ভালোবাসি আমি যে তোমায় পর্ব:৪৫

0
2081

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব:৪৫

ভার্সিটিতে মেডিকেল সেন্টারে এসেছি।হঠাৎ করে আমাদের ফ্রেন্ড আদনান খুব অসুস্থ হয়ে পরেছে।এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছে আমরা ওর বাবাকে জানিয়ে দিয়েছি একটু পরই ওকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা…

আমরা সবাই ক্যান্টিনে বসে চা আর পুরীবার্গার খাচ্ছি।সবাই চা খেলেও আমি কফি নিয়েছি কারন চা আমার ভাল লাগেনা আর খাইনা বললেই চলে।কফি নিয়েও একটুও খাইনি এটা ঠান্ডা করার জন্য রেখে দিয়েছি,ঠান্ডা হলে তারপর খাবো।এখন পুরীবার্গার খাচ্ছি আর সবার সাথে গল্প করছি।

রিপন:সামনে সেমিস্টার ফাইনাল আসতেছে, টেনশনে তো আমার আত্মা শুকিয়ে যাইতেছে।(টেবিলের উপর হাত রেখে)

আইরিন:আরে মামা তোমরা যদি টেনশন করো তাহলে আমাদের কি হবে?(হাসতে হাসতে)

রিপন:ঐ একদম মামা ডাকবিনা।(রেগে)
তামান্না:কেন কেন?কেন ডাকবো না?আমি তো সবসময় তোরে মামা ডাকবো ইভেন তোদের সবাইকে মামা ডাকবো।(হোসে)

কিয়াম:এই না, আমি বাদে।(খেতে খেতে)
আইরিন:কেন?তুই বাদ কেন?(ভ্রু কুচকে)

কিয়াম:আরে তোরা যদি আমাদের মামা ডাকিস,আমরা তো আমাদের জেনারেশনে বউ পাবো না।(মুচকি হেসে)

ইচ্ছে:বলিস কি?(অবাক হয়ে)
আইরিন:খুলে বল।(কিয়ামের দিকে তাকিয়ে)

কিয়াম:রিপু বলতো।(খেতে খেতে)

রিপন:দেখ তোরা যদি মামা ডাকিস তাহলে তোরা আমাদের ভাগ্নি আর আমাদের জেনারেশনে তোদের সব বোন,জুনিয়র,সিনিয়র ব্লা ব্লা সবাই আমাদের ভাগ্নি।তাহলে তোরাই বল আমরা কাদের বিয়ে করবো?সবাই তো ভাগ্নি হয়ে গেলি।(হাসতে হাসতে)

ইচ্ছে:মামারে মামা তোদের লজিক শুনে আমার হসপিটালে যেতে মন চাচ্ছে,আমার মাথাটা যে ঘুরছে।(মাথা ধরে)

আইরিন:খাঁটি সত্য যুক্তি।তবে আমরা মামা না ডাকলেও তোরা এই জেনারেশনে বউ পাবিনা।(হাসতে হাসতে)
কিয়াম:এই একদম এসব বলবিনা।আমি তাড়াতাড়ি বিয়ে করে সুখের সংসার করবো।(মুচকি হেসে)

আইরিন:আচ্ছা আগে আমার লজিক শোন তারপর বিয়ের স্বপ্ন দেখিস।

আদনান:আর কি স্বপ্ন দেখবো আমার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।(আমার দিকে তাকিয়ে মন খারাপ করে)

আইরিন:রাখ তোর প্যান প্যানানি।আগে আমি বলি শোন।
সাফি:বল বল তাড়াতাড়ি বল আর একটু পর তো ক্লাস শুরু হবে,যা বলবি শর্ট কাটে বলে শেষ কর।(আগ্রহ নিয়ে আইরিনের দিকে তাকিয়ে)

আইরিন:দেখ তোরা কেবল ফাস্ট ইয়ার।অনার্স মাস্টার্স শেষ করতে লাগবে দশ বছর।

সাফি:দশ বছর?(অবাক হয়ে)
আইরিন:না তোর লাগবেনা, তুই মেধাবী।মেধা দিয়ে তুই সময়ের আগেই পড়ালিখা শেষ করে ফেলবি কিন্তু আমার বাকি মামারা তো নিজেকে ইমপ্রুভ করতে করতে দশ বছর লাগিয়ে দিবে।যাইহোক আসল কথায় আসি,ওই দিকে দশ বছর আর জব পেতে মুটামুটি তিন বছর।এই দিয়ে হলো তেরো বছর আর জব পাওয়ার সাথে সাথে কি বিয়ে হয়?লিজেন্ডরা জব পাওয়ার দুইবছর পর বিয়ে করে।তাহলে মোট পনেরো বছর পর তোরা বিয়ে করার জন্য উপযুক্ত হবি তত দিনে আমাদের জেনারেশনের কোন মেয়ে থাকবেনা সবার বিয়ে হয়ে যাবে,সো তোদের এই জেনারেশনে বউ পাওয়া হলো না….তোদের বউ এখনও পৃথিবীতে আসেনি,তারা এখন মায়ের পেটের মধ্যে আছে।(হাসতে হাসতে)

তামান্না:এই তোদেরকে আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, এখনকার মেয়েদের সাথে কোন ইটিস ফিটিস করবি না নাহলে বিয়ের পর দেখবি তোদের শাশুড়ি আম্মা তোদের কিশোর বয়সের প্রেমিকা ছিল।তখন কিন্তু মহা ঝামেলায় পরে যাবি।(হাসতে হাসতে)

আইরিন:এই যেমন আদনান মামাকেই ধর না। ও তো অন্তর প্রেমে পাগল কিন্তু অন্তর তো বিয়ে হয়ে গেছে।কয়েকদিন পর ওর একটা মেয়েও হয়ে যাবে।আর পনের বছর পর সেই মেয়ে যুবতি হয়ে যাবে।বাই এনি চান্স আদনান মামা যদি সেই যুবতি মেয়ের প্রেমে পরে তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে বুঝতে পারছিস?(সবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে)

আইরিনের লজিক শুনে আমরা সবাই হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি।কারও মুখে কোন কথা নেই।হঠাৎ আদনান চেয়ার থেকে উঠে বলল,

আদনান:তোর লজিক শুনে আমার কলিজা শুকিয়ে গেছে।কি ভয়ঙ্কর!পানি দে পানি।(আতংকিত হয়ে)

বলেই আদনান আমার কফি মগ নিয়ে ঢক ঢক করে কফি খেয়ে আবার চেয়ারে বসলো।আর সঙ্গে সঙ্গে সবাই দম ফাটা হাসিতে মেতে উঠলো।হাসি তো আর থামেই না।কি এক কান্ড!এই দিকে আমার তো লজ্জা লাগছে।

তামান্না:নানু ভাই তোর হুরপরী এখন থেকে তোর শাশুড়ি হয়ে গেল যে।(হাসতে হাসতে)

আদনান:আহ্ আর বলিস না বুকটা চিন চিন করতেছে,পেটের মধ্যেও কেমন গুলোচ্ছে।(বুকে হাত দিয়ে)

রিপন:তুই যে আমাদের নির্ভীক ভাইয়ের বউ এর খাওয়া কফি খেয়ে নিলি রে ভাই সেজন্য মনে হয় তুই গর্ভবতী হয়ে গেছিস(হাসতে হাসতে)

আমি:আমি ওটা খাইনি।(ভাব নিয়ে)
আদনান:আমার কি আর সেই কপাল আছে?(মন খারাপ করে)

সাফি:ওকে গাইস,টাইমস আপ। চল ক্লাসে যাই।(চেয়ার টেনে উঠতে উঠতে)

কিয়াম:এই চল তোরা, এলার্ম বেজে গেছে।(উঠতে উঠতে)
সাফি:ঐ একদম আমারে এলার্ম বলবিনা।(রেগে গিয়ে)

সবাই উঠে গেছি তখনই আদনান বমি করতে শুরু করলো।আমরা তো ভয় পেয়ে গিয়েছি।ছেলেরা ধরাধরি করে ওকে মেডিকেল সেন্টারে এনেছে আমরাও সাথে এসেছি।এখন ওর অবস্থা ভাল না, মুখ দিয়ে ফেনা উঠছে।আদনানের বাবাকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।আদনানকে এখন হসপিটালে নিজে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আমরা মেয়েরা একপাশে জড় সর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।এখানকার চিকিৎসকরা বলছেন ও বিষ খেয়েছে।এটা শুনে তো আমরা হতবাক।কখন বিষ খেল ওতো আমাদের সাথেই ছিল,ইনফ্যাক্ট ও যা খেয়েছে আমরাও তাই খেয়েছি।আর আদনান আমাদের চোখের সামনেই ছিল। সবার মনে এখন একটায় প্রশ্ন আদনান বিষটা খেল কখন।

আদনানকে দ্রুত হসপিটালে পাঠানো হলো, ওর সাথে রিপন, সাফি আরও কয়জন ফ্রেন্ড গেল।আর আমরা বাকিরা মেডিকেল সেন্টারের বাহিরে দাঁড়িয়ে আদনানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।এই ঘটনাটা কিছুসময়ের মধ্যে পুরো ভার্সিটি ভাইরাল হয়ে গেল।সবার মুখে এক কথা কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের এক ছেলে ক্যান্টিনে বিষ খেয়েছে।প্রায় আধ ঘন্টা পর ভার্সিটি কতৃপক্ষ আদনানের সাথে যারা ছিল তাদের কে ডাকলেন।আমরা সেখানে গেলাম।উনারা আমাদের জিজ্ঞাসা বাদ করলেন,সব শেষ উঠে আসলো আদনানকে বিষ খেতে কেউ দেখেনি আর ও সবশেষে আমার কফি খেয়েছে।

ছেলেটা সবশেষ ভিসি স্যারের ছেলের বউ এর কফি খেয়েছে।ভিসি স্যারের ছেলের বউ এর কফিতে বিষ এল কোথায় থেকে?এসব কি কারও প্ল্যান ছিল নাকি ক্যান্টিনের খাবারের সমস্যা?নাকি ছেলেটা ইচ্ছে করে বিষ খেয়েছে?কিন্তু ছেলেটার বন্ধুরা বলছে ওকে কেউ অন্যকিছু খেতে দেখেনি আর ছেলেটা সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল।

এই কথাগুলো মুহূর্তের মধ্যে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে গেল।ভিসি অ্যাঙ্কেল আমাকে উনার সাথেই রেখেছেন।অ্যাঙ্কেলের জন্যই আজ পুরো ভার্সিটি জেনে গেল আমি উনার ছেলের বউ।কেউ জানতোই না ভিসি স্যারের ছেলে বিয়ে করেছে আর তার বউ এই ভার্সিটিতেই পরে।আদনানের ব্যাপারটা শুনে অ্যাঙ্কেল ভয় পেয়ে গিয়েছেন তাই আমাকে উনার কাছে রেখে নির্ভীক ভাইয়াকে ফোন দিয়ে আসতে বললেন।নির্ভীক ভাইয়া পাশেই উনার ক্যাম্পাসে আছেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসবেন।

অ্যাঙ্কেলের কেবিনে এক কোনায় আমি আর ইচ্ছে বসে আছি,কেবিনে আরও কিছু টিচার আছেন।দরজা ঠেলে দুজন লোক ভেতরে এসে বললেন,”স্যার ছাত্ররা ক্যান্টিনে ভাঙচুর করছে,ছেলেটির অবস্থা আশংকাজনক।ডক্টর বলেছেন বাঁচার চান্স নেই বললেই চলে।”

লোকটার কথা শুনে আমাদের শুকনো মুখ আরও শুকিয়ে গেল।আমাদের বন্ধুর আজ একি হয়ে গেল।ওর যেন কিছু না হয় মনে মনে এই প্রার্থনাই করতে থাকলাম।

অ্যাঙ্কেল:ওদের থামানোর ব্যবস্থা করুন।ওদের শান্ত করুন।ক্যান্টিনে তালা লাগান, তদন্ত করার জন্য কিছু বাঁচিয়ে রাখুন নাহলে ঘটনাটা যদি সত্যি কারও পরিকল্পনা হয় তাহলে আমাদের হাতে কোন প্রমান আসবেনা।(ব্যস্ত হয়ে)

লোকগুলো দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।একটু পরই হন্ত দন্ত হয়ে নির্ভীক ভাইয়া, সিয়াম ভাইয়া আর সাথে আরও দুটো ছেলে ভেতরে আসলেন।
নির্ভীক:বাবা?হোয়াট হেপেন্ড?অন্ত কোথায়?(অ্যাঙ্কেলের সামনে গিয়ে)

উনি অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছেন,টেনশনের চোটে খেয়াল করেননি উনি আমাদের পাস করেই অ্যাঙ্কেল পর্যন্ত গিয়েছেন।উনার আসা দেখেই আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম তাও খেয়াল করেননি।

অ্যাঙ্কেল:ওই তো ওরা ওখানে,তুমি ওদের নিয়ে বাসায় যাও।পরে কথা হবে।(আমাদের দিকে ইশারা করে)

নির্ভীক ভাইয়া পেছনে তাকাতেই আমাকে দেখতে পেলেন।দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
নির্ভীক:আর ইউ ওকে?
আমি:হুম।

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে অ্যাঙ্কেলকে বলে আমাদের নিয়ে বাহিরে আসলেন।বাহিরে এসে সবাই আমাদের দেখছে যেন আমরা কোন ফিল্ম স্টার।নির্ভীক ভাইয়া আমাদের নিয়ে গাড়িতে উঠলেন।গাড়িতে উঠেই আমি রিপনকে ফোন দিলাম,
আমি:আদনানের কি অবস্থা?(স্পীকার অন করে)

রিপন:দোস্ত অবস্থা ভাল না।আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছেনা।(কাঁদতে কাঁদতে)

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা।আমার হাত-পা কাঁপছে।রিপন কোন সারা না পেয়ে ফোন কেঁটে দিল।

ইচ্ছে:অন্ত আমার ভয় করছে।আদনান মনে হয় আর..
আমি:এসব বলিস না।কিছু হবে না।(ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে) আমি হসপিটালে যাবো,আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন।(নির্ভীক ভাইয়ার হাত ঝাকিয়ে)

নির্ভীক:তোমার যাওয়ার দরকার নেই।তোমাকে বাসায় দিয়ে আমরা যাবো।সিয়াম, ড্রাইভ ফাস্ট।(সিয়াম ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে)

আমি:প্লিজ আমাকে নিয়ে চলুন।ওই কফিটা আমার খাওয়ার কথা ছিল।আদনান না খেলে ওটা আমি খেতাম।ওর জায়গায় এতক্ষণ আমি….

পুরো কথা বলার আগেই নির্ভীক ভাইয়া আমার মুখ চেপে ধরলেন।আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
নির্ভীক:সিয়াম হসপিটালে চল।

হসপিটালে আসতে আসতে আমি আর ইচ্ছে নির্ভীক ভাইয়াকে পুরো ঘটনা বলে দিলাম।হসপিটালে এসে দেখি আদনানের মা-বাবা আর বোন কাঁদছে,ভার্সিটি থেকে যারা এসেছিল তাদের মধ্যে যারা ক্লোজ তারা কাঁদছে আর বাকিরাও খুব দুঃখী ফেস করে দাঁড়িয়ে আছে।ওদের দেখেই বুঝা যাচ্ছে আদনানের কন্ডিশন খুবই খারাপ।আমরা যেয়ে আদনানের মায়ের কাছে বসলাম।উনি খুব কাঁদছেন।শান্তনা দেবার কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা।

আমরা যাবার প্রায় ১ঘন্টা পর ডক্টর বেড়িয়ে আসলেন।আমরা সবাই মৌমাছির মতো ডক্টরকে ঘিড়ে ধরলাম।আমাদের সবার কন্ডিশন দেখে ডক্টর হালকা হাসলেন।এই হাসিতেই যেন আমাদের সব টেনশন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।

আদনানের মা:ডক্টর আমার ছেলে কেমন আছে?আমি দেখতে চাই ওকে।(ব্যস্ত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে)

ডক্টর:দূর থেকে দেখতে পারেন।এখন ও ঘুমোচ্ছে। আপনারা প্লিজ এখন কেউ রোগীকে ডিস্টার্ব করবেন না,ছেলেটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে।ওর শরীরে এখন মিনিমাম শক্তিটুকুও নেই।চিন্তার কোন কারন নেই।আপনাদের মধ্যে প্লিজ কেউ আমার কেবিনে আসুন।

ডক্টরের সাথে আদনানের বাবা আর নির্ভীক ভাইয়া গেলেন।আমরা সবাই আদনানের কেবিনের দরজার কাচ লাগানো অংশে উকি ঝুকি মেরে দেখতে লাগলাম।ছেলেটা পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে,দেখে মনে হচ্ছে ডক্টর ওর সব রক্ত শুষে বের করে নিয়েছেন আর মাথার খাড়া চুলগুলোও ভিজে নেতিয়ে আছে।

সারাদিন পর সন্ধ্যার একটু আগে আমরা বাসায় ফিরলাম।আদনানের সাথে আমাদের কথা হয়নি কারন ও ঘুমোচ্ছিল।বাসায় এসে ক্লান্ত শরীরে সোফায় গিয়ে বসলাম।বাসার সবাই আমাদের কাছে এগিয়ে এলো।অ্যাঙ্কেলও এখন বাসাতেই আছেন।আম্মু,জারিফ ভাইয়াও এসেছে।আমরা আসতেই অ্যাঙ্কেল নির্ভীক ভাইয়ার কাছে সব শুনতে চাইলেন।নির্ভীক ভাইয়া সবাইকে সবটা বললেন।আমরা ক্লান্ত থাকায় রুমে চলে আসলাম।নিচে এখনো সবাই ওসবই আলোচনা করছে।

রুমে আসতেই নির্ভীক ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলেন।আমিও কিছু না বলে চুপচুাপ উনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।মনটা খুব এলোমেলো লাগছে।কফিটা খেলে এতক্ষণ আমি লাশ হয়ে পরে থাকতাম।আদনান স্ট্রং ছেলে তাই ও কোন মতে বেঁচে গিয়েছে।ঘটনাটা আমার সাথে ঘটলে আমার স্পট ডেথ হয়ে যেত।আর আমার আপনজনেরা আমার শোকে এতক্ষণ পাগল হয়ে যেত।নির্ভীক ভাইয়ার কি হতো?কি করতেন উনি এই সময়?

হঠাৎ নির্ভীক ভাইয়ার ফোন বেজে উঠলো।উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন,
নির্ভীক:তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাউ।

আমি উনার কথা মতো ফ্রেশ হতে যেতে লাগলাম।কিছুদূর যেয়েই আমার পা আটকে গেল উনার কথা শুনে।কল রিসিভ করে উনি বললেন,
নির্ভীক:হুম মিষ্টি বল।
মিষ্টি:….
নির্ভীক:আচ্ছা আমি সরি,কাল দেখা করবো।আজ একটু প্রবলেম ছিল।(ভ্রু কুচকে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে)
মিষ্টি:……
নির্ভীক:ওকে ডান।(সোফায় বসে)

উনি কল কেঁটে ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।আমি ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে ভাবলাম এই মিষ্টির ব্যাপারটা দিন দিন গুরুতর হয়ে যাচ্ছে।কে এই মিষ্টি? নির্ভীক ভাইয়া তো আমাকে ভালোবাসেন তাহলে মিষ্টির সাথে উনার কি সম্পর্ক?প্রতিদিন এক মিনিটের জন্য হলেও উনি মিষ্টির সাথে কথা বলেন।আমাকে সবটা জানতে হবে।উনার ফোন আর একবার চেক করতে হবে।আজই উনার ফোন চেক করবো।

ওয়াশরুম থেকে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি এখনও সোফায় বসে থেকে ফোন টিপছেন আর মুচকি হাসছেন।আমি রাগী ফেস করে উনার কাছে যেয়ে উনার ফোন ছো মেরে নিয়ে নিলাম।

নির্ভীক:হোয়াট দ্যা…(রেগে আমার দিকে তাকিয়ে)
আমি:ফ্রেশ হয়ে আসুন আগে তারপর ফোন পাবেন।(স্বাভাবিক ভাবে)

নির্ভীক:ওকে বাট ওখানে দরকারি কাজ আছে ওটা ঠিক করে রাখি আগে।(ফোন আমার হাত থেকে নেওয়ার চেষ্টা করে)

আমি:না,পরে ঠিক করবেন আগে আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।(ফোন পেছন দিকে লুকিয়ে)

নির্ভীক:ওকে।(উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে)

বলেই উনি ওয়াশরুমে ঢুকলেন।আমি উনার ফোন নিয়ে সোফায় বসলাম।ফোনে এখনও আলো জ্বলে আছে,উনি এতক্ষণ উনাদের ডিপার্টমেন্ট গ্রুপে চ্যাট করছিলেন।এখান থেকে বের হতেই চ্যাটলিস্টের চার নাম্বার কনভারসেশনে দেখলাম মিষ্টু লিখে নাম সেভ করা।মিষ্টি থেকে মিষ্টু?বাহ!বাহ!আর কি দেখতে হবে কে জানে।মিষ্টির কনভারসেশন এ ঢুকতেই আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো।

“সব ভুলেরই কোন না কোন শাস্তি হয়,আমি ভুল করেছি শাস্তিও পেয়েছি। এইবার কি আমাকে ক্ষমা করা যায় না?তুমি প্লিজ আগে যা হয়েছে সব কিছুকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দাও,চলো আমরা নতুন করে বাঁচি।আমার কাছে এসো প্রিয়া,প্লিজ কাম ব্যাক টু মাই লাইফ।আই লাভ ইউ,আই লাভ ইউ মোর দ্যান এনিথিং।”

মিষ্টির দেওয়া এই মেসেজের নিচেই মিষ্টির আরেকটা আছে,

“যা বলেছি মন থেকে বলেছি,এর মধ্যে আমার সর্বোচ্চ ইমোশন আছে।এর চেয়ে বেশি কিছু আর বলতে পারবোনা।অহ হ্যা সরিটা বলা যায়,আগে যা হয়েছে তার জন্য আই ফিল রিয়েলি ভেরি সরি।….. ওকে?”

এর নিচেই নির্ভীক ভাইয়ার একটা ছোট মেসেজ,

“ওকে”

আর কোন মেসেজ নেই।ফোন রেখে দুই হাত দিয়ে চোখ মুছে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকালাম।তারপর আবার ভাবলাম উনার ফোনে লাভ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা কার সেটা দেখা দরকার।ফোন হাতে নিয়ে পাওয়ার বাটন অন করতেই দেখি ফোন লক।আগে তো উনার ফোন সুয়াইপ আপ ছিল এখন প্যাটার্ন দিয়ে রেখেছেন কেন?আমার জন্য?

এসব ভাবতেই আমার কান্না পাচ্ছে।উনি আমাকে নয় মিষ্টিকে ভালোবাসেন,আগের থেকেই উনি মিষ্টিকে ভালোবাসেন।মিষ্টি আগে কোন ভুল করেছিল দেখে উনি মিষ্টিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।এখন মিষ্টি সরি বলছে তো উনিও ইটস্ ওকে বলছেন।আমার এখন উনাদের মধ্যে থাকায় ঠিক নয়।নির্ভীক ভাইয়া আমার সাথে কেন এমন করলেন?হুয়াই।

এসব ভেবেই আমি কান্নায় ভেঙ্গে পরলাম।চোখ মুছে উঠে দাঁড়াতেই নির্ভীক ভাইয়া টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেড়িয়ে এলেন।আমাকে দরজার দিকে যেতে দেখে বললেন,
নির্ভীক:কোথায় যাচ্ছো?(চুল মুছতে মুছতে)

আমি শুনেও না শুনার ভান করে বেড়িয়ে আসলাম রুম থেকে।নিচে এসে দেখি জারিফ ভাইয়া আর আম্মু চলে যাচ্ছে।
আমি:ভাইয়া আমিও যাবো তোমাদের সাথে।(ভাইয়ার এক হাত ধরে)

জারিফ:এখন?কাল যাস,চাঁদ কোথায়?
আমি:এখনই যাবো,চলো।(জেদ করে)
আফ্রা:এভাবে যাবি?মাথায় তো চিরুনিও করিসনি।(ভ্রু কুচকে)

আপুর কথা শুনে আমি মাথায় ওড়না দিয়ে আবার বললাম,
আমি:ভাইয়া চলো।

ভাইয়া এবার অ্যাঙ্কেলের দিকে তাকালো।অ্যাঙ্কেল বললেন,
অ্যাঙ্কেল:এত করে যেতে চাইছে নিয়ে যাও।চাঁদ যেয়ে নাহয় নিয়ে আসবে ওকে।(হাসি মুখে)

ভাইয়া আর আম্মুর সাথে আমাদের বাসায় চলে আসলাম।আমার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে কাঁদতে লাগলাম।অনেক কষ্ট হচ্ছে।নির্ভীক ভাইয়া যদি মিষ্টিকেই ভালোবাসেন তাহলে আমাকে ভালোবাসার কথা বলেন কেন?উনি মনে হয় মিষ্টির উপর রাগ করেই আমাকে বিয়ে করেছেন।সেজন্যই এমন হুট করে বিয়ে করে নিলেন।

প্রায় একঘণ্টা কান্না করার পর আমি উঠে বসলাম।বাহিরে অন্ধোকার হয়ে গেছে।অনেকক্ষণ কান্না করার জন্য মাথাটা ব্যাথায় ছিড়ে পরছে।আমি দরজা খুলে ধীরে ধীরে আম্মুর রুমে গেলাম।আম্মু এখন রুমে নেই।মেডিসিন বক্স খুঁজে টাফনিল আর ল্যাক্সিল খেয়ে আম্মুর বেডেই এলোমেলো হয়ে শুয়ে পরলাম। প্রায় আধ ঘন্টা পর আম্মু রুমে এসে অবাক হয়ে বলল,

আম্মু:ওমা তুই এখানে?আমি তোকে পুরো বাসা খুঁজে পাচ্ছি না।খাবি কিছু চল।(আমার কাছে বসে)

কথা বলতে একটুও ইচ্ছে করছে না।তাও খুব কষ্ট করে বললাম,
আমি:ঘুম পাচ্ছে প্রচুর।

আম্মু:খেয়ে এসে ঘুমা,এখানে এনে দিবো?(আমার মাথায় হাত রেখে)

আমি কিছু বললাম না।ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলাম।ঘুম ভাঙলে তাকিয়ে দেখি নির্ভীক ভাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছেন।উনার নাক আমার গালে ঠেকে আছে।আশেপাশে পাশে তাকিয়ে দেখি সকাল হয়ে গেছে আর আমি নির্ভীক ভাইয়ার রুমে শুয়ে আছি।হাত পা অবশ হয়ে আছে,হয়তো অনেকক্ষণ কোন নড়াচড়া করিনি সেজন্য।আমি একটু নড়াচড়া করতেই নির্ভীক ভাইয়া জেগে গেলেন।কাল সন্ধ্যার কথা মনে হতেই কান্নায় বুক ভার হয়ে আসলো।উঠতে যাবো তখনই নির্ভীক ভাইয়া আমার ঠোঁটের কাছে মুখ এনে ঘুম ঘুৃম কন্ঠে বললেন,
নির্ভীক:মিষ্টি খাবো।(চোখ বন্ধ করে)

আমি উনাকে ঠেলে সরিয়ে দিলাম।ধুরমুর করে বেড থেকে নেমে দাঁড়ালাম।উনি সকাল টা শুরু করলেন মিষ্টির নাম দিয়ে আর প্রতিদিন সকালে একই কাজ করেন।আমি আগে বুঝতে পারিনি।এখন আমার খুব রাগ হচ্ছে তাই রেগে গিয়ে উনাকে বললাম,

আমি:এতই যখন মিষ্টিকে ভালোবাসেন তাহলে আমাকে বিয়ে করলেন কেন?যান গিয়ে মিষ্টিকে বিয়ে করুন।(উনার দিকে তাকিয়ে)

নির্ভীক:হুম করবো,আমার মিষ্টি।(চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে)

শেষ সব শেষ,আমি শেষ।ওখানেই ফ্লোরে বসে উনার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলাম।উনার কথা শুনে আমার চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছে করছে,

“বুকের ভেতর নোনা ব্যাথা
চোখে আমার ঝরে কথা
এপার ওপার তোলপাড় একা।”

চলবে……………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here