ভালোবাসি তোকে ❤ #লেখিকা: অনিমা কোতয়াল #পর্ব- ২৬

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৬
.
আমি ছলছলে চোখে ল্যাপটপের স্ক্রিনে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে তাকালাম আদ্রিয়ানে দিকে। আদ্রিয়ান একটা টেডি স্মাইল দিয়ে আরেকটু শক্ত করে জরিয়ে ধরে বললেন,

— ” কনগ্রাচুলেশন। মাই উড বি ডক্টর ওয়াইফ।”

সবাই একসাথে বলে উঠল,

— ” কনগ্রাচুলেশন।”

বলে সবাই একসাথে হেসে উঠল। তারমানে আমি যখন চোখ বন্ধ করে ছিলাম তখন সবাই রেসাল্ট দেখে নিয়েছে। আমি অবাক চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকাতেই উনি হেসে দিলেন। আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” ওটা স্ সত্যি..”

আদ্রিয়ান আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন,

— ” শুধু মেডিকেলে চান্স হয়েছে তাই না। গোটা র‍্যাংকিং ফিফত্ পজিশনে আছো। সো অবভিয়াসলি ডিএমসি।”

আমি অবাক দৃষ্টিতে আবারও ল্যাপটপের দিকে তাকালাম। তারপর দুহাতে মুখ চেপে ধরে হেসে দিলাম। আদ্রিয়ান আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

— ” এবার ফোন করে সবাইকে জানাই। সকাল থেকে বাবা মামনী, আমার বাবা-মা কতবার ফোন করেছেন।”

বলে প্রথমে আমার আব্বুকে কল করলেন। উনি কিছুক্ষণ কথা বলে আমার সাথেও আব্বু আম্মুর কথা বলিয়ে দিলেন। ওনারা খুব বেশিই খুশি হয়েছেন। এরপর বাবা মামনী, আরও সব আত্মীয়দের সাথে কথা বললাম। মামা বাড়িতে সবাই খুব খুশি। মামাতো খবরটা শুনেই চলে গেছেন মিস্টি আনতে। বাড়িতে এখন একটা উৎসব উৎসব ভাব। সবাই মিলে হই হুল্লোড় করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মেঝ মামা মিষ্টি নিয়ে এলো। মামারা, সজীব ভাইয়া, অর্ণব ভাইয়া, কাব্য মিলে পুরু এলাকায় মিষ্টি বিলি করতে গেলো। নিজের কাছেই নিজেকে এখন খুব হালকা লাগছে আমার। সবার এই আনন্দের মাঝে আমি শুধু আদ্রিয়ানকে দেখছি। ওনাকে সবচেয়ে বেশি খুশি লাগছে আজ। ওনার চোখে মুখে খুশির ছাপটা স্পষ্ট। এমন মনে হচ্ছে যেনো বিশ্বজয় করে ফেলেছেন। অথচ আমার যখন এইচ এস সি রেসাল্ট দিলো তখন উনি কতটা ভাবলেশহীন ছিলেন যেনো ওনার এতে কিছুই যাচ্ছে বা আসছে না। উল্টে আমাকে ধমকে বলেছেন, ‘এতো আনন্দের কিছু নেই আসল পরীক্ষাটাই এখনও বাকি।’ অথচ আজ ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো এই জয়টা আমার নয় পুরোটাই ওনার। সবার সাথে মজা করছে। একটু পর পর ফোন করে নিজের সব পরিচিতদের বলছে। আমি অবাক আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওনাকে দেখছিলাম। উনি কেমব্রিজে চান্স পাওয়ার পরেও এতোটা খুশি হয়েছিলেন কী না সেটা নিয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। তারসাথে আমার পরিবারটাকেও দেখছি। আমার এই সাফল্যে ওনারাও কতো খুশি। এটাই হয়তো একটা পরিবারের একসঙ্গে থাকার অানন্দ হয়। কোনো একজনের খুশিতে সবার খুশি হয়ে যাওয়া, কারও কষ্টে সবাই কষ্ট পাওয়া, কারো বিপদে সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে আসা এসবের নামই তো পরিবার। যেখানে আমি বলে কিছুই হয়না সবটাই আমরা।

__________________

সারাদিন সেলিব্রেশন এর পর রাতে রুমে এসে দেখি আদ্রিয়ান নেই। কোথায় গেল? নিশ্চয়ই ছাদে আছে। আমার মন এখন খুব ভালো। আজকে সারাটা দিন এতো এতো ভালো কেটেছিল যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আর কেউ জানুক আর না জানুক আমিতো জানি আজ যা হয়েছে তার পেছনে ওনার অবদান অনেকটা জুড়ে। এসব ভাবতে ভাবতে ছাদে গিয়ে দেখি যা ভেবেছি তাই উনি রেলিং এর ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। কারো আওয়াজে পেছনে তাকিয়ে আমায় দেখে একটা হাসি দিলেন উনি। একটু এগিয়ে এসে বললে,

— ” কিছু বলবে?”

আমার কী হলো আমি নিজেই জানিনা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওনাকে। আমার কেনো জানিনা এটা করতেই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ইচ্ছা করল। আমি টাইট করে জড়িয়ে ধরে ওনার বুকে মাথা দিয়ে রেখে দিয়েছি ওনার ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকা হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি আমি। আচ্ছা ওনার চেহারার এক্সপ্রেশনটা এখন কেমন? অবাক হয়ে আছেন? নাকি মুচকি হাসছেন? চোখ বন্ধ করে এসব ভাবছি। তখন হুট করে জড়িয়ে ধরলেও এখন লজ্জায় ওনাকে ছাড়তে পারছিনা। এখন ওনার দিকে তাকাবো কী করে আমি? এসব যত ভাবছি ওনাকে জড়িয়ে ধরা হাতদুটো ততই শক্ত হয়ে আসছে। হঠাৎ অনুভব করলাম ওনার দুটো হাত আমার পিঠের ওপর আলতো করে রাখলেন। আমি চোখদুটো আরও খিচে বন্ধ করে বললাম,

— ” থ্যাংক ইউ সো মাচ।”

উনি আস্তে করে নরম সুরে বললেন,

— ” কেনো?”

— ” আমি হওয়ার জন্যে আর আমায় আপনি বানানোর জন্যে।”

উনি বাহু ধরে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাহু ধরে দাঁড় করালেন আমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। উনি হাসিমিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

— ” মানে?”

আমি নিচের দিকে তাকিয়েই না বোধক মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ কিছুনা। উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

— ” তুমি খুশি তো?”

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে হেসে দিয়ে বললাম,

— ” খুব। আর সবকিছু আপনার জন্যে হয়েছে। আগে যা যা হয়েছে তাতে আমি যেই পরিমাণ ডিপ্রেসড ছিলাম তাতে আমি পড়াশোনায় এতোটা কনসেনট্রেট করতেই পারতাম না যদিনা আপনি রোজ দায়িত্ব নিয়ে রেগুলার আমাকে এভাবে না পড়তেন। আমাকে এভাবে সাপোর্ট না করতেন।”

উনি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে ভ্রু কুচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,

— ” তোমার জন্যে কিছুই করিনি আমি। যা করেছি নিজের জন্যে।”

আমি একটু ভাবুক হয়ে বললাম,

— “সেটা কীভাবে?”

আদ্রিয়ান আমায় ছেড়ে একটু গলা ঝেড়ে বললেন,

— ” দেখো আমাকে কম বেশি সবাই একটুআধটু চেনে। আফটার আল দা গ্রেট আদ্রিয়ান আবরার জুহায়ের। এখন যদি তার বউ মেডিকেলেও চান্স না পায় তাহলে আমার মাথা হেট হয়ে যেতো। আমিতো জানতাম তুমি একটা গাঁধামার্কা স্টুডেন্ট তাই কাঠখড় পুড়িয়ে তোমায় পড়াশোনা করিয়েছি যাতে তুমি চান্স টা পাও আর আমার সম্মান টা বাঁচে। বুঝেছো?”

আমি কিছুক্ষণ চোখ ছোট ছোট করে ওনার দিকে তাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে থেকে বললাম,

— ” তাইনা?”

উনি ঠোঁট চেপে একটু হেসে বললেন,

— ” হ্যাঁ তাইতো।”

আমি হাত ভাজ করে মুখ ফুলিয়ে বললাম,

— ” আচ্ছা? ফাইন দেন। আপনি আপনার ঐ রেপুটেশনের সাথেই গিয়ে কথা বলুন গিয়ে আমার কাছে একদম আসবেন না। আর আমার সাথে কথাও বলবেন না।”

বলে আমি চলে যেতে নিলেই উনি আমার হাত ধরে ফেললেন। তারপর একটানে নিজের বুকের ওপর ফেলে কানের পিঠে চুলগুলো গুজে দিতে দিতে ফিসফিসে গলায় বললেন,

— ” এতো রাগ? এতো রাগ শরীরের জন্যে ক্ষতিকর। আর তাছাড়াও বাচ্চাদের এতো রাগ দেখাতে নেই।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,

— ” এই সারাদিন এতো বাচ্চা বাচ্চা কেনো করেন হ্যাঁ? আমি কী বাচ্চা?”

— ” বাচ্চা নও বুঝি?”

— ” প্রুভ লাগবে আপনার?”

বলে সাথে সাথেই জিবে কামড় দিলাম। ইস! কী বলছিলাম এসব? উনি কী ভাবলেন? আমি আসলেই একটা গবেট। কথা বলার সময় একটু ভেবে বলিনা যে ঠিক কী বলছি। ওনার দিকে তাকাতেই উনি ঠোঁট কামড়ে ধরে দুষ্টু একটা হাসি দিয়ে কানে কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল,

— ” সত্যিই প্রুভ দিতে চাও?”

আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,

— ” ছাড়ুন আমার ঘুম পাচ্ছে রুমে যাবো।”

— ” এমা ঘুমাবে মানে কী? তুমি যে বললে প্রুভ দেবে?”

আমি ভ্রু কুচকে ওনার দিকে তাকাতেই উনি আমার নাকটা টিপে দিয়ে বলল,

— ” আচ্ছা চলো।”

বলে উনি আমার হাত ধরে নিচে রুমে নিয়ে গেলেন। রাতে আমাদের মধ্যে বিশেষ আর কোনো কথা হয়নি। দুজনেই রুমে গিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পরেছিলাম।

_________________

পরেরদিন সকালে আমরা ঢাকা ব্যাক করলাম। সজীব অর্ণব ভাইয়া আর কাব্য আমাদের সাথে আদ্রিয়ানদের বাড়িতেই এলেন কারণ আব্বু আম্মু ওখানেই আছে আর আজ সবার লাঞ্চের দাওয়াত ওখানে। বাড়িতে গিয়ে আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলে রুমে গিয়ে প্রথমে আদ্রিয়ান পরে আমি ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পরে দুজনেই নিচে গেলাম। সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতেই লাঞ্চ করলাম। বিকেলের দিকে আম্মু, আব্বু, ভাইয়ারা সবাই চলে গেলেন। বাবা, মামনী, বড় আব্বু, বড় আম্মু ওনারাও ভীষণ খুশি আমি মেডিকেলে চান্স পাওয়াতে। সন্ধ্যায় ড্রয়িং রুমে বসে কবে ভর্তি হবো, গ্রান্ড সেলিব্রেশ কীভাবে কী হবে সবনিয়ে আদ্রিয়ানের সাথে আলোচনা করতে করতেই ডিনারের টাইম হয়ে গেলো।

আমি আয়নার সামনে বসে চুল আচরাচ্ছি আর আদ্রিয়ান বেডে হেলান দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করছেন। আমি কিছু একটা ভেবে চুল বেধে উঠে গিয়ে ওনার পাশে গিয়ে বেডে হেলান বসে বললাম,

— ” আচ্ছা নূর আপুর সাথে কথা হয়েছে আপনার কেমন আছেন উনি?”

আদ্রিয়ান কাজ করতে করতেই বললেন,

— ” হুম হয়েছে। মুখেতো বলে ভালো আছি। কিন্তু কতোটা ভালো আছে আমার চেয়ে ভালো কে জানে? তবে তোমার সেদিনের বলা কথাগুলো খুব কাজে দিয়েছে। এখন আর অযত্ন করেনা নিজের।”

— ” এইসময় অযত্ন করাটা ঠিকও না। ওনার ডেলিভারির দিন তো এগিয়ে আসছে তাইনা।”

— ” মাসখানেক আছে এখনও।”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

— ” ইশরাক ভাইয়া থাকলে কতো এক্সাইটেড থাকতেন তাইনা? বেবি আসবে শুনেই যা করছিলেন। কতো স্বপ্ন ছিলো এই বাচ্চাটা নিয়ে ওনার আর নূর আপুর। একটা ছোট্ট ভালোবাসাময় পরিবারের স্বপ্ন দেখেছিলেন ওনারা। অথচ একটা দমকা হাওয়ায় সব শেষ হয়ে গেল।”

আদ্রিয়ান কাজ থামিয়ে বললেন,

— ” দমকা হাওয়াগুলো এমনি হয় অনি। হঠাৎ করে সব শেষ করে দেয়। সব সুখ, স্বপ্ন, আনন্দ নিমেষেই এলোমেলো করে দেয়। তখনই শুধু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসই বেঁচে থাকে আর কিচ্ছুনা।”

— ” কিন্তু ভাবলেই খুব খারাপ লাগে। এতো অল্প বয়সে এতোটা কষ্ট কীকরে সহ্য করতে পারে কেউ? নিজের ভালোবাসার মানুষটার মৃত্যু কেউ কীকরে সহ্য করতে পারে? নিজেরই চোখের সামনে নিজের স্বামীর লাশ দেখে কেউ কীকরে ঠিক থাকতে পারে। এভাবে চলে যাওয়াটা কীভাবে মানতে পারে যখন সেই মানুষটার সন্তান তার গর্ভে থাকে? এতটা যন্ত্রণাও সহ্য করা যায়? ”

উনি সামনের দিকে তাকিয়েই স্হির কন্ঠে বললেন,

— ” তুমি পারবেনা?”

আমি চমকে তাকালাম ওনার দিকে। পুরো চুপ হয়ে আছি আমি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” বলো? নূরের সাথে যা হয়েছে সেটা তোমার সাথেও যদি হয় তাহলে? এতোটাই ভেঙ্গে পরবে? এরকমটাই হয়ে যাবে তুমি?”

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ এসব কেনো বলছেন? এধরণের কথার মানে কী? আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” ক্ কী বলছেন এসব?”

উনি হালকা হেসে ল্যাপটপটা বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” বাদ দাও। তবে একটা কথা জানো? তোমার আচরণ বাচ্চা বাচ্চা হলেও তোমার কিছু কিছু কথায় ম্যাজিক থাকে। তুমি তোমার কথা আর আচরণ দিয়েই নূরকে স্বাভাবিক করেছো আর আমাকেও।”

আমি কিছুই বুঝলাম না আমি আবার কী করলাম? আমি ওনার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

— ” আমি কী করলাম?”

উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বললেন,

— ” এইজন্যেই তোমাকে এতো.. পছন্দ করি।”

আমি একটু হেসে বললাম,

— ” যাক আপনার পছন্দের কেউ তো হতে পারলাম?”

আমার কথা শুনে উনি কিছুই বললেন না শুধু ওনার সেই ভুবন ভোলানো হাসিটা দিলেন আর আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই হাসি দেখতে লাগলাম।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here