প্রিয়ম তুমি কি আমায় একটুও ভালোবাসো না?
এই একটুখানি। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে পরিমাণটা দেখিয়ে দিলো কুহু।
কুহুর এমন কথায় ভড়কালো না প্রিয়ম। শান্তশিষ্টভাবেই জবাব দিলো, “না বাসি না। একটুও ভালোবাসিনা আমি তোকে। যাতো এখান থেকে। জ্বালাবি না একদম।”
“প্রিয়ম প্লিজ আজকের দিনে অন্তত সত্যিটা স্বীকার করো।” প্রিয়মের হাত ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল কুহু। ওর চোখদুটো ছলছল করছে।
কুহুর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়ম বলল, “তোর সাহস তো দেখি দিনকে দিন বেড়েই চলেছে কুহু! কোন সাহসে তুই আমাকে নাম ধরে ডাকিস! গুনে গুনে তোর তিনবছরের বড় আমি।”
“শুধু নাম ধরে কেন দরকার পড়লে তোকে আমি তুই করেও বলবো। ভাব দেখাস আমার সাথে! তোর ভাব যদি আমি না ছুটিয়েছি তাহলে আমার নামও কুহু না।” মনে মনে কথাগুলো বিড়বিড় করলেও কণ্ঠনালী পর্যন্ত আনার সাহস করলোনা।
কুহু মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই প্রিয়ম বলল, “পাত্রপক্ষ হয়তো এতক্ষণে চলে এসেছে। যা, নিচে যা।”
প্রিয়মের এমন কাটকাট কথা শুনে খানিকটা মিইয়ে গেলো কুহু। চোখের কোণে হয়তো একটু জল এসেও জমলো। কিন্তু ওর সামনে দাঁড়ানো পাষণ্ডটা তো সেটা দেখতে পাচ্ছেনা। তবুও বাচ্চাদের মতো গো ধরা গলায় বলল, “না, যাবোনা আমি।”
প্রিয়ম মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, “তোকে আমি নিচে যেতে বলেছি কুহু। এবার কিন্তু মার খাবি আমার হাতে।”
ব্যথাতুর দৃষ্টিতে একবার প্রিয়মের দিকে তাকালো কুহু। তারপর মনে একরাশ অভিমান আর আকাশসম কষ্ট নিয়ে এক ছুটে ছাদ থেকে নিচে চলে যায়। প্রিয়ম কুহুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
______________
নীল রঙের জামদানী, কপালে কালো টিপ, দুহাতভর্তি নীল কাচের চুড়ি, ঠোঁটে পিঙ্ক লিপস্টিক আর চোখের নিচে গাঢ় কাজলের রেখা টেনে তৈরি হয়ে নিলো কুহু। সাজ কমপ্লিট হতেই আয়নায় একনজর নিজের প্রতিবিম্বটা দেখে নিলো।
প্রিয়মের ফুফু নীলিমা এসে দেখেন কুহু তৈরি হয়ে গেছে। ওকে তৈরি হতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন তিনি। যাক মেয়েটার সুমতি হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপদটাকে কাধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচেন। নয়তো বলা যায়না কবে আবার তার ভাইপোর কাঁধে ঝুলে যায়। নিজের ভাই আর ভাবীর মতিগতিও তার কাছে ভালো ঠেকছেনা। নিজের সোনার টুকরো ভাইপোর সাথে বাপ মা মরা, চালচুলোহীন এ মেয়েটাকে উনি কিছুতেই মানতে পারবেননা। তাইতো গোপনে এ মেয়ের জন্য পাত্র দেখছিলেন অনেকদিন ধরেই। মোটামুটি ভালো একটা ছেলে পেতেই ভাই-ভাবীকে না জানিয়েই ওদের আসতে বলে দিয়েছেন। আগে বললে তারা যদি না করে দেন সেই শঙ্কায়। তবে ওদের হাবভাবই বলে দিচ্ছে যে তারা এতে মোটেও খুশি হয়নি। তাতে অবশ্য নীলিমার বিশেষকিছু যায় আসেনা। কাজের কাজ যেটা সেটা হলেই হলো।
____________
ছেলেপক্ষরা সবাই চলে এসেছে ইতোমধ্যে। তাদের সামনের সিঙ্গেল সোফাটার উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন চাপছে প্রিয়ম। প্রিয়মের এমন ভাবলেশহীন আচরণে গায়ে জ্বালা ধরে উঠলো কুহুর। পারলে কাচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো এই প্রিয়মের বাচ্চাটাকে। ভেবেছিল ওকে এভাবে সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে আসতে দেখে রেগে হলেও প্রিয়ম হয়তো সত্যিটা বলবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। আপাতত এসব আকাশকুসুম ভাবনাগুলো মনের মাঝেই দাপন করে অন্য সিঙ্গেল সোফাটায় গিয়ে বসে পড়লো। পাত্র একটু পরপর আড়চোখে কুহুকে দেখছে এতে যেন গায়ের জ্বালাটা আরো বেশি বেড়ে গেলো ওর। ইচ্ছেতো করছে ছেলেটার চোখগুলো গেলে দিতে একদম। জীবনে মেয়ে দেখেনি মনে হয়! আর চাউনিটাও কেমন যেন? অস্বস্তিকর।
সেই সাথে প্রিয়মের উপর মনের মাঝে জমা রাগ আর অভিমানের পারদটাও তরতর করে বেড়ে চলেছে। প্রিয়ম যদি আজ সত্যিটা কনফেস করতো তাহলে ওকে এখানে আসতেও হতোনা আর এমন অস্বস্তিজনক পরিস্থিতিতেও পড়তে হতোনা।
ভেবেছিলো ওকে এভাবে সেজেগুজে আসতে দেখলে হয়তো প্রিয়ম রেগেমেগে হলেও সত্যিটা বলে দিবে।
নীলিমা আর দীপ্তি সবার আপ্পায়নে ব্যস্ত। নীলিমা বেশ খোশমেজাজেই আপ্পায়নে সাহায্য করছেন। আর দীপ্তি ভাবলেশহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মনে মনে তিনি বেশ বিরক্ত নিজের ননদের উপর। নেহাত ননদের অপমান হবে তাই এখন চুপচাপ সবটা হজম করে যাচ্ছেন। নয়তো ছেলেপক্ষকে বাড়ির ভেতর পা রাখার অনুমতিটুকুও দিতেন কিনা সন্দেহ।
প্রিয়ম এখনো অনবরত ফোন চাপছে। কুহু ভেবে পাচ্ছেনা ফোনে কি এমন কাজ যে এমন মুহূর্তে এসেও ফোন নিয়ে এতোটা ব্যস্ত। বড্ড রাগ লাগলেও চুপচাপ সেটা হজম করে নিলো। মাঝেমাঝে ওকে করা প্রশ্নের উত্তরগুলো দিচ্ছে আর ফাঁকেফাঁকে আড়চোখে প্রিয়মকে দেখে চলেছে। যতোই ওকে দেখছে ততোই রাগটা তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। এদিকে নীলিমা পাত্রের মায়ের সাথে গল্প পেতে বসেছেন। তাদের দুজনের কথায় ব্যাঘাত ঘটলো কর্কশ শব্দে কলিং বেলটা বেজে উঠায়। দীপ্তি গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই রাফসান সাহেবকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এতক্ষণ তার মুখে দুশ্চিন্তা আর ভয়ের যে মেদুর ছায়া পড়েছিলো মুহূর্তেই সেটা কেটে গিয়ে সেখানে এখন স্নিগ্ধ হাসির ফোয়ারা বইছে। রাফসান সাহেবও স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটা ঝলমলে হাসি উপহার দিলেন।
ড্রয়িংরুমে এসে আগন্তুকদের দেখে দীপ্তির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন, “উনাদের তো ঠিক চিনলাম না। কারা এনারা?”
দীপ্তি কিছু বলার আগেই নীলিমা ভয়ে ভয়ে বললেন, “উনারা কুহুকে দেখতে এসেছে ভাইয়া। ছেলে খুব ভালো জব করে আর ফ্যামিলিও ভালো তাই আমিই তাদের আসতে বলেছিলাম।”
ননদের অবস্থা দেখে দীপ্তি মুখটিপে হাসছেন। রাফসান সাহেব বোনের দিকে একটা নিরব দৃষ্টি ছুড়ে দিলেন। ভাইয়ের এমন শান্ত চাউনিতে নীলিমা বেশ ঘাবড়ে গেলেন। বোনের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মেহমানদের দিকে ফিরে বললেন, “আপনাদের এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। মাফ করবেন। আমাদের মেয়ে এখনো অনেকটাই ছোট। আঠারোও হয়নি এখনো। আমরা এখনি মেয়ে বিয়ে দেবোনা। আমার বোন আমাদের না জানিয়েই আপনাদের ডেকে ফেলেছে। জানালে এমন ভুল হতোনা।”
“আরে ভাইয়া আর মাস তিনেক পরেই তো কুহুর আঠারো হয়ে যাবে। তারা নাহয় এখন আংটি পড়িয়ে গেলো। ওর আঠারোতম জন্মদিনের পরেই নাহয় বিয়ের কাজটা…” ভাইয়ের রক্তিম চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে বাকি কথাটুকু আর শেষ করতে পারলো না সে।
পাত্রপক্ষের সবাই বিদায় নিয়ে চলে যায়।
প্রিয়ম অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে। ওর বাবা মানুষটা পারেও বটে। সকলের সামনে এমন ভাব করলো যেন তিনি এসবের কিছুই জানতেন না।
______________
প্রিয়ম ওর বারন্দায় লাগানো গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। বিকেলের নরম আলো এসে গাছগুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
“তা ইয়াং ম্যান সব দুশ্চিন্তা এবার দূর হলো তো?”
প্রিয়মের কাধে চাপড় মেরে কথাটা বললেন রাফসান সাহেব। বাবার কথায় পেছন ঘুরে মিষ্টি করে হাসলো প্রিয়ম। ছেলের হাত থেকে পানির পটটা নিয়ে রাফসান সাহেব নিজেই পানি দিতে থাকলেন গাছগুলোতে। বাবা ছেলে দুজনেই বড্ড গাছ আর বই পাগল। বারান্দা ছাড়া ছাদেও তাদের খুব সুন্দর একটা বাগান আছে। বাবা ছেলে দুজন মিলেই এগুলোর দেখাশোনা করে। আর স্টাডি রুমে রয়েছে অজস্র বইয়ের সমাহার। বাবা ছেলে দুজনেরই অবসর সময় কাটে গাছের দেখাশোনা করে নয়তো স্টাডি রুমে বইয়ের মাঝে বুদ হয়ে।
__________________
দীপ্তি দুটো কফি বানিয়ে কুহুর হাতে দিয়ে বললেন প্রিয়মের ঘরে গিয়ে দিয়ে আসতে। কুহু কফির ট্রেটা দীপ্তির হাতে ফেরত দিয়ে বলল, “তোমার ছেলেকে তুমিই গিয়ে দিয়ে এসো। আমিতো পারলে কফির সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দেই তোমার ওই বজ্জাত ছেলেকে। খুন করতে মন চাইছে তাকে আমার।”
কুহুর কথাশুনে শব্দ করে হেসে উঠলেন দীপ্তি। মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললেন, “তোর সাহস তো দেখি কম না মেয়ে! আমার সামনেই আমার ছেলেকে মারার কথা বলছিস।”
“তুমিতো আমার সোনা মা। তোমাকে না বললে কাকে বলবো বলোতো?” বলেই দীপ্তির গলা জড়িয়ে ধরলো। দীপ্তি হাতের ট্রেটা শক্ত করে ধরে বললেন, “আরে করছিস কি! আস্তে, কফিটা পড়ে যাবেতো।”
কুহু জিহ্বায় কামড় দিয়ে ছেড়ে দিলো দীপ্তিকে। দীপ্তি কফির ট্রেটা আবারো কুহুর হাতে দিয়ে বললেন, “আমার লক্ষ্মী মা। যা, গিয়ে প্রিয়মকে আর তোর বড় বাবাকে কফিটা দিয়ে আয়। ওরা প্রিয়মের ঘরেই আছে।
কুহু হতাশার একটা শ্বাস ফেলে কফির ট্রেটা হাতে তুলে নিলো।
চলবে,,,
ভালোবাসার_রংমহল সূচনা পর্ব
#জাহানারা_রিমা