালো নয়,নিজের হৃদয়ের রাণীকে সে কত কষ্ট দিয়েছে!

নিঝুমের ছোট চাচা সাম্যকে খুঁজতে বেড়িয়েছে।গ্রামে রাত নামলে অন্যরকম পরিবেশ হয়।সাম্য তেমন কিছু চেনে না, জানে না তারপরও কোথায় গিয়েছে? ছোট চাচা প্রায় সব জায়গায় খুঁজে পুকুর ঘাটের দিকে আসলো। আবছা আলোয় দেখলো সাম্যকে।কাছে এসে সাম্যর ঘাড়ে হাত রাখলেন। সাম্য চমকে উঠলো।নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে দাঁড়ালো।

আশফি কফি হাতে ছাঁদে উঠলো। দোলনায় দোল খেতে খেতে রাতের আকাশের মিটিমিটি জ্বলা অগণিত তাঁরা গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুদিন ধরে উদাস হয়ে আছে কেন তার মন?কোনো কিছুতেই ভালো লাগে না।সবকিছু এলোমেলো লাগে কেন?

ফোনটা হাতে নিয়ে নিঝুমের নম্বরে ফোন করলো। আশফিকে অবাক করে দিয়ে ওপাশ থেকে মৃদু রিনিঝিনি সুরে ভেসে আসলো নিঝুমের কথা।

হ্যালো, কে বলছেন?

আশফির হার্টবিট যেন দ্বিগুণ হলো।গলা শুকিয়ে আসলো তার।তবুও সাহস করে বলে ফেললো,

“আমি আশফি রহমান বলছি।”

ফোনের ওপাশ থেকে নিঝুম খুব অবাক হলো। কোনরকমে সালাম দিলো।

আশফি সালামের জবাব দিয়ে বললো,”কেমন আছো?ক্লাসে আসছো না কেন?”

“স্যার,আমি গ্রামের বাড়িতে এসেছি।শহরে ফিরেই ক্লাসে আসবো।”

আশফি কি কথা বলবে ভেবে পেল না।চুপ করে থেকে বললো,”এটা জানার জন্যই ফোন করলাম।ভেবেছি আবার অসুস্থ হলে কিনা, তাই অফিস থেকে তোমার নম্বরটা নিয়েছি।”

“আমি এখন সুস্থ স্যার।”

“ওকে,রাখছি। “আশফি ফোনটা কেটে দিলো। আটকে রাখা নিশ্বাসটা ছেড়ে দিলো।

ফোনটা কেটে যাওয়ার পরও নিঝুম ঘোর থেকে বেরোতে পারলো না।আশফি স্যার তার খোঁজ নেয়ার জন্য নিজে থেকে ফোন করতে পারে! নিঝুমের কেন যেন খুব ভালো লাগলো।এই প্রথম পরিবারের বাইরে কেউ একজন তাকে নিয়ে ভাবলো।স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। সত্যি মানুষ হিসেবে আশফি স্যার অনেক ভালোএকজন মানুষ।নিঝুম সেদিন মাথা ঘুরে পরে যাওয়ার আগে আশফি স্যার এসে তাকে ধরে ফেলেছিলো তা না হলে নিচে পড়ে গেলে মাথা ফেটে যেত।ক্লাসে ফিরে স্যারকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে।

***
সাম্য রাতে কোনরকম একটু খেলো।চাচা,চাচীরা একটু জোড় করাতে খেতে হলো। গলা দিয়ে নামছিলো না খাবার।নিঝুমের দিকে আজ তাকাতে পারছে না সে।তাড়াতাড়ি খেয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পরলো সে।নিঝুম ঘরে ঢুকে সাম্যকে শুতে দেখে একটু অবাক হলো।গতকাল তো এতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পরেনি!মুখে কিছুই বললো না সে।চাচীর ঘরে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই সাম্যর ডাকটা কানে এলো।

“নিঝুম একটু এদিকে আসবে?”

নিঝুম থমকে গেল।ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে হেটে আসলো বিছানার কাছে।

সাম্য একরাশ অনুশোচনা নিয়ে তাকালো নিঝুমের দিকে।নিঝুম সাম্যর এভাবে তাকানোর অর্থ বুঝলো না।বললো,কিছু বলবেন?

সাম্য মাথা নাড়লো।কথা গুলো গুছিয়ে নিতে চাইলেও সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার।

বাইরে জোরে হাওয়া দিচ্ছে। আকাশের কোণে, কোণে মেঘ জমেছে।যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।
সাম্য কিছু বলার আগেই কারেন্ট চলে গেল।নিঝুম ভয় পেয়ে বিছানায় বসে পরলো।সাম্য ফোনটা খুজে নিয়ে আলো জ্বালালো। ছোট চাচা চেচিয়ে বললো,নিঝুমকে ঘরের জানালা গুলো বন্ধ করে নিতে।

নিঝুম কাঁপা গলায় বললো,আপনি একটু জানালা গুলো বন্ধ করে আসবেন?

সাম্য জানালা গুলো বন্ধ করে বিছানায় আসলো।নিঝুমও উঠে বসলো। এমন অন্ধকার, তার ওপর আকাশে অবস্থা ভালো নয়।

সাম্য বুঝতে পারলো নিঝুম একটু ভয় পাচ্ছে।আজ খুব ইচ্ছে করলো,নিঝুম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,আমি আছি তোমার পাশে,তোমার কাছে ভয় পাবে না।
কিন্তু বলা হলো না।কথাটা বলার কোনো অধিকার নেই তার।কোন মুখে সে নিঝুমকে আগলে রাখতে চাইবে?এতোদিন যাকে অপমান,আঘাত করে এসেছে, তাকে?নিঝুম বা কেন তাকে সেই অধিকার দেবে।নিঝুমও তো তাকে ঘৃণা করে।তবুও নিঝুমকে বললো,”তুমি এইদিকে সরে এসো,অন্ধকারে নড়তে গিয়ে পরে যাবে।”

নিঝুম ক্ষনিকের জন্য থমকে গেল।মনে হলো,সাম্য এমন স্বরে তার সাথে কখনো কথা বলেনি বিয়ের পর থেকে।কেন যেন সাম্যর কথা গুলো হৃদয়ের এক কোণ ছুঁয়ে গেল।

হঠাৎ ব্রজপাতে হলো।নিঝুম ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরলো সাম্যকে।আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সেই আলোর রেশ জানালার ফাঁক দিয়ে মৃদু আসছে।সাম্যর হৃদয় বোধহয় ক্ষনিকের জন্য থেমে গেল।নিঝুম তাকে জড়িয়ে ধরেছে!এটাই তো সে চেয়েছিলো! তার ভালোবাসাকে এভাবেই জড়িয়ে রাখতে।মাঝখানে সবকিছু উল্টো হয়ে গিয়েছিল। নিঝুমকে সে খুব করে অনুভব করতে চাইলো তার আগেই নিঝুম উঠে পরলো সাম্যর বুক থেকে।

মাথা নিচু করলো নিঝুম।মনে, মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে সাম্যর কটুবাক্য শোনার।নিশ্চয়ই সাম্য নিঝুমকে এখন অনেক কিছু বলবে?কিন্তু নিঝুমকে অবাক করে দিয়ে সাম্য বললো,”আমাকে কি এতোই ঘৃণা করো,ইচ্ছে করে না হোক ভুলেও কি আমর কাছে থাকা যায় না?”

নিঝুম অন্ধকারে সাম্যর দিকে তাকিয়ে রইলো। সাম্যর কথা গুলো বোধগম্য হলো না তার।বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি নামলো।বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ কাঁপন ধরিয়ে দিলো দুজনকে।এমন রাতে প্রতিটি ভালবাসার মানুষ আঁকড়ে ধরতে চায় তার ভালোবাসাকে।মিশে যেতে চায় একে অপরের সাথে।প্রকৃতির বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে ভিজতে চায় নিজেদের ভালোবাসার বৃষ্টিতে!আর এই অন্ধকার ঘরের দুজনের মনেই চলছে অন্যরকম ভাবনা।কারো মন আকুল হচ্ছে প্রিয়জনের জন্য আর কেউ বুঝতে চাইতে নতুন করে অপর মানুষটাকে!

কোহিনূর বেগম দুই রাত ধরে ঘুমোতে পারেন না।সাম্য,নিঝুমকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার পর থেকেই এমন হচ্ছে তার।তিনি যতই চেষ্টা করে যাচ্ছেন ছেলেকে নিঝুমের জীবন থেকে সরিয়ে আনতে ছেলেটা ততই জড়িয়ে পরছে যেন।অবশ্য ছেলেটার বা কি দোষ। বাপ,চাচাদের মুখের ওপর কখনো কিছু বলতে পারেনি।যৌথ সংসারে থেকে নিজের মতো করে কিছু ভাবার অবকাশ নেই কারো।বৃষ্টি হচ্ছে, সামির তার পাশেই বেঘোরে ঘুমোচ্ছো।অথচ তার চোখে ঘুম নেই।ভাইকে দেয়া কথা রাখতে পারবেন তো? এই চিন্তায় তাকে অস্থির করে তুলছে । ঠিক করলেন কাল একবার ভাইয়ের বাড়িতে যাবেন।ভাইকে নিয়ে আবার একবার উকিলের কাছে যাবেন।

সীমা অনেক চেষ্টা করলো সারার ফোনটা হাতে নিতে। কিন্তু পারলো না।সারা তার ফোন সবসময় নিজের কাছে রাখে।চার্জে দিলেও ঘরে বসে থাকে।সাম্য ভাইয়াকে কি করে দেবে ফোনটা?অনেক চেষ্টার পর যখন সে পারলো না তখন হতাস হয়ে ছোট চাচার বাড়ির দিকে এগোলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here