#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১৩
#সিফাতী সাদিকা সিতু
সাম্য,নিঝুম শহরে ফিরেছে দুদিন হলো।নিঝুম খেয়াল করেছে গ্রাম থেকে ফেরার পর সাম্য খুব একটা তার সামনে আসে না।সকালে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পরে দুপুরেও খেতে আসে না, রাতে ফেরে।সে তখন ঘুমিয়ে থাকে।নিঝুম বুঝতে পারে সাম্যর এমন আচরণের কারণ।সেদিন হাটু গেড়ে বসে মাফ চেয়েছে তার কাছে সাম্য।নিঝুম অবাক হয়ে গেছে সাম্যর এমন কান্ডে।সাম্য তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত এটা নিঝুম বেশ বুঝেছে তবুও কেন যেন মন থেকে সে সাম্যকে মাফ করতে পাচ্ছে না!এতোদিন ধরে সাম্যর করা আচরণ গুলো সে ভুলতে পারবে না সহজে।আর রইলো বিয়ে নামক সম্পর্ক, সেটা নিয়ে কিছুই ভাবতে চায় না সে।যা কপালে থাকবে তাই হবে।
মামনির হাতে খেয়ে নিঝুম ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরী হলো।কোহিনূর বেগমকে হঠাৎ তার ঘরে দেখে একটু চমকে গেল।
কলেজ যাচ্ছো?
জ্বি, কিছু বলবে ছোট মা!
কোহিনূর বেগমের ভ্রু কুঁচকে গেল।মেয়েটা তাকে পুরনো সম্মোধন করছে। তিনি একটু কড়া গলায় বললেন,তুমি এখন এ বাড়ির মেয়ে নও শুধু,এ বাড়ির বউ।সাম্যর কোনো দায়িত্ব পালন কর না, সংসারের কিছু করনা এভাবে তোমাকে রাজরাণী করে রাখছে বড় ভাবী।কিন্তু মনে রেখ আমি তোমার শ্বাশুড়ি হই।তোমার এমন জমিদারি আমি সহ্য করবো না।এমনিতেই আমার ছেলের ওপর জুড়ে বসে তার জীবনটা নষ্ট করে দিচ্ছো তারপরও তোমার কোনো হেলদোল নেই!
নিঝুমের চোখ ভিজে গেল।সে কিছু বলতে গেলেই দেখলো মামনি দরজা থেকে তাকে ইশারা করলো চুপ করে থাকতে।
নিঝুমকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে কোহিনূর বলে উঠলো ,তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না?তুমি এতো বেয়াদব তা তো আগে বুঝতে পারিনি।ভালো মেয়ে সেজে থাকতে কেন?আমার ছেলেটাকে কব্জা করতে?
নাজনীন বেগম এবার ঘরে ঢুকে বললেন,তুই যে এতো কথা নিঝুমকে বলছিস তার কি কোনো কারণ আছে?
নাজনীন বেগম কে দেখে কোহিনূর বেগম একটু চমকালেন।সেটা বুঝতে না দিয়ে বললো,ও এখন আমার ছেলের বউ, বড় ভাবী। আমি কিছু বলতে পারবো না কেন?
তুই যদি মানতি নিঝুম তোর ছেলের বউ তাহলে বলতি না নিঝুমকে বিয়ে করে সাম্যর জীবনটা নষ্ট হয়েছে!আর সংসারের কথা যে বলছিস আমরা শ্বাশুড়িরা রাশ টেনে রাখলে বউ কিভাবে দায়িত্ব পালন করবে ঠিক ভাবে?
বড় ভাবী, তুমি তোমার বোনের মেয়ের গুনকির্তন আমায় শোনাতে এসো না।
তুই এমন কেন করছিস ছোটো?নিঝুমের কি খারাপ দেখেছিস তুই?সুপ্তি,আরোহীর মতো তুইও তো ওকে আদর করতি।তাহলে আজ সাম্যর বউ হিসেবে মেনে নিতে এতো বাঁধছে কেন তোর?
সেটা তুমি বুঝবে না বড় ভাবী। আমার ছেলের দিকটা আমাকে ভাবতে হবে।তুমি যেমন তোমার বোনের মেয়ের ভালো চাও তেমনি আমিও আমার ছেলের ভালো চাই।
নিঝুম নিরবে শুনছে সবকিছু।তার জীবনে দোষের ভান্ডার বোধহয় শেষ হবে না কোনোদিন!
নাজনীন বেগম নিঝুমকে বুকে চেপে ধরে বললেন,তোর ছেলের কি খারাপ হয়েছে?তখন থেকে আমার বোনের মেয়ে বলে কথা বলছিস কেন?নিঝুম আমার মেয়ে। জন্ম না দিলে কি মা হওয়া যায় না।তুই তো সাম্যকে জন্ম দিয়েছিস,মা হয়ে ছেলের মন বুঝতে পারিস কই?
কোহিনূর বেগম বেরিয়ে গেলেন রেগে।
নাজনীন নিঝুমের চোখ মুছে দিয়ে বললেন, কাঁদছিস কেন রে পাগলি?এমনটা হওয়া স্বাভাবিক।সংসারের সবার মন এক সাথে পাবি না। সাম্য ঠিক থাকলেই হলো।নে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে দেরী হয়ে যাবে তোর ক্লাসের।
নিঝুম একরাশ মন খারাপ নিয়ে দুটো ক্লাস করলো। আজ সিঁথি না আসায় আরও মন খারাপ হয়েছে।নিঝুমের আর তেমন কোনো বন্ধু নেই।একা একাই সে ক্যান্টিনে এসে বসলো। খিদে পেয়েছে তাই একটা বার্গার নিয়ে বসলো খেতে।খাওয়া শেষ করে উঠতে যাবে এমন সময় আশফি এসে বসলো।
নিঝুম চমকে গিয়ে সালাম দিলো স্যারকে।
তোমার মন খারাপ কেন নিঝুম?
আশফির এমন প্রশ্নে নিঝুম কি জবাব দিবে ভেবে পেল না।
আশফি আবার বললো,মন খারাপ নিয়ে ক্লাস করলে কি পড়া মনে থাকবে?
নিঝুম একটু হাসলো।বললো,না তেমন কিছু নয় স্যার।সিঁথি আসেনি তো আজ তাই একা একা বোর হচ্ছি।
কেন তোমার আর কোনো বন্ধু- বান্ধব নেই?
নাহ্,তেমন কেউ নেই।
হুম,আমি লক্ষ্য করেছি তুমি নিজেকে কেমন গুটিয়ে রাখো!এটা ঠিক নয়।বন্ধুদের সাথে আড্ডা, মজা করা, ঘুরে বেড়ানো এসব তো এই বয়সেই করবা।বিয়ে হয়ে গেলে তো কিছুই হবে না।
আশফির কথায় নিঝুম চমকালো।তার বিয়ে হয়েছে এটা স্যার জানে না!তারও ইচ্ছে করলো না স্যারের কাছে তার বিয়ের ব্যাপারটা বলতে।
কি ভাবছো?
কিছু না, স্যার।
তুমি ক্লাসে যাবে না?
নিঝুম তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো। বললো,যাচ্ছি স্যার।
নিঝুমের বলার ধরণ দেখে হাসি পেলো আশফির।সে উঠে দাঁড়িয়ে একটু ঝুকে নিঝুমের কাছাকাছি এসে বললো,আজ রাতে ফোন করবো আশা করি তুমি ধরবে!নিঝুমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আশফি চলে গেলো।
নিঝুম সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। স্যারের ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না।নিঝুম ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলে সবুজ নামের ছেলেটা সাম্যকে ফোন করে সব জানালো।
***
আজ পরিবেশ টা অনেক শান্ত,সুন্দর। শরতের আকাশ কি নির্মল হয়!সারাদিন তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে আকাশ পানে।নাজনীন বেগম নিঝুমকে টেনে আনলেন জানালার পাশ থেকে। বললেন,সারদিন এমন উদাস হয়ে থাকিস কেন বলতো?নতুন বউ, কতো রংঢং করবি তা না।একটু সাজগোজ করতে পারসি না?
নিঝুম জোরে হেসে উঠলো, মামনিকে জড়িয়ে ধরে বললো, কেমন রংঢং করবো একটু শিখিয়ে দাও তো!
আসলেই তোকে শেখাতে হবে। এখন আয় তোকে একটা শাড়ি পরিয়ে দেই।সবসময় সালোয়ার কামিজ পরিস, মাঝে, মাঝে শাড়ি পরবি ভালো লাগবে।বিয়ের সময় কতো শাড়ি কিনেছি একটাও তো পরলি না।
থাক না মামনি।বাড়িতেই শাড়ি পরে কি করবো?
তোর বরকে দেখাবি?
ধুর!লজ্জায় মামনির বুকে মুখ গুজলো নিঝুম।
এতো লজ্জা পেতে হবে না।আয় শাড়ীটা পরিয়ে দেই।
নাজনীন বেগম সুন্দর করে নিঝুমকে শাড়ী পরিয়ে দিলো।মেরুর রংয়ের শাড়ীটা নিঝুমের পরনে ফুটে উঠেছে। নাজনীন বেগম বললেন,দ্যাখ,তোকে কি সুন্দর লাগছে!
আয়নায় তাকিয়ে নিঝুমের মনে হলো সত্যি তাকে অন্যরকম লাগছে।আগেও তো শাড়ী পরেছে এমন অন্যরকম লাগেনি নিজেকে।বিয়ের পর বুঝি সব মেয়েরই নিজেকে অন্যরকম লাগে!
সাম্য ঘরে ঢুকেই আগে গোসলটা সেড়ে নিলো।যে ফার্মে সিভি জমা দিয়েছেল সেখানে আজ তাকে ডেকেছে।রাফাত সহ গিয়েছিলো।আশা করা যায় চাকরিটা হবে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সাম্য একটা ঝটকা খেলো। শাড়ী পরে একদম বউ সেজে নিঝুম সরবত হতে ওর জন্য দাঁড়িয়ে আছে! সে স্বপ্ন দেখছে নাতো দিন দুপুরে!
আপনার জন্য মামনি পাঠালো।নিঝুম গ্লাসটা এগিয়ে ধরলো।
সাম্য এক ঢোকে পুরোটা শেষ করে ফিরিয়ে দিলো নিঝুমকে।
নিঝুম চলে যেতে ধরলে সাম্য ডাকলো,নিঝুম!
নিঝুম ঘুরে তাকালো।কিছু বলবেন?
“তোমায় সত্যি খুব সুন্দর লাগছে।”
নিঝুমের বুক ধড়াস করে উঠলো। সাম্যর কথা টুকু ছুঁয়ে গেল তাকে।অচেনা ভালো লাগা ঘিরে ধরলো।মুচকি হেসে চলে গেল সে।
সাম্য বুকে হাত দিলো।নিঝুম তো তারই বউ!এতো আড়ষ্ট ভাব কেন তবে?নিজের ভুলের জন্যই আজ সে এতদূরে নিঝুমের থেকে,তার ভালোবাসার থেকে।আচ্ছা, নিঝুম কি জানতে পারবে সাম্য নিঝুমকে ভালোবাসে,তাও আবার পাঁচ বছর ধরে!কেন সেদিন নিঝুমকে বিশ্বাস করলো না সে।সে তো শাস্তি পেয়েছে, পাচ্ছে। নিঝুমকে ভালোবাসে তা বলতে পারে না,নিঝুম তার বউ অথচ সে অধিকার নিয়ে নিঝুমের সামনে দাঁড়াতে পারে না,নিঝুমের এতো কাছে থেকেও যেন সে বহুদূরে!এসব কি তার শাস্তি নয়?
নাজনীন বেগম ঘরে এসে সাম্যকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন,কিরে এমন করে কি ভাবসছিস দাঁড়িয়ে? চুল গুলোও ঠিক মতো মুছতে পারিস না এখনো।নাজনীন বেগম সাম্যর চুল ভালো ভাবে মুছে দিলো।
তুই এমন কেন রে বাপ,নতুন বউকে নিয়ে একটু ঘুরতে গেলেও তো পারিস?
সাম্য বললো,বড়মা আমি নিয়ে যেতে চাইলে কি নিঝুম যাবে?
ওমা,এটা কেমন কথা।তোর বউ যাবে না তো কে যাবে?
তাহলে নিঝুম বলো,বিকেলে বাইরে যাবো ওকে নিয়ে।
নাজনীন বেগমের মুখে হাসি ফুটলো।
চলবে…