#ভালোবাসার_রঙ ‘৪’
#Jerin_akter_nipa
(ভালো না লাগলে জানাবেন। আমি এই গল্প অফ দিয়ে নতুন গল্প দিব।)
.
রায়া ঘরে এসে ফুলগুলো ওড়না থেকে বিছানার উপর রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মুখ টিপে হাসলো। বিছানায় রাখা ফুলগুলোর দিকে ফিরল।
-তোমাদের ওই বদ খাটাশ মালিকটার জন্য তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের থেকে আলাদা করে আনতে হয়েছে। নইলে কি আমি কখনও ফুল ছিড়ি? তোমরাই বলো, আমি ভালো মেয়ে না?’
দু’পা তুলে আরাম করে বেডে বসলো রায়া। সময় নিয়ে একটা একটা করে সবগুলো ফুল দিয়ে মালা গেঁথে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাজাল। কপালে, কানে, গলায়, হাতে… চোখ বড় বড় করে নিজেকে দেখছে রায়া।
-হায়! এটা আমি! কত সুন্দর লাগছে আমাকে। দেখি দেখি খোঁপায় একটা বড় ফুল লাগিয়ে নিই। এই যা! খোঁপাই তো করা নেই।’
বদটাকে জব্দ করতে পেরেছে ভেবে মনে মনে গুনগুন করতে করতে খোঁপা করলো রায়া। খোঁপায় একটা লাল গোলাপ গেঁথে নিল। তারপর নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
-আমি বনফুল গো। টা…না না… উম… গো। আ… আমি বনফুল গো। হুমহু হুহু না না। ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে… টা…না না না হুম গো…
রায়ার গান শুনে মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওকে দেখে চোখ কপালে তুলে বললেন,
-এই কি হয়েছে তোর? এই রায়া…তুই সাতসকালে এরকম ফুল দিয়ে সেজেছিস কেন?’
রায়া মায়ের কথা কানে না নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এখনও গান গেয়ে যাচ্ছে।
-বাসন্তিকার সঙ্গে আমি। টু টুরু রু উম… মালিকার ও দুল গো…
এতক্ষণে মা এসে রায়ার বাহু ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললেন,
-এই রায়া, মা আমার পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই? তোর মাথা ঠিক আছে তো? সকাল সকাল এতগুলো ফুল কোথায় পেলি তুই? এই রায়ার বাবা! এদিকে এসে দেখে যাও না। তোমার মেয়েকে জ্বীন ভূতে ধরেছে নাকি। এই রায়ার বাবা…
বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে রায়া মায়ের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
-আহ মা! আমার কিছুই হয়নি। তুমি শুধু শুধু বাবাকে ডাকছো। আমাকে জ্বীনেও ধরে নি, ভূতেও না। এই দেখো, আমি একদম ঠিক আছি।’
-তাহলে তুই ফুল দিয়ে এভাবে সেজেছিস কেন? ‘
-ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
-আর গান গাইছিস কেন তুই? হ্যাঁ? ‘
-মনে সুখ লেগেছে মা। তাই না চাইতেও মুখ দিয়ে গান চলে আসছে। এবার তুমি তোমার কাজে যাও তো। বাবাকে চা দিয়ে এসো।’
এই মেয়ের মতিগতির কোন ঠিক ঠিকানা নেই। ওর মনে কখন কী আসে তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। মা রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
-পাগল ছাগল জন্ম দিয়েছি একটা। এখন কোন দিন না জানি ওর বাবাকে আর আমাকেও পাগল করে দেয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এর বিয়ে দিতে হবে। আর লেখাপড়ার দরকার নেই। পড়তে হলে জামাই বাড়ি গিয়ে পড়বে। একে আমি আর সহ্য করতে পারব না।’
শেষের দিকের মায়ের কথাগুলো শুনে মুখ বাঁকাল রায়া।
-এহহহ! আসছে আমাকে বিয়ে দিতে! দাও দেখি কেমন পারো। মহিলা কাম কাজ কিছু পারে না, সারাক্ষণ শুধু আমার পেছনে পড়ে থাকে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত বাবাকে এক কাপ চা তো দিতে পারেনি। শুধু রায়ার বিয়ে দাও, বিয়ে দাও।’ শেষের দুই লাইন ভেঙ্গিয়ে বলেছে রায়া। আজ সকালটা এতো ভালো তার জন্য ওই বদের হাড্ডিকে উচিত শিক্ষা দিতে পেরেছে। তার মধ্যে মা কী সব শুরু করে দিয়েছে।
-ধ্যাত! মেজাজ খারাপ করে দিল মহিলাটা।’
ইহফাজ দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে কলিংবেল চাপলো। নিউজ পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। চাপা গলায় বলল,
-ইহফাজ ভাই, তুমি কি ভেতরে গিয়ে রায়া আপুকে মারবে? ‘
কটমট করে চাইল ইহফাজ।
-চুপ থাক তুই। নইলে ঝড়ের গতি ঘুরে তোর দিকে আসবে।’
-আমি চুপ।’
মুখ চেপে ধরল নিউজ। আবার কলিংবেল চাপলো। ভেতর থেকে রায়ার মায়ের গলা শোনা যাচ্ছে।
-আসছি, আসছি। একটু ধৈর্য ধরতে হবে তো।’
দরজা খুলে দিয়ে সামনে ইহফাজকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে বললেন,
-আরে, বাবা তুমি? কিছু দরকার? সকাল সকাল…
ভেতর থেকে রায়ার বাবা বললেন,
-কে এসেছে রায়ার মা?’
-ইহফাজ। ইহফাজ এসেছে।’
-ওকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছ কেন? ভেতরে নিয়ে আসো।’
-আসো বাবা।’
ইহফাজ আশেপাশে নজর রেখে ভেতরে চলে গেল। ফাজিল মেয়েটা কোথায়? ওকে একবার হাতের কাছে পেলে মজা বুঝাবে সে। এই ইতর মেয়ে তার ভয়ে লুকিয়ে আছে নাকি? রায়ার বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
-রায়া কোথায়? ইহফাজকে চা দিচ্ছ না কেন? ‘
রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে মা বললেন,
-তোমার মেয়ের মাথায় ভূত চেপেছে। সকাল থেকে ফুল দিয়ে সেজে নাচছে, গান গাইছে আরো কি অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করছে।’
কথাটা শুনে ইহফাজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। তার ধারণাই ঠিক। এই মেয়েই তার গাছের ফুল এনেছে। নিউজ ইহফাজের মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে দোয়া দরুদ পড়ে বারবার রায়ার রুমের দিকে উঁকি দিচ্ছে।
-আল্লাহ! এখন যদি রায়া আপু ইহফাজ ভাইয়ের সামনে চলে আসে, তাহলে ইহফাজ ভাই ওর বাবা মা’র সামনেই ওকে তুলে মাথার উপর থেকে আছাড় মারবে।’
-বাব! বাবা শোনো না…
বাবাকে কী বলতে বলতে যেন রায়া বসার ঘরে এসে উঁকি দিল। বাবার পাশে বসে থাকা ইহফাজকে দেখে পাথরের মূর্তির মত থমকে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বেরুচ্ছে না। এই ব্যাটা তাদের ফ্ল্যাটে,তার বাবার পাশে বসে কী করছে? বিচার দিতে এসেছে নাকি?
আগুন গরম চোখে রায়াকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল ইহফাজ। ইচ্ছে তো করছে এর গালে এক্ষুনি ঠাস করে দু’টা চড় মারতে। এটুকু একটা মেয়ের সাহস কী করে হয় ওর সাথে লাগতে আসার! ইহফাজের চোখের চাউনিতে এমন কিছু ছিল যা দেখে সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গেছে রায়া। লোকটার চোখাচোখি চাইতে হাত পা কাঁপছে যেন। বাবা বললেন,
-কিরে মা, কী বলছিলি?’
বাবার কথা রায়ার কানে ঢুকলে তো। ইহফাজ উঠে দাঁড়াল। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে রাগ সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে।
-আঙ্কেল আজ তাহলে আমি আসি।’
-সেকি! তোমার সাথে তো ভালো করে কথাই হয়নি। আরেকটু বসে যাও।’
-না আঙ্কেল। অন্য কোনো দিন আবার আসব। আজ যাই। ‘
যাবার আগে আবার রায়াকে ভালো করে দেখে নিল ইহফাজ। রায়া ভয়ে ভয়ে বাবার কাছাকাছি চলে গেছে। ইহফাজ চলে গেলে বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
-তোর আবার কী হয়েছে? ‘
-কিছু না বাবা। আমি ঘরে যাই।’
ঝড়ের গতিতে রায়া বাবার সামনে থেকে চলে গেল। উনি পেছন থেকে ডেকে বললেন,
-কী বলতে এসেছিলি সেটাই তো বললি না।’
ওই দিনের ঘটনার পর থেকে রায়া ভুলেও ইহফাজের সামনে পড়তে চায় না। হাতের নাগালে পেলে এই লোক তাকে কাঁচা চিবিয়ে খাবে, এটা বুঝে নিয়েছে রায়া। তাই এখন আন্টি ডাকলেও রায়া ওদের ফ্ল্যাটে যায় না। ছাঁদে গেলে যদি লোকটার সামনাসামনি হয়ে যায়, সেই ভয়ে আজ চারদিন ধরে ছাঁদেও যায় না।
-আমি এতো সহজে ওই ব্যাটার চোখের চাওয়া ভুলতে পারব না। সেদিন বাবা সামনে না থাকলে আমাকে মাথায় তুলে একটা আছাড়ই দিত। তাতেই আমার ইন্নালিল্লাহ হয়ে যেত। ব্যাটা বদ! মুখে পারিস না, চোখ দিয়ে ভয় দেখাস।’
টেবিলের উপর এলোমেলো হয়ে ছড়ানো বইয়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে আবার বলতে লাগল,
-একদম ঠিক করেছি তোর সাথে। দু’টা থাপ্পড় খেয়ে এমনি এমনি ছেড়ে দিব নাকি?’
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রায়া।
-চার, চারটা রাত ধরে তোর জন্য আমি ঠিক করে ঘুমাতে পারি না। স্বপ্নের মধ্যে এসেও ভয় দেখাস। একদিন তো দেখলাম ছাঁদ থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছে। আমি নিচে পড়ে আলু ভর্তা হয়ে গেছি।’
ওদিকে ইহফাজও মনে মনে রায়াকে শাস্তি দেবার একশোটা পথ ভেবে রেখেছে। কিন্তু কিছুতেই সুযোগ পাচ্ছে না। ওকে শায়েস্তা করা তো দূরের কথা মেয়েটার টিকির লাগালও পাচ্ছে না।
দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিউজ বলল,
-গরম খবর। ‘
কপাল কুঁচকে ইহফাজ বলল,
-কী খবর বলে ফেল।’
-রায়া আপু তোমার ভয়ে চারদিন ছাঁদে আসেনি। তোমাদের বাড়িতেও আসে না। আন্টি আমাকে দিয়ে দু’বার খবর পাঠিয়েছে। তবুও আসেনি। আমাকে আকারে ইঙ্গিতে অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করেছে তুমি কখন কখন বাড়ি থাকো।’
নীরবে শয়তানি হাসি দিল ইহফাজ। বিরবির করে বলল,
-যতই ভয় পেয়ে ইঁদুরের গর্তে গিয়ে লুকাক। তবুও তাকে আমি একদিন তো হাতের কাছে পাবই। সেদিন শোধ তুলব।’
-কিছু বললে? ‘
-না। তোকে কিছু বলা মানে ব্রেকিং নিউজ বানানো। নিজের কাজে যা তুই।’
-দাম দিলে না ইহফাজ ভাই। একদিন ঠিকই বুঝবে এই নি…
-গেলি তুই? ‘
-যাচ্ছি যাচ্ছি।’
তার কয়েকদিন পরই ইহফাজ প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেল। বিকালে কেনই যেন ছাঁদে এসেছিল সে। ছাঁদে দড়িতে কাপড় শুকাতে দেয়া। একনজর দেখে চিনতে ভুল করলো না ইহফাজ। ওই অসভ্য ফাজিল মেয়েকে এই কাপড়েই প্রথমে দিন দেখেছিল। সেদিন থেকেই তো মেয়েটা হাত ধুঁয়ে তার পেছনে পড়ে আছে। মাঝ রাস্তায় তাকে চোর বলা। সিঁড়িতে নিজে থেকেই ধাক্কা খেয়ে তাকে যা তা বলা। তার ফুল গাছ থেকে সব ফুল ছিড়ে নেয়া। আজ একটু হলেও মনের ঝাল মেটাবে সে। মেয়েটার উপর দিয়ে না হোক। ওর কাপড়ের উপর দিয়েই শোধ নিবে। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল ইহফাজ।
-এটা রায়া আপুর ফেভারিট ওড়না।’
হঠাৎ নিউজের কথায় ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওকে দেখে শান্ত হয়ে বলল,
-তাই নাকি? ‘
-হুম। পাক্কা খবর। আপুর কোন খালাতো না ফুপাতো ভাই গিফট করেছিল।’
-ও তাই? নিশ্চয়ই ওই ভাইটা মেয়েটার ক্রাশ?’
-তুমি জানলে কী করে? ‘
চোখ ছোট ছোট করে ইহফাজের দিকে চেয়ে আছে নিউজ। উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। মনে মনে হেসে কুটিকুটি হয়ে গেল ইহফাজ। জানা কথা মেয়েদের এসব বিষয়ে একটু বেশিই আবেগ কাজ করে। ভালো একটা আইডিয়া পাওয়া গেছে।
-কাঁচি নিয়ে আয়।’
-হ্যাঁ? ‘
-কাঁচি চিনিস না? যা, কাঁচি, ছুরি, ব্লেড চোখের সামনে যা পাস একটা নিয়ে আয়।’
-এসব কিন্তু ঠিক না ইহফাজ ভাই।’
ধমক দিল ইহফাজ। সাথে একটু ভয় দেখল।
-যাবি নাকি উল্টো ঝুলিয়ে রাখব তোকে? আমাকে তো চিনিসই।’
-যাচ্ছি। মনে রেখো, আমার কিন্তু কোন দোষ নেই।’
-হ্যাঁ। যা, যা।’
ইহফাজ নিজেও বুঝতে পারছে না মেয়েটাকে শায়েস্তা করতে কতটা বাচ্চামু কাজ করছে সে। কিন্তু এই বাচ্চামি করতে তার ভাল লাগছে।
চলবে…