#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ৫৯
.
আজ পুরো বাড়িতে আনন্দের রমরমা পরিবেশ তৈরী হয়ে গেছে। সবাই খুব খুশি, ইফাজ ভাইয়া একটু আগে বেশ কয়েক কেজি মিষ্টি কিনে নিয়ে এসছে। পুরো এলাকায় বিলিয়েছে। আব্বু আম্মু আর বাকিরাও সন্ধ্যাবেলা চলে এসছে। বড় আম্মু, বড় আব্বু আর আপি মিলে সন্ধ্যার স্নাকস্ বানাচ্ছে। আদ্রিয়ান তো কী রেখে কী করছে নিজেই জানেনা, কিছুক্ষণ আগে ভয় পেলেও আপাতত খুব বেশি খুশি ও, ইফাজ ভাইয়াও ভীষণ খুশি হয়েছে। দুই ভাই মিলে সবার সাথে কথাবার্তা বলছে। আদ্রিয়ান তো সারাক্ষণ হিয়াজকে নিজের কোলেই রেখে দিয়েছে। দাদি তো সেই কখন থেকে এটা ওটা বলে আসর মাতিয়ে রাখছে। আর আমি অসহায় বাচ্চার মত সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছি। বেশ অনেকটা লজ্জা লাগছে আমার। দাদি আমার পাশে বসে খোঁচা মেরে মেরে কথাতো বলেই যাচ্ছে। মামনী স্নাকস এনে আমার পাশে বসে টেবিলে ট্রে রেখে ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
— ” যাক বাবা এবারে আমাদের পরিবারটা পূর্ণ হবে।”
বড় আম্মু বলল,
— ” হ্যাঁ তা যা বলেছিস। এখন সব ঠিকঠাক হলেই হয়।”
আম্মু আমায় জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলো, এরপর বিভিন্ন উপদেশ দিল, কীভাবে চলতে হবে, খেতে হবে, কী কী করা যাবেনা। মায়ের যা বলে থাকে আরকি। গোটা সন্ধ্যা একপ্রকার উৎসবের মধ্যেই কেটে গেছে সেদিন।
__________________
দেখতে দেখতে মাস দুই মত কেটে গেছে। ডক্টর বলেছে তিনমাস চলছে আমার। ইদানীং ঘুম বেশি পায়, অল্পেই ক্লান্ত লাগে, এটা ওট খেতে ইচ্ছে করে আর কিছু কিছু খাবারের গন্ধই সহ্য হয়না। এই দুই মাসে আদ্রিয়ানের যত্ন নামক অত্যাচার সহ্য করেছি প্রতিনিয়ত। আমার চব্বিশ ঘন্টার একটা অসহ্যকর রুটিন সেট করে দেওয়া আছে। যেখানে আমি কী খাবো, কখন খাবো, কখন ঘুমাবো, কতটুকু ঘুমাবো, কী কী করা মাস্ট, কী কী করা একেবারেই বারণ, সব সেট করে দেওয়া। আর কোনদিন একটুখানি নরচর হলেই তার পানিসমেন্ট রেডি থাকে। সত্যিই ভাবা যায় এসব? যেন দুনিয়াতে এই প্রথম মা আমিই হচ্ছি, আর ও বাবা। যদিও আমিও কম জ্বালাই না ওকে। বমি করলে সেসব পরিষ্কার করা, খাইয়ে দেওয়া এরকম সব যত্ন ওই করে। হুটহাট করে আমার বিভিন্ন বায়না রক্ষা করতে হয়, সেটা ভাবারের হোক বা অন্যকিছু। এরওপর মাঝে মাঝেই মাঝরাতে পায়ে খিল ধরে যায়, খিঁচুনি ধরে তখন আমার খেয়াল রাখে, আমি কখন ঘুমিয়ে পরি নিজেই বলতে পারিনা। কখনও এই ঠান্ডার মধ্যে সারারাতেও আমার জন্যে একটু ঘুমোতে পারেনা বেচারা। আর বাড়ির সবার কথা কী বলব। ইফাজ ভাইয়া প্রায় রোজই হসপিটাল থেকে ফেরার সময় আমার জন্যে খাবার কিছু নিয়ে আসে, কখনও ফুচকা, কেক, চকলেট। কারণ এগুলো আদ্রিয়ান আনতে চায়না। কিন্তু আইসক্রিম খেতে দেয়না। বড় আম্মু, মামনী, আপি সারাক্ষণই আমি কী খাবো, কী খেতে পারছি, আমার মুখে কী ভাল লাগছে এসব নিয়েই পরে আছে, বড় আব্বু আর বাবাও রোজ বাজারে যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করবে আমি কী খাবো, সেগুলোই আনে, জাবিনতো ফ্রি সময়টা আমার সাথেই কাটায় আমার মুড ঠিক রাখতে। আর অভ্রও মাঝেমাঝে ফোন করে করে খোঁজ নেয়।
আমি আর আদ্রিয়ান দুজনেই রেডি হচ্ছি আজ অভ্র আসবে আমাদের সাথে দেখা করতে, আজ নাকি ওর সেই গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমাদের আলাপ করাবে। প্রথমে হসপিটালে যাবো ওখান থেকে চেকআপ করে তারপর পার্কে। প্রথমে গেলাম হসপিটালে সেখান থেকে চেকআপ করে নিলাম। আদ্রিয়ান তো টেনশনে শেষ, না জানি ডক্টর কী বলবে। আমি নিজে প্রেগনেন্ট আমার তার বিন্দুমাত্রও টেনশন হচ্ছে না যতটা ওর হচ্ছে। অবশেষে ওর সব টেনশনের অবসান ঘটিয়ে ডক্টর আঙ্কেল জানালেন আমি পার্ফেক্টলি ওকে আর আমার বেবিও। আদ্রিয়ান একটা লম্বা স্বস্তির শ্বাস ফেলল।
হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে খেয়ে আমরা সেই পার্কে গেলাম। গিয়ে দেখি অভ্র বসে আছে একটা বেঞ্চে। আমরা দুজন ওখানে যেতেই সালাম দিয়ে আমাদের খোঁজখবর নিল। আমরাও ওর খোঁজ নিলাম। আদ্রিয়ান বলল,
— ” কী ব্যাপার? তোমার গার্লফ্রেন্ড আসেনি?”
অভ্র হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” এইতো চলে আসবে এক্ষুনি। ”
এটুকু বলে আমাদের পেছনে তাকিয়ে বলল,
— “ওইতো এসে গেছে।”
আদ্রিয়ান আর আমি দুজনেই পেছনে তাকালাম। তার পেছনে তাকিয়েতো আমরা দুজনেই শকড হয়ে তাকিয়ে আছি। সামনের মেয়েটিও আমাদের দিকে হকচকিয়ে তাকাল। এটা কী করে সম্ভব? মেয়েটা আর কেউ নয় বরং জাবিন। আদ্রিয়ান আর আমি হতভম্ব হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে আবারও জাবিনের দিকে তাকালাম। জাবিন গুটিয়ে ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওও তারমানে এই ব্যাপার? এটাই চলছিল তাহলে এতদিন? আমি আদ্রিয়ানের দিকে হতাশ চোখে তাকালাম। আদ্রিয়ান গম্ভীরভাবে দেখছে দুজনকে। অভ্র এগিয়ে এসে বলল,
— ” আরে সালাম দাও। উনিই আমার বস আদ্রিয়ান আর উনি বসের ওয়াইফ অনিমা।”
আদ্রিয়ান হাত ভাজ করে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। জাবিন কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে মেকি হেসে দাঁতে দাঁত চেপে অভ্রকে বলল,
— ” ইনি আমার ভাই আর ইনিই আমার ভাবী, নিজের।”
অভ্রতো বড়সর রকমের একটা ঝটকা খেলো। হা করে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমি একটা মেকি হাসি দিলেও আদ্রিয়ান এখনও চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। জাবিনের তো কাঁদোকাঁদো অবস্থা। আর অভ্র শুকনো ঢোক গিলে একবার আমাদের দেখছে একবার জাবিনকে।
আমাদের বাড়ির ড্রয়িংরুমে সবাই গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। অভ্র এক সাইডে আর জাবিন আরেকসাইডে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আদ্রিয়ান লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল,
— ” কবে থেকে চলছে এসব?”
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর অভ্র বলল,
— ” স্যার সবটাই আমি আগেই আপনাকে বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু এটা জানতাম না যে ও আপনার বোন।”
ইফাজ ভাইয়া জাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” আর আপনি ম্যাডাম?”
জাবিন অসহায় কাচুমাচু মূখ করে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে নিচু কন্ঠে বলল,
— ” সরি ভাইয়া।”
অভ্র মাথা নিচু করে রেখেই বলল,
— ” আমিও সরি স্যার।”
আদ্রিয়ান এবার উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,
— ” তো এখন কী চাইছ তোমরা?”
আবারও বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা ছিল। নিরবতা ভেঙ্গে অভ্র বলল,
— ” স্যার আপনি যা চাইবেন।”
বাড়ির সবাই অভ্রকে চিনি। ওর মত ছেলে খুব কম হয় কিন্তু আমাদের সবার দৃষ্টি এখন ইফাজ ভাইয়া আর আদ্রিয়ানের দিকে। এমনকি বড় আব্বু আর বাবাও আদ্রিয়ানের সিদ্ধান্ত ছাড়া কাজ করেন না। কারণ ওনারা জানেন ইফাজ ভাইয়া আর আদ্রিয়ান দুজনেই বয়স কম হলেও খুব বিচক্ষণ মানুষ। যা সিদ্ধান্ত নেয় খুব ভেবেই নেন। অভ্র আর জাবিনের মুখটা দেখার মত হয়ে আছে। সবার বুকের পাথর নামিয়ে দিয়ে আদ্রিয়ান আর ইফাজ ভাইয়া একসাথে হেসে উঠল। আর ওদের হাসির মানে কী সেটা বুঝতে কারোরই বাকি রইল না। জাবিন তো কান্নাই করে দিয়েছে আমি আর আপি মিলে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। অভ্রও জেনো হাফ ছাড়লো। বাড়ি জুড়ে আবারও উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরী হয়ে গেল।
ঐ সপ্তাহেই অভ্র নিজের পরিবার নিয়ে এলো।ঠিক করা হল এই মাসে এনগেইজমেন্ট হবে আর জাবিনের ওনার্স কম্প্লিট হওয়ার পর বিয়ে। অভ্র আর জাবিনকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে ওরা কত খুশি। আমরাও খুব খুশি। বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা।
_________________
বেশ ঠান্ডা পরেছে আজ। কিছুদিন আগে একটু শীত কাটলেও হঠাৎ করেই অাবার শীত পরে গেল। আমি কম্বল গায়ে জড়িয়ে গুটিশুটি মেরে বসে পড়ছি। আদ্রিয়ান আমার পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আর একটু পর পর ঘড়ি দেখছে। ঘড়ি দেখছে কারণ রুটিন অনুযায়ী দশটায় দুধ খেতে হবে সেটাই দেখছেন আরকি। আর আমি মাঝেমাঝে আড়চোখে ওনাকে দেখে যাচ্ছি আবার পড়ায় মনোযোগ দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান হুট করেই উঠে চলে গেল। আমি জানি এখন এখন এক গ্লাস দুধ গেলাবে উফফ। একটু পর আমার ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে আদ্রিয়ান সাহেব এক গ্লাস দুধ নিয়ে এল। আমার পাশে বসে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
— ” নাক চেপে ধরে এক নিশ্বাসে শেষ করে ফেল।”
আমি অতি অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম আদ্রিয়ানের দিকে। কিন্তু কিছু বলার নেতা কারণ এটা খুব ভালো করেই জানা কথা যে এক্ষেত্রে আমার ইমোশনাল, মশোনাল কোন ড্রামা বা ব্লাকমেইল কাজে দেবে না। তাই গ্লাসটা নিয়ে চোখ মুখ কুচকে দুধটা খেয়ে নিলাম। ওও বরাবরের মতই ‘গুড গার্ল’ নিজের কাজে মনোযোগ দিল। আমিও পড়ায় মনোযোগ দিলাম। আধঘন্টার মত ভালোই ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই গা গুলিয়ে উঠল। চোখ মুখ কুচকে একটু আওয়াজ করে মুখ চেপে ধরতেই আদ্রিয়ান তাড়াতাড়ি এসে আমার মাথায় হাত রেখে বলল,
— ” কী হলো? বমি পাচ্ছে?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ করলাম। আদ্রিয়ান তাড়াহুড়ো করে বলল,
— ” তাড়াতাড়ি ওঠো সেদিন নিজের জামাকাপড় করে ফেলেছিলে।”
বলে আমায় ধরে ওয়াসরুমে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বমি করার পর আমি থামলাম। আদ্রিয়ান টাওয়েল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিয়ে বলল,
— ” আর করবে না তো?”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম। ও আবারও জিজ্ঞেস করল,
— ” শিউর তো আর করবে না?”
আমার এখন মোটেই বমি পাচ্ছেনা তাই ‘হুম’ বললাম। ও আমায় ধরে দরজা অবধি নিয়ে এলো। দরজা অবধি আনার সাথেসাথেই সারা শরীর গুলিয়ে উঠল আমার কোনরকম সময় না নিয়েই বমি করে দিলাম। আর সেটাও পুরোটাই আদ্রিয়ানের গায়ে। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে একবার নিজের দিকে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে তাকালো, তারপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলল,
— ” আরও করবে?”
আমি নিচু কন্ঠে বললাম,
— ” মনে হয় না।”
ও মুচকি হেসে বলল,
— ” তুমি যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আমি মাথা নেড়ে চলে গেলাম। এই ছেলে একটুও বিরক্ত হয়না আমার ওপর? এত কীকরে সহ্য করে মনে মানুষ?
__________________
মাসের পর মাস কেটে গেল। আদ্রিয়ান এখন ঘুমোচ্ছে। মাঝখানে অনেকগুলো মাস ডায়েরিতে হাত দেইনি কিন্তু কেন জানিনা আজ লিখতে ইচ্ছে করছে। কারণটা আমার অজানা কিন্তু মনটা আনচান করছে। ডক্টর আমার সাড়ে আট মাস বার দিন চলছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি অনুযায়ী ডক্টর বলেছে আমার মেয়ে হবে। যদিও আমরা জিজ্ঞেস করিনি ডক্টর নিজেই বলেছে। ডক্টর আর সাত দিন পর ডেলিভারী ডেট দিয়েছে। দুই-একদিনের মধ্যেই আদ্রিয়ান আমায় হসপিটালে এডমিট করবে। শারিরীক অনেক পরিবর্তন এসেছে আমার মধ্যে। পেট বেশ বড় হয়েছে, খুব বেশি না হলেও খানিকটা গুলোমুলো টাইপ হয়ে গেছি, শরীর ভীষণ ভারী লাগে। প্রতি মাসে একটু একটু করে অনুভব করেছি মা হওয়ার স্বাদ। বিভিন্ন মাসে বিভিন্ন রকম শারীরিক জটিলতার সাথে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু এরজন্যে পড়াশোনার গাফিলতি খুব একটা করিনি। কলেজের ডক্টররা, আমার ফ্রেন্ডরা সবাই খুব সাপোর্ট করেছে আমায়। আদ্রিয়ানের বউ হওয়ার কারণে একটু আলাদাভাবে ট্রিট করেছে আমায় এই মুহূর্তে। আর ভাগ্যক্রমে আমার ডেলিভারি ডেটও লম্বা ভ্যাকেশের মধ্যেই পরেছে। আদ্রিয়ানকেও প্রচুর জ্বালিয়েছি এই কয়েকমাস। জেদ করে বসে থাকতাম, উদ্ভট আচরণ করতাম, যখন তখন যেকোন কিছু বায়না করে বসতাম, একটু এদিক ওদিক হলেই রাগ করে বসে থাকতাম, ধমক না দিতেই কেঁদেকেটে ভাসিয়ে ফেলতাম। কিন্তু আদ্রিয়ান সবটা নিরবে সহ্য করেছে, টু শব্দও কখনও করেনি। বাড়ির বাকিরাও খুব যত্ন নিয়েছে আমার। তবে আদ্রিয়ান অনেক করেছে, সারাদিন নিজের অফিশিয়াল কাজ করে এসে আবার আমায় সামলানো যে খুব কষ্টের বুঝতে পারতাম, আবার একেকটা উদ্ভট বায়না শুনে যখন ও ক্লান্ত মুখে হাসি দিয়ে নিরবে করতে যেত খারাপ লাগত। কিন্তু কী করতাম? আমি নিজেই জানিনা আমি এসব কেন করি। প্রচন্ডভাবে মুড সুইং করে। আর শারিরীক বিভিন্ন কষ্টতো আছেই। তবে যতবার অনুভব করেছি আমার গর্ভে আমার আর আদ্রিয়ানের সন্তান একটু একটু করে বেড়ে উঠছে ততোবার এই সব কষ্টকেই তুচ্ছ মনে হত। তবে এই কয়েকমাসে আদ্রিয়ানের করা পাগলামোর কথা কী পারবো। এমন কোন দিন নেই যেদিন ঘন্টাভর আমার পেটে মাথা রেখে বেবিকে ফিল করেনি, বেবির সাথে কথা বলেনি, আর রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ওর প্রথম কাজ আমার কপালে আর পেটে চুমু দেওয়া এরপর বাকি সব। যখন আমার পেটে মাথা রেখে ও কথা বলে তখন এক স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতে পারি আমি। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খুশি ব্যাক্তি মনে হয় নিজেকে। এইত আমার বেবি যেদিন ফার্স্ট কিক করল সেদিনকার কথা-
গভীর রাত আদ্রিয়ান বহু কষ্টে আমায় সামলে ঘুম পারিয়ে নিজেও হয়তো একটু ঘুমিয়ে ছিল। হঠাৎই বেবি কিক করাতে আমি ঝট করে জেগে মৃদু আওয়াজ করে উঠলাম। আদ্রিয়ান হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
— ” ক-কী হয়েছে? ঠিক আছো তুমি? পেটে ব্যাথা হচ্ছে? কিছু হয়েছে?”
আমি হাফানো কন্ঠে বললাম,
— ” বেবী কিক করেছে!”
ও অবাক দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। বেবী আবারও কিক করাতে আমি চমকে গিয়ে পেটে হাত দিয়ে বললাম,
— ” আবার!”
আদ্রিয়ানের ক্লান্ত মুখেও হাসি ফুটে উঠল। ও সাথে সাথেই আমার পেটে মাথা নাড়লো। সাথে সাথেই বেবী আবার কিক মারল। আমার কষ্ট হলেও কেন জানিনা অদ্ভুত এক তৃপ্তিও হচ্ছিল। যেই আমি একটু ব্যাথাও কেঁদে দিতাম সেই আমার এই যন্ত্রণায়ও প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণাও যে কখনও শান্তির হয় সেটা এখন বুঝতে পারছি। আদ্রিয়ান আমার পেটে মাথা রেখেই বলল,
— ” আমার প্রিন্সেসও বুঝতে পেরেছে যে তুমি ওর বাবাকে ভীষণ জ্বালাচ্ছো তাই সে ভীষণ বিরক্ত।”
আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
— ” মোটেই না?”
— ” মোটেই হ্যাঁ।”
আমি মুখ ফুলিয়ে পেটে হাত রেখে বললাম,
— ” সোনা, তুমিই বল এটা কী সত্যি?”
কো-ইন্সিডেন্টলি তখন বেবী আবারও কিক করল। আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে আমার পেটে চুমু দিয়ে বলল,
— ” দেখলে হ্যাঁ বলল।”
— ” উহু ও না বলেছে।”
এই নিয়ে দুজনে কিছুক্ষণ ঝগড়া করলাম, যাকে বলে মধুর ঝগড়া। কিন্তু আমার ন্যাকা কান্না করা দেখে আদ্রিয়ান সেচ্ছায় হার মেনে নিয়েছিল।
সেসব ভেবেই হাসলাম আমি। আজ সকাল থেকেই মনটা ভালো লাগছে না আর শরীরটাও। কেমন অদ্ভুত আশঙ্কা বাসা বাঁধছে আমার মনে কিন্তু সেটা কীসের বসতে পারছিনা। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু কী হতে চলেছে? আদ্রিয়ান আমার পাশে বসে আমায় এক জড়িয়ে নিয়ে বলল,
— ” কী হয়েছে?”
আমি অসহায় চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,
— ” আমার খুব ভয় করছে আদ্রিয়ান।”
ও একহাতে আমার চুন নাড়তে নাড়তে বলল,
— ” এসময় এরকম একটু হয়। চিন্তা করোনা আমি আছিত তোমার সাথে।”
আমি ওর বুকে মাথা রেখে কাঁপা গলায় বললাম,
— ” আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে আদ্রিয়ান? কেন মনে হচ্ছে আমি কোথাও হারিয়ে যাচ্ছি।”
আদ্রিয়ান আমায় আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,
— ” এভাবে বলেনা জানপাখি। আমার কষ্ট হয় বোঝনা তুমি?”
আমি কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললাম,
— ” এত সুখ, এত আনন্দ সব আমার সহ্য তো? আমার কেন মনে হচ্ছে আমি সব হারিয়ে ফেলতে চলেছি?”
— ” কেন হবেনা? আমি আছিতো তোমার সাথে সবসময় আছি। কেন বলছো এসব?”
আদ্রিয়ানেরও কন্ঠ ধরে আসছে। আমার চোখ দিয়ে অকারণেই জল গড়িয়ে পরল। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
— ” আমার কেন মনে হচ্ছে এত সুখ আমার জন্যে না। কেন? কেন নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আদ্রিয়ান। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি থাকতে চাই আদ্রিয়ান। আমি তোমার সাথে আমার সন্তানের সাথে থাকতে চাই। আমি বাচ্চাকে নিজের হাতে মানুষ করতে চাই। তোমার পরিপূরক হয়ে থাকতে চাই। আমি তোমাদের ছেড়ে যেতে চাইনা।”
কথাগুলো বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললাম। আদ্রিয়ান আমায় আরো শক্ত করে ধরে কান্নামিশ্রিত গলায় বলল,
— ” জানে মেরে ফেলব কিন্তু। কীসব কথা এগুলো? হ্যাঁ? আমায় আঘাত করতে খুব শান্তি লাগে তাইনা? তুমি জানো যতবার তুমি এসব কথা বল ততবার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করি আমি। এরকম বল না জানপাখি। আমার কাছ থেকে দূরে যাওয়ার কথা ভাববেও না। কিচ্ছ হবেনা তোমার, আমার বাচ্চার। আমি হতে দেবনা। কিচ্ছু হবেনা।”
আমি ওর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি। আমি জানি আদ্রিয়ানও নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। আদ্রিয়ান ভাঙা গলায় বলল,
— ” না আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব আর না তুমি আমাকে ছাড়া। তাই আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া আমাদের যাতে একসাথেই নিয়ে যায়। কারণ যেকোন একজনও যদি আগে চলে যাই তাহলে অপরজনের জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে।”
আমি কিছু বললাম না কিন্তু নিঃশব্দে দুজনেই কাঁদছি। ওর আমার দুজনের ডান হাতই আমার পেটের ওপর। ওর চোখের জলগুলো আমার মাথায় ফোঁটায় ফোঁটায় পরছে বুঝতে পারছি আমি। আর আমার চোখের জলে ওর বুক ভিজছে। ভালোবাসা এত কষ্টের কেন হয়? এত হারানোর ভয় তিলে তিলে কেন শেষ করে দেয়? এই অসহ্য যন্ত্রণা, ভয়, বিষাদ প্রতিনিয়ত এভাবে নিশ্বাস বন্ধ করে দিতে চায়। আমার এরকম হচ্ছে নিঃস্ব লাগছে নিজেকে। কেন এমন হচ্ছে? কেন?
পরের পৃষ্টা উল্টে আর কিছু পেলোনা অদ্রিজা। অনি-আদ্রিয়ানের শেষের কথপোকথন পরে কেঁদে ফেলেছে ও। এখনও তো কয়েক পাতা বেঁচে আছে ডায়েরিতে। তবুও পৃষ্ঠাগুলো সব ফাঁকা কেন? ডায়রির খালি পাতাগুলো নেড়েচেড়ে যখন কিছুই পেলোনা তখন কৌতুহলী চোখে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ানেরও চোখ ছলছল করছে। হয়তো ঐসব কথা মনে পরে গেছে। একদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে ও। অদ্রিজা একবার ডায়েরির দিকে তাকিয়ে আবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ” এরপর কী হয়েছিল? ম্যামই বা কোথায় এখন?”
আদ্রিয়ান একটা লম্বা শ্বাস নিল। কিছু বলবে তার আগেই ‘বাবাই’ বলে বাচ্চা আর মিষ্টি কন্ঠে একটা মেয়ে ডেকে উঠল। ডাক শুনে আদ্রিয়ান তাকিয়ে দেখল হাতে একটা বল নিয়ে গ্রে রঙের স্লিভলেস হাটু অবধি ফ্রক পরা একটা বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সিল্কি ঘাড় ছোঁয়া চুলগুলো সাইড সিথি করে ছেড়ে দেওয়া, চুলের এক সাইডে পুতুল ওয়ালা দুটো ক্লিপ পরা, বয়স তিন বছর হবে। মেয়েটা আর কেউ না। আদ্রিয়ানের মেয়ে। অনি আর আদ্রিয়ানের মেয়ে আদ্রিমা আবরার জোহানি। বাড়িতে সবাই আদর করে মিষ্টি বলে ডাকে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে উঠে এগিয়ে গিয়ে মেয়ের সামনে হাটু ভেঙ্গে বসে বলল,
— ” কী হয়েছে আমার প্রিন্সেসের?”
মিষ্টি হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,
— ” কিছু না। বায়ি যাবো।”
আদ্রিয়ান মুখে হাসি রেখেই ভ্রু কুচকে বলল,
— ” আজ এত তাড়াতাড়ি? কেউ কিছু বলেছে?”
মিষ্টি এবারও মাথা নাড়িয়ে না বলল। আদ্রিয়ান ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
— ” তাহলে?”
মিষ্টি মুখ ফুলিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল কিন্তু কিছু বললনা। তখনই পাশ তাকিয়ে দেখল মিষ্টি যেই ছেলেটার সাথে খেলে তাকে তার মা কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উদ্দেশ্য। আদ্রিয়ান বুঝতে পারল কী হয়েছে। ছোট্ট একটা শ্বাস নিয়ে মিষ্টির দিকে তাকালো। এরমধ্যেই হাফাতে হাফাতে অভ্র এসে বলল,
— ” স্যার আপনার মেয়ে সামলাতে সামলাতে আমি শেষ। কে বলবে এ তিনবছরের বাচ্চা মেয়ে। বাপড়ে! হটাৎ কী একটা দেখে মন খারাপ করে চলে এল।”
আদ্রিয়ান হাসলো। মিষ্টির গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,
— ” আচ্ছা চল। আজ বাড়ি গিয়ে আমরা কার্টুন দেখব। আর বাবাই তার প্রিন্সেসের জন্যে তার ফেবরেট চিকেন বিরিয়ানি বানাবে।”
মিষ্টি সাথেসাথেই নাক কুচকে ফেলল। অভ্রও অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। মিষ্টি বলল,
— ” না আমি মিল্কিই খাবো।”
আদ্রিয়ান ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
— ” আরে এভাবে পঁচাশ না মা, খেতে পারবি। সেদিন খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে আজ পার্ফেক্ট হবে।”
অভ্র অসহায় গলায় বলল,
— ” স্যার প্লিজ তারপর সেটা আমায় খেতে বলবেন না। আমি আর পারবোনা।”
আদ্রিয়ান তোতলানো কন্ঠে বলল,
— ” অ-আচ্ছা। কেউ খেতে না পারলে আমিই খাবো।”
মিষ্টি দুহাতে মুখ চেপে ধরে হেসে ফেলল। অভ্রও ঠোঁট কামড়ে হাসলো। আদ্রিয়ানও আড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। আসলে আদ্রিয়ান সব রান্না জানলেও এই চিকেন বিরিয়ানিটাই ঠিকভাবে রান্না করতে পারেনা। কিন্তু তবুও মিষ্টির জন্যে বানায়। কেউ তো খেতে পারেই না শেষে বেচারা অভ্রকে খেতে হয়।কিন্তু এখন অদ্রিজা একদৃষ্টিতে এতক্ষণ বাবা-মেয়ের খুনশুটি দেখছিল। ডায়েরিতে লেখা সেই খুনশুটি যেন প্রত্যক্ষ দর্শন করছে শুধু পার্থক্য একটাই। ওটা স্বামী-স্ত্রীর খুনশুটি ছিল আর এটা বাবা-মেয়ের। এটা একটা অনাথ আশ্রম। অদ্রিজা একজন এনজিও ওয়ার্কার। তিনদিন ধরে ভিসিট করছে এখানে আরো চারদিন করবে। আদ্রিয়ান মিষ্টিকে নিয়ে আসে রোজ বিকেলে। এখানেই মিষ্টির সাথে পরিচয় অদ্রিজার তার সুত্রে আদ্রিয়ানের সাথেও। ডায়েরিটা আদ্রিয়ান ভুলে বেঞ্চের ওপর রেখে মিষ্টিকে আনতে গেছিল। তখনই ওটা দেখে অদ্রিজা। আদ্রিয়ান ফিরে এলে জিজ্ঞেস করেছিল ” এটা কী আপনার লেখা গল্প বা উপন্যাস স্যার?” আদ্রিয়ান মলিন হেসে বলেছিল, ” আমার স্ত্রীর লেখা তার গল্প। তার প্রত্যেক অনুভূতির গল্প, অস্তিত্বের গল্প, আবেগের গল্প কিন্তু প্রতিটা শব্দ বাস্তব।” এটা ডায়েরিটা পড়ার তীব্র ইচ্ছা জাগে ওর মনে। তাই আদ্রিয়ানকে অনুরোধ করে আদ্রিয়ানের পাশে বসেই ডায়েরিটা পড়ে ও। আর পড়ার পর পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। এরকম গল্পও কারো হতে পারে। আদ্রিয়ান মিষ্টিকে অভ্রর কোলে দিয়ে বলল,
— ” তুমি ওকে নিয়ে গাড়িতে বসো আমি আসছি।”
অদ্রিজা এগিয়ে এসে মিষ্টিকে কোলে নিয়ে বলল,
— ” আজকের মত টাটা শোনা। কাল চলে আসবে কিন্তু সময়মত।”
মিষ্টি হেসে অদ্রিজার গালে চুমু দিয়ে বলল,
— ” টাটা।”
অভ্র এরপর মিষ্টকে কোলে নিয়ে চলে গেল। আদ্রিয়ান চলে যেতে নিলেই অদ্রিজা বলল,
— ” স্যার!”
আদ্রিয়ান ঘুরে তাকালো। অদ্রিজা ইতস্তত করে বলল,
— ” এরপরে কী হয়েছিল সেটা জানা হলোনা।”
আদ্রিয়ান মলিন হেসে বলল,
— ” আজ সময় নেই আর কালকে এসে বলব।”
অদ্রিজা মুচকি হেসে বলল,
— ” আচ্ছা।”
আদ্রিয়ান চলে গেল আর অদ্রিজা আদ্রিয়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল। কতটা ভালোবাসতো একে ওপরকে। এরকম ভালোবাসা আজকাল দেখা যায়? কিন্তু তারপর কী হয়েছিল? আদ্রিয়ান আর আদ্রিমা তো একদম ঠিক আছে। তাহলে? তাহলে কী অনিমার সাথেই খারাপ কিছু হয়েছে? যদি হয়ে থাকে সেটা কে করেছে? রূপ নয়ত? জিজ্ঞেস করলে আদ্রিয়ান কষ্ট পাবে তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করেনি। আরো একটা দিন অপেক্ষা করতে হবে সেটা জানার জন্যে। কিন্তু ওর যে জানার জন্যে মন ছটফট করছে কী ছিল ওদের এই অসাধারন প্রেমের পরিণতি?
#চলবে…
[ 😑😑😑]