#ভালোবাসার_রঙ ‘৬’
Jerin Akter Nipa
মা, আন্টি, আপু নিউজের মা সবাই একসাথে বসে গল্প করছে। মহিলাদের আলাপ শুনতে রায়ার মোটেও ভালো লাগছে না। সে পাশের সোফায় বসে ছিল। ওর দিকে কারো খেয়াল নেই। সবাই যার যার আলাপে মগ্ন। রায়া আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। ড্রয়িংরুমটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। আগেও কয়েকবার এসেছে। কিন্তু এতো ভালো করে কিছুই দেখা হয়নি। বদের হাড্ডি নিজের ঘর থেকে একবারো বের হয়নি। যাক ভালো হয়েছে। ওর সামনে তো পড়তে হচ্ছে না। দেয়ালে বড় করে বাঁধানো কয়েকটা ছবি দেখল রায়া। কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। গালে হাত রেখে ভাবছে সে, ছবিতে দু’টা মেয়ে কোত্থেকে এলো? না মানে, আন্টির তো একটাই মাত্র মেয়ে। আর ছেলেও একটা। তাহলে দ্বিতীয় নম্বর মেয়েটা কে? লাল ফ্রকে, মাথায় পাখির বাসার মত বড় লাল রঙের হেয়ারব্যান্ড, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। লাল টুকটুকে এই মেয়েটা কে? আন্টির আরেক মেয়ে না তো? যে ছোট বেলায় মারা গেছে। রায়া ওদের দিকে ফিরল। বলল,
-আন্টি, ছবিতে লাল পরীর মত এই মেয়েটা কে?’
রায়ার কথা শুনে ইহফাজের বোন হাসতে লাগল। রায়া বুঝতে পারল না। এই স্বাভাবিক কথা শুনে এতো হাসির কী আছে। ভুল কিছু বলেছে নাকি সে?
-কোন পরীর কথা বললে মা? লাল পরীটা? ওই যে ছোট লাল পরী, যার হাতে প্লাস্টিকের লাল ফুল?’
-হুম। মেয়েটা কে?’
-মেয়ে! ‘
পেট চেপে হাসতে লাগলো আপু। হাসতে হাসতেই বলল,
-ও মা গো! মরে যাব। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে আমার। মা, বলছো না কেন মেয়েটা কে?’
আন্টিও মিটমিট করে হাসছে। আপুও পাগলের মত হাসছে। ওদেরকে এভাবে হাসতে দেখে বোকা হয়ে গেল রায়া। মনে মনে ভাবছে,
-পুরো পরিবারেরই মাথার তার ছিড়া নাকি? বুঝলাম না ভাবা। পাগল, ছাগল সব একসাথে কীভাবে? মেয়েটা পাগল। আর ছেলেটা হচ্ছে গিয়ে ছাগল। রায়াকে বোকা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আপু অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
-ছবিতে তোমার ওই লাল পরীটা মেয়ে না, রায়া। ওটা ছেলে। আমাদের ইফু।’
-অ্যাঁ!’
রায়ার মুখ হাঁ হয়ে গেল। কী বলে এসব? এটা ওই বদের হাড্ডিটা! সিরিয়াসলি?
-হ্যাঁ। ওই ছবিতে যাকে দেখছো সে আমার ভাই। ছোট বেলা আমার খুব শখ ছিল ওকে আমার মত মেয়ে সাজাব। আমার জামা কাপড় পরিয়ে সুন্দর করে সাজাব। তখন তো ছোট ছিলাম। নিজে পারতাম না। তাই একদিন আমার কান্নাকাটি থামাতে গিয়ে মা ওকেও আমার মত করে সাজিয়ে দিল।’
একবার ইহফাজের ছবির দিকে একবার আন্টির দিকে তাকাচ্ছে রায়া। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না রায়া। একটুও বোঝা যাচ্ছে না এটা ছেলে, মেয়ে না। আন্টি বললেন,
-ইফুটা ছোট বেলা ইভার থেকেও সুন্দর ছিল। একদম সাদা সুন্দর। চিকন চিকন নাক মুখের কারণে ওকে মেয়ে মেয়েই লাগল।’ ইভার দিকে দেখিয়ে আন্টি বললেন,
-এই বজ্জাতটা আমার ছেলেকে অনেক জ্বালিয়েছে। কেঁদে কেটে ওর সাথে আমার ছেলেকেও মেয়ে সাজিয়েছে। ওর সব ক’টা জামা ইফুকেও পরিয়েছে।’
-ভালোবাসা মা। এটাই ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালোবাসা।’
রায়ার পাশে এসে দাঁড়িয়ে রায়ার কাঁধে হাত রেখে ইভা বলল,
-সুন্দর লাগছে না আমার ভাইকে? একদম মেয়ে মেয়ে লাগে। তুমি ঠিকই বলেছিলে, লাল পরী একটা। এই ছবিটা দেখলে এখনও ওকে গাল টেনে আদর করতে ইচ্ছে করে।’
রায়া নিজেকে সামলে নিয়েছে। সত্যিই বড় বোন ভালোই অত্যাচার করেছে বদটার উপর।
-এই ছবি নিয়ে কত কাহিনী। ইহফাজ তো এই ছবি রাখতেই দিবে না। নষ্ট করে ফেলবে। নয়তো রুমের কোন কোনায় কানায় রেখে দিবে। প্রথম দিন যখন দেখল এটা আমি বসার ঘরে টানিয়েছি,সেদিন তো আমার সাথে ঝগড়া করে মারামারি লেগে চুল ছিঁড়েছে পর্যন্ত। আমিও কম যাই না। কসম টসম কাটিয়ে এটাকে এখানেই রেখেছি। তবে ইফুর শর্ত বাইরের কাউকে বলা যাবে না,এটা যে ওর ছবি।’
ইভার কথা শুনে মৃদু হাসল রায়া। এই প্রথম তার আফসোস হচ্ছে। ইশ আমারও যদি আরেকটা ভাই/বোন থাকত। তাহলে আমিও এমন করতে পারতাম। কত মজাই না হতো। এই প্রথম ইহফাজের নাম বারবার শুনেও ওর রাগ হচ্ছে না। বরং ছবির বাবু টার গাল টেনে সত্যিই আদর করতে মন চাইছে।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই গল্প করতে করতে খাচ্ছে। রায়া মাঝে মাঝে আড়চোখে ইহফাজের দিকে তাকাচ্ছে। বদটা আজ এতো ভালো হয়ে গেল কীভাবে? তাকে যেন চিনেই না। তাদের মাঝে কোনোদিনও ঝামেলা হয়নি। সবার কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে হেসে হেসে খেয়ে যাচ্ছে। রায়ার বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
-জবের কথা কিছু ভেবেছ, বাবা? ‘
-জি আঙ্কেল। কয়দিন আগে একটা জবের জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছি। প্রাইভেট কোম্পানি। তবে সুযোগ সুবিধা ভালো। স্যালারিও ভালোই দিবে। বছরে একবার কী দু’বার অফিস থেকেই দেশের বাইরে পাঠাবে। নিজের দক্ষতা দেখিয়ে দুই বছরের ভেতর প্রমোশনও পাওয়া যাবে।’
-বাহ! তাহলে তো ভালোই।’
-হ্যাঁ। আমিও ভাবছি ওরা ডাকলে জয়েন করে নিব। তারপর দেখা যাক। আরও ভালো কোথাও সুযোগ পেলে তখন নাহয়…’
রায়া চুপচাপ বদটার কথা শুনছে। ব্যাটা নিজের বড়াই করতে করতে আকাশে উড়তে শুরু করেছে। একটা চাকরিই তো পাচ্ছিস। তাও প্রাইভেট কোম্পানিতে। এতে এতো উড়াল পারার কী আছে হ্যাঁ? রায়া একবার স্টাডি কমপ্লিট করুক না। সে-ও তোর থেকে ভালো চাকরি পেয়ে দেখিয়ে দিবে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই আরেক দফা গল্পের আসরে বসলো। বিরক্ত লাগছে রায়ার। বদের হাড্ডিটা একটু আগে কোথায় যেন বেরিয়েছে। এই ফাঁকে নিউজ জোর করে রায়ার হাত ধরে টেনে ইহফাজের ঘরে নিয়ে এলো।
-বুঝলে আপু,এটা ইহফাজ ভাইয়ের জাদুঘর। তাই শুধু ঘর ভেবে ভুল কোরো না। জাদুঘরে যেমন সব জিনিস চোখে দেখার অধিকার আছে। ছোঁয়ার অধিকার নেই। তেমনি ইহফাজ ভাইয়ের ঘরের সবকিছু চোখে দেখতে পারবে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না। নাহলে কিন্তু ইহফাজ ভাই হাত কেটে রেখে দিবে।’
ঘরের চারপাশে দেখতে দেখতে মুখ মুচড়ে রায়া বলল,
-তোর ভাইটা আস্ত একটা গুন্ডা। সারাক্ষণ মারামারি, কাটাকাটি, ভাঙাভাঙির কথা বলে। ভালো কথা ভুলেও মুখ দিয়ে বের হয় না।’
-তুমি ইহফাজ ভাইকে চিনতে ভুল করলে বাছা। ভাই আমার হিরো। তবে কেনই জানি তোমার সাথে ভিলেনগিরি করে। তুমি ছাড়া বাকি সবার সাথে তো ভালো ভাবেই মিশে।’
রায়া মনে মনে বলল,
-আমি যে তার পাকা ধানে মই দিয়েছি। তাই আমাকে দেখতে পারে না। বদের হাড্ডি একটা।’
নিউজকে তার মা ডাকলে সে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল।
-কোনো কিছুতে হাত দিয়ো না কিন্তু।’
নিউজ চলে গেলে রায়ার চোখ বিছানার উপর পরলো। বিছানার উপর খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নিশ্চয়ই টিয়ার খেলনা এগুলো। বদটা ভাগ্নিকে তো ভালোই আদর করে। শুধু তার সাথেই এমন লেগে থাকে কেন?
কাঁচের সুন্দর একটা পুতুল হাতে নিল রায়া। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গেল। ভয়ে রায়ার কলিজা শুকিয়ে আসছে। ওই বদ দেখলে তাকে কাঁচা খাবে। কিন্তু রায়া তো ইচ্ছে করে ভাঙে নি। হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে। রায়া কিছু ভেবে না পেয়ে নিচে থেকে পুতুলের ভাঙা টুকরো গুলো হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এই ঘরে কেউ আসার আগে বেরিয়ে যেতে হবে। কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। রায়ার বেলায়ও ঠিক তেমনটাই হলো। দরজার দিকে ফিরতেই ইহফাজ এসে দাঁড়াল। ইহফাজকে দেখে ঢোঁক গিলল রায়া। এই লোক আজ তাকে খুন করবে।
ইহফাজ প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল মেয়েটা হয়তো ভুল করে ওর ঘরে এসে পড়েছে। কিন্তু রায়ার রক্ত শূন্য মুখ দেখে খটকা লেগে গেল। পরক্ষণেই তার হাতের দিকে তাকিয়ে মাথায় রক্ত উঠে গেল। মেয়েটা তার সাথে না পেরে তার জিনিসের উপর দিয়ে রাগ দেখাবে। সেদিন ফুলগুলো, আজ টিয়ার পুতুলটা! এটা তো অন্তত ভাবার দরকার ছিল,ইহফাজ এই বয়সে পুতুল খেলবে না। বাড়িতে যেহেতু টিয়াই একা বাচ্চা,তাই এটা টিয়ার। জেনেও মেয়েটা ইচ্ছে করে ভেঙেছে নাকি? রায়া বুঝতে পারছে ইহফাজ তাকে ভুল বুঝছে। সে ইহফাজকে বলতে যাচ্ছিল, ইচ্ছে করে সে আজ কিছুই করেনি।
-প্লিজ, প্লিজ। আমার কথাটা একবার শুনুন। আমার উপর…
ইহফাজ ঝড়ের বেগে এসে রায়ার হাত চেপে ধরল।
-আমি ইচ্ছে করে…
ইহফাজ রায়ার হাত মুচড়িয়ে পেছন দিকে নিয়ে আটকে ধরলো। ব্যথায় হাত থেকে ভাঙা পুতুলের টুকরো পড়ে গেল। অসহ্য যন্ত্রণায় রায়ার মুখ নীল হয়ে গেছে। ইহফাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-ছেলেমানুষ ভেবে আজ পর্যন্ত তেমন কিছুই বলিনি। ভেবেছি বাচ্চা মেয়ে, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না। কুত্তার লেজ কখনও সোজা হয় না। তোমার মত অসভ্য বেয়াদব মেয়েও কখনো ভালো হতে পারবে না। আমারই ভুল। প্রথম থেকেই উচিত শিক্ষা দিলে আজ এতটা সাহস পেতে না। টিয়ার খেলনা ভেঙে কী করতে চাইছিলে তুমি? আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছিলে,টিয়ার খেলনা ভেঙে? গর্দভ কোথাকার!’
ইহফাজের কথায় আর হাতের ব্যথার রায়ার চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে পড়েছে। লোকটা তার কোন কথা শুনছেই চাইছে না। একটা বার বলতে তো দিবে, তার কোন দোষ নেই।
ভুল কি মানুষের হয় না? লোকটা কিছু না জেনে তাকে এভাবে অপমান করতে পারে না।
-আমি…
রায়াকে কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না ইহফাজ। ধমক দিয়ে উঠল সে।
-চুপ। আর একটা কথাও না। বের হয়ে যাও আমার রুম থেকে। ভুলেও আর কখনও আমার সামনে আসবে না।’
রায়ার হাত ছেড়ে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল ইহফাজ। রায়া ছলছল চোখে ইহফাজকে দেখছে। সে কি এতই খারাপ? লোকটা তাকে একটুও বিশ্বাস করে না? ডান হাতে চোখ মুছতে মুছতে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল রায়া। কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে এলো। পেছন থেকে বাবা, মা অনেক ডেকেছে। রায়া কারো কথায় থামেনি। কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। লোকটা একটা পাষাণ।
চলবে…