ভালোবাসার_রঙ ‘১০’ #Jerin_akter_nipa

0
207

#ভালোবাসার_রঙ ‘১০’
#Jerin_akter_nipa

রায়াকে এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল ইহফাজ। মনে মনে বলল,
-আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে কী দেখছে? চোখের পলক ফেলছে না। মনে মনে নতুন কোন শয়তানি আটছে নাকি?’
নিজেকে সামলে নিয়ে মুহূর্তে শক্ত গলায় বলল,
-আমাকে আজ নতুন দেখছ?’
প্রশ্নটা যে তাকেই করা হয়েছে, প্রথমে বুঝতে পারল না রায়া। এর আগে ইহফাজ কখনও সরাসরি এভাবে তার সাথে কথা বলেনি। আগে আপনি করে বলত নাকি তুমি করে? ওর মুখ থেকে হঠাৎ তুমি ডাকটা কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে।
-হ্যাঁ? ‘
বিরক্ত মুখে ইহফাজ বলল,
-কানে সমস্যা আছে? কম শোনো?’
একের পর এক ধাক্কা খাচ্ছে রায়া। এই ব্যাটা তুমি তুমি করে তার সাথে এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে কেন? ভাব জমাতে চাইছে নাকি? রায়ার মনে দুনিয়ার যত আজেবাজে চিন্তা আছে সব এসে ভর করতে লাগল। একটু একটু ভয়ও লাগছে। তার কাছে তো ব্যাটার মতলব ভালো ঠেকছে না।
রায়াকে বোবা সেজে বসে থাকতে দেখে চটে গেল ইহফাজ। পুরোটা বেড দখল করে বসে আছে। সে শোবে কোথায়? রাত তো আর কম হলো না। ধমক দেওয়ার মত করে ইহফাজ বলল,
-বেড থেকে নামো। নইলে সরে বসো। একা পুরো বেড দখল করে নিয়ে বসে আছো। নিজে তো রুমে এসেই এক ঘুম দিয়েছ। অন্যের কথা তো তোমার ভাবার দরকার নেই।’
নাক ফোলালো রায়া। ওকে খোটা দিচ্ছে। বেড থেকে নেমে যেতে বলছে। এত বড় অপমান!
আস্তে আস্তে নেমে দাঁড়াল রায়া। ইহফাজ ওকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে বেডে বসল। সোফার উপর কাপড় রাখা। ও ঘুমানোর সময় আপু হয়তো দিয়ে গেছে।
-ওই যে তোমার কাপড় রাখা আছে। ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নাও।’
ভালো মেয়ের মত চেঞ্জ করে এলো রায়া। উফ! এখন একটু হালকা হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে বিশ কেজি ওজনের কোন ভার গা থেকে নেমে গেছে। মনে মনে রায়া ভাবছে,
-আমাকে কি বেডে থাকতে দিবে না? নিজের ঘর বলে খবরদারি করবে? প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মাটিতে শোয়াবে আমাকে? ‘
ইহফাজ চিন্তা করছে, মেয়েটা এখানে নতুন। তার সাথে আগের ঝগড়ার কারণে হয়তো সহজ হতে পারছে না। এমন হলে, কোন কিছু নিয়ে অসুবিধা হলেও বলবে না। এখন থেকে বাকি জীবনটা যেহেতু একসাথে কাটাতে হবে তাহলে দু’জনকে এখন থেকেই মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে। ওর সাথে কথা বলে সবকিছু ক্লিয়ার করে নিলে কেমন হয়?
ইহফাজ এসব ভাবতে ভাবতে রায়া অন্য কাণ্ড ঘটিয়ে বসে আছে। সে নিজে বেডে শুতে না পারলে বদটাকেও শুতে দিবে না। এটা ভেবেই পানির জগ নিয়ে বিছানায় ঢেলে দিল। ইহফাজ লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। কোটর ছেড়ে চোখ বেরিয়ে আসছে তার। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
-এই মেয়ে, কি করলে তুমি এটা? পাগল নাকি তুমি? বিছানায় পানি ফেললে কেন? এখন শোবে কোথায়? আল্লাহ! এই মাথা খারাপ মেয়েকে আমার কপালে লিখলে কেন? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব পড়েছিল, আমার বাপ মা’র চোখে এই মেয়েই পড়েছে।’
জেদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে রায়া। ইহফাজকে এসব বলতে দেখে বলল,
-উচিত করেছি।’
-পাগল তুমি! এটা কেন করলে? ‘
-আমাকে মাটিতে শোয়াবেন। আর আপনি আরাম করে বেডে শোবেন এটা তো হতে পারে না। তাই বেডে যেন কেউই থাকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করে দিলাম।’
-তোমাকে মাটিতে শুতে বলেছে কে?’
-আপনি।’
-কিহ! আমি এই কথা কখন বললাম? ‘
-সরাসরি বলেননি। কিন্তু বেড থেকে নেমে যেতে বলেছেন। ‘
-ওরে আল্লাহ! আমি তো তোমাকে সাইড দিতে বলেছিলাম। মাঝখানে বসেছিলে তুমি। আমি ঘুমাতাম কোথায়? সেজন্য সরে যেতে বলেছিলাম।’
-সত্যি? এমন বলেছিলেন নাকি! ‘
কপাল চেপে ধরল ইহফাজ। সে এতক্ষণ এই পাগল মেয়ের সাথে মানিয়ে নেবার কথা ভাবছিল! এর সুবিধা অসুবিধার কথা চিন্তা করে কথা বলতে চাচ্ছিল। সিরিয়াসলি! সব ভুলে এর সাথে জীবন কাটাতে রাজি হয়ে যাচ্ছিল। অসম্ভব। এর সাথে মানিয়ে নেওয়ার আর প্রশ্নই উঠে না। তার ছিড়া মেয়ে একটা। না বুঝে এটা কী করে ফেলেছে ভেবে মনে মনে আফসোস করছে রায়া। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা হয়তো একেই বলে। এবার এই ছেলে ঠাস করে তার গালে একটা লাগিয়ে দিক। নিজের ভালো ভেবে, আস্তে আস্তে ইহফাজের সামনে থেকে কেটে পড়ছে রায়া। চুপচাপ সোফায় এসে ওপাশে মুখ করে শুয়ে পড়েছে। যেন ইহফাজের চোখে পড়তে না হয়। তাকে দেখলে বদের হাড্ডি আরও রেগে যাবে। পুরো রুমে দুমিনিট নীরবতা কাটার পর পানির ঝাপটায় ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল রায়া। ইহফাজও কম যায়না। জগের বাকি পানি রায়ার উপর ঢেলেছ সে। জবজবে ভিজে গেছে রায়া। রেগে চেঁচিয়ে উঠে বলল রায়া,
-পাগল আপনি? আমাকে ভিজিয়ে দিলেন কেন? ‘
দাঁত বের হেসে ইহফাজ বলল,
-জি। দুমিনিট আগেও ছিলাম না। কিন্তু আপনার পাল্লায় পড়ে আমাকেও পাগল হতে হয়েছে ম্যাম।’
রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে রায়ার।
-আমাকে ভিজালেন কেন? ‘
-ধরে নাও মনে একধরণের শখ জেগেছিল তাই।’
রসিকতা করছে রায়ার সাথে। মুখে ‘এবার বুঝো ঠেলা’ টাইপ হাসি ঝুলিয়ে রায়ার দিকে চেয়ে আছে।
-পাগল ছাগল লোক। এই শীতের রাতে ভেজা কাপড়ে সারারাত কীভাবে থাকব আমি?’
-সেটা আমার বেড ভিজানোর আগে ভাবা উচিত ছিল। তুমি মনের সুখে সোফায় ঘুমাবে আর আমি গাধার মত দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে রাত পার করব নাকি?
-গাধা না, ঘোড়া দাঁড়িয়ে ঘুমায়।’
-ওই একই কথা। একটু এদিক ওদিক হয়ে গেছে শুধু। সোফা ভিজিয়ে দিলাম এবার তুমিও আমার মতই দাঁড়িয়ে ঘুমাবে। আর নইলে দু’জনই মাটিতে।’
-আপনি একটা চরম ফাজিল লোক। অসভ্য জাহিল!’
-জি, থ্যাংকস ফর ইওর কমপ্লিমেন্ট।’
ইহফাজ কাবার্ড থেকে চাদর আর কম্বল বের করে, বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে রায়ার পাশ কাটিয়ে ঘরের মাঝে এসে দাঁড়াল। মেঝেতে চাঁদর আর কম্বল বিছিয়ে বিছানা করে নিল।রায়া ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইহফাজের কাণ্ড কাহিনী দেখছে। রায়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে বালিশ রেখে হাতের উপর মাথা ভর দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল।
-আমার ব্যবস্থা আমি করে নিয়েছি। এবার তোমার রাস্তা তুমি দেখো।’
আরাম করে ঘুমাতে গেল ইহফাজ। হতভম্ব রায়া বুঝতে পারছে না, লোকটার আক্কেল জ্ঞান কিছু নেই নাকি? তাকে ভিজিয়ে দিয়ে নিজে ঘুমানোর ব্যবস্থা করে নিল! শীতে থরথর করে কাঁপছে রায়া। ভেজা কাপড়ে আর কতক্ষণ থাকবে? এই রুমে তার নিজের আর তো কাপড়ও নেই। তার লাগেজটা ইভা আপু কোথায় রাখল? রায়া উঁকি দিয়ে দেখছে সত্যিই ইহফাজ ঘুমিয়ে গেছে নাকি?
-দাঁড়িয়ে থাকো। ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কত মজা লাগে এবার দেখো। ফাজিল মেয়ে, তোমাকে একটা সুযোগ দিতে যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু তুমি কি করলে? কিছু না বুঝে গাধামি করে বিছানায় পানি ঢেলে দিলে! এবার ঘুমাও কোথায় ঘুমাবে।’
শীতে কাঁপুনি উঠে গেছে রায়ার। বেশ অনেকক্ষণ পর কাঁপতে কাঁপতে ইহফাজকে ডাকল রায়া।
-এইযে শুনছেন?’
ইহফাজ সজাগই ছিল। ওপাশ ফিরে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল রায়া এখন কী করবে। ফাজিল মেয়েটার শিক্ষা হোক একটু। রায়া আবার ডাকল,
-ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? শুনুন না।’
ইহফাজ এপাশ ফিরে রায়ার মুখের দিকে তাকাল।
-কি?’
-আমার ভীষণ শীত লাগছে। ভেজা কাপড়ে কাঁপছি দেখছেন না!’
ডান ভ্রু উঁচিয়ে ইহফাজ বলল,
-দেখছি। এখন আমি কি করতে পারি? ‘
রেগে গেল রায়া।
-কি করতে পারি মানে? আপনি আমাকে ভিজালেন। এখন আমার জ্বর এলে সব দোষ আপনার।’
-আচ্ছা ঠিক আছে। ঘুমাই এবার? নাকি আরও কোন দোষ দেয়া বাকি আছে? ‘
রাগে রায়ার মাথা ফেটে যাচ্ছে। পানির জগের দিকে তাকাল সে। না, খালি। এক ফোঁটাও পানি নেই। এই বদকে না ভিজালে কলিজা ঠান্ডা হবে না তার। ওয়াশরুম থেকে পানি এনে হলেও একে আজ রাতে গোসল করিয়ে ছাড়বে। রায়াকে ওদিকে যেতে দেখে ইহফাজ বলে উঠল,
-ভুলেও এই কাজ করো না। তাহলে তোমার কপালে খারাবি আছে। পানি ঢালাঢালি আগে তুমি শুরু করেছ। শেষ কিন্তু আমিই করব।’
এই জাহিল ছেলের সাথে বেশি উজানো ঠিক না।
-তাহলে আমাকে শুকনো কাপড় দেন। ভেজা কাপড়ে কতক্ষণ থাকব। শীল লাগছে আমার।’
-আপুকে ডাকো। তোমার লাগেজ আপু রেখেছে।’
রায়া সত্যিই ডাকতে যাচ্ছিল। ইহফাজ বলল,
-দাঁড়াও দাঁড়াও। আপুকে ডেকো না।’
রায়া কপাল কুঁচকে বলল,
-কেন?’
-আপু রুমে এলে বেড ভেজা দেখে যদি জিজ্ঞেস করে বেড, সোফা কীভাবে ভিজল? মাটিতে শুয়েছি কেন আমি? তুমিই বা ভিজলে কি করে? তখন কী বলবে?’
-কী বলব? সত্য বলব আমি। বলব আপনি আমাকে ভিজিয়ে দিয়েছেন।’
-আর আমি বলব বেড তুমি ভিয়েছ।’
-আমি বলব সোফায় আপনি পানি ফেলেছেন।’
কিছু ভাবল ইহফাজ। তারপর বলল,
-থাক আর বলাবলির দরকার নাই। বাসর রাতে স্বামী স্ত্রী ঝগড়া করে বেড,সোফা আর বউ ভিজিয়েছ জানতে পারলে লোকে হাসবে। তার থেকে আপুকে না ডেকে ওয়ারড্রোব থেকে আমার শার্ট প্যান্ট বের করে পরে নাও। সকালে সবার ঘুম ভাঙার আগে আমি তোমার লাগেজ এনে দিব। এখন বাইরে যাওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই আপু টিয়াকে নিয়ে জেগে আছে। এখন বাইরে বেরুতে দেখলে হাজার প্রশ্ন করবে।’
প্রথমে রায়া আপত্তি জানাল। কিন্তু পরে সে-ও ভেবে দেখল ইহফাজ ঠিকই বলছে। তাদের মধ্যে মিলমিশ নেই এটা বাইরে জানানো ঠিক হবে না। ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে রেখে করবে। তাতে দু’জনের পরিবারই চিন্তামুক্ত থাকবে। ওয়ারড্রোব থেকে ইহফাজের শার্ট প্যান্ট বের করে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে চেঞ্জ করে এল। ইহফাজ একবারও রায়ার দিকে না তাকিয়ে বলল,
-না ঘুমিয়ে বসে থাকতে মন চাইলে তুমি বসে থাকো। কিন্তু লাইট অন করে বসে থাকা যাবে না। আলো থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না। আর তোমার মত বেকারও না আমি। সকালে কাজ আছে আমার।’
রায়া মনে মনে বলল,
-এহহ কি কাজটাই না করে। আলুর কাজ তোর।’
-কি হলো? লাইট অফ করো।’
বাধ্য মেয়ের মত কথা না বাড়িয়ে লাইট অফ করে দিল রায়া। পাঁচ মিনিটের মত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকল। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। ভেজা বিছানায় শোয়া যাবে না। ইহফাজের পাশে গিয়ে বসল রায়া।
-ঘুমিয়ে গেছে নাকি ব্যাটা?’
হালকা গলায় ডাকল রায়া।
-একটু ওদিকে যান না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামুব নাকি? কী আজব লোকরে বাবা!’
জেগে থাকলেও ইহফাজ কথা বলল না। সে জেগে আছে এটাও বোঝালো না। ঘুমের মধ্যে নড়ে যাবার মত করে রায়াকে জায়গা করে দিল। ইহফাজের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল রায়া। এক টানে কম্বল পুরোটা নিজের কাছে নিয়ে এল। পরে ভাবলো,
-না বাবা, যে খাটাশ লোক। কম্বল না পেয়ে শীত লেগে ঘুম ভেঙে গেলে আমার ঘাড় মটকিয়ে রক্ত খাবে।’
আস্তে করে ইহফাজের গায়ে কম্বল দিয়ে দিল। নিজেও ইহফাজের কাছে ঘেঁষে এসে শুয়ে পড়ল। শব্দ করে হাসতে পারছে না ইহফাজ। অনেক কষ্টে হাসি চেপে, মনে মনে হাসল।
-যাক। একটু হলেও ভয় পায় তাহলে। কিন্তু এমন ভাব করে যেন কোন কিছুতেই ভয় পায় না। তার ছিড়া ছাগল মেয়ে।’
রাত বাড়ার সাথে সাথে ওরা দু’জনও ঘুমের দেশে পারি দিল। রায়া ঘুমের মধ্যে ইহফাজের হাতকে বালিশ বানিয়ে নিয়ে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ইহফাজও ওকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে পরম আনন্দে সুখস্বপ্ন দেখে মিটমিট করে হাসছে।
সকালে ইহফাজের ঘুম আগে ভাঙলো। রায়া এখনও ছোট্ট বেড়াল ছানার মত গুটিসুটি মেরে ওর বুকের মধ্যে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। একপলক স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখে আস্তে করে বুকের উপর থেকে ওকে সরিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে গেল ইহফাজ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here