#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-৯
#সিফাতী সাদিকা সিতু
ট্রেন চলছে তার নিজস্ব গতিতে। নিঝুম জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। গাছপালা গুলো কেমন ছুটে দূরে সরে যাচ্ছে। রাতের আকাশ, দূরের ঘরবাড়ি গুলোর টিমটিমে আলো সবকিছু মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে। কতদিন পর নিজের সেই চিরচেনা গ্রামে যাচ্ছে সে! বাবা মায়ের কবর দেখতে পাবে।নিজের বলতে তো শুধু আছে ওই কবর দুটোই। নিঝুমের চোখ ভিজে গেলো।সাম্য তার পাশে বসে আছে চোখ বন্ধ করে। ঘুমিয়ে পরেছে কিনা বুঝতে পারছে না।গ্রামে গিয়ে কি করবে ভেবে অস্থির সে।সাম্যর সাথে ঠিকমতো কথাও তো সে বলে না,বলতে পারে না।চাচা,চাচী কারো সাথেই তেমন সখ্যতা নেই।ঢাকায় চলে আসার পর ছোট চাচাই শুধু খোঁজ খবর রেখেছেন।তিনি স্টেশনে থাকবেন ওদের নিতে।ট্রেনের হালকা ঝাঁকুনিতে ঝিমুনি এসে যাচ্ছে। এ কামরার সবাই ঘুমিয়ে পরেছে।কত রাত হয়েছে জানা নেই।ফোনটা ব্যাগের ভেতর রাখা, আর ব্যাগটা সাম্য উপরে তুলে রেখেছে।নিঝুম সিটে মাথা এলিয়ে দিলো।একা এভাবে জেগে থাকতে ভালো লাগছে না।
আশফি সন্ধ্যা থেকে নিঝুমকে ফোন করছে কিন্তু নিঝুম ফোনটা তুলছে না।পরিক্ষার পর নিঝুম ভার্সিটি আসছে না।এ কারণে তারও যেতে ইচ্ছে হয় না।কিন্তু, সে অপারগ।ভেবে ছিল নিঝুমের সাথে আজ কথা বলবে,পরিচয় দিবে,ভার্সিটি না আসার কারণ জানতে চাইবে। অথচ নিঝুম ফোন তুলছে না।আশফির মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো।ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বের হলো।একটু রিফ্রেশমেন্ট প্রয়োজন। অনেক দিন থেকে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসছে না সে।সবার অভিযোগ শুনতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে সবাই সিলেট ট্যুর শেষ করে ফিরেছে।আশফিকে অনেক বার বলার পরও সে যেতে পারে নি।এই বিষয়টা নিয়ে সবাই ওর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে।সে কি করবে।ভার্সিটি ছেড়ে ঘুরতে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।
ছেলেকে বেরোতে দেখে মিনারার মনটা আবার খারাপ হয়ে গেলো।ছেলেটা কি আগের জীবনে ফিরতে চাইছে?
***
নিঝুমদের নিতে ছোট চাচা এসেছে।সাম্যর সাথে কুশল বিনিময় শেষে ওদের নিয়ে বাড়ি মুখে চলছে। নিঝুম ছোট চাচাকে দেখে প্রায় কেঁদে দিয়েছিল। গ্রামের সবকিছু কয়েক বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে।অধিকাংশই বাড়ি এখন পাঁকা।নিঝুমের দাদুর বাবা ছিলেন এ গ্রামের জমিদার। সেই রেশ এখনো আছে।গ্রামের সকলে ওদের পরিবারকে খুব মান্য করে,সম্মান করে।নিঝুমের বাবা ছিলেন সবার বড়।সেই সাথে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার হওয়ার খুব সম্মানীয় ছিলেন।
নিঝুমরা ওর ছোট চাচার বাড়িতে এসে উঠলো।সবাই আলাদা ভাবে ঘরবাড়ি তুলেছে। নিঝুমের চাচী ওদের সাদরে গ্রহণ করলেন।নিঝুম সাথে জামাই নিয়ে এসেছে তাই বেশ খাতির যত্ন করলেন।নিঝুম ব্যাগ রেখেই বাইরে বেরিয়ে আসলো।নিজেদের বসত ভিটাটা একবার দেখতে।কিন্তু খুজে পেলো না।চাচাকে জিজ্ঞেস করার পর জানতে পারলো,সামনের ওই গাছগাছালির বাগানটুকু ওদের ভিটা।নিঝুমের মন খারাপ হয়ে গেলো। বাবা মায়ের কবর দেখতে চাইলে ওর চাচা আগে খেয়ে নিতে বললেন। তারপর পারিবারিক গোরস্থানে নিয়ে যাবেন।
নিঝুম, সাম্যর পাশে খেতে বসলো।সাম্য ফিসফিসিয়ে বললো,”এতো ভেঙে পরলে কিন্তু চলবে না।নিজেকে ঠিক রাখো।তা না হলে বড় মাকে সব বলে দিবো।”
নিঝুম সাম্যর কথার কোনো জবাব দিলো না।সে তো আর সাম্যর মতো নয়।এতোদিন পর বাবা মায়ের কবর দেখবে তাতে মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। এটাও যেন সাম্যর সহ্য হচ্ছে না।লোকটা তাকে কোনোদিন বুঝতে পারবে না!
সাম্য জানে নিঝুমের ভেতর কি চলছে।নিঝুম যতই খারাপ হোক না কেন,বাবা,মাকে হারানোর ব্যাথা নিশ্চয়ই আছে! আসার সময় বড়মা বারবার বলে দিয়েছে, নিঝুকে সামলাতে।খুব বেশি সময় থাকা যাবে না।আজকের দিনটা পার হলেই নিঝুমের চাচার সাথে কাগজ পত্র গুলো নিয়ে কথা বলবে।
খাওয়া শেষে নিঝুম,সাম্যকে নিয়ে ওর ছোট চাচা ওদের পুরান বাড়িতে নিয়ে গেলেন।ওখানেই পারিবারিক গোরস্থান। নিঝুম বাবা মায়ের কবরের কাছে দাঁড়িয়ে নিরবে কাঁদলো।সাম্য একটু দূর থেকে দেখছে।আজ নিঝুমের কান্না দেখে ঠিক সেদিনের মতো অনুভূতি হচ্ছে। নিঝুম যেদিন তার বাগানে বসে কাঁদছিল সেদিন তারও হৃদয় আন্দোলিত হয়েছিল।নিঝুমের কান্না তার বুকে শেলের মতো বিঁধেছে।সাম্য নিঝুমের চাচাকে ইশারায় নিঝুম নিয়ে আসতে বললো।
নিঝুম ওর মেজো চাচার বাড়িতে এসেছে।সবাই ঠিক ভাবে কথা বললেও “সারা “ঠিক মতো কথা বললো না।সারা ওর মেজো চাচার মেয়ে।নিঝুম খুব অবাক হলো।সারা ওর সমবয়সী ছিল,ওরা এক ক্লাসেও পরতো।নিঝুমের বাবা মা সারাকেও নিঝুমের মতো ভালোবাসতো।ঢাকা যাওয়ার পর নিঝুম সারার সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু সারা পাত্তা দেয়নি।নিঝুম ভেবেছে, সে চলে আসায় সারা অনেক কষ্ট পেয়েছে, তাই অভিমানে কথা বলে না।আজ এতো কাছে এসেও সারা একই ব্যবহার করছে!সারা একটু কথা বলেই ভিতরে চলে গেছে।ব্যাপারটা সাম্যও খেয়াল করেছে।
সাম্য বাইরে বেরিয়েছে ফোনে কথা বলতে। এখানে নেটওর্য়াকের খুব বেশি সমস্যা। গ্রামে সন্ধ্যা নামার পরপরই মনে হয় অনেক রাত।বাঁশ ঝাড়ের দিকে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। মন্দ লাগছে না তার।বাড়িতে কথা বলার পর কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো।হালকা ঠান্ডা বাতাসে শরীর ফুরফুরে হয়ে গেলো। শান্তার ফোনে সেটা বিগড়ে গেলো।সাম্যর একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না শান্তার সাথে কথা বলতে।তারপরও ফোনটা ধরলো।
–তুই কি সত্যি আমাকে এখন বন্ধুও ভাবিস না?
–সেটা ভাবার মতো অবস্থা কি তুই রেখেছিস?
–দোষটা না হয় আমার।তোর প্রতি অন্যরকম অনুভূতি আমার মনে আছে।কিন্তু তুই তো শুধু আমাকে বন্ধুই ভেবেছিস, তাহলে কেন এমন করছিস?
–দ্যাখ শান্তা,এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা।তাছড়া এখন আমি শহরে নেই।এসব কথা পরে হবে।
–কোথায় তুই?
–নিঝুমকে নিয়ে ওর গ্রামে এসেছি।
–ভালোই তো।নতুন দম্পতি তোরা।এখনই তো ঘুরে বেড়ানোর সময়!
–বাজে কথা বলবি না।আমি বা নিঝুম কেউই এখানে শখের বসে ঘুরতে আসিনি।বড় বাবা আমাদের পাঠিয়েছে কিছু কাজে।
–নিঝুমের গ্রামের বাড়িতে তোর আবার কি কাজ?
–নিঝুমের বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির বিষয়ে কিছু কাজ আছে।
–এই বার বুঝেছি।তোদের নিঝুমের প্রতি এতো দয়া-মায়া কেন?ভালোই হলো সাম্য তুই অনেক সম্পত্তির মালিক হবি।তাই নিঝুমকে এখন খুব ভালো মনে হবে, এটাই স্বাভাবিক।
–শান্তা!তুই, তোর সীমার মধ্যে নেই।অন্তত বন্ধুর মর্যাদাটা রাখ।নিজেকে এভাবে নিচে নামিয়ে আনিস না।
সাম্য ফোনটা কেটে দিলো।শান্তার প্রতি রাগটা বেড়ে গেলো।
ঘরে ফিরে দেখলো নিঝুম বসে আছে বিছানায়।ওকে দেখে বললো,”এখানে তো সোফা নেই,বাংলা সিনেমার নায়িকাদের মতো আমি নিচে শুতে পারবো না।”
সাম্য, নিঝুমের কথায় কড়া চোখে তাকালো।
নিঝুম সেই দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বিছানার এক পাশে শুয়ে পরলো।তার বুক ধুকপুক করছে সাম্যকে এভাবে বলে!
সাম্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিঝুমকে দেখলো।এখন নিঝুমের পাশে শুতে হবে তাকে!কি ঝামেলায় পরলো সে!ঘরের ভেতরেই পায়চারি করলো।একটু বাদেই সেও নিঝুমের পাশে শুয়ে পরলো।শোয়ার পর মনে হলো এই বিছানাটা অনেক ছোট!সাম্য বিছানায় আসার পর নিঝুমের ধুকপুকানিটা আরো বেড়ে গেলো।এই প্রথম সাম্যর সাথে সে একই বিছানায় শুয়েছে।বিছানার দুইপ্রান্তে দুটো মানুষ নড়াচড়া বন্ধ করে আড়ষ্ট হয়ে আছে।কিন্তু এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়।নিঝুম আস্তে করে পাশ ফিরে শুতে চাইলো।পা দুটো নড়াতেই সাম্যও নড়ে উঠলো।ফলাফল স্বরূপ দুজনের পায়ে পায়ে বিবাদ ঘটে গেলো!
চলবে…