#ভালোবাসার_রঙ’২’
#Jerin_akter_nipa
বিকেলে রায়ার বাবা মা ট্রাক ভর্তি জিনিস নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠে এলেন। পুরো বিকেল কেটে গেল জিনিস নামিয়ে ভেতরে নিতে নিতে। রায়া আজ অনেক কাজ করেছে। জন্মেও সে এত কাজ কখনও করেনি। দুপুরে যে মামার বাসা থেকে খেয়ে এসেছিল। সেই খাওয়া এখনও। আজ বিকেলে আর কিছু খেতে পারেনি। রাতে মা রানা করছে। রায়া রান্নাঘরে এসে উঁকি দিল।
-মা!”
ঘাড় ঘুরিয়ে মা বললেন,
-এখনও রান্না শেষ হয়নিরে মা। আর একটু সময় দে।”
-আরে মা, রান্নার কথা বলছি না। আমি একটু বাড়িওয়ালার সাথে দেখা করে আসি?”
-এখন যাবি?”
-যাই না একটু। নতুন এসেছি একটু খাতির জমিয়ে আসি। ”
-যাবি, তাহলে যা। কিন্তু তাড়াতাড়ি এসে পড়িস। তোর বাবা এলেই টেবিলে খাবার দিব।”
-আচ্ছা। আমি যাব দু একটা কথা বলব। আর চলে আসবো।”
রুম থেকে দৌঁড়ে গিয়ে ওড়নাটা নিয়ে নিলো। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে উপরে উঠতে লাগলো। নেচে নেচে কয়েক পা উঠে গিয়ে কিছুর সাথে ধাক্কা খেল। কপালে এমন ব্যথা পেয়েছে যেন কপালটা কারেন্টের খাম্বার সাথে বারি খেয়েছে। কপালে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলতে লাগলো,
-কোন হাতির বাচ্চা রে? কপালের নিচে আল্লাহ চোখ দেয় নাই? নাকি চোখ খুলে হাতে নিয়ে ঘুরিস? আহ! আমার কপাল। মেরে ফেলল গো।”
ইহফাজ চোখ গরম করে মেয়েটাকে দেখছে। এই মেয়ে এখানে কেন? তার বাড়িতে এই অসভ্য মেয়ে কী করছে? আর উপরে কোথায় যাচ্ছে?
রায়া এতক্ষণ সামনের মানুষটাকে না দেখেই এতগুলো কথা বলেছে। এখন সামনের দিকে তাকিয়ে তার চোখ কপালে ওঠে গেল। এই বজ্জাত খাটাশ ছেলে এই বাড়িতে কী করছে?
-আপনি এখানে? ”
-আমারও একই প্রশ্ন। আপনি এখানে কেন?”
-আমি এখানে কেন মানে? আমার বাড়ি।”
-কি! আপনার বাড়ি? ”
রায়া কাঁধে ওড়না ঠিক করতে করতে বলল,
-না মানে ভাড়া নেয়া বাড়ি। ”
-অহ গড। আব্বা আপনাকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে!”
-আব্বা! কার আব্বা? ”
-এই বাড়ির মালিক আমার জন্মদাতা পিতা। আমি উনার একমাত্র ছেলে।”
রায়ার চোখ এখন যেন কপাল থেকে মাথায় ওঠে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে।
-মানে এটা আপনার বাড়ি? ”
-জি।”
হা করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রায়া। তারপর বলল,
-তো কি হয়েছে? ঠিক আছে আপনার বাড়ি। কিন্তু আমরা ভাড়া নিয়েছি। এখন আপনার বাড়ি বলে আপনি আমার মাথায় ঠোকা মারতে পারেন না।”
-ঠোকা!”
-হ্যাঁ। একটু আগেই ঠোকা মারলেন। দেখেন আমার কপাল ফোলে গেছে।”
-ও হ্যালো! আমি ইচ্ছে করে আপনাকে ঠোকা মারতে যাইনি। আপনিই নিজে থেকে…
-আমি নিজে থেকে ঠোকা মেরেছি! চুরি তো চুরি। তার উপর আবার সীনাজুড়ি! নিজের বাড়ি বলে চোখ খোলা রেখে হাঁটবেন না? আমি যদি পড়ে যেতাম।” নিচের দিকে তাকাল রায়া। বুকে হাত রেখে বলল,
-নিচে কতগুলো সিঁড়ি। এখান থেকে গড়িয়ে নিচে পড়লে নির্ঘাত আমি মারা যেতাম। আপনি আমাকে মার্ডার করার প্ল্যান করেছিলেন! ”
মেয়েটার কথা শুনে ইহফাজের ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চড় মারতে। নিজের রাগ সামলাবার চেষ্টা করে ইহফাজ বলল,
-মাথায় গোবর ছাড়া কিচ্ছু নেই, না? আমি আপনাকে চিনি না, জানি না। আপনার সাথে আমার কোনো শত্রুতা নেই। তাহলে আমি আপনাকে মারার প্ল্যান করব কেন? আর আপনি যে আমার বাড়িতে আছেন এটাও তো আমি জানতাম না।”
-শত্রুতা আছে। সকালে আমি আপনাকে চোর বলেছিলাম। তখন থাপ্পড় দিয়েও আপনার মন ভরেনি। তাই এখন…
-শাট আপ! আপনি নিচে থেকে উপরে উঠছিলেন। চোখ, কান আপনারও খোলা রাখা উচিত ছিল। সামনে আস্ত একটা মানুষ দেখতে পেলেন না!”
-বুঝি। বুঝি। ছেলেদের সব চাল বুঝি আমি। এই মুহূর্তে আপনার চালও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। সুন্দর মেয়ে দেখলেই ধাক্কা খেতে ইচ্ছে করে।”
সকালের সেই কাজটা বাধ্য হয়ে আবার করতে হলো ইহফাজের। এই মেয়ের অসভ্যতা আর সহ্য করা যায় না। ছলছল চোখে গালে হাত দিয়ে ইহফাজের দিকে তাকিয়ে আছে রায়া।
-আপনি আমাকে মারলেন!”
-হ্যাঁ মেরেছি। আপনার মত অসভ্য মেয়েকে মারতে হয়। বুঝেন না কিছু। অথচ চিৎকার চেচাঁমেচি করে সীন ক্রিয়েট করতে পারেন।”
গালে হাত বুলাতে বুলাতে রায়া বলল,
-এই নিয়ে এক দিনে আপনি আমাকে দু’টা চড় মারলেন।”
-সবই আপনার কর্মের ফল।” হঠাৎ করে ইহফাজের হাসি পাচ্ছে। মেয়েটা অনেক কষ্ট করে কান্না চেপে রাখছে। সুন্দর একটা মেয়ে। কিন্তু মাথায় গোবরে ভরা। ইহফাজ আর এখানে দাঁড়াল না। রায়াকে পাশ কাটিয়ে নিচে নামতে লাগল। সিঁড়িতে ওর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রায়া কটমট করে কিছুক্ষণ ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল।
-এই শালার বাচ্চা শালাকে আমি ছাড়ব না। আমার গায়ে হাত তোলা! রায়াকে চড় মারা! তাও একবার না, দু’বার। তোকে আমি খুন করব শালা। আমাকে তুই চিনিস না। এক বাড়িতেই যেহেতু আছি। তোকে তো আমি এতো সহজে ছাড়ছি না। আমাকে চড় মারার উপযুক্ত শাস্তি তোকে দিব। দেখিস তুই। আমার নামও রায়া। ”
রায়া আর উপরে গেল না। ঘরে ফিরে এসেছে। মা তাকে ফিরে আসতে দেখে বলল,
-এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে? বাড়ির মালিকের সাথে কথা হয়নি?’
ফুঁসতে ফুঁসতে রায়া বলল,
-মালিকের অসভ্য অভদ্র জানোয়ার ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল।’
রান্নাঘর থেকে মা বললেন,
-কিছু বললি?’
রায়া চিৎকার করে উঠে বলল,
-না মা। তোমার কাজ তুমি করো না। এতো জ্বালাও কেন? ‘
মা রায়ার অহেতুক রাগ বুঝতে না পেরে বললেন,
-আমি আবার কখন জ্বালালাম! এই মেয়ের মাথা ঠিক নেই। ওর বাবাই এই কথা বিশ্বাস করতে চায় না। নইলে আত্মীয় স্বজন সবাই এটাই মানে।’
টেবিলে খাবার দিতে দিতে রায়াকে ঘরে যেতে দেখে মা বললেন,
-কোথায় যাচ্ছিস? টেবিলে খাবার দিচ্ছি। বাবা আসছেন। কথা হয়েছে একটু আগে।’
-তোমরা খাও। আমি খিদে নেই। এমনিতেই দুই চড় খেয়ে গলা পর্যন্ত পেট ভরে গেছে। আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছা নাই।’
-কী বিরবির করিস তুই? খেয়ে ঘরে যা।’
-তোমাদের খাওয়ার হলে তোমরা খাও। আমাকে শান্তি দাও মা।’
রায়া ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল। মেয়ের উদ্ভট আচরণ আজ নতুন দেখছেন না তিনি।
-এই মেয়ের বিয়ে দিলে তবেই আমার শান্তি হবে। এতো রাগ নিয়ে মেয়েমানুষ বাঁচতে পারে না। শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে এই মেয়ে উঠতে বসতে কথা শুনবে। দেখা যাবে তখনও আবার রাগ দেখিয়ে চলে আসবে। মেয়ে এমন হওয়ার পেছনে সব দোষ ওর বাবার। এক মেয়ে যেন আর কারো হয় না! মেয়েকে নিয়ে কত আদিখ্যেতা। শেষ বয়সে জ্বালা বুঝবে। তখন পস্তাবে,কেন মেয়েকে এতো ভালোবাসা দিয়েছিলাম।’
রাতে বাবা বাড়িতে এসে রায়াকে ডেকেছে। রায়া কারো সাথে কথাও বলেনি। দরজা খুলে খেতেও আসেনি। খাবার টেবিলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
-আমার মেয়ের আজ আবার কী হলো? নতুন বাড়িতে আসবে বলে তো অনেক খুশি ছিল। তাহলে এখন ঘরে দরজা দিয়ে আছে কেন? ‘
-আমি কী জানি? আমাকে জিজ্ঞেস করো কেন? মেয়েকে তুমি এমন বানিয়েছ। আদর দিয়ে দিয়ে গাছে তুলেছ। এবার গাছ থেকে কীভাবে নামাবে তা তুমি জানো। এই মেয়েকে পরের বাড়িতে দিয়ে ভুগতে হবে তোমাকে। সাথে আমাকেও।’
স্ত্রীর এসব কথা উনি কানে নিলেন না। মেয়ের ব্যাপারে চিন্তিত উনি।
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। এই পাড়ার অনেক কিছুই রায়ার চেনা হয়ে গেছে। বাড়ির মালিকের সাথেও ভালো খাতির জমেছে। ভদ্র মহিলা আর উনার স্বামী নিরীহ টাইপ ভালো মানুষ। ভদ্রলোক ব্যাংকে চাকরি করতেন। এখন বাড়িতেই আছেন। ভদ্রমহিলা গৃহিণী। ঘরের কাজ এতো সুন্দর করে করেন বলার মত না। উনাদের দুই ছেলে মেয়ে। বড় মেয়েও বাবা মা’র মতই ভালো। দেখা হয়েছে তার সাথে দু’য়েক বার। কাছেই ওর স্বামীর বাড়ি। সময় পেলেই বাবা মা’কে দেখতে চলে আসে। এই পরিবারের সবাইকেই রায়ার পছন্দ হয়েছে। শুধু একজনকে বাদে। রায়া বুঝে উঠতে পারে না। ওই ভদ্রমহিলার পেট থেকে এমন অসভ্য, অভদ্র ছেলে জন্ম নিল কিভাবে? নিশ্চয়ই হাসপাতালে গণ্ডগোল হয়েছে। আর সেখানেই মহিলার ছেলে বদল হয়ে গেছে। নইলে বাপ এতো ভাল,মা এতো ভাল,বোন এতো ভালো৷ এই ছেলেটা কিভাবে ইবলিশ শয়তান হলো! প্রথম দিনের সেই চড় খাওয়ার পর দেখেই রায়া ইহফাজকে দু’চোখে দেখতে পারে না। পারলে একে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। বাবার কাছে রায়া এই ছেলের অনেক সুনাম শুনেছে। ছেলে নাকি মাস্টার্সে ভীষণ ভালো রেজাল্ট করেছে। এখন দেশে চাকরি করবে নাকি বিদেশে যাবে তা ভাবছে। তবে বাবা মা বোনের ইচ্ছা বিদেশে পাঠানো। কিন্তু ছেলে নাকি যেতে চায় না। দেশেই কিছু করবে সে। বাবা সেদিনও চা খেতে খেতে বলছিলেন,
-আমাদের বাড়ি ওয়ালার ছেলের মত আরেকটা ছেলে হয় না। যেমন পড়াশোনায়। তেমন খেলাধুলায়। কথাবার্তাও তেমন। কোনো দিক দিয়ে কম না। যেত আসতে আমার সাথে দেখা হলে সালাম ছাড়া কথাই বলে না। যতক্ষণ আমার সাথে থাকে মুখ থেকে হাসি সরে না।’
মা, বাবার দিকে বিস্কিট এগিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-সত্যিই গো,ইহফাজ সবার থেকে আলাদা। সোনার টুকরো ছেলে। ভাগ্য করে ওর বাবা মা, ওর মত ছেলে পেয়েছে।’
রাগে রায়ার মাথায় আগুন ধরছিল৷ তার বাপ মা তার সামনে ওই ছেলেকে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে কেন? রায়া বাবার হাত থেকে চায়ের কাপ কেড়ে নিয়ে বলল,
-পরের ছেলের প্রতি এতই যখন ভালোবাসা তাহলে দত্তক নিয়ে নাও তাকে। নিজের মেয়ের কোনো গুণ তো কারো চোখেই পড়ে না। আজকের পর থেকে আমি তোমাকে আর কখনও চা বানিয়ে খাওয়াবো না। ওই ছেলের হাতের চা খাও গিয়ে।’
চলবে…