#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-১৮
#সিফাতী সাদিকা সিতু
শান্তা প্রচন্ড রাগ নিয়ে বসে আছে বাবার সামনে। টেবিলের ওপর পরে থাকা ছবি আর বায়োডাটার দিকে একটুও তাকাচ্ছে না।
তুই এতো রেগে যাচ্ছিস কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না? বিয়েটা তো করতেই হবে, তাই না?
না,সবাইকে বিয়ে করতে হবে এটার তো কোনো মানে নেই?তোমরা প্লিজ এসব বন্ধ করো।আমি বিয়ে করবো না।
কেন করবি না,সমস্যা কি তোর?শান্তার মা চেঁচিয়ে উঠলেন।
কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমি এখন বিয়ে ফিয়ে করতে পারবো না বলে দিলাম!আমার আরও সময় চাই।
অনেক সময় পেয়েছিস, আর নয়।বেশি বাড়াবাড়ি একদম করবি না।তোকে সব ধরনের আদর দিয়ে বড় করাটাই আমাদের ভুল হয়েছে।যখন যা চেয়েছিস, তাই দিয়েছি।তোর বাবা কখনো তোকে বকা পর্যন্ত দিতে দেয়নি আমায়।বাবা,মার কষ্ট কখনো বোঝার চেষ্টা করেছিস।সবসময় নিজেরটা ভেবেছিস।যথেষ্ট স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে তোকে।যদি মনে করিস বাবা,মা তোর কেউ নয়, তাহলে করতে হবে না বিয়ে। থাক তুই তোর মতো।শান্তার মা কাঁদতে,কাঁদতে ঘরে চলে গেলেন।
শান্তা মায়ের এমন আচরণে বেশ অবাক হলো আজ।মা যেন অনেক দিনের চাপা কষ্ট আজ প্রকাশ করলো।
বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সে।
তোর মায়ের কথায় মন খারাপ করিস না মা।আমরা কখনো তোর খারাপ চাইতে পারিনা।আমার বন্ধু নিজেই এসে তার ছেলের জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। ছেলে বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে কয়েক মাস হলো দেশে ফিরেছে।ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে।আমার বন্ধুও তো ওই ভার্সিটির ভিসি।সবদিক বিবেচনা করে আমার ভালোই মনে হয়েছে। এখন তুই ভেবে দ্যাখ, কি করবি?চাইলে ছেলের সাথেও দেখা করতে পারিস।এখানে সবকিছু থাকলো, মন চাইলে দেখিস।
শান্তার বাবা উঠে গেলেন।শান্তার হঠাৎ খুব কান্না পেল।সাম্যর মুখটা মনের কোণে উঁকি দিলো, সেই সাথে নিঝুমের হাস্যজ্জ্বল মুখটাও।শান্তা সাথে, সাথে চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়ালো।বাবার ঘরে ঢুকে বললো,”আমি বিয়ে করবো বাবা।”
সকালের নাস্তার পর সবাই এক সাথে বসেছে। সবার মুখ গম্ভীর। থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে সারাঘর জুড়ে। কোহিনূর বেগম ভাবশালীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।আমির, জামির,সামির
তিন ভাই আজ উপস্থিত। সামির বেশি চোটে আছে। গতকাল সাম্য ফোনে জানিয়েছে কোহিনূর উকিলের কাছে গেছে ডির্ভোসের জন্য। সামির সোজা অফিস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। কোহিনূর বেগমকে হাতে নাতে ধরতে পেরেছেন।স্ত্রীর এতবড় কান্ডে রাগে,লজ্জায় নিজেকে সামলাতে পারছেন না।নেহাত বড়ভাই সামনে আছে।
নিঝুম এক কোণে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।তার খুব লজ্জা করছে তাকে ঘিরেই এতসব কান্ড হচ্ছে।সাম্য সে তুলনায় বেশ শান্ত।
নাজনীন তুমি আমায় এসব আগে জানালে, এসবের কিছুই হতো না।আমির বেশ কড়াভাবে বললেন।
সেরকম কিছু তো বুঝতে পারিনি। ভেবেছি কোহিনূরকে একটু সময় দেয়া উচিত। ভয়ে, ভয়ে কথাটা বললেন নাজনীন।
ছোট বউ, তুমি আসলেই কাজটা ঠিক করনি।মা হয়ে ছেলের সংসার ভাঙতে চাও! তোমার এই বিয়েতে মত না থাকলে আমায় জানাতে পারতে।
ভাইজান, আপনার ভাইয়ের ওপর কথা বলেছি কোনোদিন? সেই তো নিঝুমের সাথে সাম্যর বিয়ে দেয়ার কথাটা আপনাকে বললো।এখানে আমার মতামতের কোনো ভিত্তি নেই।
আচ্ছা বুঝলাম।কিন্তু নিঝুমকে মেনে নিতে তোমার এতো সমস্যা হচ্ছে কেন?ওর কি খারাপ দেখলে তুমি?
কোহিনূর বেগম জবাব দিতে পারলেন না।রাগে ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। এরা সবাই তাকে অপরাধী মনে করছে।বিচার করতে চাইছে! গতরাতে সামির বলেছিলো,”তোমারও একটা সংসার আছে মনে রেখ।আমিও কিন্তু কোনোদিক ভেবে দেখবো না!”
ছেলেটাও কিছু বলছে না।সবাই তাকে দোষী ভাবছে।যৌথ পরিবারে বাবা তাকে বিয়ে দিয়ে জীবনটাই নষ্ট করে দিলো।নিজের সংসার, স্বামী,সন্তান কোনটাই নিজের হলো না।
সাম্য মাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে কাছে এসে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে।
তুমি নিজেকে ছোট ভাবছো কেন মা?আমি তো জানি তুমি আমায় কত ভালোবাসো?আমার খারাপ তুমি চাইতে পারো না।তুমি কোনো চিন্তা করো না,আমি মামার কাছে কিছু টাকা দিয়েছি, তোমার ভাগ্নীর দেখে শুনে বিয়ে দেবে।প্লিজ, নিঝুমকে মেনে নাও।ওর তো বাবা, মা নেই।আমরাই ওর সবকিছু।
কোহিনূর বেগম চোখের জল মুছে বললেন,ভাইজান, আমার আর এমন ভুল হবে না। ছেলে,ছেলের বউ ওরা ভালো থাকুক।কোহিনূর বেগম চলে গেলেন নিজের ঘরে।
নিঝুম অবাক চোখে শুধু সাম্যকেই দেখছে।
***
দূর আকাশে জ্বলজ্বল করছে একফালি চাঁদ। ছাঁদে পাটি বিছিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে সবাই।রাফাত ওর নতুন বউ নিয়ে বেড়াতে এসেছে সাম্যদের বাড়িতে।নাজনীন বেগম যেতে দেননি রাতে।নিঝুম সুপ্তির পাশে বসে আছে। আরোহী, রাফাতের বউ তানিয়া,রাফাত একসাথে বসেছে।সাম্য নিঝুমের মুখোমুখি বসেছে।আবছা অন্ধকারে নিঝুমের মায়াবী মুখটা দেখার লোভ সামলাতে পারেনি।
নাজনীন বেগম পাকোড়া, মুড়িমাখা দিয়ে গেছেন।সবাই জমজমাট আড্ডায় মেতেছে।আরোহী গান গেয়েছে।অনেক গল্প,হাসি তামাশা করেছে। রাফাত সাম্যকে ধরলো গান গাওয়ার জন্য। সাম্য এক পর্যায়ে রাজি হলো।রাফাত গিটারটা সাম্যর হাতে দিলো।
সাম্য একবার নিঝুমের দিকে তাকালো। দেখলো,নিঝুম কৌতুহল দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে গান ধরলো,
ভালোবেসে,যদি হাতটা ধরো,
ছেড়ে দেব যে সবই।
কাছে এসে,জড়িয়ে রাখো,
ভুলে যাবো পৃথিবী।
বুকের মাঝে চিনচিন করে,
জানো নাকি এ মন পুড়ে,
এভাবে দূরে থেকো না।
তোমার মাঝে ডুবি,ভাসি,
নিজের থেকে আরও বেশি,
ভালোবাসি কেন বুঝো না।
গান শেষ হওয়ার সাথে, সাথে সবাই হাত তালি দিলো শুধু নিঝুম ছাড়া।সে এখনো আবেশের ঘোরে আছে।সাম্য এত সুন্দর গাইতে পারে জানা ছিলো না তার।গানের প্রতিটি কথা তার হৃদয় ছুঁয়েছে।যেন কথা গুলো সাম্য তাকেই বলছে।এমন কল্পনা কেন হচ্ছে তার?
সাম্য নিঝুমের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে খুশি হলো।হৃদয়ের রাণী কি বুঝতে পেরেছে, সাম্য তার জন্যই গানটা গেয়েছে। নিজের মনের অনুভূতি গুলো দিয়ে ছুঁয়ে দিতে চেয়েছে।অব্যক্ত চাওয়া পাওয়া গুলো আজকাল তার বসে থাকতে চাইছে না।
রাতে ঘুমোনোর আগে নিঝুম জিজ্ঞেস করলো,আপনি কি গান শিখতেন?
সাম্য হেসে বললো,নাহ্,এমনি বন্ধুদের সাথে গাইতাম।ভার্সিটির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গাইতাম, এই আর কি।
এতো সুন্দর গাইতে পারেন,আপনার উচিত এটা নিয়ে একটু ভাবা।
আমি নিজের ভালোলাগা থেকে গান করি।সূদুর প্রসারী চিন্তা, ভাবনা নেই।
সাম্য লাইট বন্ধ করে শুয়ে পরলো।নিঝুম ও কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করলো।কিন্তু আজ ঘুম নামছে না চোখে।সাম্যর সেই সুর,কথা ভেসে উঠছে মনে।অজানা শিহরণ জাগছে!
সবকিছু ঠিকঠাক চললেও বিধাতার ভাবনা চিন্তা যেন অন্য রকম ছিলো।বিপদের কালো ছায়া যেন গভীর ভাবে ঢেকে নিলো সুখের পরিবারকে।অব্যক্ত ভালোবাসা ব্যক্ত হওয়ার আগেই বিলীন হয়ে গেল।
চলবে….