#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২৯
.
রাতের পরেই ভোর আসে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আর বলা হয় যে রাত যত অন্ধকারাচ্ছন্ন হয় ভোর নাকি ঠিক ততটাই ঝলমলে আর উজ্জ্বল হয়। কথাগুলো কতটা সত্যি আমি জানিনা কিন্তু আজকের সকালটা আমার কাছে খুব বেশিই স্পেশাল ছিল। এমন মনে হচ্ছে যেন ঘোর অন্ধকারের পর আজ ঝলমলে আলো এসছে আমার জীবনে। এখনও ওনার বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি আমি। ওনার এখনও ঘুম ভাঙেনি আমার আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। ঘুমন্ত এই মুখটা দেখে একটা নিষ্পাপ বাচ্চা লাগছে। ওনার কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো নেড়ে দিলাম। পাতলা একেবারে হালকা পিংক আফা ছড়ানো ঠোঁটটা জেনো কেউ এঁকে বসিয়ে দিয়েছে। চেহারার সাথে একদম পার্ফেক্ট, সোজা সুন্দর নাক, হালকা লালচে কান, ঘন ভ্রু। সবমিলিয়ে আস্ত একটা কিউটের ডিব্বা। এতো কিউট হতে আছে? আয়নার নিজেকে দেখলে নিজেরই নিজর প্রতিবিম্ব নিয়ে জেলাস ফিল হয়। এতো কিউট হাজবেন্ট কেনো আমার? হোয়াই? মাত্র তিনটে ওয়ার্ড, আই লাভ ইউ। এটুকুই আমার মনটাকে এতো ভালো করে দিলো? আমার দিনটাকে এতো চমৎকার সুন্দর করে তুলল? নাকি যার মুখ থেকে শুনেছি সেই মানুষটাই আমার কাছে খুব বেশিই স্পেশাল ছিল? কী জানি? আচ্ছা কাল উনিতো বললেন শুরু থেকেই ভালোবাসেন। ভালোই যখন বাসতেন তাহলে বিয়ের পর আমায় মানতে কেনো চান নি? যাই হোক এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাবোনা শুধু এই সময়গুলো উপভোগ করব, ওনার ভালোবাসা উপভোগ করবো। এসব ভাবতে ভাবতেই চুলে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখলাম উনি মুচকি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে। আমার মাথায় হালকা করে ঠোঁট ছুইয়ে বললেন,
— ” সবসময় এতো কী ভাবো বলোতো? প্রায়ই চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাও?”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। কীকরে বলব আমার সব চিন্তা ভাবনার জায়গাতো উনিই দখল করে নিয়েছেন। উনি আমার থুতনি ধরে মুখটা একটু উঁচু করে বললেন,
— ” এমনিতেতো তোমায় পড়ার জন্যে ডেকে তুলতে তুলতে আমি হাফডেট হয়ে যেতাম। আজ এতো তাড়াতাড়ি উঠলে যে।”
আমি নিচু গলায় বললাম,
— ” আসলেই এমনিই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো।”
উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
— ” আমার বুকে ঘুমাতে তোমার ঘুমাতে প্রবলেম হয়েছে?”
আমি তাড়াতাড়ি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম,
— ” নাহ নাহ আমার তো খুব ভালো লেগেছে।”
বলে সাথে সাথে চুপ হয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে ফেললাম। উনি আমার চুলে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
— ” সত্যি? তাহলে তো আজ থেকে রোজ রাতে তোমাকে বুকে নিয়েই শুতে হবে।”
আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,
— ” উঠুন তো! ল্যাবে যাবেন না নাকি?”
বলে আমি উঠে বসে বললাম,
— ” আপনি যান ফ্রেশ হয়ে নিন আমি কফি আনছি।”
উনি একটা হাই তুলে উঠে বসে বললেন,
— ” না আমি একবারে নিচে থেকে ব্রেকফাস্ট করে চলে যাবো। আজ তো ফার্স্ট ক্লাস তাইনা?”
আমি চুলে কাঠি লাগাতে লাগাতে বললাম,
— ” হ্যাঁ কেনো?”
— ” যাওয়ার সময় আমি তোমাকে ড্রপ করে দেবো কিন্তু আসার সময় গার্ড পাঠিয়ে দেবো ওরাই নিয়ে আসবে তোমাকে।”
আমি একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বললাম,
— ” আদ্রিয়ান আমি একাই আসতে পারবো। গার্ডের দরকার নেই। আমি সিএনজি তে চলে আসবো।”
আদ্রিয়ান এবার চোখমুখ শক্ত করে বলল,
— ” এটা আমার ওর্ডার। না মানে না। একা কোনোভাবেই বেড়োনো যাবেনা। যদি এর নড়চড় হয় দেন ইউ নো এজ ভেরি ওয়েল হোয়াট ক্যান আই ডু।”
আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললাম। মুখ গোমড়া করে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নিলেই উনি হাত ধরে আটকে নিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমায় নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন আমি মাথা নিচু করে আছি। উনি আমার দুগালে হাত রেখে বললেন,
— ” আচ্ছা একাই আসবে। হ্যাপি?”
আমি মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। উনিও হেসে দিয়ে আমার নাক টেনে দিয়ে বললেন,
— ” পিচ্চি একটা। যাও ফ্রেশ হয়ে নিচে যাও আমি আসছি। ”
আমি মাথা নেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলাম। আমি ফুরফুরে মেজাজেই আছি আমি। কারণটা হয়তো উনি। নিচে যেতে না যেতেই আমার হাসিখুশি মুখটা দেখে দাদি পিঞ্চ করতে ভোলেন নি। কিছুক্ষণ পর ওপরে গিয়ে দেখি আদ্রিয়ান রেডি হয়ে গেছেন। আমায় দেখে আমাকেও রেডি হয়ে নিতে বললেন। আমিও রেডি হয়ে বেড়িয়ে এলাম। দুজনে একসঙ্গে রেডি হয়ে নিচে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করলাম। খেয়ার করলাম সবাই আমাদের দেখে মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছেন। আজব। হাসার কী আছে? খাওয়া শেষে সবার কাছে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে এলাম। মেডিকেলের সামনে গাড়ি থামিয়ে উনি আমার সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বললেন,
— ” কি হতো গার্ড পাঠালে?”
— ” আমি পারবো ফিরতে।”
— ” সাবধানে বাড়ি ফিরবে। আর হ্যাঁ একদম রাস্তাঘাটে লাফালাফি করবে না। সাইডে থেকেই সিএনজি নেবে।”
আমি মাথা নাড়লাম। উনি আমার কানের ওপর হাত রেখে গালে একটা কিস করে বললেন,
— ” বাই।”
আমি নিজেকে সামলে কোনোরকম বাই বলে চলে এলাম।
____________________
বিকেলে বাড়িতে ফেরার পরেই সবাই জিজ্ঞেস করলো প্রথম দিন কেমন ছিলো। আপি, জাবিন এক্সাইটেড হয়ে সব জানতে চাইলো আমিও সবটা বললাম। সন্ধ্যার দিকে আদ্রিয়ান এলেন সাথে আদিব ভাইয়াও। আমাকে দেখে বললেন,
— “প্রথম দিন কেমন ছিলো?”
আমি হেসে বললাম,
— ” ভালো ভাইয়া”
এরপর কিছুক্ষণ গল্প করে ওনারা দুজন ওপরে চলে গেলো। আমি নিচে আপি জাবিনের সামনে গল্প করছি তখন মামনী এসে বলল,
— ” অনি কফি দুটো ওদের রুমে দিয়ে আয় না মা।”
আমি মাথা পেড়ে ট্রে টা নিয়ে ওপরের দিকে পা বাড়ালাম। কফি নিয়ে রুমের দরজার কাছে এসে ওনাদের গলার আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলাম। আদ্রিয়ান বলছেন,
— ” অনিকে আমি আমাদের বিয়ের একসপ্তাহ পর থেকেই নিজের বউ হিসেবে মেনে নিয়েছি। ভালোতো আমি ওকে শুরু থেকেই বাসি। যেদিন ঐ পিংক গাউন পরে আমার সামনে ভীত মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেদিন থেকেই মায়ায় পরে গেছিলাম। বাচ্চাদের মতো আমার অল্প ধমকেই কেঁদে দিয়েছিলো। এরপর আস্তে আস্তে ওর বাচ্চামো, দুষ্টুমি, সরলতা সব আমাকে ক্রমশ দুর্বল করেছে ওর প্রতি। এতো মায়া আছে মেয়েটার মধ্যে যে প্রথম দেখা থেকেই ভালোবেসেছি আর সেটা ক্রমশ গভীর হয়েছে। ভেবেছিলাম ভাইয়ার বিয়ের পরেই বাবাকে বলব। কিন্তু ভাইয়ার রিসিপশনের দিনটাই সব এলোমেলো করে দিলো। এরপর ওকে নিজের থেকে দূরে রেখেছি। কিন্তু ভাগ্যের কী খেলা দেখ ওর সাথেই আমার বিয়ে হলো। যাকে এতোটা ভালোবাসি সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও খুশি হতে পারিনি। অার তারপর কেনো ওকে বউ হিসেবে মানতে চাইনি সেটা তোর চেয়ে ভালো কে জানে?”
আদিব ভাইয়া বললেন,
— ” হ্যাঁ তাতো জানি কিন্তু তাহলে এই তিনমাস কেন ওকে দূরে রেখেছিলি। শুধু দায়িত্ব বলে চালিয়ে দিয়েছিলি? যেখানে মেয়েটাকে তুই এতোটা ভালোবাসিস? এভাবে কষ্ট কেন দিয়েছিলি?”
উনি আবার বললেন,
— ” কী করতাম বল? মেয়েটা বাচ্চা। আজকের যুগে আঠারো বছরের একটা মেয়েকে বড় বলা চলেনা। টিনেজের এই সময়টা আমরা পার করেছি আমরা তো জানি এই সময়টা কেমন। এসময় একটা মেয়ে সবসময় চায় যে ওর লাইফে যে আসবে সে ওকে সবসময় স্পেশাল ফিল করাবে, ভালোবাসবে। নিজেদেরকে কোন গল্প বা সিনেমার হিরোয়িনদের মতো করে কল্পনা করে। আর এটা ভাবে পুরো গল্পটাতেই ওর রাজত্ব থাকবে। একটা ফ্যান্টাসি একটা কল্পনার জগতে বাস করে ওরা। আমি যেদিন প্রথম ওর সাথে একটু ফ্লার্ট করেছি সেদিন থেকেই খেয়াল করলাম অনির মধ্যেও সেসবই হচ্ছে। নিজে নিজেই একটা কল্পনার রাজ্য বানাচ্ছে। যেখানে সবটা জুড়ে আমি আছি। পড়তে বসেও আমায় নিয়ে ভাবছে, সারাক্ষণ আমার চিন্তা ওর মাথায় ঘুরছে। এই সময়ে ওর মনে হাজারও কল্পনা জল্পনা করে চলেছে। এরফলে ওর স্টাডিতে মারাত্মক এফেক্টও পড়ছে। পড়া গুলিয়ে ফেলছে। পড়তে দিলে পড়ছে কম ভাবছে বেশি। আর সেটা ভালো করে বুঝলাম সেদিন যেদিন ও তোদের সবার সামনেই আমার ডিফেক্ট আছে কীনা, নিরামিষ এন্ড অল বলছিল। কারণ ও সেটা পাচ্ছিল না যেটা ওর মন এস্পেক্ট করছে। আর পেতো তাহলে নিজের কল্পনার জগৎ আরো প্রসারিত করতো। দোষটা ওর নয় ওর বয়সের। কিন্তু আমিতো ম্যাচিউর। তাই সেদিন রাতে ওর প্রতি একটু রুড হয়ে হলেও ওকে বোঝালাম যে কল্পনা কল্পাতেই সুন্দর। বাস্তবটা অনেক ভিন্ন। ভাবতে যতটা ভালোলাগে বাস্তবে সেটা ঘটলে সবসময় এটাচড হওয়া যায়না। আর বারবার আমার ভালোবাসাকে দায়িত্ব বলে ওকে সেই কল্পনা সেই ফ্যান্টাসি থেকে বার করে আনতাম। আর এই কারণেই ও আবার স্টাডিতে কনসেন্ট্রট করতে পেরেছে। এন্ড রেসাল্ট তোর সামনে। র্যাংকিং ফিফট পজিশন করে নিয়েছে।”
— ” তুই এতোকিছু ভেবেছিস। সত্যিই ভাই তোর পা ধরে সালাম করতে ইচ্ছা করছে। একমাত্র তোর দ্বারাই এটা সম্ভব।”
আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
— ” আমি চাইলে শুরুতেই নিজের মনের ভেতরের ভালোবাসাটা উজার করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা করিনি। ওর স্বপ্ন ছিল একজন ডক্টর হবে। যেখানে ওর সম্পূর্ণটাই আমার বলে মেনে নিয়েছি সেখানে ওর স্বপ্ন মানেই তো আমার স্বপ্ন। নিজেই নিজের স্বপ্ন ভাঙার কারণ কীকরে হতাম বল? নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছি ওকে আর এমনভাবে তৈরী করব যাতে কোনোদিন যদি আমি ওর পাশে নাও থাকি ওকে জেনো নূরের মতো অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে না হয়।”
আমি চোখ দিয়ে নিরবে জল পরছে। আব্বুর প্রতি মাঝেমাঝে অভিমান হতো যে কেনো আমার কাছে একটাবার জিজ্ঞেস না করেই অন্য একজনের হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু আজ আব্বুর কাজে কৃতজ্ঞ যে এমন একজনকে আমার জন্যে বেছেছেন। আজ আব্বুর বলা কথাটা খুব মনে পড়ছে, ” আজ তোমার মনে হচ্ছে আমরা তোমার সাথে অন্যায় করেছি কিন্তু দেখবে একদিন আমাদের এই সিদ্ধান্তের জন্যেই তুমিই নিজেই নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করবে।” সত্যিই আজ নিজেকে অনেক বেশিই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। আজকের দিনে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে এভাবে কজন ভাবে? সবাই তো নিজের স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত। এরকম একজন স্বামী পাওয়া সৌভাগ্য নয় পরম সৌভাগ্যের বিষয়।
#চলবে…
( রি-চেইক করা হয়নি। টাইপিং মিস্টেকগুলো বুঝে নেবেন।)