#ভালোবাসি তাই
part:20
Writer:Afifa Jannat Maysha
🍁
মাকে কি উত্তর দেবো বুঝতে পারছি না আমি। সত্যিই একদিন না একদিন তো বিয়ে করতেই হবে। মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছি তখন সারাজীবন তো আর এ বাড়িতে পড়ে থাকতে পারবো না। এই সমাজে থেকে সেটা তো আরো সম্ভব নয়। আর আমিই বা না করবো কেনো? সায়ন ভাইয়ার জন্য? উনি নিজেই তো সারাজীবনের জন্য অন্য কারো হাত ধরতে চলেছেন। শুরু করতে চলেছেন এক নতুন জীবন। যেখানে “মাইশা” নামক কারো স্থান নেই।
আমি একজন মেয়ে। জীবনের পথে তো আর একা একা চলতে পারবো না। বাস্তবতা তো এটাই। কাউকে ভালোবাসলে তাকে যদি না পাই তাহলে যে সারাজীবন তাকে ভালোবেসে একা একাই কাটিয়ে দেবো সেটা নিছকই স্বপ্ন। বাস্তবে তা কখনো সম্ভব নয়।বাস্তবতার কাছে ভালোবাসা সবসময়ই হেরে যায়। এটা মেনে নিতেই হবে আমায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করলাম আমি। ঘুরে তাকালাম মায়ের দিকে। মা এখনো উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে দেখে চলেছে আমায়। আমি দমবন্ধ করে উত্তর দিলাম
– আমি রাজি মা। বাকিটা তোমাদের ইচ্ছা।
আমার উত্তরে মুহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে গেলো মায়ের মুখ। যেনো নিভে যাওয়া মোমবাতিটা জ্বলে উঠেছে। আমার একটা সেক্রিফাইজ কতগুলো মানুষের আনন্দের কারণ হতে পারে! তাই আমি এই বিয়েটা করবো। নিজের জন্য না হলেও ফেমিলির জন্য। মা হাঁসিমুখ করে বললো
– তুই বুঝতে পেরেছিস এটাই অনেক। দেখবি রাহুলের সাথে তুই অনেক সুখী হবি।
– হয়তো।
মা চট করে একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
– নে রেডি হয়ে নে।
-এটা কি?
– শাড়ি।
– কিন্তু আমি তো শাড়ি পরবো না। এই গাউনটা পরবো।
– আরে কনেকে আলাদা পোশাক পরতে হয়। সবাই তো গাউন পরছে। এখন যদি তুইও পরিস তাহলে কে কনে তাকে কি চেনা যাবে?
– তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না মা। কনে তো আপু। আর আপু তো শাড়ি পরছেই। আজ আপুর এনগেজমেন্ট মা। আমার না যে আমায় শাড়ি পরতে হবে।
– আজ তো শুধু মালিশার এনগেজমেন্ট নয়। আজ তোরও এনগেজমেন্ট হবে।
অবাক হতে হতে আর অবাক হতে পারছি না আমি। সবকিছু এতো তারাতাড়ি হয়ে যাচ্ছে যে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না আমার। অবাক হওয়া চেহারা নিয়েই মাকে বললাম
– কিসব বলছো মা? আজ আমার এনগেজমেন্ট মানে কি?
– হ্যাঁ, রাহুলের মা চান আজই সায়ন আর মালিশার সাথে তোদের এনগেজমেন্টটাও যেনো হয়ে যায়। শুধু এটাই না বিয়েটাও ওদের বিয়ের দিন দিতে চান। তাহলে সব ঝামেলা একসাথে শেষ হয়ে যাবে।
– এতো তারাহুরো করার কি আছে? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছি?
– একহিসেবে ভালোই হবে। বিয়েটা আজ হোক বা কাল হোক হবে তো। তাই আগেভাগে হয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে। জানিস না শুভ কাজে দেরি করতে নেই।
– আমি কিছু জানি না। তোমরা যা ভালো মনে করো তা-ই করো।
– হুম। এবার যাতো তারাতাড়ি রেডি হয়ে আয়।
– তুমি যাও আমি আসছি।
মাকে বিদায় দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম আয়নার সামনে। সাজতে ভালো না লাগলেও আজ আমি সাজবো। পুরো আপুর মতো করে সাজবো। সবকিছু যেভাবে চলছে সেভাবেই চলতে থাকুক। তাতে ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা না করে মানিয়ে চলাটাই ভালো হবে সবার জন্য।
শাড়ির রঙটা কালো। কিন্তু রাহুল ভাইয়া তো কালো পরেননি। কালো তো পরেছেন সায়ন ভাইয়া। হাহ……. যাকিছুই করতে যাই না কেনো সায়ন ভাইয়ার কথা মাথায় আসবেই। উনি আমার খুব কঠিন একটা রোগ। যেটা থেকে আমি চাইলেও পরিত্রাণ পেতে পারছি না।
🍁
সাজা শেষে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়েই হাঁটা ধরলাম ড্রয়িংরুমের দিকে। এনগেজমেন্ট পার্টি ওখানেই হচ্ছে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় খেয়াল করলাম আমার সব কাজিন আর পরিচিত আত্মীয়রা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। হবেই তো, যেই আমাকে মেরে ফেললেও এভাবে সাজতে চাইতাম না। সেই আমি আজ এতো ভাড়ী মেকআপ করেছি। ওদের এক্সপ্রেশন দেখেই বুঝতে পারছি ওরা কেউ এখনো আমার এনগেজমেন্ট সম্পর্কে কিছু জানে না।
আপুকেও নিয়ে আসা হয়ে গেছে এখানে। ভালোভাবে খেয়াল করে বুঝলাম আমার আর আপুর শাড়ির ডিজাইন সেইম। আমিও আপুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। আশেপাশের মানুষের গুজুরগুজুর শুনে বুঝা যাচ্ছে তারা কনফিউজড হিয়ে আছে। কে আসল কনে সেটা বুঝতে পারছে না বোধহয়।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। এনগেজমেন্টের রিচুয়াল শুরু হবে। সবাই নিজেরদের মাঝে ভীষণ আগ্রহ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা আর আঙ্কেল মিলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে নানা কথা বললেন। এবার পালা আংটি বদলের। সায়ন ভাইয়া আর আপুকে পাশাপাশি দাঁড় করানো হলো। পলকহীন চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। পলক ফেলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না আমার মাঝে।
– সায়ন রিংটা পরিয়ে দাও মালিশাকে।
খালামনির কথামতো আংটিটা নিয়ে আপুর দিকে হাত বারালো সায়ন ভাইয়া। এবার নিজেকে ঠিক রাখা কষ্টকর হয়ে আমার। সায়ন ভাইয়ার হাতটাও কেমন কাঁপছে।
দুজনেই দুজনকে আংটি পরানোর মাধ্যমে এনগেজমেন্ট শেষ করলো। সবাই মিলে হাততালি দিয়ে চলেছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে সবার তালিগুলো যেনো আমাকেই উপহাস করছে। সবাই যখন তালি দিতে ব্যাস্ত তখনই বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো
– এখানেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়নি। আরেকটা খুশির সংবাদ আছে। আমার ছোট মেয়ে মাইশা আর রাহুলেরও এনগেজমেন্ট হবে আজকে।
বাবার এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই যে অবাক হয়ে গেছে তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। তবে আমার মাঝে তেমন কোনো পতিক্রিয়া নেই। হঠাৎই চোখ গেলো সায়ন ভাইয়ার দিকে। উনি কেমন ভাবে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। উনার চোখে অবাক আর ক্ষোভ দুটোই ভেসে উঠছে। আমি উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকালাম রাহুল ভাইয়ার দিকে। উনার চোখমুখ চকচক করছে।
একইভাবে আমায় আর রাহুল ভাইয়াকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে আংটি পরানোর জন্য বলা হলো। রাহুল ভাইয়া ঝটপট আমার হাতে আংটি পরিয়ে দিতে লাগলেন। সবকিছুই অসহ্য লাগছে আমার। রাহুল ভাইয়ার হাতটা ছুরে মারতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই। আমিও কোনো ভণিতা ছাড়া রিং পরিয়ে দিলাম উনাকে।
আবারও সবাই হাততালি দিলো। ওখান থেকে সারার পাশে এসে দাঁড়ালাম আমি। সারাও যে আমার এ সিদ্ধান্তে অনেক খুশি সেটা ওকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে।
– অবশেষে তোর মাথা থেকে একতরফা ভালোবাসার ভুত নামলো। এটা তোর লাইফে সেকেন্ড বেস্ট সিদ্ধান্ত।
– সেকেন্ড বেস্ট সিদ্ধান্ত মানে? প্রথমটা কি ছিলো?
– আমায় তোর ফ্রেন্ড হিসাবে চুজ করাটা ছিলো ফার্স্ট বেস্ট সিদ্ধান্ত।
– ওওওও তাই নাকি?
– হুম জানু। এই তুই আমার সাথে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো রে?
– তাহলে কি তোর ভুতের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবো?
– তা কেনো? তোর বরের সাথে দাঁড়িয়ে থাকবি।
– আমার বর আবার কে?
– কেনো রাহুল ভাইয়া।
– সারা আমাদের বিয়েটা এখনো হয়নি।
– বাট হবে তো।
– হওয়ার পর বর বলিস। এখন না।
– ওক্কেহ।
সারার সাথে কথা বলার সময়ই পাশে এসে দাঁড়ালো ভাইয়া। একটা বড় শ্বাস নিয়ে বললো
– এতো তারাতাড়ি বিয়ে করে আমাদের ছেড়ে চলে যাবি সেমাই?
– তোকে কতবার বলবো যে আমার নাম মাইশা। সেমাই নয়। মুর্খের ডিম সামান্য নামটাও উচ্চারণ করতে পারিস না।
– বলনা সত্যিই বিয়ে করে নিবি?
– আজব! এনগেজমেন্ট করেছি যখন বিয়েটাও নিশ্চই করবো। নাকি তুই চাইছিস বিয়ের দিন যেনো হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মতো লাল লেহেঙ্গা পরে স্লো – মোশনে দৌড়ে পালিয়ে যাই। আমারো কিন্তু এমন ইচ্ছা আছে ভাইয়া। তুই হেল্প করলে সত্যি সত্যিই পালিয়ে যেতে রাজি আছি। যদিও আমার বয়ফ্রেন্ড নেই। পালানোর পরে কোথায় থাকবো সেটা কিন্তু তোকেই ঠিক করে দিতে হবে।
– এতো তারাতাড়ি তোর বিয়ে হয়ে যাবে ভাবতে পারছি না আমি। তুই রাজি কেনো হয়ে গেলি?
– তো কি করবো? সারাজীবন কি গায়ে “অবিবাহিত ” নামক তকমা লাগিয়ে ঘুরবো নাকি?
আমার উত্তরে ভাইয়া মুচকি হেঁসে চলে গেলো।
– মোয়াজ ভাইয়া, এখনই তোকে মিস করা শুরু করেছেরে মাইশা।
সারার কথায় আমিও এক ফালি মুচকি হাঁসি দিলাম।
– জানি। সারাদিন যার সাথে ঝগড়া করতো তাকে ছেড়ে থাকতে তো কষ্ট তো হবেই।
– হুম।
🍁
রাত প্রায় ১০ঃ০০ টা। বেশির ভাগ গেস্টরাই চলে গেছে। কাছের অতিথিরা থেকে গেছে শুধু। তবে সায়ন ভাইয়ারা যায়নি। উনারাও কাল যাবেন।
নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম । মেকআপ গুলোকে জাস্ট অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে এসবের ওজনই তিন চার কেজি হয়ে জাবে। এখনই যদি ফ্রেশ না হই তাহলে যেকোনো মুহুর্তে বিরক্তির চোটে স্ট্রোক করে বসবো আমি। তাই দ্রুত পা চালাচ্ছি ঘরের দিকে।
কিন্তু গেস্টরুমের সামনে আসতেই একজোড়া হাত টেনে ভেতরে নিয়ে গেলো আমায়। আচমকা এমন কিছু হওয়ায় ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেম আমি। কিন্তু কেমন চেনা চেনা গন্ধ পাচ্ছি মনে হয়। ফট করে চোখ খুলে ফুট করে দেখে নিলাম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটিকে।
আমায় টেনে আনা ব্যাক্তিটি হলো সায়ন ভাইয়া।
-এমন ব্যবহারের মানে কি ভাইয়া?
– জানি না।
– তো আমায় এখানে আনলেন কেনো?
– তোকে উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।
– বাহ বাহ। আমায় নিয়ে টানাটানি করছেন আর জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে বাধ্য নন?
– আগে আমার প্রশ্নের জবাব দে?
– হুম বলুন কি প্রশ্ন?
– রাহুলকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছিস কেনো?
– সেটা একান্তই আমার ব্যাক্তিগত বিষয়।
আমার উত্তরে রেগে গিয়ে দেয়ালে একটা ঘুষি মারলেন সায়ন ভাইয়া। সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম আমি। ঘুষি উনি দিলেও মনে হয় ব্যাথাটা আমার লেগেছে। কিন্তু আমি কোনো কিছুই বললাম না উনাকে। উনার প্রতি কেয়ারিং হওয়ার জন্য তো আপু আছে। এবার কাছে এসে কাধ ঝাকিয়ে উনি বললেন
– তুই দেখতে পাসনি আমি দেয়ালে ঘুষি মেরেছি?
– হ্যাঁ দেখেছি।
– তবুও কিছু বললি না কেনো?
– কি বলবো? এটাও আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়।
– হুম তাইতো।
দুজনেই আবার চুপ করে গেলাম। অনেকক্ষণ পর নিরবতা কাটিয়ে আমিই বললাম
– একটা কথা বলবো?
– কি?
– বিয়েটা তো এখনো হয়ে যায়নি ভাইয়া। আপনি কি পারেন না আমায় মেনে নিতে? আমি যে আজও ভালোবাসি আপনাকে।
আমার কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেললেন সায়ন ভাইয়া। পরমুহূর্তেই মাথা তুলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন
– পসিবল না।
ব্যাস এটুকুই। আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। এখন তো আমার নিজের উপর রাগ হচ্ছে। আমি তো জানি উনি আমায় কোনোদিন মেনে নেবেন না। তবুও নির্লজ্জের মতো আবার উনার কাছে ভালোবাসার কথা বলতে গেলাম? কিন্তু না। এই ভুল দ্বিতীয়বার আর করবো না আমি। রাহুল ভাইয়ার মাঝেই ভালোবাসা খুজে নিতে চেষ্টা করবো।
চলবে…….
[ ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ]