#ভালোবাসার_রঙ ‘৮’
#Jerin_akter_nipa
-তুই বিয়ে করবি,তোর বাপও বিয়ে করবে।’
কথাটা বলেই ইভা বাবার দিকে তাকিয়ে জিভে কামড় দিল। কান ধরে বলল,
-সরি বাবা। আসলে তোমার ছেলের এমন সব কথা শুনে মাথা ঠিক রাখা যায় না। রায়ার মত মিশুক স্বভাবের ভদ্র একটা মেয়েকে ও অসভ্য, বাদর বলছে। না বাবা, আমি এটা মেনে নিতে পারব না।’
আপুর ব্যবহারে বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে ইহফাজ।
-ওই মেয়ে কেমন সভ্য তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না! তোদের কাছে ও অনেক ভালো মানুষ হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে না। আমি ওর আসল চেহারা খুব ভালো করেই জানি। এক নম্বরের ফাজিল মেয়ে।’
বাবা ইহফাজকে ধমকে উঠলেন।
-হয়েছে, হয়েছে। বিয়ে করতে না চাইলে সরাসরি বলে দে। শুধু শুধু মেয়েটাকে কেন আমাদের চোখে খারাপ বানাতে চাইছিস? রায়া কেমন তা আমরা সবাইও জানি।’
মা বললেন,
-তোর কি অন্য কোন মেয়ে পছন্দ আছে?’
-আহ মা! পছন্দ থাকলে তোমাদের জানাতাম না? কেন উল্টাপাল্টা ভাবছো। আমার অন্য কোন মেয়ে পছন্দ না। কিন্তু এই মেয়েকেও পছন্দ না।’
-থাক, তোর পছন্দ কেমন হবে তা আমার ভালো করে জানা হয়ে গেছে। যে রায়াকে অপছন্দ করে, তার কাছে পৃথিবীর কোন মেয়েই ভালো লাগবে না।’
রাগ দেখিয়ে ইভা টিয়াকে কোলে নিয়ে রুমে চলে গেল। বাবা বললেন,
-পছন্দ যেহেতু নেই। তাই আমরা যাকে ঠিক করেছি তাকেই বিয়ে করতে হবে। এবং এটাই আমার শেষ কথা। আমার সিদ্ধান্তে তোমার কোনো আপত্তি থাকলে, ওই যে দেখ দরজা খোলা আছে। সোজা চলে যেতে পারো। আমরা কেউ আটকাব না।’
বেরিয়ে যেতে যেতে বাবা বললেন,
-ভালো একটা মেয়ের নামে যা তা বলছে। বিয়ে করবে না তাই বলে মেয়েটার নামে অপবাদ দিবে! আশ্চর্য!’
ইহফাজ ভেবে পাচ্ছে না, ওই মেয়ে দু’দিনে তার বাবা, মা, বোনকে কী এমন জাদু করলো। বাবা তাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে। তবুও মেয়েটার নামে কোন কথা শুনতে চাইতে না। তার কথা কেউ বিশ্বাসই করতে চাইছে না। সবাই ভাবছে বিয়ে না করার জন্য সে এসব বানিয়ে বলছে! আজব তো!
-সব ভাবে জ্বালানো শেষ। এখন আমাকে বিয়ে করে আমার গলায় ঝুলে জ্বালানোর মতলব করা হচ্ছে! আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও ইহফাজ, এতো সহজে তো আমি তোমাকে ছাড়ব না মেয়ে। তোমার জীবন তেজপাতা বানিয়ে তারপর স্বস্তির নিঃশ্বাস নিব। এর আগে না।’
মায়ের শত বোঝানোর পর বাবার সম্মানের কথা ভেবে রায়া বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু বাবার উপর থেকে রাগ, অভিমান পুরোপুরি গেল না। বলতে গেলে বাবার উপর এক প্রকার রাগ দেখিয়েই রাজি হয়ে গেছে। বিয়ে দিতে চাইছে তো? দিক। বিয়ের পর যখন রায়া শ্বশুরবাড়ি থেকে আসবে না। তখন বুঝবে মজা। এক মেয়ের জন্য কেঁদে কেটে বুক ভাসাবে। চোখের পানি দিয়ে বন্যা বইয়ে দিবে তবুও সে আসবে না। অর্থহীন রাগ মনে চেপে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বাবা রায়াকে দেখে মৃদু হাসলেন। বললেন,
-রাগ কমেছে আমার মা’র? ‘
হুম, না কিছুই বলল না রায়া। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
-আমি ওদেরকে না করে দিব। বলব আমার মেয়ে রাজি না। এবার খুশি তো মা?’ বাবা মুখে হাসি রেখেই রায়ার মুখের দিকে তাকালেন। ভাবলেন রায়া হয়তো এই কথা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠে উনার গলা জড়িয়ে ধরবেন। কিন্তু রায়া এমন কিছুই করল না। উল্টো থমথমে কালো মুখে বলল,
-না।’
ভ্রু কুঁচকে বাবা বললেন,
-না! কী না, মা?’
-আমি রাজি। তুমি যা বলবে আমি সেটাই করব। তোমার কথার বিরুদ্ধে যাব না। তুমি আমার জন্য যা ভালো মনে করেছ। তোমার কথায় আমি কোন প্রশ্ন তুলবো না।’
কথা বলতে বলতে কান্না আটকে রাখতে পারছিল না রায়া। কোনরকমে কথাটা বলেই বাবা মা’র সামনে থেকে চলে এলো। মা বললেন,
-দেখলে, বলেছিলাম না? তোমার মেয়ে তোমার কথার বাইরে যাবে না।’
স্ত্রীর কথা উনার কানে যাচ্ছে না। রায়াকে নিয়ে ভাবছেন উনি। চিন্তিত মুখে রায়ার চলে যাওয়া দেখলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-মেয়েটা আমার উপর রাগ দেখানোর জন্যে এসব করছে। আমি জানি, আমার মেয়ের মনে কী চলছে। আমি ওকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করেছি বলে প্রথমে রাগ করেছে। এখন অভিমান করে বিয়েতে রাজি হয়েছে। ও জানে ওকে ছাড়া থাকতে আমার কতটা কষ্ট হবে। তাই বিয়ে করে আমার থেকে দূরে চলে যেতে চাইছে।’
-কী সব বলছো তুমি! অযথা এতকিছু ভেবো না তো। এমন কিছুই না। আর রায়া আমাদের ছেড়ে দূরে যাচ্ছে কোথায়? এই বাড়িতেই থাকব আমরা। ওরা উপরে। আমরা নিচে। যেতে আসতে দেখা হবে। যখন ইচ্ছে তখন আমাদের কাছে আসতে পারবে। আমার তো মনে হয়, এর থেকে ভালো আর হতেই পারে না। ইহফাজের বাবা মা বিয়ের প্রস্তাব না। আমাদেরই দেওয়ার দরকার ছিল।’
বিরবির করে উনি বললেন,
-তুমি ওর মা। কিন্তু কখনও ওর মন বুঝো না। অন্তত যতটা আমি বুঝি তার এক ভাগও বুঝো না।’
রাগের মাথায় রায়া জানতেও চাইল না কাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে গেল সে। ছেলেটা কে? কী করে? দেখতে কেমন? বাসা কোথায় কিছুই জানার প্রয়োজন মনে করলো না। দেখতে দেখতে গায়ে হলুদের দিন চলে এলো। ছাদে স্টেজ বাঁধা হয়েছে। নিউজ সকাল থেকে একবার রায়াদের এখানে তো একবার ইহফাজদের ওখানে ছুটাছুটি করছে। এক সপ্তাহের জন্য নানির বাড়ি গিয়েছিল সে। এসেই এই ব্রেকিং নিউজটা পেল। ইহফাজ ভাই রায়া আপুকে বিয়ে করছে। এর থেকে বড় ধাক্কা নিউজ মনে হয় তার এগারো বছরের জীবনে খায় নি। ভয়ে ইহফাজকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না সে। রায়ার কাছে জিজ্ঞেস করবে ভাবছে। কিন্তু রায়ার মন খারাপ বুঝতে পেরে উসখুস করছে। ইভা এসে রায়াকে হলুদের শাড়ি আর গহনা সেট পরিয়ে সাজিয়ে দিয়ে গেল। রায়া ভাবছে ইভা আপুদের দাওয়াত করা হয়েছে তাই এসেছে। ইভা যাবার আগে নিউজকে বলে গেল।
-নিউজ, ভাই আমার। আমি ও দিকটা দেখেই কূল পাচ্ছি না। তুই একটু পরে রায়াকে নিয়ে ছাদে স্টেজে আসিস, কেমন? আমি এখন যাই।’
-তুমি কোন টেনশন নিয়ো না, আপু। সব চাপ আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি আপুকে নিয়ে যাব।’
ইভা চলে গেলে নিউজ রায়ার পাশে বসলো। রায়ার ওড়না ঠিক করতে দিতে দিতে বলল,
-আচ্ছা আপু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
কান্না পাচ্ছে রায়ার। এই নিউজকে কত বকেছে সে। মিষ্টি করে কোনদিনও একটা কথা বলেনি। কাল ওদের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই চোখ ভিজে আসছে। নরম গলায় রায়া বলল,
-কী বলবি, বল।’
-আপু তুমি কি নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করছো? নাকি কেউ তোমাকে জোর করেছে? ‘
কারণ নিউজ ভেবে পাচ্ছে না, আসমান জমিন কীভাবে এক হচ্ছে? রায়া তো ইহফাজকে দেখতেই পারে না। তাহলে বিয়ে করছে কেন? ওর ছোট মাথায় কিছুতেই এই প্রশ্নের উত্তর আসছে না। রায়া কেঁদে ফেলল। নিউজ তার নরম নরম হাতে চোখ মুছে দিয়ে বলল,
-কাঁদছো কেন তুমি? ‘
ফোঁপাতে ফোঁপাতে রায়া বলল,
-আমি চলে গেলে আমার কথা মনে পরবে তোর? কষ্ট হবে আমার জন্য? ‘
অবাক হলো নিউজ।
-তুমি কোথায় যাবে? তুমি তো আমাদের সাথেই থাকবে।’
মনে মনে হাসল রায়া। পাগল ছেলে! ও হয়তো এখনও বিয়ের মানেই বুঝে না। বিয়ের পর তো মেয়েরা বাবা, মা চেনা পরিচিত সবাইকে ছেড়ে স্বামীর সাথে অচেনা পরিবেশে পা বাড়ায়। নিউজ বলেই যাচ্ছে।
-আমরা সবাই একসাথে থাকব। আমার তো বড় ভাই বোন নেই। ছোটও না। আমি একাই। আমার মনে হয় তুমি আর ইহফাজ ভাই আমার ভাই বোন। মায়ের পেটের আপন ভাইবোন যেমন হয়না? ঠিক তেমন। ইহফাজ ভাই বাইরে থেকে সব সময় আমাকে ধমকালেও মনে মনে ভালোবাসে। আর তুমি তো,এখন আমার জন্য কাঁদছো। বলো আমার জন্য কাঁদছো না?’ নিজের কাঁপা হাতে নিউজের ছোট হাত দু’টা চেপে ধরল রায়া।
রায়া তখনও জানতো না ইহফাজের সাথে তার বিয়ে হচ্ছে। ছাদে গিয়েও প্রথমে বুঝতে পারেনি। ইহফাজের বাবা মা এখানে থাকবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাদের বাড়ি এটা। বাবা মা দাওয়াত করেছেন তাদের। যেহেতু একই বাড়ি, একসাথে হলুদ হবে তাই আর আলাদা স্টেজ করে নি। ইভা একগাল হেসে রায়াকে নিয়ে স্টেজে বসিয়েছে। নিচু গলায় ইভা রায়ার কানে বলল,
-কাঁদছো নাকি তুমি? বিয়ের আগেই কান্নাকাটি সেরে নাও। কাল আমি তোমাকে সাজানোর পর কাঁদলে খবর আছে। মেকআপ কিন্তু একটুও নষ্ট হতে পারবে না।’ হঠাৎ রায়ার চোখ ছাদের দরজায় পড়লো। কাঁচা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা প্যান্ট পরে ইহফাজ উঠে আসছে। চুলগুলো ভাঁজ করা। এই প্রথম ছেলেটাকে দেখে রায়ার ভালো লাগছে। রাগ হচ্ছে না। চোখ সরিয়ে নিতেও ইচ্ছে করছে না। বিরক্ত মুখে এগিয়ে আসছে ছেলেটা। আজ রায়ার মনে বদ কথাটাও আসছে না। ছেলেটা বদ না। মোটামুটি ভালোই। শুধু একটু বেশি রাগী। ইহফাজ তার দিকে একবার তাকিয়েছে। চোখে চোখ পড়লেও চোখ নামিয়ে নেয়নি রায়া। সেই প্রথম দিন ভুল বুঝে ওকে চোর বলেছিল। মাঝ রাস্তা এক চড় খেয়েছিল। আবার সেদিনই রাতে সিঁড়িতে আরেক চড় খেয়েছিল। তার প্রতিশোধ নিতে গাছ থেকে সব ফুল ছিড়ে নিয়ে গয়না বানিয়ে পরেছিল। ওই অবস্থায় আবার ছেলেটার মুখোমুখি হয়েছিল। আজও সে হলুদের সাজে বসে আছে। কাল বিয়ে হবে তার। আচ্ছা, ছেলেটা মনে মনে কী ভাবছে?
ইহফাজ বিরক্ত মুখে ইভাকে বলল,
-যা করার তাড়াতাড়ি কর। আমি ত্রিশ মিনিটের বেশি এখানে বসে থাকতে পারবো না। তোদের এই নাটক সহ্য হবে না আমার।’
-ইফু! আজ তোদের গায়ে হলুদ। তুই আজও এমন খিটখিট করছিস! দিন দিন বড্ড বেয়াদব হচ্ছিস তুই। বড় বোন হিসেবে যখন দুই গালে দু’টা লাগাব,না। তখন চোখে সর্ষে ফুল দেখবি। এখন চুপচাপ স্টেজে উঠে ভদ্র ছেলের মত রায়ার পাশে গিয়ে বস।’
-আমি ওই মেয়ের পাশে বসতে পারব না।’
-এখনই তোকে এক চড় লাগাব নাকি? আমি বুঝতে পারছি না, তুই ওই মেয়ে,এই মেয়ে, সেই মেয়ে করছিস কেন? রায়া তোর বৌ হবে। তুই ওকে ওই মেয়ে, ওই মেয়ে করে বলবি নাকি?’
-না তো জান বাবু বলে চুমু খাবো?’
ছি ছি বড় বোনের সামনে মুখ ফসকে এটা কী বলে ফেলেছে! লজ্জা লজ্জা! রাগে মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে। ইভা ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
-তা বিয়ের পর নাহয় বলিস। তোর বউকে তুই কী বলে ডালবি এটা একান্তই তোর ব্যাপার। জান বাবু বলবি নাকি কলিজা ময়না টিয়া বলে চুমো খাবি ওসব পারে ভাবিস। আগে সুন্দরমতো হলুদ আর বিয়েটা হয়ে যাক। এখন আমার লক্ষ্মী ইফু হয়ে ভাবির পাশে গিয়ে বসো, সোনা।’
ইহফাজ স্টেজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওকে এদিকে আসতে দেখে রায়ার বুক ধুকপুক করছে। কোন কথা না বলে রায়ার দিকে না তাকিয়ে ইহফাজ ওর পাশে এসে বসলো। ঘটনার আকস্মিকতায় রায়ার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। এই ছেলের মাথার তার টার ছিড়ে গেছে নাকি? তার পাশে এসে বসেছে কোন আক্কেলো? নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল রায়া। ইভার কথায় থমকে গেল।
-বর কনে হাজির। এবার তাহলে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করা যাক? মাশাআল্লাহ! মাশাআল্লাহ! একসাথে দু’জনকে কত সুন্দর লাগছে! দোয়া করি, আল্লাহ তোমাদের দু’জনকে এমন ভাবেই সারাজীবন এক সাথে রাখুক। সুখে শান্তিতে ভরিয়ে দিক তোমাদের সংসার।’
হাঁসের ডিমের মত বড় বড় চোখ করে ইহফাজের দিকে ফিরল রায়া। বলে উঠল,
-এই বদের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে! এর সাথে সারাজীবন কাটাতে হবে আমার! একে বিয়ে করে, এর বাচ্চা কাচ্চা সংসার সামলাতে হবে? অসম্ভব। এই বিয়ে কিছুতেই হবে না। আমাকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। এর কথা আমাকে কেউ বলে নি। তাহলে আমি কোনদিনও রাজি হতাম না।’
চলবে….