ভালোবাসার_ফোড়ন পর্ব_৭
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
মামী আমাকে দেখে মামা’র কাছে বলতে লাগলো…
– এই তো এসেছে নবাবজাদি, আমার টাকা চুরি করে শান্তি তে ঘুমিয়েছিল মুখপুড়ি।
আমি মামী’র কথা শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কি বলছে মামী এইসব,
মামা আমার দিকে তাকিয়ে বলল..
– কিরে টাকা তুই চুরি করেছিস?
– না মামা তুমি এসব কি বলছো! আমি টাকা চুরি করতে যাবো কেন?
মামী চেঁচিয়ে বলে উঠলো..
– যাবি কেন মানে? তুমি শোন কাল রাতে ও আমার টাকা চেয়েছে আমি দেই নি তাই টাকা চুরি করেছে ও
– মামী তুমি ইচ্ছে করে মিথ্যে বলছো কেন?
– আমি মিথ্যে বলছি এই তুমি চলো তো, ওর ঘরে খুঁজে দেখো টাকা নিশ্চিত ওখানেই পাবে।
– মামী তুমি মিথ্যে অপবাদ কেন দিচ্ছো আমায়।
– আমি কি বললাম তুমি দেখো তো।
.
মামী’র কথায় মামা আমার ঘরে এসে তলাশি করতে লাগলেন। এখানে ওখানে করে পুরো ঘর খুঁজছে। মামী বলে দিচ্ছে এখানে খুঁজতে আবার ওখানে খুঁজতে ।
মামা সব খুঁজে যখন টাকা পেলো না তখন মামী বলল..
– ওই ব্যাগ টা খুঁজে দেখেছো।
– না দেখছি..
ব্যাগ তো আমার বই কেনার টাকা রাখা আছে। তাই আমি বলে উঠলাম…
– মামা শোন…
এর আগেই মামী আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলেন।
মামা আমার ব্যাগ খুঁজে ২ হাজার টাকা পেলেন। আমি সাথে সাথে বলে উঠলাম..
– মামা এটা আমার বই কেনার টাকা। কাল বেতন পেয়েছি সেই টাকা।
মামী চেঁচিয়ে বলে উঠলো…
– কি বললি মুখ পুড়ি, এটাই তো আমার টাকা। বললাম না তোমাকে আমার টাকা ওই’ই চুরি করেছে। এখন বাঁচার জন্য মিথ্যে বলা হচ্ছে!
মামী’র কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে মামা কে বললাম..
– মামা তুমি বিশ্বাস করো এটা আমার টাকা, আমি মামী’র টাকা নেয় নি।
মামী আমাকে ধমক দিয়ে বললেন..
– আবার মিথ্যে বলছিস তুই!
আমি কাঁদতে কাঁদতে মামা’র কাছে গেলাম। তার হাত ধরে বললাম..
– মামা এই টাকা আমি বই কেনার জন্য রেখেছি, তুমি একটি বার শোন আমার কথা…
হুট করেই মামী এসে আমার গাল জোরে চড় বসিয়ে দিলেন। আমি গালে হাত দিয়ে কাঁদছি, তবুও বলছি এই টাকা’টা আমার। মামা কড়া কড়া গলায় বলল…
– এতো বড় কাজ তুই করলি কিভাবে, শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরেই টাকা চুরি করলি।
– মামা তুমি শোন আমার কথা…
মামী এসে আমার চুলের মুঠি ধরে..
– অনেক শুনেছি তোর কথা এবার আমার কথা শোন। এই হাত দিয়ে আমার টাকা চুরি করেছিস না তুই। দেখ তোর এই হাতের আমি কি হাল করি।
বলেই মামী আমার চুল ধরে রান্না ঘরে নিয়ে গেলেন। মামা আমাদের পিছন পিছন আসল। মামী ছিটকে ফেলে দিলেন আমায়। আমি নিচে পরে গেলাম। মামী একটা খুন্তি গরম করে আমার ডান হাতের তালুতে লাগিয়ে দিলেন। আমি জোরে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু আমার সেই চিৎকার মামী’র কানে পৌছাল না। মামা বের হয়ে গেলেন।মামী এক হাত দিয়ে খুন্তি ধরে আছে অন্য হাত দিয়ে আমার হাত। আমি ইচ্ছে করেও সরাতে পারছি না। শুধু কেঁদে যাচ্ছি!
কিছুক্ষণ পর মামী আমাকে ছেড়ে দিলেন, আমি দৌড়ে কলের নিচে হাত রাখলাম। খুব যন্রণা হচ্ছে, মামী চলে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন “কখনো যেন তার কথার উপর নাহ না বলি”।
এক হাত কলের নিচে রেখে কাঁদছি, যন্রণায় আমার জান বের হয়ে যাচ্ছে। মামী এমন’টা না করলেও তো পারতো। আমি তো বলেছিলাম টাকা দিয়ে দিবো। তারপরও এমনটা কেন করলো সে।
হুট করেই মামী কতোগুলি থালা বাসন এনে আমার সামনে রাখল। বলল এক্ষুনি এইসব ধুয়ে দিতে। এতো কিছু’র পর না বলার সাহস পেলাম না। কোনো মতে এক হাত দিয়ে ধুতে লাগলাম তবুও হাত খুব জ্বলছে। মামী এসে তাড়া দিয়ে গেল, তাড়াতাড়ি করে থালা বাসন ধুয়ে যেন রান্না চাপাই। হাতে একটা কাপড় বেঁধে তাড়াতাড়ি করে রান্না বান্না সব করলাম। তারপর ভার্সিটিতে চলে আসলাম। ভার্সিটিতে আসলে একটু মানসিক শান্তি পেতাম আমি। এখানে তো আর মামী এসে বকাঝকা করতে পারবে না কিন্তু তাও হারাম করে দিলো নিতি আর তার বন্ধুরা।
জানি আজও কিছু না কিছু করবে, কিন্তু কিছু করার নেই আমার সহ্য করা ছাড়া। হাতের দিকে তাকিয়ে আনমনে ক্লাসরুমে যাচ্ছিলাম। হাতের কাপড়’টা সরিয়ে ফেললাম না হলে ক্ষত টা শুকাবে না। এতো পানি দেবার পরও হাতে ফোস্কা পড়েই গেল। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ’ই কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। তাকিয়ে দেখি আহিয়ান। বুঝলাম না কিছু সবসময় কি ওর সাথেই আমার ধাক্কা খেতে হবে। তাড়াতাড়ি করে আশপাশ তাকালাম নাহ নিতি আপু কোথাও নেই।
সামনে তাকিয়ে দেখি আহিয়ান রেগে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম না কি হলো। খেয়াল হলো ওর হাতে ফোন নেই, সেটা মেঝেতে পরে আছে। আমার সাথে ধাক্কা খেয়েই পরেছে বোধহয়। আমি সরি বলতে যাবো তার আগে আহিয়ান আমার পোড়া হাত টা চেপে ধরে বলল…
– এই মেয়ে কি করলে এটা তুমি? চোখে দেখে হাঁটতে পারো না। চোখ কোথায় থাকে তোমার।
আমি ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠলাম। আপনা আপনি চোখ থেকে পানি পড়তে লাগল। আহিয়ান সাথে সাথে আমার হাত ছেড়ে দিলো। হয়তো অবাক হয়েছে একটু হাত ধরাতে আমি এতো ব্যাথা পেলাম কি করে? কিন্তু ও’তো আর জানে না আমার হাত’টা পুড়ে গেছে।
আহিয়ান এখনো অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি হাত ধরে কাঁদতে থাকি। হুট করেই ও আবার আমার হাত ধরে দেখতে লাগল। আমার পোড়া হাত দেখে কপাল কুঁচকে বলল…
– তোমার হাত পুড়লো কিভাবে?
উনার থেকে হাত সরিয়ে..
– সেটা আপনার না জানলেও চলবে। সরি আমি খেয়াল করি নি। আপনার ফোন’টা পরে গেছে..
বলেই নিচ থেকে উনার ফোন’টা তুলে তাকে দিতে গেলাম।
উনি ফোনের বদলে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল। আমি কোনোমতে তার থেকে হাত ছাড়াতে পারছি না। ভয়ে আমার কলিজা’র পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। নিতি দেখলে আজ আমাকে মেরে’ই ফেলবে। আমি আশপাশ তাকিয়ে যাচ্ছি আর উনাকে ডেকে যাচ্ছি। কিন্তু কে শুনে কার কথা। উনি উনার মতো’ই আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা উনি আমায় মারবে না তো। ফোন তো ঠিক’ই আছে। তাহলে…
আহিয়ান আমাকে Rest Room এ নিয়ে গেল। কিন্তু এখানে কেন? আহিয়ান একটা চেয়ারে আমাকে বসিয়ে দিয়ে কি জানি খুঁজতে লাগলো। তারপর আমার সামনে চেয়ার টেনে বসে আমার হাত নিজের কাছে নিলো। উনি শান্ত গলায় বলে ওঠলো..
– এখনো হাতে মলম লাগাও নি কেন? এতো ফোস্কা পড়ে গেছে, তারপর এভাবে ঘুরছো। হাত এভাবে পুড়লে কি করে।
বলেই আমার হাতে মলম লাগাতে যাবে আমি তাড়াতাড়ি করে হাত সরিয়ে ফেললাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে
অবাক হয়ে বলল…
– কি হলো?
– আপনি প্লিজ আমাকে ধরবেন না নিতি আপু দেখলে আমাকে আবার পানিশমেন্ট দিবে।
কপাল কুঁচকে বলল..
– আবার পানিশমেন্ট দিবে মানে..
– কিছু না কিছু না। কিছু করা লাগবে না আপনার এটা ঠিক হয়ে যাবে।
বলেই আমি ওঠতে লাগলাম।
– এই দাঁড়াও কোথাও যাবে না তুমি বসো এখানে!
– কিন্তু..
আমার হাত থেকে ফোন টা নিয়ে..
– বসো এখানে আমি আসছি!
বলেই বাইরে চলে গেলেন। আমি সেখানে বসলাম, খানিকক্ষণ বাদে ফিরে এসে আবার চেয়ারে বসলেন। আমি বলে উঠলাম..
– এখন আমি যাই!
– যেতে বলেছি আমি বসো এখানে.. ( ধমক দিয়ে )
– আমি আবারও বসে পরলাম।
.
কিছুক্ষণ পর’ই ইতি আসলো। আমাকে দেখে সে আমার কাছে দৌড়ে আসলো। তার পিছু পিছু আকাশ ভাইয়া। তাহলে কি উনি ইতি’কে ডাকতে গিয়েছে। ইতি আমার কাছে এসে বলে ওঠলো..
– কি হয়েছে তোর? আকাশ ভাইয়া বলল কি নাকি হয়েছে তোর। জানিস কতো ভয় পেয়েছে আমি।
কিছু বলতে যাবো তার আগে আহিয়ান বলে উঠলো..
– কিছু হয় নি হাত পুড়ে গেছে এই নাও ঔষধ লাগিয়ে দাও।
– কি কই কই দেখি, বেশি পুড়েছে!
– আরে না না.. ( হাত দেখালাম )
– এটা কম, অনেকক্ষণি তো পুড়ে গেছে। এভাবে পুড়লো কিভাবে?
– রান্না করতে গিয়ে!
আহিয়ান আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকায়। আমি তার থেকে চোখ সরিয়ে নেই। এভাবে তাকিয়ে আছে কেন তিনি। ইতি তাড়াতাড়ি করে আমার হাতে মলম লাগিয়ে দিলো। খুব ব্যাথা করছিলো।ইতি অনেক বকাঝকাও করলো। তারপর আমি উঠে ইতি কে নিয়ে চলে এলাম। আসার সময় আহিয়ান’কে একটা ধন্যবাদ ও দিলাম। আহিয়ান আর আকাশ ভাইয়া দু’জনেই ছিলেন এতোক্ষণ। আমি আসার পর’ও তারা ওখানেই ছিলো।
ক্লাস শেষ করে বের হতে’ই দেখি নিতি আর তার দল। কিন্তু অবাক হবার ব্যাপার হলো সে আমাকে দেখে রেগে চোখে’ই গিলে খেলো। মুখে কিছু বললো না। বেশ হবাক লাগলো। নিতি আমাকে চোখ রাঙিয়ে চলে গেলো। তারা চলে যেতে’ই আকাশ ভাইয়া এসে বলতে লাগলো..
– নিতি কিছু বলেছে তোমায়?
– না ভাইয়া! ( অবাক হয়ে )
মুচকি হেসে বললেন..
– চিন্তা করো না আর বলবে না, আহি ওদের মানা করে দিয়েছে।
– ধন্যবাদ ভাইয়া। ( কিঞ্চিত হেসে )
– ঠিক আছে। সাবধানে থেকো আর হাতের খেয়াল রেখো।
– জ্বি ভাইয়া।
.
উনি চলে গেলেন। আমি আর ইতি অনেকটা অবাক হলাম। ইতি আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলে উঠলো..
– যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততোটা মনে হচ্ছে না।
– যাই হোক কিন্তু আমার সাথে যা করেছে আমি তা কখনো ভুলবো না।
বলেই হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু মনে কোথাও উনার জন্য একটু হলেও ভালো লাগা কাজ করলো। কিন্তু সেটা ভালোবাসা নাহ। উনার ভালো মানুষী দেখে ভালো লাগা। কিন্তু এটা কি সত্যি’ই উনার ভালোমানুষী নাহ অন্যকিছু। নতুন কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস নাকি বুঝতে পারলাম না।
আকাশের পানে তাকিয়ে এসব ভাবছিলাম। উনার এমন ব্যবহার আমি আসা করি নি। কিন্তু সেদিনের উনার ব্যবহারে উনার প্রতি আমার ভয় কমে গেলো। হঠাৎ’ই কারো ডাকে হুস ফিরল..
– ভাবনা শেষ তোমার!
চমকে উঠলাম, পাশে তাকিয়ে দেখি আহিয়ান বিন ব্যাগ বসে আছে..
– আপনি!
দু হাতের তালু ঘসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে…
– হ্যাঁ আমি! ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় হিসেব করে গত আধ ঘণ্টা ধরে তোমাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম।
আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম…
– কি আধ ঘণ্টা !
– জ্বি হ্যাঁ, গত আধ ঘন্টা ধরে এখানে বসে তোমাকে দেখছি। আর তুমি টের ও পাওনি। কার ভাবনা ডুবে ছিলে এতোক্ষণ। এতো মনোযোগ দিয়ে কাকে ভাবছিলে!
– কাউকে নাহ!
– হতেই পারে না, কাউকে না কাউকে তো ভাবছিলে। কিন্তু কাকে, তোমার তো বফ টফ নেই
– আপনি কি করে জানলেন?
– তোমার সব খবর আছে আমার কাছে। এখন বলো কার কথা ভাবছিলে।
কিঞ্চিত হেসে..
– কারো কথা না শুধু কিছু অতীত!
– অতীত কে এতো মনোযোগ দিয়ে ভাবছিলে, আসলেই তুমি আস্ত একটা বোকা।
– কেন?
– অতীত ভেবে কি লাভ হুম। ভাবলে বর্তমান নিয়ে ভাববে কাজে লাগবে।
– জানি কিন্তু কিছু অতীত আমাদের সারাজীবন মনে রাখতে হয়, কারন এটার সাথে আমাদের বর্তমান জড়িত।
– হ্যাঁ বুঝেছি।
– বাহ্ এইবার বুঝলেন আমার কথা, তার মানে আপনার মতো একটা মুরগি’কে আমি মানুষ বানাতে পারলাম। ( জোরে হেসে )
ধমক দিয়ে বললেন…
– নিহা!
সাথে সাথে চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু সেটা ক্ষনস্থায়ী। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম..
– তা এতোক্ষণ আমার পর্যবেক্ষণ এর কারন কি?
– মা ডাকতে পাঠিয়েছিলো তোমাকে, কিন্তু এখানে এসে দেখি তুমি তোমার ভাবনার জগতে আছো।
কপালে হাত দিয়ে..
– কিহহহহ মা আমাকে সেই আধ ঘণ্টা আগে ডাকলো আর আপনি তা না করে এখানে বসে ছিলেন।
– হ্যাঁ মানে…
– ধুর ছাতার মাথা রাখুন আপনার মানে টানে।
বলেই ঘরের দিকে গেলাম। এতোক্ষণ বেলকনির দোলনায় বসে ছিলাম। আর উনি নাকি আমাকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। হায় আমার কপাল!
রুমে এসে দেখি পুরো রুম পরিস্কার, তার মানে সার্ভেন্ট এসে রুম ও পরিষ্কার করে গেছে আর তাও আমার ধ্যান ভাঙে নি। তাড়াতাড়ি করে মা’র রুমের দিকে গেলাম। আর উনি আমার পিছন পিছন আসতে লাগলেন!
#চলবে….
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/409040194151092/