#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১৫
#সিফাতী সাদিকা সিতু
ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে সাম্য।সন্ধ্যার মৃদুমন্দ বাতাসে বেশ ফুরফুরে লাগছে।তবে মনের অবস্থা ভালো নয়। নিঝুম কিছুই বলেনি। আরোহী, সুপ্তি ঘরে আশায় তাদের তেমন কথা হয়নি। একটু আগেই কেক কাঁটার আয়োজন শেষ হয়েছে।নিঝুম সবাইকে কেক খাইয়ে দিলেও তাকে হাতে দিয়েছে সেটাও বড়মা বলাতে।সাম্যর খারাপ লাগছে না।এটাই তো স্বাভাবিক! দুজনের এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আগের মতো সহজ হয়ে থাকতে পারছে না।নিঝুম আগে সাম্য ভাইয়া বলে ডাকলেও মারুফের ঘটনার পর থেকে ডাকে না।সাম্য সেদিন খুব দোষারোপ করেছিল। সেই থেকে নিঝুমও কেমন গুটিয়ে ছিল তার থেকে।বিয়ের পর সেটা আরও বেশি হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা এভাবে করা ঠিক হয়নি।কিন্তু ভাগ্য তো তারই সহায় ছিল তা না হলে বিয়েটা হয়ে গেল কিভাবে? নিঝুম তার থেকে হারিয়ে যায়নি!বরং নিঝুমের সাথে তার ভাগ্য জুড়ে গেছে না চাইতেই।অথচ দুজনে দুই মেরুর প্রান্তে আছে।দুটো শরীর এক ঘরে বাস করলে কি হবে?মন, সে তো বহুদূরে আছে! আকাশে রুপোলী থালার মতো গোল চাঁদটা যেন তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।তাকে উপহাস করে বলছে,”নিজ দোষে ভালোবাসাকে হারিয়েছ তুমি, তাহলে এখন আপসোস ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না।প্রতিনিয়ত গুমরে, গুমরে মরবে।ভালোবাসার জালে তুমি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছ ভুল করে।বেরোবার কোনো পথ খোলা নেই যদি না বাইরে থেকে কেউ তোমায় বের করে।”
নিঝুম সাম্যর কাছে এসে দাঁড়ালো।সুপ্তির কাছে জেনেছে সাম্য এখন ছাঁদে আছে। আজ সাম্য তার উপস্থিতি জানতে পারেনি!নিঝুম একটু হালকা সুরে বললো,”আপনি তো আমায় একটু হলেও জানতেন তবু কেন সেদিন আমায় বিশ্বাস করতে পারেনি? জানেন, আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি?বাবা মা চলে যাওয়ার পর আপনাদের সাথেই তো আমার বসবাস তাহলে কেন চিনতে পারেননি?আমি এতটা নিচে কি করে নামতে পারি,একজনকে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে আবার তাকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিতে? মৃত্যুটাকে তো আমি বড্ড ভয় পাই।মৃত্যু নামেই আমার কাছে আগুনে পুড়ে যাওয়া দগ্ধ লাশ!খুব কষ্ট পেতাম আপনার আচরণে!”
সাম্য অপরাধী দৃষ্টিতে একবার নিঝুমের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।নিজের কাছে আজ নিজেই অসহায়। সত্যি! মানুষকে কষ্ট দেয়ার সময় আমরা উপলব্ধি করতে পারিনা সেই কষ্টের পরিমান কতটা?
নিঝুম আবার বললো,”কিন্তু ভেবে দেখলাম আপনিও তো ঠিক। আমার আগে আপনার বন্ধু এসেছে আপনার জীবনে তাহলে আমায় বিশ্বাস না করাটা তেমন অন্যায় ছিল না।আমার ছবি, নাম নিয়ে যে সারা এমন করবে তা তো কেউ জানতাম না।বন্ধুর মৃত্যুতে আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন জানি।হয়ত চোখের দেখাটাকেই সত্যি মনে হয়েছিল সে সময়!আপনিই তো সেই ভুলটা খুঁজে বের করে আমায় নির্দোষ প্রমাণ করলেন! সারার ব্যাপারটা হয়ত কখনো জানতেও পারতাম না!আপনার কারণেই সত্যিটা সামনে এসেছে! “আপনি নিজেই অনুতপ্ত।শাস্তি দেয়ার মতো কিছুই নেই।আর আমি বা কে শাস্তি দেয়ার? শাস্তি মানে তো শুধু কষ্ট দেয়া নয়?সমস্ত বিষয়টাই ছিল ভুল বোঝাবুঝি!মন থেকে বলছি আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।আমি বন্ধুত্বের হাতটা বাড়িয়ে দিতে চাই!”
সাম্য চট করে মাথা তুলে তাকালো। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না নিঝুম তাকে মাফ করেছে!অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুধু।
সাম্যর তাকানোয় নিঝুম হাসলো।বললো,আজকের চাঁদটা অনেক সুন্দর!সবাইকে ডেকে নিয়ে আসি, আজ চন্দ্রবিলাস করবো!নিঝুম কিছুটা যেয়ে আবার থেমে গেল। সাম্যর দিকে তাকিয়ে বললো, “জন্মদিনের এতো সুন্দর আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ। ”
চাঁদের ঝলমলে আলোর মতো সাম্যর মুখে হাসি ফুটলো।
***
শান্তা প্রায় রাত না ঘুমিয়ে কাটায়।সাম্যকে হাজার চেষ্টায়ও ভুলতে পারছে না।এমন কেন হলো তার সাথে? সে তো শুধু ভালোবেসেছে,অথচ শাস্তি পেল সেই ভালোবাসার কারণে! হয়ত একেই বলে ভাগ্য!তবু যেন নিজেকে মানাতে পারছে না?ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে এসেছে। তাও একঘন্টার বেশি ঘুমোতে পারলো না।সাতটার আগেই বিছানা ছাড়লো।অনেকদিন ধরে মর্নিং ওয়ার্কে যায় না।আজ ইচ্ছে করলো একটু বেরতে। রান্না ঘর থেকে পানির বোতল নিয়ে দৌড়াতে লাগলো বাসার পাশের পার্কটার উদ্দেশ্যে।আধাঘন্টা ধরে ওর্য়াক আউট করেই হাঁপিয়ে উঠলো।শান বাঁধানো জায়গাটায় বসে বেশ কিছুক্ষণ দম নিলো।আশে পাশের বিল্ডিংয়ের অনেকেই আশে এখানে।শান্তা আবার উঠে দাঁড়ালো। দৌঁড় শুরু করতেই অচেনা একটা ছেলের সাথে ধাক্কা লেগে হুড়মুড় করে পরে গেল! ব্যাথা পেয়ে আহ্ শব্দ করে উঠলো।
স্যরি, আমি দেখতে পাইনি।খুব বেশি ব্যাথা পেয়েছেন?ছেলেটা প্রশ্ন করতে, করতে নিচে বসে শান্তার পায়ে হাত দিলো।
শান্তা দ্রুত হাতটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিলো।রেগে বললো,আপনাকে ধরতে হবে না?ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে ভদ্রতা দেখাতে হবে?
শান্তার এমন কথায় হচকিয়ে গেলো ছেলেটি, সেই সাথে অবাকও হলো!
শান্তা কষ্ট করে উঠলো। ব্যাথায় চোখ,মুখ কুঁচকে গেল তার। এক পা এগোতেই আবার ককিয়ে উঠলো।ছেলেটা এগিয়ে এসে শক্ত করে শান্তার হাত ধরে ফেললো।
কোহিনূর বেগম সাম্যকে টেনে আনলেন নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে সাম্যর সামনে এসে দাঁড়ালেন।সাম্য বুঝে গেছে মা তাকে কি বলবে।তবু সে চুপ করে রইলো। মাকে কিছুটা সময় দিতে হবে।
তুই আমাকে কি বলেছিলি সাম্য?ওই মেয়েটার স্বামী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করছিস কেন?
মা,নিঝুম সাথে ধর্ম মতে বিয়ে হয়েছে আমার।অস্বীকার বা কি করে করবো?
আমি তোর কাছে উওর চাইছি, প্রশ্ন নয়?
সাম্য দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললো, তুমি আমায় কি বলতে এনেছ, বলো।
এভাবে কতদিন চলবে? নিঝুমের সাথে সংসার শুরু করার ইচ্ছা আছে নাকি?
সাম্য চুপ করে রইলো। কিভাবে বলবে মাকে,সে নিঝুমকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে!ভুল বুঝে নিঝুমের সাথে খারাপ আচরণ করতো।
কথা বলছিস না কেন?
আমি নিঝুমকে বউ হিসেবে মেনে নিয়েছি মা।
ঘরের ভেতর যেন বজ্রপাত হলো! কোহিনূর বেগম ভাষা হারিয়ে ফেললেন।ছেলেটা কি বলছে এসব?
কোহিনূর বেগমের মনে হলো তিনি ঠিক শুনতে পাননি।কাঁপা গলায় বললেন,কি বললি তুই,আবার বলতো?
সাম্য মাথা নিচু করে বললো,বিয়েটা আমি ভাঙতে পারবো না।বড় বাবা,বড়মা,বাবাকে কি জবাব দিবো?তাঁরা তো ভেঙে যাওয়ার জন্য বিয়েটা দেয় নি।
বাপ,চাচাদের কথায় নিজের জীবনটাকে শেষ করবি তুই? তোর কোনো কথা আমি শুনতে চাই না।নিঝুমকে তুই ডির্ভোস দিবি এটাই আমার শেষ কথা।
সাম্য হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো মায়ের পানে।বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।নিঝুমকে দ্বিতীয় কোনো আঘাত সে মরে গেলেও দিবে না!
মা, তোমাকে একটা কথা কখনো বলা হয়নি।”আমি নিঝুমকে ভালোবাসি চারবছর ধরে।”
কোহিনূর বেগম দরদর করে ঘেমে উঠলেন। মনে হলো তিনি এখুনি মাথা ঘুরে পরে যাবেন!
সাম্য ঘরে এসে নিঝুমকে কোথাও দেখতে পেল না।ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ধাক্কা লেগে গেল তার!
চলবে…