#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১৪
#সিফাতী সাদিকা সিতু
সাম্য তাকিয়ে আছে শাড়ী পরা হাস্যজ্বল নিঝুমের দিকে। নিঝুমকে যত দেখছে বুকের ভেতর কষ্টটা বেড়েই চলেছে। এতদিন ধরে নিজের ভালোবাসাকে ভুল ভেবে কষ্ট পেয়েছিল।আজ কষ্টটা অন্যরূপ নিয়েছে।নিজেই ভালোবাসাকে ভুল ভেবে আঘাত করে অন্যায় করেছে জানার পর থেকে তার দিনরাত কি করে কাটছে তা শুধু সেই জানে!নিঝুমকে তো এই রূপেই চেয়েছিল এতদিন।আজ পেয়েও না পাওয়ার ভীড়ে ইচ্ছে গুলো ভীড় করেছে।হয়ত এটাই তার শাস্তি।ভালোবাসা হাতের মুঠোয় ধরা দিয়েও চলে গেল নিঃস্ব করে। নিঝুম এখনো ক্ষমা করতে পারে নি তাকে।করবেই বা কেন?অপরাধ তো কম করেনি সে।কিন্তু নিঝুমের কাছে কি আর একবার সুযোগ চাইবে সে।তবে স্বামী হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে পাশে থাকার।মনের কথা কখনো বুঝতে দিবে না সে নিঝুমকে।তার ভালোবাসা যদি সত্যি হয় তবে নিঝুম ঠিক একদিন বুঝতে পারবে।যদি না পারে ধরে নিবে সেটাই তার পাওনা ছিল।
নিঝুম একা আসতে চায়নি তার সাথে। সুপ্তি আর আরোহীকে সাথে নিয়ে এসেছে। সাম্যর জন্য ভালোই হয়েছে। সে নিঝুমের কাছে স্বাভাবিক হতে পারছে না।অপরাধ বোধ প্রবল ভাবে অসস্তি তৈরী করেছে তার আর নিঝুমের মধ্যে ।
নিঝুমের ফুচকা খাওয়ার দৃশ্যটা বেশ লাগছে দেখতে। সাম্য জানে নিঝুমের ভেতর বাচ্চাসুলভ কিছু আচরণ আছে।কিন্তু জীবনের টানাপোড়নে সেগুলো ঢাকা পরে গেছে। মা বাবাকে হারিয়ে অন্যরকম হয়ে গেছে।সাম্যর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে তো তার দুঃখী রানী কে সুখী করতে চেয়েছিল।কিন্তু নিজেই কত কষ্ট দিয়েছে ফেলেছে। দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে তার।আরোহী এসে জানালো তাদের খাওয়া হয়ে গেছে। সাম্য টাকা দিয়ে দিলো।সাম্য খেয়াল করলো নিঝুমের ঠোঁট বেশ লাল হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই ঝাল বেশি খেয়েছে!সাম্য ভেবে পায় না মেয়েরা কি করে এত ফুচকা খেতে পারে। সে একটু এগিয়ে গিয়ে আইসক্রিম কিনলো তিনটে।নিঝুমকে দেয়ার সময় শুধু বললো,নাও!
নিঝুম স্বাভাবিক ভাবে নিলেও মনে,মনে বেশ অবাক হলো।সাম্য কি করে বুঝলো তার ঝাল লেগেছে! নিঝুম এক পলক দেখলো সাম্যকে ঠিক তখনি সাম্যও তাকালো তার দিকে।দৃষ্টি বিনিময় হতেই দুজনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল।সাম্য চট করে অন্যদিকে তাকালো।
আশফি গাড়ির ভেতর থেকে নিঝুমকে দেখছে অপলকভাবে।শাড়ী পরিহিতা নিঝুম আজ তার চোখে অন্যরূপে ধরা দিয়েছে। আশফি বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য বেরিয়েছিল।নিঝুমকে দেখতে পারবে কল্পনাও করেনি।নিঝুমের সাথে আরও দুটো মেয়ে আর নিঝুমের সেই ভাইকে দেখতে পাচ্ছে সে।কিন্তু নিঝুম শাড়ী পরেছে কেন?বাকি দুজনে তো পরেনি?আশফির মনে হঠাৎ যেন অজানা আশংকা ভর করলো।সে কি দেরী করে ফেললো,নিঝুমের কি বিয়ে হয়ে গেছে?আশফি আর ভাবতে পারলো না।সে মোটেও দেরী করবে না।ড্রাইভারকে গাড়ী ঘোরাতে বললো,বাসার উদ্দেশ্যে।বাবাই একমাত্র তার ভরসা!আজকেই বাবার সাথে কথা বলতে হবে।আগামীকাল নিঝুমের সাথেও কথা বলতে হবে।কিন্তু ভার্সিটিতে কিভাবে সব কথা বলবে?
***
নিঝুম নাস্তা করে ঘরে এসে দেখলো সাম্য নেই!সে খুশি মনে বই নিয়ে বসলো।সুপ্তি একটু পর, পর নিঝুমের ঘরে এসে উঁকি দিচ্ছে। নিঝুমকে মন দিয়ে পড়তে দেখে কি করবে ভেবে পেল না।সাহস নিয়ে ঢুকে বললো,তুমি আজ ভার্সিটি যাবে না আপু?
নিঝুম বইয়ের মধ্যে দৃষ্টি রেখে বললো, নাহ্, আজ যেতে ইচ্ছে করছে না।
সুপ্তি মাথায় হাত দিলো।আপু ভার্সিটি না গেলে কি করে সব হবে? এখন কি করবে সে?মাকে ডেকে আনতে হবে!
সুপ্তি দ্রুত বেরিয়ে গিয়ে নাজনীন বেগমকে ডেকে নিয়ে আসলো।নাজনীন বেগম এসে নিঝুমকে একটু কড়া গলায় বললেন,বিয়ের পর তুই কিন্তু খুব ফাঁকিবাজ হয়ে গেছিস, ভার্সিটি যাবি না কেন?
মামনির কথায় নিঝুম চমকালো। বললো,আজ যেতে ইচ্ছে করছে না মামনি।
কেন ইচ্ছে করছে না?
এমনিতেই।
নাহ্,এভাবে ক্লাস ফাঁকি দেয়া যাবে না। তুই এখুনি তৈরী হয়ে নে। তোর মনিবাবাকে বলছি তোকে নিয়ে যাবে।
ও মামনি আজ না যাই, প্লিজ!
একদম ঢং করবি না।তাড়াতাড়ি আয়,তোর মনিবাবার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
নাজনীন বেগম সুপ্তিকে ইশারায় চলে যেতে বলে নিজেও বেরিয়ে গেলেন।
নিঝুম অসহায় হয়ে সুপ্তির দিকে তাকালো।সুপ্তি শান্তনামূলক হাসি হেসে বেরিয়ে গেল। আচ্ছা, মামনি হঠাৎ তাকে এভাবে ঠেলে পাঠাচ্ছে কেন ভার্সিটিতে?
আশফির আজ দুটো ক্লাস ছিলো সকালে। সে দুটো শেষ করে ক্যাম্পাসে একটু হাটলো।নিঝুমকে দেখতে পেল না কোথাও।তার অফিসে এসে বসে পিয়নকে পাঠালো নিঝুম কে ডেকে আনতে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে পিয়নের পিছে, পিছে নিঝুম এসে দাঁড়ালো তার সামনে।নিঝুমের চোখে মুখে কৌতুহল স্পষ্ট। পিয়ন বেরিয়ে গেলে নিঝুমকে বসতে বললো আশফি।
নিঝুম বসার পর বললো,আমায় কিছু বলবেন স্যার?
হুম,তোমার বাসার ঠিকানা টা লিখে দাও। আশফি কাগজ এগিয়ে দিলো।
নিঝুমের ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। বাসার ঠিকানা কেন চাচ্ছে স্যার?সে কি করলো,পরীক্ষার রেজাল্ট খুব একটা খারাপ তো হয়নি , তাহলে?
নিঝুমের ফ্যাকাসে মুখটা দেখে আশফির হাসি পেল।হেসে বললো,ভয় নেই, ভার্সিটির কোনো ব্যাপারে ঠিকানা চাচ্ছি না।
তাহলে, স্যার কেন চাইছেন?
তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো তাই।আশফি ভাব শালীন কন্ঠে বললো।
নিঝুমের মুখটা আপনা আপনি হা হয়ে গেল।সে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না!
নাজনীন বেগম তাড়া দিয়ে সবাইকে সবকিছু গুছিয়ে নিতে বললেন। তার রান্নাবান্নাও সব শেষ হয়েছে। নিঝুমের ফেরার সময় হয়ে গেছে।
চিন্তা করো না মা।বেলুন গুলো ফোলালেই কাজ শেষ।সাম্য ভাইয়া কেক নিয়ে এসেছে। আপুর নিজের জন্মদিনের কথা মনেই নেই।ঠিকই সারপ্রাইজড হবে দেখো!
সাম্য কোথায় রে?
রুম ডেকোরেশন করছে।
ওকে ডাক, নিঝুম আসলো বলে।
সুপ্তি একটু মায়ের কাছাকাছি এসে ফিসফিসিয়ে বললো,সাম্য ভাইয়া বলেছে সে সন্ধ্যায় কেক কাঁটার সময় থাকবে, এখন আসবে না।
নাজনীন বেগম অবাক হয়ে বললেন, কেন?
হয়ত, তোমাদের সামনে লজ্জা পাবে!
ঠিক আছে।নিঝুম তো ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঘরে যাবেই, ওখানে ওরা কথা বলবে নিশ্চয়ই।
হ্যাঁ,তাই ভালো।
নিঝুম কোনোরকমে পা চালিয়ে বাসায় ঢুকলো।আশফি স্যারের কথা গুলো তার সবকিছু আজ এলোমেলো করে দিয়েছে। ভেতরে ঢুকতেই আরোহী, সুপ্তি চেচিয়ে বলে উঠলো,”হ্যাপি বার্থডে আপু।”
নিঝুম প্রচন্ড অবাক হলো।আজ তার জন্মদিন অথচ তারই মনে ছিলো না!
নাজনীন বেগম এসে পায়েস খাইয়ে দিয়ে নিঝুমের কপালে চুমু দিয়ে বললেন,অনেক ভালো থাকরে মা,সবাইকে ভালো রাখিস।
নিঝুম মামনিকে জড়িয়ে ধরলো। তার জন্মদিন মামনি কখনো ভোলে না।আজকের দিনটায় বাবা,মাকে খুব মনে পরে তার।মামনি সেটা জেনেই চেষ্টা করে নিঝুম খুশি রাখতে।
নাজনীন বেগম নিঝুমের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,বড় হয়ে গেলি রে মা।এইতো সেদিনের কথা।আপার লেবার পেইন উঠেছে শুনে ছুটে গিয়েছি।পৌঁছে দেখি তুই এসেছিস পৃথিবীতে। সেই যে তোকে কোলে তুললাম, মনে হলো একটা গোলাপ ফুল ধরেছি।
নিঝুমের চোখ ভিজে এলো।মামনির বুকে মুখ লুকালো।মামনি সত্যি তার মায়ের জায়গা নিয়ে নিয়েছে।
কোহিনূর বেগম দূর থেকে এসব দেখে রেগে ঢোল হয়ে যাচ্ছেন।কিছুই বলতে পারছেন না। বলবেনই বা কি করে নিজের ছেলেটাও যে নিজে থেকে এমন কান্ডে জড়াবে তা কি আর জানতেন?সব আশা, ভরসা শেষ হতে চললো।ভাইকে দেয়া কথা রাখতে পারবেন না বোধহয়। ভেবেছিলেন,সাম্য হয়ত নিঝুম কে পছন্দ করে না।তাই সাহসটাও ছিল।এখন দেখছেন সব ভিন্ন। সাম্যর ভাবগতি বুঝে উঠতে পারছেন না।
নিঝুম একরাশ ভালোলাগা নিয়ে ঘরে আসলো।ঘরে ঢোকার পর সেই ভালো লাগাটা বেড়ে গেল!
এত সুন্দর করে ঘর সাজালো কে?
নিঝুম অবাক হয়ে ঘুরতেই দেখলো,সাম্য একঝাঁক বেলুন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। নিঝুম থমকে দাঁড়ালো। মুখের হাসিটা নিভে গেল।
সাম্য ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বললো,আমাদের সমস্ত সম্পর্ক ফিকে হয়ে যাক, শুধু থাকুক বন্ধুত্ব!তুমি কি আমায় মাফ করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিবে নিঝুম?
নিঝুম জবাব দিতে পারলো না।শুধু তাকিয়ে রইলো। সাম্য তাকে কি বউ হিসেবে এখনো মানতে পারলো না?তাদের মাঝে কি কোনো সম্পর্কই সত্যি নেই?
নিঝুমের চোখে যেন তার মনের কথা ভেসে উঠলো। সাম্যর বুঝতে দেরী হলো না।চট করে বলে উঠলো, আমি তোমার স্বামী হবার যোগ্য নই নিঝুম!তোমাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। বিয়ের বন্ধনে জড়িয়েও খারাপ ব্যবহার করেছি।তুমি তো এসবের কারণ ছিলে না।তবু কষ্ট পেয়েছ আমার কাছে।আমি সেই কষ্ট গুলো কখনোই ভুলিয়ে দিতে পারবো না হয়ত।বন্ধু হয়েও যদি তোমার পাশে থাকতে পারি তাহলে আমার অপরাধ বোধ একটু হলেও কমবে।আমায় এই সুযোগটা দিবে না তুমি?
চলবে..