ভালোবাসার রংমশাল পর্ব-১২

0
2380

#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১২
#সিফাতী সাদিকা সিতু

নিঝুমকে নিয়ে সাম্য এসেছে সীমাদের বাড়িতে।সীমা সকালে একফাকে এসে বলে গিয়েছিল সে ফোনটা নিতে পারেনি। তাই সাম্যই হাজির হয়েছে। সারা তাদেরকে দেখে খুব একটা খুশি হলো না।তবুও টুকটাক কথা বললো।সাম্য খেয়াল করলো সারার হাতে ফোন নেই।সীমাকে ইশারায় বললো ঘরে দেখে আসতে। সীমা দেখে এসে জানালো ফোন চার্জে দেয়া। সাম্য হেসে সীমার সাথে এগোলো রান্না ঘরে। নিঝুম চাচীর সাথে বসে আছে।সারা নাস্তা তৈরী করছে। হয়ত ওদের জন্যই।

সাম্যকে রান্না ঘরে আসতে দেখে সারার মা বললো,জামাই তুমি এইহানে আইলা কে?ঘরে বইসো। এইহানে গরম বেশি।

চাচী, আমি আসলে ভুলে ফোনের চার্জার ছেড়ে এসেছি।ফোনটা খুলছে না।আমার একটু দরকারী কাজ আছে। ইন্টারনেট এর প্রয়োজন।সারার নাকি স্মার্টফোন আছে? যদি একটু দিতেন?

তোমার লাগবো বাবা?ওই সারা তোর ফোনটা দে জামাইরে।

সারা হতভম্ব হয়ে গেছে।অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো।কিছু বলার আগেই সীমা বলো,আপা তুমি নাস্তা সাজাও আমি আনি দিচ্ছি। সারার কথা না শুনেই সীমা দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসলো ফোনটা।

নিঝুম হা হয়ে আছে সাম্যর কান্ড দেখে।কি বললো সাম্য?শুধু চার্জার না সাম্য পাওয়ারব্যাংকও নিয়ে এসেছে!কিছুই বুঝতে পারছে না সে।কি করতে চাইছে সাম্য?

সাম্য ফোনটা হাতে নিয়ে সারাকে বললো লক খুলে দাও।সারা কিছু বলতে পারলো না মায়ের সামনে। তবে মন কু ডাকছে তার।আজ কিছু একটা খারাপ হবে।বাধ্য হয়ে ফোনের লক খুলে দিলো।সাম্য বাইরে আসলো ফোন নিয়ে।সীমা বেরিয়ে আসলো সাম্যর পিছু পিছু।সারাও বের হতে চাইলো কিন্তু মায়ের ধমকে পারলো না।অগত্যা নাস্তা বানাতে লাগলো।ভেতরে ভেতরে ভয় পাচ্ছে সে।

সাম্যর বুকটা ধড়াস করে উঠলো “নিঝুম অরন্যে” আইডি লগইন করা দেখে।দ্রুত হাতে খুঁজলো কিন্তু পেলো না।মারুফের আইডি কোথাও পেল না।হয়ত সব ডিলিট করে দিয়েছে। সাম্য দেখলো একটা আইডিতে কিছু মেসেজ। দেখে মনে হলো সারা ছেলেটার সাথে রিলেশনে আছে।নিঝুমের কিছু ছবি দেয়া।সাম্যর চোয়াল শক্ত হয়ে আসলো।সে সবকিছুর স্ক্রিনশট নিয়ে রাখলো নিজের ফোনে।

নাস্তা খাওয়ার এক ফাঁকে সারাকে বললো,তুমি এতোদিন যা কিছু করেছ নিঝুমের নাম নিয়ে সব বলবে নিঝুম কে। না বললে তোমার বাবা মাকে আমি সব বলে দিবো।

সারা বুঝে গেল সে ধরা পরেছে।আলাভোলা নিঝুমের এমন ধড়িবাজ স্বামী কি করে জুটলো! সাম্য যে তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে না তা খুব সহজেই বুঝে গেল।

সাম্য বললো,বিকেলে ছোট চাচাদের বাড়িতে এসো ওখানেই সব কথা হবে।

সারা কথা না বলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।

শান্তা সাম্যকে গতকাল থেকে বারবার ফোন করছে কিন্তু সাম্য ধরেনি।এখন বাধ্য হয়ে ধরলো।ধরার কারণ তারা সবাই মিলে এতোদিন ধরে যে ভুল বুঝে আসছিল নিঝুমকে সে বিষয়ে কিছু কথা আজ শান্তাকে বলবে।

ফোন ধরার সাথেই শান্তা বলে উঠলো, তুই আমার ফোনটাও ধরতে চাস না কেন সাম্য,এতোটাই পর করে দিলি আমাকে?

“ফোন না ধরার অনেক কারণ থাকে শান্তা।না জেনে কথা বলবি না।আর জানিস তো আমি গ্রামে আছি এতোবার ফোন কেন দিস?”

ওহ,আমি ফোন দিলে তোর বউয়ে বুঝি খুব রাগ হয়।রাতে বোধহয় তোকে ঘরে থাকতে দেয় না?

“শান্তা!যাস্ট স্টপ। তোর মিনিমাম শেল্ফ রেসপেক্ট থাকলে এভাবে কথা বলতি না।তুই এখন এমন করিস কেন?আগে তো এমন ছিলি না?প্রতিটা কথায় কেন তুই নিঝুম টেনে আনিস।আজকের পর বরং নিঝুমের কাছে ক্ষমা চাইবি তুই?”

হোয়াট, আমি কেন ক্ষমা চাইবো নিঝুমের কাছে?

“কারণ এতোদিন ধরে আমরা যেটা ভেবে এসেছি সেটা মিথ্যে। মারুফের সাথে নিঝুমের কোনো সম্পর্ক ছিলো না।নিঝুমের কারণে মারুফ আত্মহত্যা করেনি!”

পাগলের মতো কি বলছিস তুই?

“হ্যাঁ, ঠিকি বলছি।নিঝুমের সাথে গ্রামে না আসলে বোধহয় জানতেই পারতাম না সত্যিটা।সারাজীবন নিঝুমকে খারাপ ভাবতাম।কথাটা বলতে সাম্যর গলাটা বুঁজে আসলো।”

সাম্য,আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

“নিঝুমের চাচাতো বোন সারা ওই আইডির মালিক।নিঝুমের নাম,ছবি দিয়ে ওই মারুফের সাথে রিলেশন করেছে।শুধু তাই না আরও কয়েকজনের সাথে একি কাজ করেছে।সব প্রমান এখন আমার কাছে আছে।মারুফের গুলো সরাসরি পায়নি তবে অন্য যথেষ্ট প্রমাণও আছে।”

এগুলা কিভাবে সম্ভব?

“সারার মতো মেয়েদের দ্বারা সব সম্ভব। তুই একটু রাফাতকে জানা।আমি এইদিকে সব সামলে ঢাকা ফিরবো।তারপর তোদের সব বলবো।এখন রাখছি।”

শান্তা কি করবে ভেবে পেলো না।তার ভয় হচ্ছে। এরপর কি সাম্য চাইবে নিঝুমের কাছ থেকে সরে আসতে?শান্তা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। যেটুকু আশা ছিলো মনে সেটুকুও আজ বিলীন হয়ে গেল।এতো যন্ত্রণা কেন পায় সে?সাম্যকে ভালোবেসে কষ্ট ছাড়া কিছুই পেল না।কেন ভালোবাসতে গেল সে সাম্যকে?কেনই না মনের কথা জানাতে দেরি করলো সে?এখন ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে তাকে।নিঝুমকে নিয়ে সাম্যর মনে খারাপ যে ধারনা ছিলো তাও আজ নেই। বরং নিঝুমের প্রতি সাম্যের অন্য ধারণা, অনুভূতি জন্মাবে।

সাম্য দুপুরের খাবার খেয়ে নিঝুমকে ডাকলো।বললো,”তোমার সাথে কিছু কথা আছে?”

নিঝুম কয়েক দিন ধরে সাম্যর আচরণে বেশ অবাক হয়।সাম্য আগের মতো রেগে কথা বলে না তার সাথে।মুখে বললো,বলেন?

“নিঝুম আমি যদি তোমার কাছে কোনো কারণে মাফ চাই তুমি কি মাফ করবে?”

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যাকে ঘৃণা করেন তার কাছে কেন মাফ চাইবেন হঠাৎ?

নিঝুমের কথা গুলো সাম্যর বুকে তীরের ফলার মতো বিধলো।কিন্তু সে কি কখনো মন থেকে ঘৃণা করতে পেরেছে নিঝুমকে? বৃষ্টি ভেজা সেই কিশোরী মেয়েটাকে প্রথম দেখেই ভালোবেসে ফেলেছিল। সেই ভালোবাসা বীজ থেকে চারাগাছ হয়েছে। ধীরে ধীরে বড় হয়েছে, ডালপালা মেলে বিস্তৃত হয়েছে। হঠাৎ একটা দমকা ঝড়ে ভেঙে পরেছিলো কিন্তু মরে যায়নি।কখনোই সে নিঝুমকে ঘৃণা করতে পারেনি।সে কথা নিঝুমকে কিভাবে বোঝাবে?

“বিকেলে সারা আসবে তোমাকে কিছু বলতে।তোমাকে সব শুনতে হবে।ও তোমার সাথে কেন ঠিকমতো কথা বলছে না তার উত্তর পেয়ে যাবে।সব শোনার পর আমাকে তুমি যে শাস্তি দিবে তা মাথা পেতে নেব।”

নিঝুমের মাথা ঘুরছে সাম্যর কথা শুনে।সারা কি বলবে,সাম্যকেই বা কেন শাস্তি দেবে।আর সাম্যই বা হঠাৎ কেন তাকে এতো আমলে নিচ্ছে? কোনো কিছুই নিঝুম বুঝতে পারলো না।

***
রক্তিম সূর্যটা হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে ঢেকে ফেলবে অন্ধকার আবরণে।আকাশটায় লাল রংয়ের ছটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মন মাতানো এক দৃশ্য। নিঝুমের সে দিকে কোনো খেয়ালই নেই।দুচোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। তবে এই চেখের পানি দুঃখের জন্য নয়।অনেক বড় অপবাদ থেকে রেহাই পেয়েছে সে।

সারার বলা কথা গুলো এখনো কানে বাজছে তার “কলেজে ওঠার পর সে জেদ করে ফোন কিনে নেয়।বান্ধবীদের কাছ থেকে শিখে নেয় ফেসবুক কিভাবে চালাতে হয়।সারার নিয়ে জের নামের আইডি খুলতে ভয় হয়।যদি বাবা জেনে যায় তাহলে আর ফোন দেবে না তাকে।সারার ফুপাতো ভাইয়ের সাথে নিঝুমের আসল আইডি এড আছে।সারা নিঝুমের ছবি গুলো ভাইয়ার কাছ থেকে নেয়।”নিঝুম অরণ্যে” নামে একটা আইডি খুলে।নিঝুম যেহেতু নেই তাই কেউ কিছু বুঝবে না।মারুফের সাথে হুট করেই সম্পর্ক টা হয়ে যায়।কিন্তু যখন বুঝতে পারে মারুফ সত্যি সত্যি তাকে ভালোবেসে ফেলেছে তখন সে সরে আসে।সে এমনি মজা করার জন্য রিলেশন করেছিলো।মারুফকে তা জানায়।মারুফ মেনে নিতে পারেনা।সারা তাকে ব্লক করে দেয়।এরপর কিছু জানে না সে।মারুফ আত্মহত্যা করতে পারে সে কখনো ভাবে নি।আজকাল ফেসবুকে এমন অহরহ সম্পর্ক হয়।”

খুশিতে কাঁদছে সে নিঝুম।মামনিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার।এতোদিন ধরে কি চাপা কষ্ট বয়ে বেরিয়েছে সেটা শুধু সেই জানে।মিথ্যা দোষারোপে দোষী হয়েছিল। এমনকি তার ঘাড়ে মারুফকে মৃত্যুর দায় পর্যন্ত এসেছিল।তার কথা বিশ্বাস করেনি তখন।সাম্য কতটা খারাপ আচরণ করতো তার সাথে!বাকিরা নাহয় তার কথা বিশ্বাস করতে পারেনি কিন্তু সাম্য তো একবারের জন্য বিশ্বাস করতে পারতো?সে তো কিছুটা হলেও নিঝুমকে চিনতো, জানতো।
নিঝুম ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। কারো একটা ছায়া পরলো তার সামনে।ছায়া মানব এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো তার সামনে।নিঝুম চমকে উঠে তাকালো ছায়া মানবের দিকে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here