#ভালোবাসার_রঙ ‘৭’
#Jerin_akter_nipa
পরের একটা সপ্তাহ রায়ার মন খারাপ ছিল। শত চেষ্টা করেও সেদিনের ঘটনা ভুলতে পারেনি। মনে মনে ইহফাজের উপর যেমন রাগ হচ্ছিল তেমনি ঘৃণা। লোকটা যা তা টাইপের। কারো মন বুঝে না। মানুষকে কষ্ট দিয়ে নিজে মজা পায়। একদিন সন্ধ্যায় রায়া নিজের ঘরে বসে পড়ছিল। বাইরে আন্টির আওয়াজ পাওয়া গেল। ইহফাজের মা এই সময় তাদের বাড়িতে কেন? হয়তো মা’র সাথে কোন দরকার তাই এসেছে। উঠে গেল না রায়া। তার একটু পরেই প্লেটে করে কিছু হাতে নিয়ে মা এসে ওর ঘরে ঢুকলো। রায়া মা’র দিকে না তাকিয়েই বলল,
-আন্টি এসেছিল?’
-হুম। ইহফা…
মা’কে থামিয়ে দিয়ে রায়া আবার বলল,
-তোমার হাতে কী?’
এবার বিরক্ত হয়ে মা বললেন,
-চোখ আছে তো তোর। চেয়েই দেখ না। তোর আন্টি মিষ্টি দিয়ে গেছে।’
কপাল কুঁচকে মায়ের দিকে ফিরল রায়া।
-মিষ্টি নিয়ে এসেছিল? কিন্তু কেন? ‘
-ইহফাজের চাকরি হয়েছে। তাই সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। নে, তুইও একটা খেয়ে দেখ।’
নাক কুঁচকিয়ে রায়া বলল,
-না। তুমিই খাও। আমি মিষ্টি খাই না।’
-খাস না? কী বলিস এসব! স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে নাকি তোর? মিষ্টির জন্য তো তুই জীবন দিস। ফ্রিজ থেকে চুরি করে, তোর বাবার থেকে কেড়ে নিয়ে খেতিস। এখন বলছিস তুই মিষ্টি খাস না।’
-আহ মা! অত কথা বলো কেন তুমি? ‘
-তোর পছন্দের কালো জাম মিষ্টি। খেলে খা, না খেলে ফ্রিজে রেখে দিচ্ছি।’
অস্পষ্ট ভাবে রায়া বলল,
-ওই কালা মন বদের হাড্ডির চাকরির মিষ্টি আমি খাই না।’ তারপর মা’কে বলল,
-খাব না আমি। যাও রেখে দাও।’
গভীর রাতে শুয়ে শুয়ে রায়া আফসোস করছে। আচ্ছা রাগটা তো বদ লোকটার সাথে। মিষ্টির সাথে তো কোন রাগ নেই। মিষ্টি কি ওই বদ বানিয়েছে? বানিয়েছে তো অন্য লোক। তাহলে মিষ্টি খেতে সমস্যা কী?
ধুর! তখন মা’কে ফিরিয়ে না দিয়ে টপাটপ কয়েকটা মিষ্টি খেয়ে নিলেই হতো। আহ, মনটা শুধু মিষ্টি মিষ্টি করছে। এখন শোয়া থেকে উঠে যেতেও ইচ্ছে করছে না। আবার মিষ্টির জন্য মনটা কেমন কেমন করছে। দূর অত না ভেবে উঠেই পড়লো রায়া। রান্নাঘরে এসে ফ্রিজ খুলে মিষ্টি বের করে একনজর ভালো করে দেখে নিয়ে টুপ করে একটা মুখে ভরে দিল। খেতে খেতে বলল,
-দোয়া করি,ব্যাটা বদ চাকরিতে টিকে যা। তোর কুত্তা মার্কা ব্যবহারের জন্য যেন বস ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে না দেয়। কিন্তু, রোজ রোজ অফিসে যেন কাজের জন্য সেই বকা খাস। যত জীবন চাকরি করিস ততদিন বস তোকে ঝাড়ি দিবে। আর তুই বাসায় এসে বসের রাগ বউয়ের উপর দেখাবি। তখন বৌ তোর জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিবে।’
আরেকটা মিষ্টি হাতে নিয়ে রায়া নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
-আমার দোয়া বিফলে যাবে না। আল্লাহ তোর বিচার করবে, ব্যাটা বদ। চাকরি পেয়ে নাচানাচি করছো, না। কিছু দিনের মধ্যেই তোমার নাচানাচি বেরিয়ে যাবে। তখন কেঁদে কুল পাবে না।’
দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল। রায়ার দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎ সে বুঝতে পারলো, মা বাবা যেন নিজেদের মধ্যে কেমন ফিসফিস করে। রায়া সামনে গেলে চুপ হয়ে যায়। যেন চুরি করে কিছু বলছিল যা রায়া শুনে ফেললে পাপ হয়ে যাবে। রায়ার মনটাও আস্ত একটা অসভ্য। বাবা মা’র কথা শোনার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে। নখ কাটতে কাটতে রায়া ভাবছে,
-বাবা, মা আমার আড়ালে চুপিচুপি কী ফন্দি করে হ্যাঁ? জামাই বৌ মিলে তো সেই ফিসফিসানি চালিয়ে যাচ্ছে। আমাকে নিয়ে কোন কুমতলব আঁটছে না তো? ব্যাপারটা তো দেখতে হচ্ছে।’
হাজার চেষ্টা করেও রায়া ব্যাপারটা বুঝতে পারলো না। কত আড়ি পেতেছে, কত উঁকিঝুঁকি পেরেছে। কিন্তু ফলস্বরূপ হাতে কোন তথ্যই পায়নি।
-ঠিক বুঝতে পারছি। এই দুই স্বামী স্ত্রী আমার আড়ালে ঘোর ষড়যন্ত্র করছে। নইলে এতো সাবধানতা বজায় রাখছে কেন? কোন ভাবেই আমাকে কিছু বুঝতে দিচ্ছে না।’
আর দু’টা দিন ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল। তৃতীয় দিন রাতে রায়া বাবা রায়াকে ডাকলেন। মা বাবার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে চাপা উত্তেজনা। শুধু উত্তেজনা না, হালকা ভয়ও দেখা যাচ্ছে। বাবা কিছু বলবে বলবে করেও বলছেন না। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বিরক্ত হয়ে রায়া বলল,
-চুপ করে বসে থেকে আমাকে দেখার জন্য এখানে ডেকেছ নাকি? কিছু বললে বলো নয়তো আমি চলে যাই।’
নরম কন্ঠে বাবা বললেন,
-আমার পাশে বস, মা। তোর সাথে কিছু কথা বলতে চাই।’
রায়া বসল। মনে মনে ভাবতে লাগল, বাবা কী এমন কথা বলবে যার জন্য এতো ভনিতা করছে? আজ বাবার গলাটাও কেমন লাগছে।
-কী বলবে বাবা?’
রায়ার মাথায় হাত রেখে বাবা বললেন,
-আমি একটা কাজ করে ফেলেছি মা। জানি তোকে না জানিয়ে কাজটা করা ঠিক হয়নি। কিন্তু মা, আমি তো তোর বাবা। আমি কি তোর খারাপ চাইব বল? তুই তো জানিস, আমি যা করবো তা তোর ভালোর জন্যই করব। আমাকে তুই ভুল বুঝিস না, মা। আমার উপর রাগ করিস না।’
কিছুই বুঝতে পারছে না রায়া। বাবার মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? হঠাৎ করে এসব কেমন ধরণের কথা বলছে। বাবা বলতেই আছেন।
-তোকে না জানিয়েই আমি তোর জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি মা। আমি তোর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি।’
কথাটা শুনে রায়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। বাবা এসব কী বলছে? বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে মানে? তার তো এখনও অনার্সই কমপ্লিট করা হয়নি। এখনই কিসের বিয়ে! বাবা তো তার পড়ার জন্যই ঢাকা এসেছে। নিজের ঘর বাড়ি ছেড়ে এখানে ভাড়া থাকছে। তাহলে হঠাৎ করে বাবা এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলো কেন?’
রায়াকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বাবা আবার বললেন,
-ছেলে আমাদের পরিচিত। ওর বাবা মা’র তোকে পছন্দ হয়েছে। উনারা আমাকে এমন ভাবে ধরলেন, আমি আর না করতে পারলাম না। ছেলেও অনেক ভালো। দেখিস তোর ঠিক পছন্দ হবে।’
রায়া বাবার উপর রাগ করবে নাকি কষ্ট পাবে ঠিক বুঝতে পারছে না। বাবা কি তার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে না? বাবার কাছে সে এতটাই ফেলনা! একটা বার তার মতামত জানারও প্রয়োজন মনে করলো না? তাকে একবার জিজ্ঞেস করতে পারতো তো। থমথমে মুখে রায়া উঠে দাঁড়াল। বাবার চোখে চোখ রেখে বলল,
-আমি এখন বিয়ে করবো না। তোমার কাছে আমি এতটাই ফেলনা তা জানতাম না বাবা। আমি ভাবতাম, আমি তোমার জীবন। আমাকে ছাড়া তুমি বাঁচবে না। কিন্তু না, তুমি আমার পুরো ধারণাটাই ভুল প্রমাণ করে দিলে বাবা।’
ছলছল চোখে কথাগুলো বলেই রায়া দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বাবা তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে হাসলেন। মা পেছন থেকে রায়াকে ডাকতে লাগল।
-তোর বাবার কথা তুই এভাবে অমান্য করতে পারিস না। তোর ভালোর দিকটা ভেবেই হয়তো লোকটা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রায়া শোন…
-ওকে এখন কিছু বোলো না। পাগলীটা আমার উপর রাগ করেছে। ওকে একা ছেড়ে দাও। মেয়েটা আমার থেকে কখনও এমনটা আশা করেনি। আমি নিজেও বুঝতে পারছি, আমার মেয়ের মতামত না নিয়ে ওদেরকে কথা দেয়া ঠিক হয়নি আমার। আমার মেয়ে রাজি না থাকলে আমি ওদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিব। মেয়ের চাওয়া আমার কাছে সবার উপরে।’ রায়ার ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে হাসলেন তিনি।
-অভিমানী মা আমার।’
ঘরে এসে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল রায়া। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে তরতর করে চোখের পানি ফেলতে লাগল। মা’র থেকেও বাবা তার বেশি কাছের ছিল। মা ছোট থেকে বকেছে, মেরেছে, কড়া কথাও বলেছে। কিন্তু এতো বছরের জীবনে বাবা কোন দিন মুখ কালো করে একটা কথাও বলে নি। হাজার ভুল করলেও হেসে বুঝিয়েছে। ক্ষমা করে দিয়েছে ছোট বড় সব অপরাধ। আজ সেই বাবা তাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেলল! রায়া কখনও বাবার কথার বিরুদ্ধে যেত না। বাবা যাকে ঠিক করে দিতো তাকেই বিয়ে করতো। কিন্তু আজ বাবা তার মন ভেঙেছে। কষ্ট দিয়েছে তাকে।
ওদিকে ইহফাজও জানে না তার সাথে কী হতে চলেছে। বাবা,মা,আপু কোন আপদ তার ঘাড়ে চাপাতে চাইছে। ইহফাজ হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি, যে মেয়েকে সে সহ্যই করতে পারে না। বাবা মা তার সাথেই ওর বিয়ে ঠিক করেছে। আপু ইহফাজকে বলার সাহস পাচ্ছে না। মা, বাবাকে বলার জন্য বলছে। শেষে বাবা কথাটা ইহফাজকে বলেই ফেললেন। প্রথমে বিয়ের কথা শুনে ইহফাজ তেমন কোন রিয়্যাক্ট করেনি। স্বাভাবিক ভাবেই বলেছে,
-আমি এখন বিয়ে করব না। জব নিয়েছি দুই মাসও হয়নি। এখনি কিসের বিয়ে? দুই তিনটা বছর যাক। তারপর দেখা যাবে।’
ইহফাজের কথা শুনে আপু ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল,
-দুই তিন বছর তো সময় তোর জন্য বসে থাকবে! বয়স বাড়বে না তো। বুড়ো হবি না।’
হেসে ইহফাজ জবাব দিয়েছে,
-তোর থেকে তিন বছরের ছোট আমি। তুই এখনও বুড়ি না হলে আমি বুড়ো হয়ে যাব কেন?’
-জানি না আমি কিছু। মা, তোমার ছেলেকে তুমিই বুঝাও। আমি এই ছেলেকে কিছু বুঝাতে পারব না।’
মুখ বাঁকিয়ে ইহফাজ বলেছে,
-তোর বুঝাতে হবেও না। নিজের চরকায় তেল দে তুই। আমার বিয়ে নিয়ে বাবা মা-ই ভাববে। শুধু শুধু আমার চিন্তা করে তোর চুল পাকাতে হবে না।’
এবার বাবা বললেন,
-আমরাই ভেবেছি। ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশাকরি আমার সিদ্ধান্তে তোর কোন আপত্তি নেই।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইহফাজ বলল,
-ভেবে নিয়েছ তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছো কেন? আমার তো মনে হয় তোমরা সব ঠিকঠাক করেই আমাকে জানাচ্ছ।’
আপু উৎসুক হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
-তাই বলে তুই মেয়েকে দেখবি না? বাবা মা’র পছন্দেই বিয়ে করে নিবি?’
-তোদের দেখা আর আমার দেখা একই কথা। তাছাড়া থাকবে তো তোদের সাথে, তোদের পছন্দ না হলে তখন শাশুড়ি বউয়েতে, ননদ ভাবিতে ঝগড়া হবে।’
-এভাবে বলিস না। আমাদের সাথে থাকবে কেন? সারাজীবন তোরা সংসার করবি। দু’জন দু’জনকে ভালো না লাগলে এক সাথে থাকতে পারবি নাকি?’
-সেটা যদি ভাবতি তাহলে মেয়ে ঠিক করার আগে আমাকে জানাতি। আমার মতামত নিতি। মেয়েকে আমার সাথে দেখা করাতি। তোরা তো কোন সুযোগই দিলি না। আগেই সব ঠিক করে ফেললি।’
-তুই চাইলে এখনই মেয়ের সাথে দেখা করতে পারিস। মেয়ে আমাদের কাছেই থাকে।’
খটকা লাগল ইহফাজের। মেয়ে কাছে থাকে মানে। কোন মেয়ে কথা বলছে?
-দেখা করবি?’
-কে মেয়ে?’
-রায়া।’ আপুর হাসি দুই কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। রায়া নামটা শুনে ইহফাজ দুমিনিট স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চেঁচিয়ে বলে উঠল,
-অসম্ভব! ওই মেয়েকে আমি জীবনেও বিয়ে করব না। মেয়ে পেলি না আর তোরা! ওই অসভ্য, ফাজিল, ইতর মেয়েকে আমার গলায় ঝোলাতে চাইছিস! না, না। আমি ওই মেয়েকে বিয়ে করব না। যা করার তোরা করেছিস। এসবের মধ্যে আমি নেই। মরে যাব, তবুও ওই বাদর মেয়েকে বিয়ে করবো না। কক্ষনো না।’
চলবে….